Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বিশ্বের অদ্ভুত কিছু কাল্ট (১ম পর্ব)

ইংরেজি ‘Cult’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ অর্চনা বা কোনো কিছুর প্রতি প্রবল শ্রদ্ধা। প্রায়োগিক অর্থে ‘কাল্ট’ হলো একটি সংগঠন যা এক বা একাধিক ব্যক্তির নেতৃত্বে একটি বড় অংশের মানুষকে কিছু নির্দিষ্ট বিশ্বাস বা জীবনাচরণ অনুসরণে বাধ্য করে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাল্টের নেতা ধর্মের শিক্ষা ও বিশ্বাস নিজের মনমতো ব্যাখ্যা দিয়ে প্রচার করেন ও মানুষকে আকৃষ্ট করেন। ধর্মের মনগড়া ব্যাখ্যার সাথে থাকে কাল্ট নেতার ব্যক্তিত্বের আকর্ষণ। কাল্টের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, অনুসারীদের বোঝানো হয় যে, তারা কাল্টে যোগদানের মাধ্যমে সামাজিক, ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে। তবে বাস্তবে দেখা যায়, কাল্টগুলো তথাকথিত আধ্যাত্মিক নেতাদের অর্থ লুট, শোষণ ও যৌন নিপীড়নের হাতিয়ার মাত্র।

প্রিয় পাঠক, চলুন বিশ্বের এমনি কিছু অদ্ভুত কাল্টের কথা জেনে নেয়া যাক। আজ প্রথম পর্বে থাকছে হেভেন’স গেট-এর কথা।

হেভেন’স গেট: গণ-আত্মহত্যার অবিশ্বাস্য নজির

মার্শাল অ্যাপেলহোয়াইট ও বনি নেটলস ১৯৭৪ সালে হেভেন’স গেট কাল্টটি প্রতিষ্ঠা করেন। ধর্মীয় বিশ্বাস, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও ভিনগ্রহের অধিবাসীদের এক বিচিত্র সংমিশ্রণ ছিল এই কাল্ট। অ্যাপেলহোয়াইট ও নেটলস নিজেদের ঈশ্বর-প্রেরিত দূত মনে করতেন, এবং বিশ্বাস করতেন, বাইবেলে তাদের আবির্ভাবের কথা উল্লেখ আছে। মূলত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর সাথে খ্রিষ্টধর্মের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে ধর্মের আধুনিকায়ন করে তারা মানুষকে এর প্রতি আকৃষ্ট করেন।

এই দুই অদ্ভুত চরিত্রের যখন দেখা হয় তখন বনি নেটলস ছিলেন একজন নার্স, আর মার্শাল অ্যাপেলহোয়াইট ছিলেন সেন্ট থমাস ইউনিভার্সিটির সঙ্গীত বিভাগের সাবেক অধ্যাপক। হাসপাতালে পরিচয় হবার পর দুজনেই বোধ করেন তাদের যেন জন্ম-জন্মান্তরের পরিচয়। এবং এই পৃথিবীতে এক বিশেষ উদ্দেশ্যে তাদের পাঠানো হয়েছে। ধর্ম, পরলোকতত্ত্ব, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, আধ্যাত্মবাদ ইত্যাদি মিশিয়ে একধরনের মতবাদ উদ্ভব করলেন তারা।

তাদের মতে, তারা দুজন ছিলেন সাধারণ মানুষের চেয়ে ওপরের স্তরের। পৃথিবীর মানুষকে পথ দেখানো তাদের  জীবনের উদ্দেশ্য। তাদের বিশ্বাস ছিল- একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর পৃথিবী ধ্বংস হয় ও সব কিছু নতুন করে শুরু হয়। তেমন একটি ধ্বংসের পর এলিয়েনরা স্পেসশিপে করে তাদের সকলকে নিয়ে যাবে অন্য এক জগতে। সেখানে তাদের দেওয়া হবে মানব শরীরের চেয়ে উন্নত শরীর ও জীবন হবে আরও সহজ, সুন্দর। সেই পর্যায়কে তারা বলতেন TELAH (The Evolutionary Level Above Human)। মানবশরীর তাদের কাছে বেশ গুরুত্বহীন ছিল, কারণ তারা বিশ্বাস করতেন এর চেয়ে উন্নত শরীর ভিনগ্রহীরা তাদের দেবে। পরকালকে তারা বলতেন ‘দ্য নেক্সট লেভেল’।

মার্শাল অ্যাপেলহোয়াইট ও বনি নেটলস; Image source: Getty Images

সমমনা মানুষ খুঁজে বের করতে ওরেগনে প্রথম প্রচারে নামলেন অ্যাপেলহোয়াইট ও নেটলস। কিছু ধর্মীয় সংগঠন এই মতবাদের বিরোধিতা করল। প্রাথমিক বাধা পেরিয়ে বিশজন সদস্য যোগাড় করে ফেললেন তারা।

‘দ্য নেক্সট লেভেল’–এর শান্তিপূর্ণ জীবনের জন্য পৃথিবীতে কঠোর সংযম পালনের নির্দেশনা ছিল। জাগতিক বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে বাঁচতে পারলে তবেই পরবর্তীতে পরমানন্দের দেখা মিলবে।

তাই অ্যাপেলহোয়াইট ও নেটলসের কথামতো পরিবার-পরিজন, সম্পত্তি সব ছেড়ে লুকিয়ে জীবনযাপন করতে লাগল সদস্যরা। সকলে নতুন নাম নিল। অ্যাপেলহোয়াইট ও নেটলস নিজেদের নাম দিয়েছিলেন “Do” আর “Ti”। একরকম পোশাকও পরত সদস্যরা। তাদের জীবন ছিল সম্পূর্ণ যৌনতা বিবর্জিত। ‘পবিত্রতা’ ও ‘বিশুদ্ধতা’ নিশ্চিত করার জন্য অ্যাপেলহোয়াইটসহ কিছু পুরুষ সদস্য স্বেচ্ছায় খোজা হন।

পুরো সত্তর-আশির দশক জুড়ে সদস্য সংগ্রহ করে হেভেন’স গেট। তাদের কাজ ছিল দেশ জুড়ে ভ্রমণ করা, আর ভবঘুরের মতো বাস করা। সময়ের সাথে সাথে তাদের বিশ্বাসের পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হয়। অ্যাপেলহোয়াইট নিজেকে যিশুখ্রিস্টের অবতার বলতেন। হেভেন’স গেটের ভাষায় যেটি ছিল যিশুখ্রিস্টের শরীরে যে ভিনগ্রহীর আত্মা বাস করত, অ্যাপেলহোয়াইটের শরীরেও সে-ই বাস করে। আর নেটলস ছিলেন ঈশ্বরের মূর্তরূপ। তাদের দাবি ছিল, তারা ভিনগ্রহীদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।

১৯৮৫ সালে নেটলস হঠাৎ করে ক্যান্সারে মারা যান। দলের বিশ্বাসের ভিত্তি নড়ে যাবার আশঙ্কা দেখা দিল তখন। যিনি নিজেকে ঈশ্বর দাবি করেন, তিনি কীভাবে মরতে পারেন? তাছাড়া নেটলসের মৃত্যুর আগপর্যন্ত সবাই জানতেন তাদের মানব শরীরই ‘দ্য নেক্সট লেভেল’-এ তাদের সাথে যাবে। তাই সাময়িকভাবে নেটলসের মৃত্যু বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। অ্যাপেলহোয়াইট তখন দায়িত্ব নিলেন সব সামলে নেবার। নতুন মতবাদ প্রচার করলেন তিনি। এবার বললেন, অন্যান্য মানুষের মতো তাদেরও মৃত্যু হবে। তবে এলিয়েনরা তাদের আবার নতুন শরীর দিয়ে জীবনদান দেবে। তাই তাদের মানবশরীর ধ্বংস হয়ে গেলেও ক্ষতি নেই। এই নতুন শিক্ষা সদস্যরা মেনেও নিল।

মার্শাল অ্যাপেলহোয়াইট; Image source: NY Daily News

এ পর্যায়ে অনেক মতবাদের সাথে তারা এটাও বিশ্বাস করতেন যে, বিশ্বের প্রধান প্রধান রাষ্ট্রীয়, আর্থিক, সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠন এমন সব এলিয়েনদের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে যারা মানুষকে ধ্বংস করে দিতে চায়। এই গোষ্ঠী তাদের কাছে ‘দ্য লুসিফেরিয়ান্স’ নামে পরিচিত ছিল।

এভাবেই চলে যাচ্ছিল সময়। এর মধ্যে ১৯৯৫ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানী অ্যালান হেল ও থমাস বপ একটি ধূমকেতু আবিষ্কার করেন যেটি তাদের নামানুসারে ‘হেল-বপ ধূমকেতু’ হিসেবে পরিচিতি পায়। ১৯৯৭ সালে এটি পৃথিবীর কাছ ঘেঁষে অতিক্রম করে। তার আগ দিয়ে ‘হেভেন’স গেট’ কাল্টে এই ধূমকেতু নিয়ে গল্প ছড়িয়ে পড়ল। সবাই বিশ্বাস করতে লাগল, এই ধূমকেতুর আড়ালে লুকিয়ে আছে সেই বহু প্রতীক্ষিত এলিয়েন স্পেসশিপ, যা তাদের নিতে আসছে।

ধূমকেতুটির পৃথিবী অতিক্রম করার দিন যত এগিয়ে এল, কাল্টে উৎসাহ-উদ্দীপনা বেড়ে চলল। তারা সিদ্ধান্ত নিল, মার্চের শেষ দিকে ঠিক যে মুহূর্তে হেল-বপ পৃথিবীর কাছ ঘেঁষে যাবে, তখন তারা আত্মহত্যা করবে আর ধূমকেতুর আড়ালে থাকা এলিয়েন স্পেসশিপ তাদের আত্মা তুলে নেবে। এ কার্যক্রম সামনে রেখে অনেক প্রস্তুতি নিতে লাগল তারা। স্পেসশিপের মাধ্যমে কীভাবে তাদের আত্মা পরবর্তী পর্যায়ে পৌঁছবে সেই বর্ণনা দিয়ে অ্যাপেলহোয়াইট ভিডিও তৈরি করলেন। সকলে একরকম জুতা পরবে বলে ঠিক করল, তাই নাইকির সাদা-কালো রঙের ডেকেড মডেলের স্নিকার কিনল লট ধরে। একরকম আর্মব্যান্ডও পরল সবাই মিলে যাতে লেখা ছিল ‘Heaven’s Gate Away Team‘।

তারপর এলো ১৯৯৭ সালের সেই দিন।

ক্যালিফোর্নিয়ার একটি ভাড়া বাড়িতে মার্চের ২২ বা ২৬ তারিখ থেকে তাদের ধাপে ধাপে আত্মহত্যা করা শুরু হয়। ৩৯ জন সদস্য কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে ভদকার সাথে ফেনোবারবিটাল মেশানো অ্যাপেলসস খেয়ে নেয়। শ্বাসরোধ নিশ্চিত করার জন্য মাথায় প্লাস্টিকের ব্যাগও পরে নিয়েছিল সবাই। একটি দল যখন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ত, বাকিরা তাদের পরিপাটি করে শুইয়ে বেগুনী আবরণ দিয়ে মৃতদেহ ঢেকে দিত। এভাবে ৩ দিন ধরে চলে তাদের ‘আত্মহত্যা আচারানুষ্ঠান’। এভাবে ৩৯ জনই মৃত্যুবরণ করে।

কাল্টের এক মৃত সদস্য; Image source: rollingstone.com

মৃত্যুর আগে অ্যাপেলহোয়াইটের বানানো ভিডিওসহ বাকি সদস্যদের রেকর্ড করা বার্তা গণমাধ্যমসহ আরও কয়েকটি ঠিকানায় পাঠানো হয়। সেই সূত্র ধরে পুলিশ ৩৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করে। বাড়ির পেছনের দরজা খোলা রেখে আত্মহত্যা করে তারা, যাতে কারো ঢুকতে অসুবিধা না হয়।

মৃতদেহ উদ্ধার চলছে; Image source: rollingstone.com

সঙ্গত কারণেই পুরো আমেরিকা জুড়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে এ ঘটনা। এতদিন পরেও এই কাল্ট নিয়ে মানুষের আগ্রহ কমেনি। হেভেন’স গেট নিয়ে আছে পডকাস্ট, যাতে এই কাল্ট ও গণ-আত্মহত্যা নিয়ে আলাপ চলে, উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়। অ্যামাজন প্রাইমে তৈরি হয়েছে ডকুমেন্টারি। এছাড়া অনেক গান, টিভি সিরিজ ও চলচ্চিত্রের সংলাপে ফিরে ফিরে এসেছে এই কাল্টের নাম। শুধু তা-ই নয়, এমন মানুষের সন্ধানও মিলেছে যারা এখনও এতে বিশ্বাস করেন!

Related Articles