মৌমাছি ফুল থেকে ফুলে উড়ে বেড়ায় আর মধু সংগ্রহ করে এনে জমা করে নিজের মৌচাকে। সেই মধু সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রয় করেন মৌয়ালরা। আর আমরা সেগুলো ক্রয় করে ভোগ করি। অত্যন্ত সহজ প্রক্রিয়া, তাই নয় কি? সহজ প্রক্রিয়া বটে, তবে তা মধু বাজারে আসার আগপর্যন্ত। মধু সংগ্রহ করার প্রক্রিয়াটি কিন্তু মোটেও সহজ নয়। বিশেষ করে হিমালয়ান মৌমাছির মধু সংগ্রহ তো রীতিমতো জীবন-মরণ ব্যাপার।
হ্যাঁ, আমরা সাধারণত যেসব মৌমাছি দেখে অভ্যস্ত, নেপালের হিমালয়ান মৌমাছিগুলো সেগুলোর চেয়ে আকারে কম করে হলেও ৫ গুণ বড়। শুধু তা-ই নয়, এরা সাধারণ মৌমাছির চেয়ে যথেষ্ট বেশি বিষাক্ত এবং এদের কামড় বা হুলের ব্যথাও অনেক বেশি। তাছাড়া, এ মৌমাছির মৌচাকগুলোর সাধারণ অবস্থান হলো সুউচ্চ গ্রানাইটের পাহাড়ের কয়েকশ ফুট উঁচু কোনো খারা ঢালের গায়ে। সেখান থেকে দৈত্যাকার সব মৌমাছির বিরুদ্ধে লড়াই করে মধু সংগ্রহ করতে যাওয়াটা রীতিমতো জীবন নিয়ে খেলার অপর নাম। অথচ নেপালের পূর্বাঞ্চলীয় প্রত্যন্ত সাদি গ্রামের কুলুং জনগোষ্ঠীর মৌয়ালরা শতাব্দীর পর শতাব্দী এই জীবন-মরণ খেলাতেই মেতে ছিলেন। কেন?
হিমালয়ান মৌমাছিগুলো বছরের বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন মধু উৎপাদন করে থাকে। মধুর প্রকার নির্ভর করে মৌসুমের উপর। বিভিন্ন মৌসুমে ফোটা বিভিন্ন ফুলের রস আহরণ করে হিমালয়ান মৌমাছিগুলো মধুও উৎপাদন করে ভিন্ন ধরনের। তবে কুলুং মৌয়ালদের মধু সংগ্রহের জন্য সবচেয়ে প্রিয় সময়টি হলো মার্চ ও এপ্রিল মাস। এ সময় বড় বড় রোডোডেনড্রন গাছগুলোতে বাহারি রঙের সব ফুল ফোটে, যেগুলো একপ্রকার সাইকোট্রপিক টক্সিন বহন করে। এই টক্সিন সমৃদ্ধ রস থেকে হিমালয়ান মৌমাছিগুলো যে মধু উৎপাদন করে, তাকে বলা হয় ‘ম্যাড হানি’ বা উত্তেজক মধু। এই মধুকে কাশির ওষুধ এবং অ্যান্টিসেপটিক হিসেবে শত শত বছর ধরে ব্যবহার করেছে এ জনগোষ্ঠীর মানুষ। কিন্তু ২০ শতক থেকে এই মধু চোরাই বাজারে একচ্ছত্র রাজত্ব শুরু করে এর মাদকীয় গুণের জন্য। তাছাড়া, কাঠমান্ডুর অলিগলিতে দেবদেবীর মূর্তি তৈরির কারখানাগুলোয় ব্রোঞ্জ মূর্তি তৈরি করার জন্যও এ মধু ব্যবহার করা হয়। ফলে এশিয়ার চোরাই বাজারে এক পাউন্ড ওজনের উত্তেজক এই মধুর মূল্য ৬০ ডলারেরও বেশি, যা সাধারণ মধুর ৬ গুণ। আর এ কারণেই এ মধুর বিশেষ চাহিদা ছিল এতদিন।
‘ছিল এতদিন’ পড়বার পর থমকে গেলেন কি? তার মানে কি এখন আর চাহিদা নেই? না, ব্যাপারটা তেমন নয়। চাহিদা রয়েছে আগের মতোই, তবে মধু সংগ্রহ করবার মৌয়াল নেই! হ্যাঁ, শতাব্দী পর শতাব্দী চলে আসা ম্যাড হানি সংগ্রহের সংস্কৃতি কিংবা পেশা, যা-ই বলুন না কেন, কুলুং জনগোষ্ঠীর মাঝে তার অস্তিত্ব এখন আর নেই। তাদের সর্বশেষ মৌয়ালও নিজের কর্মজীবনের সর্বশেষ মধু সংগ্রহের কাজটি করে ফেলেছেন গত বছরই! ফলে দীর্ঘদিনের এই মধু সংগ্রহের রীতির অবসান ঘটেছে কুলুং সম্প্রদায়ের মাঝে।
পৃথিবী থেকে প্রতিদিনই এভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে কত সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আর পেশা, তার হিসাব নেই। ভাগ্যক্রমে, কুলুং সম্প্রদায়ের মধু সংগ্রহের রীতির সমাপ্তি ঘটলেও তার শেষ দলিল আমাদের কাছে রয়ে গেছে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফির একটি দল এই সম্প্রদায়ের সর্বশেষ মৌয়ালের জীবনের শেষ মধু সংগ্রহের পুরো ভিডিও চিত্রই ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিল। ফলে, এই রীতি কিংবা পেশাটি হারিয়ে গেলেও, এর দলিল থেকে যাবে চিরকাল, থেকে যাবে এ সম্প্রদায়ের শেষ মৌয়াল ব্যক্তিটির কর্মজীবনের ক্রান্তিলগ্নের কিছু মুহূর্তের ভিডিও চিত্র। কে সেই ব্যক্তিটি?
আমার সন্তানরা স্কুলে পড়ালেখা করছে, তাদের আর এই ঝুঁকিপূর্ণ পেশা গ্রহণ করতে হবে না
– কুলুং সম্প্রদায়ের শেষ মৌয়াল মাউলি ধন
মাউলি ধনের বয়স বর্তমানে ৫৭ বছর। এ বয়সে বাঁশ আর দড়ির তৈরি ঝুলন্ত সিড়ি বেয়ে কয়েকশ ফুট উঁচুতে উঠে মধু সংগ্রহের কাজটি তার জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে। অবশ্য এ কাজ তার জন্য শুরু থেকেই চ্যালেঞ্জিং ছিল, যখন মাত্র ১৫ বছর বয়সে শুরু করেছিলেন। মৌচাকটি পাথরের গাঁ থেকে খুলে নেবার সময় মৌমাছি তার হাতে, পায়ে, মুখে সর্বত্র হুল ফুটাতে শুরু করলে ব্যথায় কাতর হয়ে ওঠেন তিনি। তথাপি শক্ত করে দড়ি ধরে রাখতে হয় দীর্ঘক্ষণ, যতক্ষণ না পুরো মৌচাকটি উদ্ধার করা যায়। আর এভাবেই মাউলি কাটিয়েছেন জীবনের ৪২টি বছর। অবশেষে গতবছর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, এ কাজের ইতি টানার সঠিক সময় তার চলে এসেছে। খাদ্যশস্য আর শাকসবজিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও তেল, লবণ, পোশাকসহ আরো কিছু প্রয়োজনীয় দ্রব্য, যেগুলো তিনি নিজে উৎপাদন করতে পারেন না, সেগুলো কেনার জন্যই মূলত তিনি মধু সংগ্রহের এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি দীর্ঘদিন করেছেন।
মাউলি ধন তার সহযোগী আসধন কুলুংকে সাথে নিয়ে শেষবারের মতো হোঙ্গু উপত্যকায় চড়েছিলেন গতবছর জুলাই মাসে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফির কর্মকর্তাদের বিস্ময় বাড়িয়ে দিয়ে কোনোরকম নিরাপত্তা দড়ি ছাড়াই উপত্যকার উপর থেকে ঝোলানো একটি লম্বা বাঁশ আর দড়ির তৈরি ঝুলন্ত সিঁড়িতে বেয়ে উঠে গেলেন কয়েকশো ফুট উপরে! উপরন্ত, কাঁধে তার ঝোলানো ছিল বড় একটি বাঁশ, দড়িতে বাধা একটি ঝুড়ি এবং ধোঁয়া জ্বালানোর কিছু সরঞ্জাম। হাত ফসকে গেলেই এসব সরঞ্জাম নিয়ে একেবারে নীচে পতিত হতে হবে, একথা স্মরণে রেখে ধীরে পদক্ষেপে প্রায় আড়াইশ ফুট উপরে উঠে থামলেন মাউলি। তখন মৌচাকটি তার থেকে ১০ ফুটের মতো দূরত্বে রয়েছে। এবার তিনি একহাতে সিড়ি ধরে রেখে আরেক হাতে কাঁধ থেকে বাঁশটি হাতে নিলেন। বাঁশের আগায় ধোঁয়া জ্বালিয়ে সেটি মৌচাকের নিকটে বাড়িয়ে ধরলেন।
ধোঁয়ার তীব্রতায় কিছুক্ষণের মাঝেই মৌচাক থেকে মৌমাছিগুলো বাইরে বেরিয়ে আসতে লাগলো এবং মাউলির গায়ে হুল ফুটাতে শুরু করলো। অথচ, সেকেন্ডে সেকেন্ডে বড় বড় হিমালয়ান মৌমাছির কামড় খেয়েও মাউলির চেহারায় কোনো যন্ত্রণার ছাপ ছিল না, কোনোরূপ ভাবের পরিবর্তন ছিল না। তিনি এমনভাবে তার কাজ করে চললেন যেন কিছুই হচ্ছে না! আপন সুরে গুণ গুণ করে কেবলই একটি মন্ত্র জপতে থাকেন, যে মন্ত্রটি ক্রোধান্বিত মৌমাছিদের শান্ত করে বলেই কুলুংদের বিশ্বাস। আর এই মন্ত্র জপতে জপতেই মধুতে পরিপূর্ণ মৌচাকটি কাঁধে ঝোলানো ঝুড়িতে ভরে ফেলেন মাউলি। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে তার লেগে যায় ২ ঘন্টার মতো সময়। এত দীর্ঘ সময় বাঁশের দড়িতে ঝুলে, দৈত্যাকার সব মৌমাছির কামড় খেয়ে মধু সংগ্রহের কাজ করার অফুরন্ত শক্তি মাউলি কোথায় পান, তা তিনিই জানেন!
শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে কুলুং সম্প্রদায়ের মানুষেরা বহির্বিশ্ব, আরো নির্দিষ্ট করে বললে নিজ দেশের অপরাপর জনগোষ্ঠীগুলো থেকেই আলাদা হয়ে বসবাস করেছে। হোঙ্গু উপত্যকার নিকটে বয়ে চলা হোঙ্গু নদী আর ঘন বনজঙ্গল ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে তাদের পৃথিবীটা। ছোট্ট গ্রাম সাদির বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন তাদের সচরাচর হয় না। মাউলির মতো এ গ্রামের অপরাপর বয়োবৃদ্ধদের কাছে জিজ্ঞেস করলে এখনো তারা নেপাল বলতে কেবল কাঠমান্ডুকে বোঝেন, যা কি না তাদের গ্রাম থেকে শত শত কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, ঠিক যেন পৃথিবীর অপর প্রান্তে! তবে সাম্প্রতিক সময়ে পর্যটনের খাতিরে বাইরের জগতটা ক্রমশই তাদের দিকে অগ্রসরমান। হোঙ্গু উপত্যকায় ট্রেকিংয়ের জন্য পাহাড়ে খনন করা হয়েছে সিঁড়ি। আর এ সিঁড়ি বেয়ে নামলে যে পথটা পর্যটকদের হোঙ্গু নদীর দিকে নিয়ে যাবে, সেটি গেছে সাদি গ্রামের ভেতর দিয়েই। ফলে এ গ্রামের মানুষজন এখন স্বদেশী ‘ভিনদেশীদের’ প্রতিদিনই দেখার সুযোগ পাচ্ছে।
আমি সেদিন চূড়ার ধারে একটি মাকড়সার ফাঁদে আটকা পড়েছিলাম। তখন উপর থেকে একটি বানর তার লেজ নীচে ঝুলিয়ে দেয়। আমি তার লেজে শক্ত করে ধরতেই সে আমাকে উপরে উঠিয়ে নেয়!
জীবনের প্রথম মধু সংগ্রহের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নিজ বাড়িতে বসে এ কথাগুলো স্মরণ করেন মাউলি। ১৫ বছর বয়সে নিজের বাবার সাথে মধু সংগ্রহের কাজে হাতেখড়ি হয় তার। তারপর একটানা ৪২ বছর এ পেশায় যুক্ত থেকে অবশেষে নিজেকে বাঁধনছাড়া করলেন গতবছর। গ্রামের সবচেয়ে দরিদ্রদের মধ্যে তিনি একজন তা তার বসবাসের বাড়িটি দেখলেই বোঝা যায়। অধিকাংশের বাড়ি ছাদ টিনের হলেও মাউলির ছাদ খড়ের তৈরি। মাটির দেয়ালে বড় একটি ফাটল দেখিয়ে তিনি মনে করিয়ে দেন ২০১৫ সালের ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পের কথা।
মাউলির যৌথ পরিবার বেশ বড়। তার তিনজন স্ত্রী মোট ছয়জন সন্তান রেখে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন, যাদের দেখভাল মাউলিই করেছেন। তার কন্যাদের মাঝে দুজন বিধবা হবার পর থেকে মাউলির সাথেই বাস করছেন। ফলে, তার কাঁধে আরো ৫ জন নাতি-নাতনির দায়িত্বও রয়েছে। এতগুলো মুখে আহার তুলে দিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মধু সংগ্রহ ছাড়া আর কোনো রাস্তা খোলা ছিল না তার সামনে।
সাদি গ্রামের বাসিন্দারা এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন আরো বহু আগে, অন্তত ১৫ বছর তো হবেই। এতকাল মাউলি একাই পাহাড়ে চড়ে মধু সংগ্রহের এ পেশাটিকে জীবিত রেখেছিলেন। এখন তিনি ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত। সংসার চালনার দায়িত্ব তাই ছেলেদের বুঝিয়ে দিয়ে নির্বিঘ্নে বাকি জীবনটা কাটাতে চান তিনি। নিতান্ত বাধ্য হয়ে দীর্ঘকাল এ পেশাটিকে একাই বাঁচিয়ে রাখা নিয়ে অবশ্য মাউলির কোনো খেদ নেই। তিনি বরং কুলুং সম্প্রদায়ের শেষ পাহাড়ে চড়া মৌয়াল হিসেবে গর্ববোধ করে। ভিডিওচিত্র ধারণ হওয়ায় তার অবসরের পরেও পৃথিবী জানতে পারবে এরকম কোনো পেশা নেপালের প্রত্যন্ত এক গ্রামে কোনোকালে ছিল, এ ভাবনায় তিনি শিহরিত হন। পাহাড়ের গায়ে লেপ্টে থাকা মৌচাকগুলোতে মৌমাছিরাও হয়তো আনন্দে শিহরিত হয়েছে এই ভেবে যে, মাউলি আর তাদের বাসা ভাঙতে আসবে না!