বিশ্বায়নের এই যুগে নতুন আঙ্গিকে সূচনা ঘটেছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের, বাড়ছে এক রাষ্ট্রের উপর অন্য রাষ্ট্রের নির্ভরশীলতা। সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানুষের মধ্যে রয়ে গেছে অধিপত্য বিস্তারের নেশা, যার সর্বশেষ পরিস্থিতি রূপ নেয় যুদ্ধে। কখনও ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে, কখনো বা জাতিতে-জাতিতে, আবার কখনও রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে বাধে যুদ্ধ।
নতুন শতাব্দীতে এসে নতুন বিশ্বব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটেছে যুদ্ধপদ্ধতি, যুদ্ধাস্ত্রের, যুক্ত হয়েছে নতুন ধারণা ও কৌশলের। বর্তমানে যুদ্ধকৌশলে যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা। বর্তমানে যুদ্ধ হচ্ছে শত্রুর বিরুদ্ধে সামরিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং প্রোপ্যাগান্ডার সমন্বয়। বিংশ শতাব্দীতে চূড়ান্ত এবং দীর্ঘস্থায়ী বিজয় অর্জনের জন্য শুধুমাত্র বলপ্রয়োগই যথেষ্ট বলে বিবেচিত হয় না। যুদ্ধ একযোগে চারটি ফ্রন্টে চালিয়ে যেতে হয়- সামরিক ফ্রন্ট, অর্থনৈতিক ফ্রন্ট, রাজনৈতিক ফ্রন্ট এবং প্রোপ্যাগান্ডা ফ্রন্ট। এই লেখায় প্রোপ্যাগান্ডা কৌশল নিয়ে আলোচনা হবে।
প্রোপ্যাগান্ডার ধারণা
প্রোপ্যাগান্ডা মূলত কোনো তথ্য, ধারণা, মতামত বা চিত্র, একপাক্ষিক যুক্তি, যা সম্প্রচারিত হয়, প্রকাশিত হয় বা অন্য কোনোভাবে জনগণের মতামত প্রভাবিত করার অভিপ্রায়ে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমান পৃথিবীতে গণতন্ত্রের জয়জয়কার, যেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় জনগণের সার্বভৌমত্ব। গণতন্ত্রে সরকার মূলত জনগণেরই প্রতিনিধি, সরকারের যেকোনো সিদ্ধান্তে থাকতে হয় জনমতের প্রতিচ্ছবি। কোনো সরকারকে যুদ্ধে জড়াতে বা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে অবশ্যই সেই দেশের জনগণের সমর্থন দরকার। কারণ, বর্তমান রাষ্ট্রের আয়তন ও জনসংখ্যা বিশাল। বিশাল জনসংখ্যার ক্ষুদ্র একটি অংশ রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী বা প্রতিরক্ষা বাহিনীতে যোগ দেয়। আধুনিক এই যুগে উদ্ভব ঘটেছে নতুন নতুন অস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জামের, যেগুলোর কাছে শুধু আর্মি বা প্রতিরক্ষা বাহিনী অপেক্ষাকৃত দুর্বল।
প্রোপ্যাগান্ডাকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রকাশ্য ও গোপনে প্রচারিত প্রোপ্যাগান্ডা। প্রকাশ্যে প্রচারিত প্রোপ্যাগান্ডাগুলোতে যে এসব ছড়ায় সে সাধারণত জনসাধারণের কাছে প্রকাশ্যে থাকে। অন্যদিকে, গোপন প্রোপ্যাগান্ডাতে তথ্যের উৎস বা এসব ছড়ানো ব্যক্তি, সংগঠন বা রাষ্ট্র থাকে ছদ্মবেশে। গোপন প্রোপ্যাগান্ডার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে কোনো রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন যা মূলত ছদ্মনামে প্রচারিত হয়। এখানে প্রোপ্যাগান্ডার উৎপত্তির ক্ষেত্র থাকে অপ্রকাশ্য, বর্তমানে এই ধরনের প্রোপ্যাগান্ডা বেশি ছড়ানো হয়।
প্রোপ্যাগান্ডা কেন ছড়ানো হয়
আমেরিকান ও ফরাসি রেভ্যলুশনের পূর্বে যখন জাতীয়তাবাদী আদর্শ নিয়ে গঠিত জাতীয় সেনাবাহিনী ছিল না, তখন মার্সেনারি আর্মি দিয়ে যুদ্ধ পরিচালিত হতো। মার্সেনারি আর্মি যুদ্ধ করত মূলত অর্থের বিনিময়ে। তাদের মধ্যে ছিল না কোনো আধুনিক জাতীয়তাবাদী চেতনা। কিন্তু পরবর্তীতে যখন আমেরিকা ও ফ্রান্স জাতীয় সেনাবাহিনী গঠন করল, তখন সেনাবাহিনী কর্তৃক যুদ্ধে তাদের অংশগ্রহণ ছিল মূলত দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ। তারা তখন কোনো অর্থ বা সুযোগ-সুবিধার জন্য যুদ্ধ করেনি, বরং তারা নিজ মাতৃভূমির জন্য প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যায় তারা। কিন্তু বর্তমানে শুধু উর্দি পরা সুসজ্জিত সেনাবাহিনী দিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা সম্ভব না। এর পেছনে থাকতে হয় বিশাল জনবাহিনী, যাতে সেই জনগণ যুদ্ধে সেনাবাহিনীর পক্ষ নেয় এবং ক্রান্তিলগ্নে কাঁধে কাঁধ রেখে যুদ্ধে অংশ নেয়। জনগণকে সরকারের বোঝাতে হয় কেন রাষ্ট্র যুদ্ধে জড়াবে, কেন রাষ্ট্রের জন্য যুদ্ধে জড়ানো লাভজনক অথবা যুদ্ধ ছাড়া রাষ্ট্রের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে ইত্যাদি। এজন্য সরকার বিভিন্ন সময় জনগণের উদ্দেশ্যে প্রোপ্যাগান্ডা ছড়িয়ে তাদের সমর্থন আদায় করে।
যুদ্ধে প্রোপ্যাগান্ডা ছড়ানোর অন্যতম আরেকটি উদ্দেশ্য শত্রুকে হতাশ করা। শত্রুপক্ষের কাছে বা শত্রুদেশের মধ্যে প্রোপ্যাগান্ডা ছড়িয়ে দিতে হবে যাতে শত্রুদেশের সেনাবাহিনী ভয় পায়, মনোবল হারিয়ে ফেলে। এমন প্রোপ্যাগাণ্ডার ফলে শত্রুদেশের জনমতও যুদ্ধের বিপক্ষে চলে যেতে পারে। সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া নতুন নতুন অস্ত্র ও ড্রোন ক্রয়, পাশাপাশি পারমাণবিক হামলার হুমকি ইত্যাদি ছড়ানোর মাধ্যমে মূলত ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে দেয়া ও ইউক্রেনের জনমত যুদ্ধের বিপক্ষে নেয়ার চেষ্টা করেছে।
প্রোপ্যাগান্ডা শত্রুরাষ্ট্রের মনে অপরাধবোধের জন্ম দেয় যা সেই দেশের জনমত প্রভাবিত করে। বিভিন্ন পদ্ধতিতে শত্রুপক্ষকে অপরাধী প্রমাণ করা এর লক্ষ্য। এভাবে যুদ্ধে নিজের পক্ষে সমর্থন আদায় করা সহজ হয় বা শত্রুকে যুদ্ধে পিছিয়ে দিতে সাহায্য করে। ইরাক যুদ্ধে সাদ্দাম হোসেনকে নিয়ে বিভিন্ন রকমের ঠাট্টা, মশকরা, অভিযোগ আনা হয়, যার দ্বারা বিশ্বের কাছে সাদ্দাম হোসেনকে অপরাধী প্রমাণের চেষ্টা চালায় আমেরিকা। ইরাক আক্রমণের পরদিন আমেরিকান পত্রিকায় তাকে পাগলা ষাঁড় আখ্যা দেয়াসহ বিভিন্নভাবে সমালোচনা করা হয়, খোদ জর্জ বুশ তাকে হিটলারের সাথে তুলনা দেন। তিনি এমনভাবে প্রচার করেন যেন যুদ্ধের সম্পূর্ণ দোষ সাদ্দাম হোসেনের ঘাড়ে এসে বর্তায়, এবং একই ধরনের অপরাধের বিপক্ষে আমেরিকার জনগণকে সোচ্চার হতে অনুপ্রাণিত করে।
তাছাড়া যুদ্ধে শত্রুপক্ষের নৃশংসতার কাহিনি প্রচারও প্রোপাগাণ্ডার অংশ। এ ধরনের প্রোপ্যাগান্ডা শক্রপক্ষকে অমানবিক প্রমাণ করে। তাদের নৃশংস কার্যক্রম ও মনোভাব বিশ্ববাসীর কাছে অকল্পনীয় হিংস্রতার বহিঃপ্রকাশ রূপে ফুটিয়ে তোলা হয়। ইরাক যুদ্ধের সময় ইরাকি সৈন্যরা কুয়েতের এক হাসপাতালে ইনকিউবেটর থেকে শিশুদের টেনে বের করে আনার মিথ্যা খবর প্রচার করা হয়, যা জনগণের মনে বিশাল ক্ষোভের জন্ম দেয়। জর্জ বুশ তখন একে সাদ্দাম হোসেনের নির্মমতা ও ঘৃণ্য প্রকৃতি হিসেবে তুলে ধরেন, যা ছিল সম্পূর্ণ প্রোপ্যাগান্ডা।
বিভিন্নভাবে প্রোপ্যাগান্ডা ছড়ানো হয়ে থাকে। যেমন- মিথ্যা ও অসত্য তথ্য প্রচার করা, বিভিন্ন ব্যঙ্গচিত্র অংকন, প্রতীক ব্যবহার করা, সংবাদপত্রে আবেগী বক্তব্য বা আবেদন ইত্যাদি। এছাড়া, শত্রুপক্ষকে বিভিন্ন নামে ডেকে প্রোপ্যাগান্ডা ছড়িয়ে দেয়া হয়।
সুতরাং, বর্তমানে শুধু সামরিক, অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক দিক থেকে যুদ্ধ চালিয়ে গেলে সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে নিজ পক্ষে প্রোপ্যাগান্ডা ছড়ানো ও শত্রুপক্ষের প্রোপ্যাগান্ডার বিরুদ্ধে সচেতন হওয়ার জরুরি। তাহলেই বর্তমানের যুদ্ধে টিকে থাকা ও সফল হওয়ার আশা করা যায়।