পাকিস্তানের যতগুলো বড় ও বিখ্যাত শহর রয়েছে, সেসবের মধ্যে কোয়েটা অন্যতম৷ দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত বেলুচিস্তান প্রদেশের রাজধানী হচ্ছে কোয়েটা। পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে ‘কোয়েটা গ্ল্যাডিয়েটর্স’ নামে একটি দলও রয়েছে। স্থানীয়রা টুর্নামেন্টের মৌসুমে এই দলের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে থাকেন।
পাকিস্তান থেকে যত ফল রপ্তানিকরা হয়, তার একটি বড় অংশ উৎপাদিত হয় কোয়েটা’য়। এছাড়া এই অঞ্চলের রাজধানীর নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এতই মুগ্ধতা ছড়ায় যে, অনেকে একে ‘খুদে প্যারিস’ হিসেবে অভিহিত করেন। এই কোয়েটা শহরেরই কাছাকাছি একটি গ্রামে ২০১৬ সালে একই পরিবারের দুই সদস্যের মধ্যে এমন এক অদ্ভুত রোগের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল, যে রোগ রীতিমতো বিস্ময় জাগিয়ে দেয় পৃথিবীর বাঘা বাঘা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মাঝে। রোগটির পেছনে যথাযথ কারণের অভাবে দেশটিতে নানারকম গুজব ও ষড়যন্ত্র তত্ত্বেরও উদ্ভব হয়েছিল।
একজন আব্দুল রশিদ। আরেকজন শোয়াইব আহমেদ। একজনের বয়স নয় বছর, আরেকজনের তের। দুজনই অবয়বে পাকিস্তানের আর দশটি শিশুর মতোই। কিন্তু তারা যে রোগে আক্রান্ত হয়েছিল, তা পাকিস্তান তো বটেই, গোটা পৃথিবীতেই আর সেই রোগের অন্য কোনো রোগী পাওয়া যায়নি।
সারাদিন দুই ভাই খেলাধুলা করে বেড়াতো, পড়াশোনা করতো, ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করতো। দিনের বেলায় একেবারে স্বাভাবিক জীবনযাপন। তাদের বয়সী শিশুদের যে স্বাভাবিক চাঞ্চল্য থাকে, সেটিও তাদের মধ্যে ছিল। কিন্তু আসল সমস্যা শুরু হতো সূর্য ডোবার সময় থেকে। সারাদিন ঠিকঠাক থাকার পর যে-ই না সূর্যের আলো মিইয়ে যেতে শুরু করতো, তখনই দুই ভাই দুর্বল হয়ে পড়তে শুরু করতো। রাত হলে তাদের চলাফেরার কোনো শক্তি থাকতো না৷ শুধু চলাফেরাই নয়, রাতের বেলা তাদের কথা বলার, খাওয়ার বা পান করারও সামর্থ্য লোপ পেয়ে যেত। পাকিস্তানে বা অন্য কোথাও কখনোই এরকম অদ্ভুত সমস্যায় আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির কথা শোনা যায়নি সেভাবে।
শোয়াইব আহমেদ ও আব্দুল রশিদের পরিবার বসবাস করছে কোয়েটা শহরের নিকটবর্তী মিয়ান কুন্ডি গ্রামে। কোয়েটা শহর থেকে এই গ্রামের দূরত্ব মাত্র পনের কিলোমিটার। এই দুই সন্তানের জনক মোহাম্মদ হাশিম একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে কর্মরত। হাশিমের মোট সন্তানের সংখ্যা ছয়। এর মধ্যে দুজন রোগে ভুগে জন্মের অল্প কিছুদিন পরেই মারা গিয়েছিল। বর্তমানে তার জীবিত সন্তানের সংখ্যা চার। এর মধ্যে দুজন হলো আব্দুল রশিদ ও শোয়াইব আহমেদ। বাকি দুজনের ভেতর একজন ছিল এক বছর বয়সী একটি ছোট্ট শিশু, যার মধ্যে কিছুটা অস্বাভাবিকতা দেখা গিয়েছিল৷ আর আরেকজন হচ্ছে একটি মেয়ে, যার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা যায়নি। মোহামেদ হাশিম কিংবা তার স্ত্রীর মাঝেও কোনো অস্বাভাবিকতাদেখা যায়নি এখন পর্যন্ত। অর্থাৎ পুরো পরিবারে মোট তিনজন এই সমস্যায় ভুগছে। আব্দুল রশিদ, শোয়াইব আহমেদ ও তার এক বছর বয়সী ভাই মোহাম্মদ ইলিয়াস।
জন্মের পর থেকেই মূলত শোয়াইব আহমেদ সমস্যায় ভুগতে শুরু করেছিল৷ জন্মের দুই বছরের মাথায় মোহাম্মদ হাশিম ছোট ছেলে আব্দুল রশিদকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তারা কোনো সমাধান দিতে পারেনি। সন্তানদেরকে ভালো কোনো হাসপাতালে নিয়ে যে চিকিৎসা করাবেন, সেই সামর্থ্যও ছিল না সামান্য মাইনের চাকরি করা মোহাম্মদ হাশিমের পক্ষে। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করতেন যে তার সন্তানেরা সূর্য থেকে শক্তি পেয়ে থাকে। এই কারণে যখন সূর্য ডুবে যায়, তখন তারা শরীরের সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলে। তবে ডাক্তারেরা তার এই বিশ্বাসকে ভ্রান্ত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ, দেখা গিয়েছে, ঝড়ের সময়ে কিংবা অন্ধকার রুমে দিনের বেলায়ও দুই ভাই স্বাভাবিকভাবেই চলাফেরা করতে পারছে, পান করতে বা খেতে পারছে। যদি সূর্য থেকেই শক্তি পেয়ে থাকতো, তাহলে দিনের বেলা অন্ধকারে তাদের পঙ্গুত্ব বরণ করার কথা ছিল। সেরকম কিছু দেখা যায়নি।
২০১৬ সালের আগপর্যন্ত ‘সোলার কিড’দের নিয়ে গণমাধ্যমে তেমন সাড়াশব্দ শোনা যায়নি। কয়েকটি স্থানীয় পত্রিকায় ছোটখাটো প্রতিবেদন প্রকাশ পেলেও সেগুলো নিয়ে তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। কিন্তু ২০১৬ সালের দিকে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এই দুই শিশুকে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়, অনেকটা হুট করেই। এরপর পাকিস্তানের খ্যাতনামা হাসপাতাল ‘পাকিস্তান ইন্সটিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেস’-এ ভর্তি করা হয় দুই ভাইকে। এই প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক জাভেদ ওমর দুই শিশুকে পর্যবেক্ষণের পর অবাক হয়ে যান। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম অ্যাসোসিয়েট প্রেসকে তিনি বলেন, ঠিক কোন কারণে শিশু দুটির মাঝে এই ধরনের অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তা নিয়ে কোনো ধারণা নেই তার। তার ভাষায়, “এই কেসটা আমাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। আমাদের চিকিৎসকরা বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষার মাধ্যমে এর রহস্য ভেদ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।” পরবর্তীতে তিনি বলেছিলেন, তার ধারণা নিউরোট্রান্সমিটারের সমস্যার কারণে হয়তো শিশুরা এই অস্বাভাবিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
ইসলামাবাদে অবস্থিত খ্যাতনামা হাসপাতাল পাকিস্তান ইন্সটিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেসের আটাশজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের সমন্বয়ে একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয় এই দুই ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য। মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা নিজেরা সামর্থ্য অনুযায়ী চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন, আবার বাইরের দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতাও গ্রহণ করছিলেন। তাদের দেহ থেকে বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করে পরবর্তীতে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো তেরোটি নামকরা প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়েছিল পরীক্ষানীরিক্ষার জন্য। এসব ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল, যার ব্যয়ভার বহন করা তাদের বাবা মোহাম্মদ হাশিমের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই সরকার এই দুই ভাইয়ের চিকিৎসার ব্যয়ভার গ্রহণ করে। শুধু তা-ই নয়, এই দুই ভাই যে গ্রামে বসবাস করতো, সেই গ্রামের বেশ কয়েকটি জায়গা থেকে বাতাস ও মাটির নমুনা সংগ্রহ করা হয় পরীক্ষা করার জন্য। এই অস্বাভাবিক রোগের কারণ উদঘাটনের চেষ্টায় কোনো কমতি রাখা হয়নি।
ইসলামাবাদের সেই হাসপাতালে যখন দুই ভাইয়ের চিকিৎসা চলছিল, তখনও দিনের বেলায় তারা স্বাভাবিক আচরণ করতো। দিনের বেলায় তারা হাসিখুশি, উৎফুল্ল থাকতো। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর হাসপাতালের পাশেই অবস্থিত ক্যান্টিনে তারা একসাথে চা খেতে যেত। আর দশজনের মতো তাদেরও স্বপ্ন ছিল। তাদেরকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তারা বড় হয়ে কী হতে চায়, তখন বড় ভাই শোয়াইব উত্তর দিয়েছিল সে বড় হয়ে একজন শিক্ষক হতে চায়। একই প্রশ্নের উত্তরে ছোট ভাই বলেছিল সে ধর্মীয় বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করতে চায়। পাকিস্তান ইন্সটিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেসের চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে তারা পরবর্তীতে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠেছিল৷
পৃথিবীতে এমন অসংখ্য অদ্ভুত রোগ রয়েছে, যেগুলোর লক্ষণগুলো সম্পর্কে জানতে পারলে হয়তো আমাদের চোখ কপালে উঠবে। পাকিস্তানের মিয়ান কুন্ডি গ্রামের এই দুই ভাইয়ের রোগ সেই অদ্ভুত রোগগুলোর অন্যতম। হয়তো আরও অসংখ্য রোগ রয়েছে, যেগুলো গণমাধ্যমের হাত ধরে আমাদের কাছে পৌঁছায়নি এখনও।