জেরুজালেমের বিখ্যাত কবি ইহুদা আমিচাই ১৯৮০ সালে লিখেছিলেন, “এই শহরের আকাশ-বাতাস প্রার্থনা এবং স্বপ্নে মুখরিত। ঠিক যেন শিল্পকারখানায় সমৃদ্ধ শহরগুলোর বাতাসের মতোই। এখানে ঠিকমতো নিঃশ্বাস নেওয়া কষ্টকর।” তার এই বক্তব্যের তিন দশক পর বর্তমান সময়ে জেরুজালেমের বাসিন্দারা ঠিকমতো নিঃশ্বাস নিতে পারলেও ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনা ঠিকই কঠিন হয়ে পড়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে প্রায় দীর্ঘদিন যাবত বন্ধ ছিল সবরকম উপাসনালয়। ইহুদী, খ্রিস্টান এবং মুসলামানদের পবিত্র ভূমি হিসেবে পরিচিত জেরুজালেম শহরে রয়েছে বিখ্যাত সব উপাসনালয়। তিন ধর্মের প্রধান প্রধান স্থাপনাসমৃদ্ধ এমন শহর পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। আর এ কারণেই মুসলমান, খ্রিস্টান এবং ইহুদীদের নিকট জেরুজালেম বিশেষভাবে মর্যাদা পেয়ে আসছে।
খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করেন, জেরুজালেমের বেথেলহামে যিশুখ্রিস্ট জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাদের মতে, এখানেই রয়েছে মাতা মেরির কবর। অন্যদিকে, আল বুরাক দেওয়াল ইহুদিদের প্রার্থনার স্থান। খ্রিস্টপূর্ব ২০ সালে নির্মিত ইহুদী মন্দিরের একমাত্র ধ্বংসাবশেষ এটি। অন্যদিকে, সরাসরি এই দেওয়ালের উপর অবস্থিত হারাম শরিফ মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্র স্থান। মূলত মসজিদুল আকসা ও পাথরের গম্বুজ (ডোম অব দ্য রক) এর সমন্বয়ে এটি গড়ে উঠেছে।
কয়েক মাস আগে জেরুজালেমে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রায় সবগুলো উপাসনালয় শর্তসাপেক্ষে বন্ধ ঘোষণা করে ইসরায়েল সরকার। ধর্মপ্রাণ মানুষদের জন্য এটি ছিল খুবই বেদনাদায়ক এক ঘটনা। কারণ এযাবতকালে এত দীর্ঘ সময় কখনোই বন্ধ রাখা হয়নি জেরুজালেমের মসজিদ, গির্জা কিংবা আল বুরাক দেয়ালের ধর্মীয় কার্যক্রম। সে যা-ই হোক, গত সপ্তাহে সীমিত আকারে আবারও খুলে দেয়া হয়েছে জেরুজালেমের উপাসনালয়গুলো। তবে স্বাস্থ্যবিধিসহ কতিপয় নতুন নিয়ম-কানুন মানার নির্দেশ দিয়েছে ইসরায়েল সরকার। নতুন নিয়মে গির্জায় প্রার্থনার অনুমতি দেয়ার পাশাপাশি মুসলমানদের সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে মসজিদুল আকসার বাইরে নামাজ পড়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করেছে কর্তৃপক্ষ। আজ আমরা আলোচনা করব নতুন নিয়মে পবিত্র শহরের ধর্মপ্রাণ মানুষদের প্রার্থনা কেমন চলছে সে সম্পর্কে।
মুসলমানদের জন্য নিয়ম
ইসলাম ধর্মানুযায়ী, আটকোণা একটি গম্বুজের ভেতরেই রয়েছে সেই পাথরের ভিত্তি, যেখান থেকে নবী মুহাম্মদ (সঃ) বোরাকে চড়ে মিরাজে গিয়েছিলেন। অনেকেই বিশ্বাস করেন, বোরাকের পায়ের ছাপ এখনও পাথরে দেখা যায়। গত মে মাসের শেষদিকে দীর্ঘ ২ মাস পর আবারও আল আকসায় নামাজ পড়ার অনুমতি পায় মুসলমানরা। এর আগে ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দে ক্রুসেডাররা যখন এটি দখল করেছিল তখন দীর্ঘদিন যাবত এখানে ইবাদাত বন্ধ ছিল। জর্ডান কর্তৃক নিযুক্ত মসজিদ পরিচালনা পরিষদের সদস্যরা আলোচনার মাধ্যমে মুসল্লিদের জন্য নতুন নতুন কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করেছেন।
নতুন নিয়মানুযায়ী সকল মুসল্লীকে অবশ্যই মাস্ক পরিধান করতে হবে। যদি মসজিদের ভেতরে কিংবা বাইরে ব্যক্তিগতভাবে কেউ নামাজ আদায় করতে চায়, তবে অবশ্যই জায়নামাজ বহন করতে হবে। ব্যক্তিগত জায়নামাজ ব্যবহার একপ্রকার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে আল আকসা মসজিদে। মসজিদের ভেতরে স্থায়ী কার্পেটের সংস্পর্শে গিয়ে নতুন করে যাতে করোনাভাইরাস না ছড়ায় সেজন্যই এই বিষয়টির উপর বিশেষভাবে জোর দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, ইতোপূর্বে আল আকসা মসজিদে নামাজ আদায়ের সময় খুব কম সংখ্যক মুসল্লী জায়নামাজ ব্যবহার করতেন।
এছাড়াও মুসল্লীদেরকে বাড়ি থেকে ওজু সম্পন্ন করে মসজিদে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে মসজিদ পরিচালনা পরিষদ। যদিও বাড়তি নিরাপত্তার জন্য স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দিয়েছে আল আকসা মসজিদের পরিচালনা পরিষদের সদস্যরা। স্বেচ্ছাসেবকেরা হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্কসহ গুরুত্বপূর্ণ উপকরণগুলো বিনামূল্যে বিতরণ করছেন মুসল্লিদের মাঝে। যদিও নতুন করে সংক্রমণ রোধ করতে জেরুজালেমের উপাসনালয়গুলোতে লোকসংখ্যা নির্ধারণ করে দিয়েছিল ইসরায়েল সরকার। আল আকসায় প্রথমে ৫০ জন একসঙ্গে নামাজ আদায়ের অনুমতি পেলেও পরবর্তীতে এই সংখ্যা কমে ১৯ জনে নেমে আসে। তৃতীয় দফায় এই সংখ্যা ১০ জন নির্ধারণ করা হয়। তবে শুক্রবারের জুম্মার নামাজে হাজার হাজার মুসল্লীর উপস্থিতি ছিল লক্ষ্যণীয়।
যদিও আল আকসায় মুসলমানদের নামাজ আদায় কিংবা ভেতরে অবস্থান করা নিয়ে নতুন করে বাধা সৃষ্টি করতে চেষ্টা করছে ইসরায়েলিরা। গোঁড়া এবং ডানপন্থী ইহুদী নেতা-কর্মীরা রাজনৈতিক কর্মসূচির আদলে কয়েকবার মসজিদের মাঠ পরিদর্শন করেছে বলে দাবি করছেন অনেকে। ইহুদীরা যাতে সেখানে প্রার্থনা করতে পারে সেজন্য নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। তাদের দাবি, পুনরায় সেখানে মুসলমানদের প্রবেশের অনুমতি দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপনাটি আবারও ফিলিস্তিনিদের দখলে চলে যাবে।
যদিও এই বিষয়টিকে পুরোপুরি এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করছেন আল আকসা মসজিদের পরিচালনা পরিষদের সদস্যরা। ইতোমধ্যেই তারা মুসলিম বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে সেটি কর্তৃপক্ষের নিকট পেশ করেছেন। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে নামাজ আদায়ে কোনোপ্রকার ঝুঁকি দেখছেন না মুসলিম বিশেষজ্ঞরা। সাম্প্রতিক এক ঘোষণায় আল আকসা থেকে করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে এমন গুজবের সমালোচনা করা হয়। আর শুক্রবার যখন হাজার হাজার মুসলমান নামাজ আদায় শেষে জায়নামাজ মাথার উপর ধরে জেরুজালেমের রাস্তা প্রদক্ষিণ করেন তখন সেটি সত্যিই ঐ অঞ্চলের মুসলমানদের জন্য এযাবতকালের সবচেয়ে স্মরণীয় প্রাপ্তি বলা যায়। সাম্প্রতিক এক সাক্ষাতকারে আল আকসা মসজিদের পরিচালনা পরিষদের অন্যতম সদস্য মোস্তফা আবু সওয়ে বলেন,
সবকিছু আবার বন্ধ হয়ে গেলে বিষয়টি হবে খুবই দুঃখজনক। কারণ মানুষকে উদ্দীপনা দেয়ার জন্য এবং বেঁচে থাকার মানসিক শক্তি যোগাতে এমন একটি জায়গা প্রয়োজন যেটি আশা জাগাবে এবং নতুন করে আলো দেখাবে।
খ্রিস্টানদের জন্য প্রার্থনার নতুন ব্যবস্থা
জেরুজালেমে খ্রিস্টানদের প্রধান উপাসনালয় দ্য চার্চ অব দ্য হলি সেপালচার নামে পরিচিত। এই পবিত্র সমাধির গির্জাটি ১,৭০০ বছর আগে বাইজান্টাইন সম্রাজ্ঞী হেলেনা নির্মাণ করেন। প্রথমবার করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর প্রাক্কালে গির্জাটি সাধারণ নাগরিকদের জন্য পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হলেও শুধুমাত্র কয়েকজন উপাসক এবং একজন নারী গায়ক ভেতরে অবস্থান করার অনুমতি পান। সেসময় গির্জার বড় কাঠের দরজাটি বন্ধ করে দেয়া হয়। সরিয়ে নেয়া হয় কাঠের বেঞ্চগুলো।
পরবর্তীতে গির্জা পরিচালনা পরিষদ সীমিত আকারে প্রার্থনার ব্যবস্থা করে। জেরুজালেমের সকল উপাসনালয় বন্ধ ঘোষণার সময়টুকুতে সীমিত আকারে অনুষ্ঠিত প্রার্থনা অনুষ্ঠানের নেতৃত্ব দেন ফাদার আমজাদ সাব্বারা। প্রতিবার তার সঙ্গে ১৯ জন খ্রিস্টান নাগরিক প্রার্থনা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারতেন। সেই হিসেব অনুযায়ী শহরে বসবাসরত খ্রিস্টানরা প্রত্যেকেই মাসে অন্তত একবার করে গির্জায় প্রার্থনার সুযোগ পেতেন। তখন খ্রিস্টান কমিউনিটির প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মতামতের ভিত্তিতে এই কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হয়। কিন্তু সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ওয়েভ ছড়ানোর আগপর্যন্ত।
বর্তমান সময়ে গির্জায় প্রবেশ পুরোপুরি বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। আর তাই জেরুজালেমের খ্রিস্টান সম্প্রদায় যাতে নিয়মিত প্রার্থনা করতে পারে সেজন্য নিয়মানুযায়ী প্রতিদিন গির্জা থেকে ফেসবুক লাইভে যোগ দিচ্ছেন ফাদার আমজাদ সাব্বারা। আর নাগরিকদের সুবিধার্থে আরবি ভাষায় বাইবেল পাঠ এবং বক্তৃতার ব্যবস্থা করেছে হলি সেপালচার কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও বিভিন্ন রকম পারিবারিক সমস্যা ও সহযোগিতায় গির্জার উপাসকদের সঙ্গে যোগাযোগের স্বার্থে একটি হটলাইন চালু করা হয়েছে। যেকোনো খ্রিস্টান নাগরিক যেকোনো সময় এই হটলাইনে কল করে পরামর্শ নিতে পারছেন।
ইহুদীদের প্রার্থনা
আল বুরাক বা পশ্চিম দেয়ালে চুমু খেয়ে প্রার্থনার রীতিনীতি বেশ পুরোনো। ইহুদীরা একে যেমন পবিত্র স্থাপনা হিসেবে বিশ্বাস করে, তেমনি তাদের প্রার্থনাগুলো কাগজে লিখে চিরকুট আকারে দেয়ালের বিভিন্ন স্থানে রেখে দেয়। করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হওয়ার পর প্রথমদিকে অবশ্য ইসরায়েলের অন্যান্য শহরের ন্যায় জেরুজালেমেও ইহুদীদের প্রার্থনার ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়নি। সবকিছুই আগের মতো চলছিল। পরবর্তীতে এপ্রিল মাসেই নিষেধাজ্ঞা আসে পশ্চিম দেয়ালে জমায়েত হওয়ার উপর। সরকার নানা নিয়মকানুন বেধে দেয় চরমপন্থি ইহুদীদের উপর। নিয়মানুযায়ী ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে পশ্চিম দেয়ালে জমায়েত হতে পারবে ইহুদীরা। তবে দেয়ালে চুমু খেতে পারবে না কেউই।
এছাড়াও জেরুজালেমের অন্যতম পুরাতন র্যাম্বান উপাসনালয়ে প্রতিদিন সকালে প্রার্থনার আয়োজন করা হয়। র্যাম্বান উপাসনালয়টি ১২৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি জেরুজালেমের পুরাতন দ্বিতীয় কোনো উপাসনালয় হিসেবেই বেশি পরিচিত। প্রতিদিন সকালের প্রার্থনা কার্যক্রম পরিচালনা করেন ৭১ বছর বয়সী ইয়েহেজকেল চান। নিরাপদ দূরত্ব নিশ্চিত করতে ৬ ফুট দৈর্ঘ্যের বেঞ্চের ব্যবস্থাও করা হয়েছে সেখানে। আর প্রতিটি কক্ষে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিভিন্ন রকম ছবি ও উপদেশ বাক্য স্থাপন করেছে কর্তৃপক্ষ। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে র্যাম্বানে সংরক্ষিত ধর্মীয় বইগুলো ধরার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। এখন শুধুমাত্র উপাসকগণ এগুলো ব্যবহার করতে পারেন। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করেই এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলেও নিশ্চিত করেছেন ইয়েহেজকেল চান।
পশ্চিম দেয়ালে প্রার্থনার মতোই র্যাম্বান উপাসনালয়েও কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে সকালের প্রার্থনা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। প্রত্যেক দলে সর্বোচ্চ ১০ জন ভেতরে প্রবেশের অনুমতি পান। আর প্রত্যেক দল ৪৫ মিনিট করে প্রতিদিন সর্বমোট ৩টি দলে বিভক্ত হয়ে প্রার্থনা করতে পারেন। আর যদি কেউ স্বেচ্ছায় বাইরে প্রার্থনা করতে চায়, তবে সেই ব্যাপারে কোনো নিয়মনীতির কথা বলেনি ইসরায়েল সরকার। এক্ষেত্রে ইহুদী নাগরিকদের চেয়েও ধর্মগুরুদের নিরাপত্তার বিষয়ে বেশি জোর দিচ্ছে তারা। আর পবিত্র নগরীতে আবারও পুরোদমে ধর্মীয় কার্যক্রম শুরু করার লক্ষ্যে বর্তমানে গৃহীত সীমিত পরিসরে প্রার্থনার বিষয়গুলোকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ জানিয়েছে ইসরায়েল সরকার।