রাষ্ট্রের প্রাথমিক বিকাশের জায়গাগুলোর একটি মিশর, পৃথিবীর ইতিহাসে মিশর আলাদাভাবে জায়গা করে নিয়েছে তাদের নির্মাণশৈলীর জন্য। হাজার বছর ধরে তারা স্থাপত্যশিল্পে নিজেদের মুনশিয়ানা দেখিয়ে আসছে, মিশরের পিরামিড জায়গা করে নিয়েছে পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের তালিকায়। নির্মাণশিল্পে প্রবল মুনশিয়ানা দেখানো মিশরীয়দের ইতিহাসের শহর কায়রো, বর্তমানে প্রেক্ষিতে কায়রো আবার পৃথিবীর বিশৃঙ্খল শহরগুলোর একটি। মিশরীয়দের নির্মাণের ঐতিহ্য আর বর্তমান শহরে নাগরিক সুবিধার অপ্রতুলতা মিলিয়ে নির্মাণ হতে যাচ্ছে নতুন রাজধানী।
মিশরের নতুন রাজধানী
পৃথিবীতে রাজধানী পরিবর্তনের ইতিহাস নতুন না। দিল্লীর সম্রাট শাহজাহান থেকে শুরু করে অনেক শাসকই নিজেদের শাসনের সুবিধার জন্য রাজধানী পরিবর্তন করেছেন, অনেকের রাজধানী পরিবর্তনের ধারণা বুমেরাং হয়েছে। সম্প্রতি রাজধানী পরিবর্তনের উদাহরণ আছে ব্রাজিলে, ১৯৬০ সালে বিপুল জনসংখ্যার চাপে ন্যুব্জ রিও ডি জেরিনো থেকে রাজধানী স্থানান্তর করা হয় ব্রাজিলিয়ায়। ১৯৯১ সালে নাইজেরিয়া নির্মাণ করে তাদের নতুন রাজধানী আবুজা, মালয়েশিয়াও কাছাকাছি সময়েই নতুন রাজধানী হিসেবে নির্ধারণ করে পাতুজায়াকে। ইন্দোনেশিয়াও রাজধানী পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান প্রেসিডেন্টের অধীনে।
মিশরের বর্তমান রাজধানী কায়রো নির্মিত হয় দশম শতাব্দীতে। এরপর ইতিহাসের বহু উত্থান আর পতনের সাক্ষী হয়েছে এই নগরী। বর্তমানে কায়রোতে ২ কোটি মানুষ বসবাস করে, মিশরের মোট জনসংখ্যার যা প্রায় ২০ শতাংশ। জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ কায়রোতে নাগরিক সুবিধার অপ্রতুলতা রয়েছে, রয়েছে সুস্থ নাগরিক জীবন নির্বাহের পর্যাপ্ত সুবিধার অভাব। ফলে, নতুন রাজধানী নির্মাণের মুখ্য উদ্দেশ্য হয়েছে কায়রোর উপর জনসংখ্যার চাপ কমানো, নতুন শহরে গুরুত্বপূর্ণ আমলাতান্ত্রিক বিষয়গুলো স্থানান্তরের মাধ্যমে জনসংখ্যার বিকেন্দ্রীকরণ করা। নতুন শহরে প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষ বসবাস করতে পারবে।
মিশরের নতুন রাজধানী বর্তমান রাজধানী কায়রো থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে, মরুভূমির বুকে গড়ে উঠছে সচিবালয়, প্রেসিডেন্সিয়াল প্রাসাদ, শপিং মল, মসজিদ, হাসপাতাল, বাসস্থান আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নতুন রাজধানী নির্মাণের ধারণা ছিল সাবেক স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের, যদিও নির্মাণ শুরু হয় আরেক স্বৈরশাসক আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি ক্ষমতায় আসার পর। ইতোমধ্যেই নির্মাণের তিনটি ধাপের মধ্যে প্রথম ধাপ প্রায় সমাপ্ত হয়েছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারির শুরুতেই শুরু হওয়ার কথা রাজধানী স্থানান্তরের প্রক্রিয়া। মন্ত্রণালয়গুলো হয়তো ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে নতুন রাজধানীতে নিজেদের কার্যক্রম শুরু করতে পারবে।
কেন নতুন রাজধানী নির্মাণ করছে মিশর?
নতুন রাজধানী নির্মাণে খরচ হবে প্রায় ৫৭ বিলিয়ন ডলার, যেটি আসার কথা ছিল দেশি আর বিদেশি অর্থের বিভিন্ন উৎস থেকে। কিন্তু, কোভিড-১৯ মহামারি অর্থের যোগানের মাত্রা বদলে দিয়েছে, মহামারির পরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধও বদলে দিয়েছে মিশরের অর্থনীতির চিত্র। গত ছয় বছরে মিশরে তিনবার আইএমএফ থেকে লোন নিতে হয়েছে, মোট লোনের পরিমাণ ছিল ২০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে, মিশর রাজনৈতিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্নেহদৃষ্টিতে থাকায়, যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যও এসেছে নিয়মিত। কিন্তু, মিশরের অর্থনীতির সংকট রয়েই গেছে, রয়েছে তারল্য সংকট। মিশরীয় ব্যবসায়ীরা ভুগছেন ডলার সংকটে। এর মধ্যেও মিশর নতুন রাজধানী নির্মাণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রথমত, নতুন রাজধানী নির্মাণের ফলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে মিশরের সামরিক বাহিনী। নতুন রাজধানী নির্মাণের দায়িত্বে আছে দ্য অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ক্যাপিটাল ফর আরবান ডেভেলপমেন্ট নামের একটি কোম্পানি, যার ৫১ শতাংশ মালিকানা মিশরের সামরিক বাহিনীর। বাকি ৪৯ শতাংশের মালিকানা গৃহায়ন মন্ত্রণালয়ের। ফলে, পুরো প্রকল্প বাস্তবায়নের অর্থের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে কাজ করছে মিশরের সামরিক বাহিনী, সাথে যুক্ত রয়েছে আমলাতন্ত্রও।
মিশরের সামরিক বাহিনী একদিকে নতুন রাজধানী নির্মাণে অর্থ ব্যয় করছে, অন্যদিকে নতুন রাজধানী নির্মাণের ফলে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক সুবিধাগুলোও সামরিক বাহিনীই পাবে। নতুন শহরে নির্মিত বাড়িগুলো বিক্রি করবে দ্য অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ক্যাপিটাল ফর আরবান ডেভেলপমেন্ট নামের কোম্পানি, আবার পুরনো কায়রোর খালি হওয়া জায়গাগুলোও বিক্রি করবে তারা। আবার, নির্মাণ প্রকল্পের একটি বড় অংশে কাজ করছে মিশরের সামরিক বাহিনী। সামরিক বাহিনীতে বাধ্যতামূলক নিয়োগে ভর্তি হওয়া সদস্যদের অত্যন্ত কম বেতন দেওয়া হয়, যেটি সামরিক বাহিনীকে একটি তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থানে এনেছে অন্য প্রতিযোগীদের থেকে।
নতুন রাজধানী নির্মাণে মিশরের অভ্যন্তরীণ শিল্প হয়তো বিকশিত হবে, বিকশিত হবে দেশের অর্থনীতির উপর সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণও। ফলে, সামরিক বাহিনী নতুন রাজধানী নির্মাণে যে বিনিয়োগ করছে, সেটি থেকে প্রধান লাভবান হবে তারাই।
দ্বিতীয়ত, মিশরের নতুন রাজধানী নির্মাণের প্রথম ধাপ কেবল শেষ হয়েছে, রাজধানীর মোট প্রত্যাশিত জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশই এখন পর্যন্ত সেখানে স্থানান্তর হয়েছে। কিন্তু, এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে, নতুন রাজধানী কতটা সবার শহর হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে?
নতুন রাজধানীতে দুই বেডরুমের একটি ফ্ল্যাটের দাম পড়ছে পঞ্চাশ হাজার মার্কিন ডলার করে, বড় পরিসরের ফ্ল্যাটগুলোর দাম ছাড়িয়ে যাচ্ছে দুই লাখ মার্কিন ডলার। মিশরের মানুষের গড় মাথাপিছু আয় মাত্র তিন হাজার ডলার। ফলে, পঞ্চাশ হাজার ডলার মূল্যের ফ্ল্যাট কিনে অধিকাংশ নাগরিকই সেখানে বসবাসের চিন্তা করতে পারবে না। অর্থাৎ, নতুন রাজধানী গড়ে উঠছে সুবিধাভোগী একটি শ্রেণির মানুষের কথা চিন্তা করেই।
নতুন রাজধানীতে গড়ে উঠছে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়, রয়েছে আট লেনের মহাসড়ক, শপিং মল, আধুনিক হাসপাতাল, রয়েছে আফ্রিকার বৃহত্তম মসজিদ আর ক্যাথেড্রাল। হোসনি মোবারকের সময়ে উত্থান ঘটা ধনী শ্রেণি আর পুঁজিপতিরা বর্তমান কায়রোতে নিজেদের পছন্দের জীবন পাচ্ছেন না, শহরের জনসংখ্যা আর ট্রাফিক জ্যাম তাদেরকে করে তুলেছে অতিষ্ট।
নতুন শহর ধনী শ্রেণিকে একটি বিচ্ছিন্ন আর স্বচ্ছন্দ্য জীবন দেবে, যেখানে কায়রোর উত্তাপ আর অসুবিধাগুলো তাদেরকে স্পর্শ করবে না। নতুন রাজধানীতে তারা ভিন্ন একটি সভ্যতা গড়ে তুলবে, গড়ে তুলবে ভিন্ন জীবনাচার। ধনীদের সন্তানদের অভিবাসন আটকাতেও এমন একটি শহর প্রয়োজন, যেখানে তারা নিজেদের মতো বাধাহীন জীবন কাটাতে সক্ষম হবেন, কায়রোর জ্যামের কারণে জীবন অতিষ্ট হয়ে উঠবে না।
তৃতীয়ত, কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা সাধারণত টিকে থাকে অর্থনৈতিক সাফল্যকে পুঁজি করে, অর্থনৈতিক অর্জনের বাস্তবিক প্রকাশই কর্তৃত্ববাদী শাসকদের বৈধতা অর্জনের পথ খুলে দেয়। কর্তৃত্ববাদী অন্যান্য দেশের মতো মিশরে ব্যক্তির রাজনৈতিক অবতারবাদ চলে, শক্তিশালী শাসকেরা খোঁজেন নিজের লিগ্যাসি প্রতিষ্ঠা করার উপায়। আবার, কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোতে পুঁজিবাদী শ্রেণি আর শাসক যৌথভাবে কাজ করে, নিজেদের স্বার্থকে সামনে রেখে।
মিশরে নতুন রাজধানী নির্মাণের ফলে অভ্যন্তরীণ শিল্প বিকাশের সুযোগ পাবে, মিশরে আসবে নতুন নতুন বিদেশী বিনিয়োগ। নতুন শহরে পানি আর বিদ্যুৎ সরবারহ পরিকল্পিত হওয়ায়, ব্যবসায়ের মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে পুঁজিপতিদের ভাবতে হবে না। নতুন অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি হলে উপকৃত হবে দেশের অর্থনীতি, বড় হবে চাকরির বাজার। এতে ব্যবসায়ী শ্রেণিরই লাভ। যদিও, এখন পর্যন্ত নতুন রাজধানী চাকরির বাজারে দৃশ্যমান তেমন কোনো প্রভাব তৈরি করতে পারেনি।
আবার, কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোতে শাসকের স্থায়িত্ব এই পুঁজিপতিদের উপর নির্ভর করার কারণে, ব্যবসায়ের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করে দেওয়ার দায় আছে শাসকদের উপর। নতুন রাজধানী নির্মাণের ফলে একদিকে যেমন অর্থনীতির উপর সিসির নিয়ন্ত্রণ শক্ত হবে, অন্যদিকে শক্ত নিয়ন্ত্রণ আসবে ব্যবসায়ী শ্রেণির উপরও। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখতে তখন তারাই সিসিকে টিকিয়ে রাখবেন।
অন্যদিকে, নতুন রাজধানী হবে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মোহাম্মদ মুরসিকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসা আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির রাজনৈতিক লিগ্যাসি, যেটি তাকে বৈধতার পাশাপাশি স্থিতিশীলতাও এনে দেবে। মিশরের রাজনীতির কেন্দ্র তাহরির স্কয়ার, তাহরির স্কয়ারকে নিয়ন্ত্রণ করা মানে মিশরকে নিয়ন্ত্রণ করা। ২০১১ সালে আরব বসন্তের ঢেউ লাগে মিশরে, আন্দোলনকারীরা দখল করে নেয় তাহরির স্কয়ার। তাহরির স্কয়ার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পুরো মিশরের নিয়ন্ত্রণ চলে আসে আন্দোলনকারীদের কাছে, পতন ঘটে হোসনি মোবারকের সরকারের।
নতুন রাজধানী তাহরির স্কয়ার থেকে অনেক দূরে, রাজধানী স্থানান্তর তাহরির স্কয়ারের রাজনৈতিক গুরুত্ব কমিয়ে দেবে। ফলে, আবদেল আত্তাহ আল সিসিকে আর তাহরির স্কয়ার থেকে সম্ভাব্য কোনো আন্দোলন মোকাবেলার প্রস্তুতি নিতে হবে না, নতুন রাজধানীতে নিশ্চিতভাবেই কোনো তাহরির স্কয়ার তৈরি করবেন না স্বৈরশাসকেরা।
চতুর্থত, মিশরের সরকারের আকার প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বড়, অর্থনীতিতে সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ থাকায় সেভাবে বিকশিত হয়নি বেসরকারি খাতও। নতুন রাজধানী বেসরকারি খাত বিকাশের একটি সম্ভাবনা রয়েছে, রয়েছে পুঁজির বিকাশের সম্ভাবনা। যেমন- প্রাইভেট কোম্পানির উদ্যোগে নতুন রাজধানীতে তৈরি হচ্ছে নুর সিটি। এটি নির্মাণে খরচ হবে ৬-৭ বিলিয়ন ডলার। নতুন রাজধানীর বিজ্ঞাপন হিসেবে উঠে আসছে নুর সিটির কথা।
বেসরকারি খাত বিকশিত হলে মিশরের অর্থনীতির আকার বাড়বে, বাড়বে মানুষের মানুষের মাথাপিছু আয়। অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য বৃদ্ধির সুবিধা পৌঁছে যাবে দেশের প্রান্ত পর্যন্ত।
নতুন রাজধানী নির্মাণের সমালোচনা
মিশরের বর্তমান রাজধানী কায়রো অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে ভারাক্রান্ত, কায়রোতে নাগরিক সুবিধাগুলো পাওয়া দিনে দিনে আরো দুষ্কর হয়ে উঠছে। নতুন রাজধানীতে স্থানান্তরের ফলে কায়রোর সমস্যাগুলোর সমাধান হবে না, কায়রোকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তাগুলোও ফুরিয়ে যাবে না। বর্তমান কায়রোর সমস্যা সমাধানে বিনিয়োগ না করে নতুন রাজধানী নির্মাণে অর্থ ব্যয় নিয়ে তাই প্রশ্ন উঠছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন রাজধানী নির্মাণের ফলে সামরিক বাহিনী আরো শক্তিশালী হবে, ধনীরা আরো ধনী হবে, গরীবেরা আরো গরীব হবে। নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত কায়রোবাসীর নাগরিক সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে।