মহাদেব শিবের পুত্র সুব্রামানিয়াম সমুদ্রদেবতা বরুণের কাছে একটি অনুরোধ জানালেন। সেটি হলো, পরশুরাম তার কুড়াল এক নিক্ষেপে যত দূর পাঠাতে পারে, সেই পরিমাণ ভূমি তাকে দিতে হবে। পরশুরাম বাস করেন পশ্চিম ঘাটে। সেখান থেকে তিনি কুড়াল নিক্ষেপ করলেন। কুড়াল গিয়ে পড়ল কন্যাকুমারীতে। তাতে সমুদ্রের বুক থেকে একটি বিশাল ভূ-ভাগ জেগে উঠল। এই ভূখন্ডই হলো আজকের কেরালা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর ‘ঈশ্বরের নিজের দেশ’।
পরশুরাম ছিলেন ভগবান বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার। তিনি অতঃপর সেই ভূখন্ডে চৌষট্টিটি নামবুদ্রি ব্রাহ্মণ পরিবারকে বসবাসের অনুমতি দেন। তারা ঋগ্বেদের শিক্ষা মেনে চলত। পরশুরাম চলে যাওয়ার আগে তাদেরকে সেই অঞ্চলের শাসনভার দিয়ে যান।
পরশুরামের এই কিংবদন্তি তৈরি করেছিল আর্যরা, যারা কি না ভারতে এসেছিল উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে। দক্ষিণের এই কালো অনার্যদের দেশে তারা নিয়ে এসেছিল বৈদিক ধর্ম এবং সংস্কৃত ভাষা। আর চালু করেছিল বর্ণপ্রথা, যা আগে কখনো এ অঞ্চলে প্রচলিত ছিল না।
পরবর্তী দু’হাজার বছর ধরে কেরালার কোডুনগাল্লুর এবং কোচির সমুদ্রবন্দরে বিভিন্ন কিসিমের মানুষের জাহাজ এসে ভিড়েছে। ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে মূলত পশ্চিম এশিয়া এবং ইউরোপের বণিকেরা আরব সাগর হয়ে এসে এই অঞ্চলে ঘাঁটি গেড়েছিল। বণিকদের এই অনুপ্রবেশের ঘটনা ছিল শান্তিপূর্ণ।
খ্রিস্টপূর্ব যুগে সর্বপ্রথম আরব বণিকেরা মসলার সন্ধানে কেরালায় এসেছিল বলে ধারণা করা হয়। প্রথম খ্রিস্টপূর্বাব্দে মালাবার উপকূলে আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রিক বণিকদের আসার ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে রোমান, মিসরীয় ও ইরানী মুসলিম এবং চীনারা কনকান ও মালাবার উপকূলে পদার্পণ করে। তাদেরকে অনুসরণ করে পর্তুগিজ, ডাচ, ফরাসি, ডেনিশ এবং সবশেষে ইংরেজ বণিকেরা কেরালায় বসতি স্থাপন করেছিল।
বিভিন্ন দিক দিয়ে এই বৈদেশিক যোগাযোগ কেরালার মানুষের জীবনধারা এবং ব্যক্তিত্বকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল। পশ্চিমা এবং আরব বণিকদের সাথে বাণিজ্যের সুবাদে কেরালা পশ্চিম ঘাট পর্বতমালার পাদদেশের ছোট পাহাড়গুলোতে চাষাবাদের একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করে। উপকূলবর্তী অঞ্চলে অর্থকরী ফসল উৎপাদনের উপর ভিত্তি করে কেরালায় একটি কৃষিব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
কেরালার অর্থনীতি নির্ভর করে গোলমরিচ, এলাচ, রাবার, চা, কফি এবং বিশেষভাবে নারিকেলের উপর। চাষবাসের আধিক্যের কারণেই কেরালা হয়ে উঠেছে চিরসবুজ। সেখানকার বিস্তৃত খালগুলো দিয়ে উপকূলবর্তী ছোট ছোট বন্দরগুলোতে উৎপাদিত শস্যগুলো রপ্তানি করা হতো। এই হিসেবে কেরালার ভূ-দৃশ্যের মধ্যে তার অর্থনৈতিক ইতিহাস লিখে দেওয়া আছে বলা যায়।
কেরালার দেশী মদের সুনাম প্রাচীনকাল থেকেই শোনা যায়। বিখ্যাত ইতালিয়ান পর্যটক মার্কো পোলো কেরালায় ঘুরে গিয়েছিলেন। তিনি তার ভ্রমণকাহিনীতে কেরালার দেশী মদের বর্ণনা দিয়েছেন। তার বর্ণনা অনুযায়ী, সেখানে মদ প্রস্তুত করা হতো চিনি থেকে। তবে ধারণা করা হয়, তালের রস বা আখের রস থেকে মদ প্রস্তুতপ্রণালির কথাই বলা হয়েছিল সেখানে।
মার্কো পোলো চীন ঘুরে কেরালায় এসেছিলেন। কেরালায় এসে তিনি বিস্মিত হয়ে লেখেন:
এখানকার সবকিছুই আমাদের চেয়ে আলাদা। আকারে এবং সৌন্দর্যে সেগুলো তুলনামূলক উৎকৃষ্ট। তাদের সব ধরনের ফলমূল, পশুপাখিও আমাদের চেয়ে ভিন্ন। চরম উষ্ণ আবহাওয়ার ফলে এমনটি হয়েছে। চাল ছাড়া তাদের আর কোনো খাদ্যশস্য নেই। তারা চিনি থেকে একধরণের উৎকৃষ্ট মদ প্রস্তুত করে। আঙুরের মদের তুলনায় তা দ্রুতই মানুষকে নেশাগ্রস্ত করে ফেলে। মানুষের বাঁচার জন্য যে সমস্ত খাদ্যসামগ্রী প্রয়োজন হয়, তার সবকিছুই এখানে প্রচুর পরিমাণে মজুত রয়েছে। শুধু ব্যতিক্রম হলো, চাল ছাড়া অন্যান্য খাদ্যশস্য পাওয়া দুষ্কর। তাদের দক্ষ জ্যোতিষীর কোনো অভাব নেই। দক্ষ চিকিৎসকেরা তাদের স্বাস্থ্যের দেখাশোনা করে। তাদের চামড়া কৃষ্ণবর্ণ। কোমরে একগাছি ধুতি ছাড়া তাদের পুরুষ ও নারী উভয়ে প্রায় নগ্ন হয়েই চলাফেরা করে। তারা কোনো প্রকার লাম্পট্য বা কোনো ধরনের কামনাকে পাপাচার বলে মনে করে না। (দ্য ট্রাভেলস অব মার্কো পোলো, তৃতীয় পুস্তক, অধ্যায়: ১৭)।
খ্রিস্টধর্মের প্রচারক সেইন্ট থমাস ৫২ খ্রিস্টাব্দে কেরালার মুজিরিসে (বর্তমান কোডুনগাল্লুর) পদার্পণ করেন বলে শোনা যায়। তিনি যিশুখ্রিস্টের বারো শিষ্যের একজন ছিলেন। তার হাতে ধর্মান্তরিত হওয়া মানুষদের নিয়ে উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন খ্রিস্টীয় সম্প্রদায় গঠিত হয়। সে সময় সেইন্ট থমাসের চার্চ বা সিরিয়ান খ্রিস্টান চার্চ তৈরি করা হয়। দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দে আরো বহু চার্চ তৈরি করা হয়েছিল। জনশ্রুতি অনুযায়ী, তিনি খুব ধৈর্য্যের সাথে মানুষকে গসপেলের শিক্ষা দেন। সে সময়ে তিনি স্থানীয় রাজা বানা পেরুমলসহ চারশোজন হিন্দু এবং চল্লিশজন ইহুদীকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেন। তিনি উপকূলবর্তী শহরগুলোতে সাতটি চার্চ স্থাপন করেন। শোনা যায়, কেরালা থেকে চীন ঘুরে পুনরায় ভারতে আসার সময়ে করোমান্ডেল উপকূলে স্থানীয় শত্রুভাবাপন্ন হিন্দুরা তাকে হত্যা করে। মাদ্রাজের (বর্তমান চেন্নাই) মায়লাপরিতে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। কেরালায় রাজ্যের মোট জনংসংখ্যার ১৮% খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বাস। ভারতের সর্বোচ্চ সংখ্যক খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী বাস করে কেরালায়।
কেরালায়, এবং উপমহাদেশেও, খ্রিস্টধর্ম আগমনের পূর্বে কোডুনগাল্লুর ও কোচিতে ইহুদী সম্প্রদায়ের বসবাসের খবর শোনা যায়। কেরালার কৃষ্ণাঙ্গ ইহুদীরা বিশ্বাস করত, তারা ইয়েমেন এবং ব্যাবিলনের বিতাড়িত বনি ইসরায়েলের বংশধর। পরবর্তীকালে মধ্যযুগে ইসলাম ধর্মের উত্থানের সময়ে ইরান ও ইরাক থেকে শেতাঙ্গ ইহুদীরা কেরালায় এসে বসতি স্থাপন করে। সামাজিক রীতিনীতির দিক থেকে কৃষ্ণাঙ্গ ইহুদীদের সাথে সাধারণ মালায়ালিদের কোনো পার্থক্য ছিল না। তবে শেতাঙ্গরা স্থানীয়দের মধ্যে নিজেদের কৌলিনত্ব বজায় রেখেছিল। কোচিতে ইহুদী সম্প্রদায়ের উপাসনালয় হিসেবে পারাদেশী সিনেগগ ১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দে তৈরি করা হয়। কমনওয়েলথ্ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরাতন সিনেগগ হিসেবে ধরা হয় একে।
কেরালায় মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৬% মুসলমান। ভারতীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে কাশ্মীরের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মুসলিম জনগোষ্ঠীর আবাস কেরালায়। মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে বৃহৎ মাপিল্লা জনগোষ্ঠী বাস করে মালাবার উপকূলে। তাদেরকে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে প্রাচীন মুসলিম জনগোষ্ঠী বলে মনে করা হয়। সপ্তম খ্রিস্টাব্দে ইসলামের স্বর্ণযুগেই আরব বণিকদের মাধ্যমে কেরালায় ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটেছিল। চেরামান পেরুমল তাজুদ্দীন নামক একজন হিন্দু রাজার চমকপ্রদ ইতিহাস জানা যায়। তিনি সে সময় আরবে স্বয়ং হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)–এর সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। কোডুনগাল্লুরের চেরামান জুমা মসজিদ ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল বলে দাবি করা হয়। এদিক দিয়ে এটি ভারতীয় উপমহাদেশে নির্মিত সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ।
মার্কো পোলোর পর আরেকজন ইতালীয় ভ্রমণকারী কেরালার উচ্ছ্বসিত বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন। নিকোলাস কোন্টি ১৪৪০ খ্রিস্টাব্দে লিখেন, ‘“চীন হলো অর্থ রোজগারের জন্য সেরা জায়গা। আর সে অর্থ ব্যয়ের সেরা জায়গা হলো কেরালা।’ যদিও তিনি কেরালায় বিশেষ কোন আকর্ষণ খুঁজে পেয়েছিলেন, সে বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়নি।
পনেরো শতকের ইতালিয়ান ভ্রমণকারীদের বর্ণনা থেকে সে সময়ের কেরালায় মুসলিম ও খ্রিস্টান সম্প্রদায় সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যায়। মুসলিম ব্যবসায়ীরা মশলার বিনিময়ে স্বর্ণখচিত কাপড় এবং রেশমের কাপড়ের মতো বিলাসদ্রব্য আমদানি করত। পর্তুগিজেরা এসকল বর্ণনার মাধ্যমে কেরালার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে।
১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত নাবিক ভাস্কো-দা-গামার নৌবহর কেরালার তৎকালীন কালিকট বন্দরে এসে থামে। কালিকটের স্থানীয় রাজা দরবার হলে একটি জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাকে স্বাগত জানান। তবে আরব বণিক এবং স্থানীয় রাজারা পর্তুগিজদেরকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি। পর্তুগাল থেকে কয়েক দফা বেশ কিছু বাণিজ্য জাহাজ নিয়ে এসে কেরালায় পর্তুগিজেরা নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টা চালায়। ইতিমধ্যে পার্শ্ববর্তী একজন প্রতিদ্বন্দ্বী রাজার সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করার মাধ্যমে পর্তুগিজরা কেরালায় স্থায়ী ঘাঁটি তৈরি করে।
পর্তুগিজ প্রভাবকালে সৈন্য এবং বেসামরিক কর্মকর্তাদেরকে তারা কেরালার স্থানীয় নারীদের বিয়ে করতে উৎসাহিত করেছিল। খ্রিস্টান মালায়ালিরা কোচিনের পৌরসভায় শ্বেতাঙ্গদের সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত। স্থানীয় ধর্মান্তরিতদেরকে প্রায়ই সামরিক ও বেসামরিক নানা উঁচু পদ-পদবীও দেওয়া হয়েছিল। ফ্রান্সিস জেভিয়ার ট্রাভাঙ্কোরের বহু নিম্নবর্ণের জেলেকে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করেছিলেন। একে কেরালায় বর্ণপ্রথার ছুৎমার্গের বিরুদ্ধে প্রথম একটি বড় আঘাত হিসেবে ধরা হয়।
ঊনিশ শতকের শুরুর দিকে কেরালায় বর্ণাশ্রমের বিরুদ্ধে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের কয়েক দফা বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। তৎকালীন ট্রাভাঙ্কোর এবং কোচিনের রাজারা বেশ কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিলে সে সময়ের উচ্চবর্ণ এবং সামন্তপ্রভুদের ক্ষমতা হ্রাস পায়। সে সময়ের রাজাদের জনকল্যাণমূলক শাসন ব্যবস্থার ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা আধুনিক কেরালাতেও রক্ষিত হয়েছে।
বর্তমান সময়ের পূর্ব পর্যন্ত বর্ণপ্রথা ছিল কেরালার একটি সর্বব্যাপী অভিশাপের নাম। স্বামী বিবেকানন্দ একশ বছর আগে কেরালায় ভ্রমণ করেছিলেন। তখন তিনি সেখানে বর্ণপ্রথার বাড়াবাড়ি দেখে সে অঞ্চলকে “পাগলাগারদ” বলে মন্তব্য করেছিলেন।
পরবর্তীকালে অবৈতনিক গণশিক্ষা কার্যক্রম এবং নিচুবর্ণের হিন্দুদের প্রতিনিয়ত সংগ্রামের ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে কেরালার সমাজ বর্তমানে প্রায় শ্রেণীহীন একটি সমাজে পরিণত হয়েছে।
শ্রী নারায়ণ গুরু একটি ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন। আন্দোলনের স্লোগান ছিল: ‘এক ঈশ্বর, এক জনতা, এক ধর্ম।’ তিনি এজাভা সম্প্রদায়কে বর্ণবৈষম্য থেকে মুক্তি প্রদানের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
১৯৫৬ সালে ভারতীয় সংবিধান মোতাবেক বর্তমান কেরালা রাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। পরের বছরে কেরালায় বিশ্বের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কমিউনিস্ট রাজনৈতিক দল হিসেবে (সিপিআই-এম) সরকার গঠন করে। ক্ষমতায় এসেই তারা রাজ্যের ভূমি সংস্কারের কাজে হাত দেয়। বিভিন্ন ঘটনাক্রমের মধ্যে দিয়ে কোয়ালিশন সরকার ষাটের দশকে বিপুল পরিমাণে ভূমি কেরালার ১৫ লক্ষ ভূমিহীন কৃষকের মধ্যে বিতরণ করে। আরো ১৮ লক্ষ মানুষ এই পদক্ষেপের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়। কেরালায় ভূমিহীন কৃষকদের পরিমাণ শতকরা ৪.৮%-এ নেমে আসে। এই পদক্ষেপের ফলে কেরালাবাসী শতাব্দী-প্রাচীন সামন্তবাদ এবং দারিদ্র্য উভয়ের হাত থেকেই রক্ষা পায়।
১৯৮৯ সালে কেরালায় একটি অভূতপূর্ব গণশিক্ষা আন্দোলন শুরু হয়। সারা প্রদেশব্যাপী প্রায় ৩,৫০,০০০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক ব্ল্যাকবোর্ড এবং শিশুপাঠ্য বই নিয়ে জেলেপল্লী, শহরের বস্তি এবং প্রত্যন্ত আদিবাসী গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। মানুষকে শিক্ষা কার্যক্রমে উৎসাহিত করতে জমিতে এবং রাস্তায় পৌরাণিক কাহিনী থেকে নাটকের আয়োজন করা হয়। ঘরের বাইরে, গাছের তলায় কিংবা কোনো গ্রামবাসীর বাড়িতে ক্লাস নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। অনেকেই এই আন্দোলনের উত্তেজনাকে জনগণের মুক্তি সংগ্রামের সাথে তুলনা করেন। নিজেদের অনেক অপূর্ণতা কাটিয়ে উঠতে বয়োজ্যোষ্ঠেরা প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। তাদের অনেকেই নিজের সন্তানের চিঠি পড়ার জন্য কিংবা বাসের সিগন্যাল দেখে বুঝে ফেলার জন্য শিক্ষিত হয়েছিলেন বলে পরবর্তী সময়ে জানিয়েছিলেন।
এই গণশিক্ষা আন্দোলন কেরালায় জনগণের স্বাক্ষরতার হার বৃদ্ধিতে ব্যাপক অবদান রেখেছিল। তাছাড়াও এটি খুব স্বাভাবিকভাবেই মালায়ালিদের মধ্যে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে সাহায্য করেছিল। মালায়ালিরা ভারতবর্ষের সবচেয়ে বেশি সংবাদপত্র পড়া জনগোষ্ঠী। গ্রামে গ্রামে পাঠাগার তৈরির মাধ্যমে জনগণের স্বশিক্ষার অবারিত সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। তারা রাজনীতি সচেতন নাগরিক। কেরালায় বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রচুর সংগঠন দেখতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন রাজনৈতিক, শ্রমিক এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো মিলে এমনতর প্রাণবন্ত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা ভারতবর্ষে খুব বেশি দেখা যায় না।
কেরালায় সরকারিভাবে সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে প্রচুর পরিমাণে ভর্তুকি দেওয়া হয়। স্বাস্থ্যখাতে বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগ করা হয়। কেরালা প্রাচীন কাল থেকেই ছিল আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতির স্বর্গরাজ্য। আধুনিক কেরালায় প্রায় বিনামূল্যে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। শিশুমৃত্যু এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির নিম্নহারের দিক থেকে কেরালা উন্নত বিশ্বের সাথে তুলনীয়।
কেরালা ভারতের সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্থ রাজ্য। তুলনামূলক কম জিডিপি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়েও ২০১৫ সালের শুমারি অনুযায়ী, কেরালার মানব উন্নয়ন সূচক ছিল ০.৭৭০, যা কি না ভারতের রাজ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উন্নত জীবনমান নির্দেশ করে। ২০১১ সালের শুমারি অনুযায়ী, কেরালার জনগণের প্রত্যাশিত আয়ু ছিল ৭৪ বছর। একই বছরে কেরালার জনগণের স্বাক্ষরতার হার ছিল শতকরা ৯৪%। ২০১৩ সালে টেন্ডুলকার কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, কেরালায় শহর এবং গ্রামে দারিদ্রসীমার নীচে বাস করা মানুষেরা মোট জনসংখ্যার যথাক্রমে ৯.১৪% এবং ৪.৯৭%। জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ০.৯%। বাল্যবিবাহ এবং শিশুশ্রমের শতকরা হারও খুবই কম। সেখানে প্রতি ১ লক্ষ মানুষের মধ্যে ১.১ জন ব্যক্তি খুনের শিকার হয়। মোটকথা, ভারতের এবং বেশ কিছু সূচকে পৃথিবীর শিল্পোন্নত দেশগুলোকেও ছাড়িয়ে গিয়ে কেরালা পৃথিবীর সবচেয়ে বসবাসযোগ্য একটি অঞ্চল হয়ে উঠেছে।
কৃষিনির্ভর একটি দরিদ্র প্রদেশ কীভাবে এমন আশ্চর্যজনক উন্নতি করে ফেলল? এর উত্তর লুকিয়ে আছে একটি বাক্যে। কেরালা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চেয়ে সমতার ভিত্তিতে মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল। কেরালার এই বিশেষ ধরনের উন্নয়নের পদ্ধতিকে ‘কেরালা মডেল’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
আধুনিক কেরালার স্বাক্ষরতার হার প্রায় শতভাগ। তাদের উন্নতি এবং মৌলিক অধিকারের সমতা প্রায় নিশ্চিত হয়েছে বলা যায়। বর্তমানের সব ধরনের উন্নতি ও সমৃদ্ধির পেছনে কাজ করেছে তাদের উপকূলীয় অবস্থান এবং বৈদেশিক নানামুখী প্রভাবের ইতিহাস। বৈদেশিক যোগাযোগ কেরালার মানুষকে সবসময় নতুন নতুন ধ্যান-ধারণা এবং জীবনাচরণের সংস্পর্শে উজ্জীবিত রেখেছিল। মালায়ালিরা তাদের নিজস্ব ঐতিহ্যের দারুণ ভক্ত এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীর দিক থেকে গোঁড়া। একইসাথে তারা বিশ্বজনীন অভিযাত্রিক। জীবিকার সন্ধানে তারা পৃথিবীর দেশে দেশে ঘুরেছে এবং সেখানে বসতিও স্থাপন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং উপসাগরীয় দেশগুলোকে তারা মক্কা বানিয়েছে। সেখানে তারা পেশাগতভাবে সফলতাও অর্জন করেছে।
বর্তমান সময়ের তরুণ মালায়ালিদেরকে ভাগ্যবান বলা যায়। কারণ এই মুহূর্তে মালায়ালি সমাজ সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সেখানে ঐতিহ্যগত শিল্পকলা নতুনভাবে ফিরে আসছে। মালায়ালাম ভাষা সমৃদ্ধ হচ্ছে নানামুখী লেখনীর দ্বারা। সাহিত্যে এবং সিনেমায় কেরালা মেধাবী শিল্পী ও নির্মাতাদের এক বিশাল ভান্ডার আবিষ্কার করেছে। তারা প্রতিনিয়ত এই আন্দোলনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
কেরালা বর্তমানে ভারতের একটি শিক্ষিত, সংস্কৃতিবান এবং ধর্মনিরপেক্ষ জনতার প্রদেশ। এর পেছনে রয়েছে কেরালার জনগোষ্ঠী এবং শাসকদেরও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার বহুপ্রাচীন ঐতিহ্য। ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এখানে বিরল ঘটনা। সবকিছু মিলিয়েই যেন এটি ঈশ্বরের নিজের দেশ হয়ে উঠেছে।