সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা শত শত গাড়ির দৃশ্য শহরবাসী যেকোনো মানুষের কাছে এতটাই মামুলি যে এ ব্যাপারে কোনো গল্প ফেঁদে বসা অসম্ভব। কিন্তু সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির সে ভিড় যদি হয় এমন, যেখানে কেউ হর্ন বাজাচ্ছে না, হেডলাইট জ্বালিয়ে-নিভিয়ে সঙ্কেতও দিচ্ছে না; এমনকি সবক’টা গাড়ির ইঞ্জিনও নিশ্চুপ হয়ে আছে বহুকাল ধরে? একটু গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা, তাই না? ব্যাপারটা আরও অদ্ভুত শোনায়, যদি সে গাড়ির বহর শহরের ভেতরে নয়, বরং আটকে থাকে পাহাড়ের উপরে ঘন এক জঙ্গলের ভেতরে।
দক্ষিণ বেলজিয়ামের ফ্রান্স সীমান্তের কাছাকাছি শহর সেন্ট-লেগার। তার একটি ছোট লোকালয়ের নাম শ্যাটিয়ন। আশেপাশের আর দশটা এলাকা থেকে আলাদা করার মতো বিশেষ কিছু নেই সেখানে। তবে চ্যাটিলনের লোকালয় ছেড়ে একটু দূরে ছড়িয়ে ছড়িয়ে থাকা প্রায় পাঁচ শতাধিক গাড়ির বিচিত্র সমাধিক্ষেত্র এই এলাকাকে অন্য সবার থেকে আলাদা করে, তা নিশ্চিতভাবেই বলা চলে। আরো অবাক করার মতো বিষয়, লাইন করে বছরের পর বছর ধরে দাঁড়িয়ে থাকা এসব গাড়ির বেশিরভাগ বেলজিয়াম তো নয়ই, এমনকি ইউরোপেও তৈরি নয়। এগুলো তৈরি হয়েছিল আমেরিকায়, চল্লিশের দশকের কোনো এক সময়!
বয়সের ভারে ক্ষয়ে যাওয়া, মরচে পড়া সেই গাড়িগুলোকে দেখলে মনে হতে পারে, এগুলো আদতে গাড়ি নয়, বরং গাড়ির ভূতুড়ে অবয়ব কিংবা কঙ্কাল। ঝরা পাতা আর বুনো ঘাসের ভিড়ে ক্ষয়ে যাওয়া গাড়িগুলোর অনেকটাই ঢাকা পড়ে গেছে। কোনো কোনো গাড়ির গায়ে জন্মেছে পরগাছা। আবার কোনোটার ভেতর দিয়ে বেরিয়ে এসেছে বিশাল কোনো গাছের শাখা।
কী এই জঙ্গলের ভেতরে মিশে থাকা গাড়ির রহস্য? এ নিয়ে যদি বেশ কয়েকটি মত প্রচলিত আছে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিতটি অনুসারে এ কাহিনীর শুরু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। সীমান্তের কাছে হওয়ায় শ্যাটিয়নের কাছেই ছিল আমেরিকান সৈন্যদের ঘাঁটি। দীর্ঘ এই যুদ্ধের সময়ে যেসব সৈন্যকে এ অঞ্চলে মোতায়েন করা হয়েছিল, তাদের ব্যবহার্য গাড়ির দেহাবশেষ এই সমাধিক্ষেত্রে। যুদ্ধশেষে যখন সবার নিজ দেশে ফেরার ডাক আসে, তখন যে যার মতো সব গুছিয়ে নিজের দেশে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বিপুল পরিমাণ সৈন্য পরিবহনের জন্যে যথেষ্ট দূরপাল্লার বাহন ছিল না যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর কাছে। সে কারণে সৈনিকরা নিজেদের সাথে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পরিবহনের সুযোগ পেলেও আস্ত গাড়ি সাথে করে নিয়ে যাবার অনুমতি পেল না। কিন্তু ঝাঁ চকচকে সব আমেরিকান গাড়ি তো আর যেখানে সেখানে ফেলে চলে যাওয়া যায় না।
তাই নিজেদের ঘাঁটির কাছাকাছি কোথাও সাময়িকভাবে গাড়িগুলো রেখে যাবার পরিকল্পনা করে তারা। লোকালয় থেকে একটু দূরে, নির্জন স্থান হিসেবে শ্যাটিয়নের পাশের বনাঞ্চল পছন্দ হলো তাদের। খুব দ্রুতই সারি বেঁধে নিজেদের শখের গাড়িগুলোকে সেখানে সাজিয়ে ফেলল তারা।
সময় বুঝে ফিরে এসে গাড়িগুলোকে নিজেদের দেশে ফিরিয়ে নেবার আশা নিয়ে বিদায় নেয় সেই সৈন্যদল। কিন্তু যে কারণেই হোক, সে সুযোগ আর কখনো হয়ে ওঠেনি তাদের। শ্যাটিয়নের পাশের সে জঙ্গলে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই চোখ ধাঁধানো সব আমেরিকান গাড়ি পরিণত হয় ভুলে যাওয়া এক সমাধিক্ষেত্রে।
তবে শ্যাটিয়নবাসী রোমাঞ্চকর এ গল্পের সাথে একমত নয়। তাদের ভাষ্য, গাড়ির এই জাঙ্কইয়ার্ড অঞ্চলে ব্যবহৃত পুরাতন গাড়ি জমানোর ফলেই হয়েছে। প্রমাণ হিসেবে তারা দাবি করে, গাড়ির এই সমাধিক্ষেত্রে এমন গাড়িও আছে, যেগুলো তৈরিই হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে। যদি এই কার গ্রেভইয়ার্ড বা সমাধিক্ষেত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকদের প্রিয় গাড়ি লুকাবার স্থানই হয়ে থাকে, তাহলে যুদ্ধের পরে তৈরি হওয়া গাড়ি সেখানে আসে কী করে?
অবশ্য এ কথা বলা যায় যে, মার্কিনিদের ফেলে যাওয়া গাড়ির পাশে পরবর্তীতে স্থানীয়রা নতুন করে গাড়ি রেখেছিল। যার কারণে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে নির্মিত গাড়ির দেখা মিলতে পারে।
স্থানীয়দের কথার সাথে একটা ব্যাপারে খটকা থেকেই যায়। স্থানীয় গাড়ির সমাধিক্ষেত্রই যদি হবে, তাহলে সেখানে এত আমেরিকান গাড়ি এল কোথা থেকে? এ প্রশ্নের উত্তর মেলে শ্যাটিয়ন বিষয়ে প্রচলিত অন্য এক লোককথায়।
সে কাহিনী অনুযায়ী, ন্যাটো প্রতিষ্ঠার পর বেশ কিছু কানাডিয়ান সৈন্যকে পরিবারসহ বেলজিয়াম আর ফ্রান্সে স্থানান্তরিত করা হয়। তারা সীমান্ত এলাকার কাছাকাছি কিছু শহরে বসবাস শুরু করে। সেই সৈনিকদের বেশিরভাগেরই ব্যক্তিগত গাড়ি ছিল আমেরিকায় তৈরি। ইউরোপের এই অখ্যাত অংশে এতগুলো আমেরিকান গাড়ি খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারটা এখানে পরিষ্কার হয়।
শ্যাটিয়নের সাথে এর যোগসূত্র কোথায়? শ্যাটিয়নের প্রায় মাঝামাঝি অংশে দেখা মেলে পরিত্যক্ত বিশাল এক হ্যাঙ্গারের। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, সেটা ছিল এ অঞ্চলের প্রসিদ্ধ গাড়ি মেরামতের গ্যারেজ। পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে চালু হওয়া এই গ্যারেজ আমেরিকান গাড়ি বিক্রি আর মেরামতের কাজে প্রসিদ্ধ ছিল। কানাডিয়ান সৈন্যদের সব গাড়ির মেরামতের কাজ ছাড়াও নতুন এবং পুরাতন আমেরিকান গাড়ি বিক্রির কাজও হতো সেখানে।
পঞ্চাশের দশকের শেষের দিক থেকে ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত একচেটিয়া ব্যবসা করেন সেই গ্যারেজের মালিক। তার মতো ইংরেজি জানা এবং আমেরিকান গাড়ি মেরামতে দক্ষ মেকানিক আশেপাশের অঞ্চলে ছিল না। যেসব গাড়ি মেরামতের অযোগ্য হয়ে পড়ত, সেগুলোকে তিনি নিজের ব্যক্তিগত একটা জায়গায় রেখে দিতেন, যাতে প্রয়োজনে যেখান থেকে যন্ত্রাংশ নিয়ে অন্য গাড়ি মেরামত করতে পারেন। আর এভাবেই গ্যারেজে জমতে থাকা গাড়ির মাধ্যমেই গড়ে উঠে বিশাল এই সমাধিক্ষেত্র।
১৯৬৭ সালের দিকে রমরমা সেই ব্যবসায় ছেদ পড়ে। কানাডিয়ান বেশিরভাগ সৈন্য এ এলাকা ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যেতে শুরু করে। সৈন্যরা তাকেও নতুন এলাকায় যাবার জন্যে অনুরোধ জানায়। কিন্তু ব্যক্তিগত কারণে তিনি শ্যাটিয়নেই রয়ে যান এবং আমেরিকান গাড়ির পরিবর্তে ইউরোপিয়ান গাড়ি মেরামত আর কেনাবেচার কাজ শুরু করেন।
সময়ের সাথে তার কাছে বিক্রির অপেক্ষায় থাকা এবং যন্ত্রাংশের জন্যে রেখে দেওয়া পঞ্চাশের দশকের আমেরিকান গাড়িগুলো পরিণত হয় ক্লাসিক গাড়িতে। বেলজিয়াম এবং আশেপাশের অন্য দেশগুলো থেকে গাড়িপ্রেমীরা আসতে শুরু করে তার এই গাড়ির অদ্ভুত সংগ্রহ দেখতে বা যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করতে।
তবে জঙ্গলের ভেতরের গাড়ির বিশাল সেই বহর সামলে রাখা মোটেই সহজ ছিল না। প্রকৃতির গ্রাস আর সময়ের আঘাত থেকে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেয় গাড়িচোরের উৎপাত। স্থানীয় মানুষ থেকে শুরু করে পুরনো গাড়ির সংগ্রাহকরাও আছে সেই চোরের তালিকায়। ছোটখাটো যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে গাড়ির লোগো, এমনকি পুরো ড্যাশবোর্ড পর্যন্ত লোপাট করে দিতে থাকে তারা।
যতদিন পর্যন্ত গ্যারেজের প্রতিষ্ঠাতা বেঁচে ছিলেন, ততদিন তিনি নিজের শখের গ্যারেজ বন্ধ হতে দেননি। সেইসাথে গাড়ির এই বিশাল সংগ্রহকেও আগলে রেখেছিলেন। আনুমানিক ২০০৭ সালের দিকে তার মৃত্যুর পর পরিস্থিতি বদলে যায়। বছরের পর বছর এই জঞ্জাল ধরে রাখতে আর আগ্রহী ছিলেন না তার ছেলে, যিনি সবকিছুর বর্তমান মালিক।
তাছাড়া এতগুলো পরিত্যক্ত বাহন এক জায়গায় পড়ে থাকার ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশেরও যে নিদারুণ ক্ষতি হচ্ছিল, সেটাও ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই সবদিক বিবেচনা করে অবশেষে ২০১০ সালে গ্যারেজের বর্তমান মালিক সিদ্ধান্ত নেন, গাড়ির এই স্তুপ ঝাঁটিয়ে বিদায় করবার। তবে সেই সাফাই অভিযানের আগে তিনি পরিচিত অন্য গ্যারেজের মালিক আর পুরনো গাড়ির সংগ্রাহকদের আমন্ত্রণ করেন, আস্ত গাড়ি অথবা কোনো যন্ত্রাংশ তাদের প্রয়োজন হলে সংগ্রহ করে নিয়ে যাবার জন্যে।
এরপর ষাট বছরের বেশি সময় ধরে একই জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলোকে বনের বাইরে নিয়ে আসা হয়। পুরাতন যানবাহন যেভাবে স্ক্র্যাপ করা হয়, সে প্রক্রিয়ায় গাড়িগুলোকে ভেঙে ফেলা হয়।
ঘন জঙ্গলের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা অদ্ভুত সেই গাড়ির বহর এখন বেঁচে আছে কেবল পুরাতন ছবিতে। শ্যাটিয়নের পাশের সে জঙ্গলে বেড়াতে গেলে এখন আর কোনো গাড়ি দেখা যায় না, তবে চোখে পড়ে গাড়ির খুচরো যন্ত্রাংশ। যার বেশিরভাগই চেনার আর উপায় নেই। প্রকৃতি নিজেকে এমনভাবে সেখানে সাজিয়ে নিয়েছে যে, আর কয়েক বছর পর হয়তো আর কোনো চিহ্নই খুঁজে পাওয়া যাবে না শ্যাটিয়নের সেই গাড়ির সমাধিক্ষেত্রের।