পাকিস্তানের রাজনীতিতে সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান পাকিস্তান সেনাবাহিনী। স্বাধীনতার পর থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সরাসরি ক্ষমতায় ছিল পাঁচ দশক, অবশিষ্ট সময়ও ছিল ক্ষমতার কাঠামোতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে। তাদের এই ক্ষমতার দৌরাত্ম্যেই এখন পর্যন্ত কোনো গণতান্ত্রিক সরকার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি, পারেনি গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে। বরং, সাংগঠনিক সক্ষমতা আর অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক্স-ফ্যাক্টর হিসেবে থেকে গেছে দেশটির সেনাবাহিনীই।
বিদায়ী সেনাপ্রধান জেনারেল বাজওয়ার সম্পদ অর্জন
পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে জেনারেল রাহিল শরীফের অবসরের পর সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্বে আসেন জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া। সেনাপ্রধান হিসেবে জেনারেল বাজওয়া দায়িত্বে ছিলেন দুই মেয়াদে ছয় বছর। দায়িত্ব থেকে অবসরে যাওয়ার আগে জেনারেল বাজওয়া ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে অভিযোগ অঠে অবৈধ সম্পদ অর্জনের। পত্রিকা মারফত জানা যায়, তাদের সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকশো কোটি টাকার। পাকিস্তানের করাচি, লাহোর আর ইসলামাবাদের মতো শহুরে অঞ্চলগুলোতে জমির পরিমাণ বেড়েছে জেনারেল বাজওয়া ও তার পরিবারে। এসব সম্পদের আনুমানিক মূল্য প্রায় ৫৬ মিলিয়ন ডলার।
অন্য যেকোনো দেশে হলে সেনাপ্রধানের এই সম্পদ বৃদ্ধির ঘটনা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হতো, ঘটনাটি প্রকাশিত হতো রীতিমতো স্ক্যান্ডাল হিসেবে, সেনাপ্রধানকে আসতে হতো জবাবদিহিতার আওতায়। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এর কোনোটাই ঘটেনি, বরং সসম্মানে অবসরে গেছেন জেনারেল বাজওয়া।
অর্থনীতিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী
জেনারেল বাজওয়া ও তার পরিবারের বিপুল সম্পদ অর্জনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে কয়েক দশক আগে, ১৯৫৪ সালে জেনারেল আইয়ুব খান আর মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা মিলে ফৌজি ফাউন্ডেশন তৈরির মধ্য দিয়ে। বর্তমানে এই ফাউন্ডেশনের বাইরে আছে বিমান বাহিনীর শাহিন ফাউন্ডেশন, নৌ বাহিনীর বাহারিয়া ফাউন্ডেশন, আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট, ডিফেন্স হাউজিং অথোরিটি (ডিএইচএ)। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সার, সিমেন্ট, কসমেটিকসের মতো বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যও তৈরি করে। তাদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে জ্বালানি খাত। রয়েছে স্টিল তৈরির কারখানা; ফার্নিচার, ফার্মাসিউটিক্যালস, খাদ্যদ্রব্যসহ আরো অনেক খাতে রয়েছে সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ। শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক খাতগুলো সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে না। এসব খাত থেকে সেনাবাহিনী বছরে প্রায় ২৬ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে, যা পাকিস্তানের মোট জিডিপির ১০ শতাংশ। মোট জিডিপির সাথে এই শতাংশের হিসেবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক সত্তা হচ্ছে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী।
অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততার বাইরেও বিভিন্ন গণসেবার সাথে সংযুক্ত সরকারি অফিসগুলো রয়েছে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। যেমন- ওয়াটার এন্ড পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (ওয়াপদা), ন্যাশনাল লজিস্টিকস সেল, স্পেশাল কমিনিউনিকেশন অর্গানাইজেশন ইত্যাদি। সামরিক বাহিনীর আছে নিজস্ব ব্যাংক, আছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও। কেবল আসকার ব্যাংক আর ফৌজি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমেই সেনাবাহিনী প্রতিবছর ১০ বিলিয়নের বেশি অর্থ উপার্জন করে। সামরিক বাহিনীর অধীনে পাঁচটি ব্যাংক রয়েছে পাকিস্তানে।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর জেনারেলরা বিভিন্ন সময়ে দুর্নীতিতে জড়ান, জড়ান বিভিন্ন ধরনের স্ক্যান্ডালে। ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধানে হামিদুর রহমান কমিশন সন্ধান পায় জেনারেল রানি ছদ্মনামের এক যৌনকর্মীর, যিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে অর্থের বিনিময়ে সেসময়ে বদলির ব্যবস্থা করে দিতেন। প্রতিরক্ষা খাতে পাকিস্তান যা ব্যয় করে, তার প্রায় কিছুই গণ-জবাবদিহিতার আওতায় আসে না।
সার্ভিসে থাকা অবস্থায় অর্থোপার্জনের সুযোগের পাশাপাশি সার্ভিস থেকে অবসরের পরেও জেনারেলরা বিভিন্ন ধরনের সুবিধা পান। অবসরে যাওয়া কোর কমান্ডারদের অর্ধেকই কাজ করেন সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন কর্পোরেট হাউজ কিংবা ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনে, বাকিদের মধ্যে একটা বড় অংশ পান রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ, সুযোগ থাকে বিভিন্ন সরকারি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কাজ করারও।
পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর এই ব্যবসায়িক চরিত্রই শীর্ষ পর্যায়ের অফিসারদের সম্পদ অর্জনকে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, জেনারেল বাজওয়াকেও দিয়েছে একটি অলিখিত দায়মুক্তি। পাকিস্তানের অনেক জেনারেলই ক্ষমতার মূলধারা থেকে ছিটকে পড়েছেন, অনেক অফিসার সার্ভিস সমাপ্ত না করেই অবসরে গেছেন। পৃথিবীর বৃহত্তম সামরিক বাহিনীগুলোর একটি হওয়ায় রয়েছে বিপুল সংখ্যক জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার আর নন কমিশন্ড অফিসারও। সকলের জন্যই পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর দিক থেকে বিভিন্ন রকমের সুযোগ সুবিধা থাকে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভূমিপ্রেম
পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের যোদ্ধা হিসেবে সুনাম আছে, মধ্যযুগের বিভিন্ন যুদ্ধে এসেছে এই অঞ্চলের বিভিন্ন বিখ্যাত যোদ্ধার নাম। আধুনিক যুগের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যাত্রা শুরু হয় ব্রিটিশদের উপনিবেশ শাসনের সময়ে, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর তারা যখন একটি অনুগত বাহিনী তৈরির দিকে নজর দেয়। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পুরুষদের সুযোগ দেওয়া হয় ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীতে যোগদানের জন্য।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে, সৈন্য সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন নীতিমালা তৈরি করে ব্রিটিশ সরকার। যেসব গ্রাম থেকে একজনও পুরুষ সামরিক বাহিনীতে যোগ দিচ্ছিল না, সেসব গ্রামের সবার জমির মালিকানা বাতিল করে দিচ্ছিল ব্রিটিশ সরকার, নারীদের আলাদা করে দিচ্ছিল পুরুষদের থেকে। কেবল, ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীতে যোগ দিলেই ফেরত পাওয়া যাচ্ছিল এসব। আবার, যারা সামরিক বাহিনীতে যোগ দিচ্ছিল, তাদের জন্য ছিলো বেতন, পেনশন আর জমির মালিকানা অর্জনের সুযোগ। ঔপনিবেশিক আমলে পাকিস্তানের মোট জমির ১০ শতাংশ সংরক্ষিত ছিল সামরিক বাহিনীর সদস্যদের জন্য, অবসরে যাওয়ার সময় সকল সদস্যই পেতেন আবাদযোগ্য জমির মালিকানা।
সামরিক বাহিনীর সদস্যদের জমির মালিকানা দেওয়ার বিধান রয়ে যায় পাকিস্তান আমলেও। জেনারেল আইয়ুব খান তার শাসনামলে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের আনুগত্য জয়ে জমি দেওয়ার বিধান ধরে রাখেন। তখনকার সময়ে মেজর জেনারেল পদের অফিসাররা পেতেন ২৪০ একর জমি, ব্রিগেডিয়ার আর কর্নেলরা পেতেন ১৫০ একর জমি। লেফটেন্যান্ট কর্নেলরা পেতেন ১২৪ একর জমি, মেজর থেকে লেফটেন্যান্ট পর্যন্ত অফিসাররা পেতেন ১০০ একর জমি। জুনিয়র কমিশন্ড অফিসারদের প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দ ছিল ৬৪ একর জমি। জমি বরাদ্দ দেওয়া হতো নন-কমিশন্ড অফিসারদেরও, একই ব্যবস্থা চালু ছিল পূর্ব পাকিস্তানেও।
১৯৭১ সালের যুদ্ধ পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে এখনও এক আলোচিত বিষয়। বিদায়ী সেনাপ্রধান জেনারেল বাজওয়াও এই ব্যাপারে মন্তব্য করে বিতর্কের মুখে পড়েছেন। সেই যুদ্ধের পর অনেক কিছু বদলালেও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভূমিপ্রীতি বদলায়নি। বরং, সময়ের সাথে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে ডিফেন্স হাউজিং অথোরিটি (ডিএইচএ), বেড়েছে ডিফেন্স হাউজিং অথোরিটির কর্তৃত্বের পরিসর। শুরুতে ডিএইচএ কেবল সামরিক বাহিনীর সদস্যদের জন্য হাউজিং প্রজেক্টে কাজ করলেও পরবর্তীতে এটি বেসামরিক লোকদের জন্যও হাউজিং প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। বর্তমানে ডিএইচএ রিয়েল এস্টেট মার্কেটে সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী।
বর্তমানে ডিফেন্স হাউজিং অথোরিটির (ডিএইচএ) অধীনে রয়েছে ৫০টিরও অধিক হাউজিং প্রজেক্ট, যাদের পরিসর রয়েছে হাজার হাজার একর জমি জুড়ে। ডিএইচএ ইসলামাবাদের অধীনে আছে ১৬ হাজার একর জমি, ডিএইচএ করাচির অধীনে আছে ১২ হাজার একর জমি। পাকিস্তানের অন্যান্য রাজ্যেও আছে ডিএইচএ-র কার্যক্রম। সরকারের কাছ থেকে কম দামে হাউজিং এস্টেটের জমিগুলো কিনে নেয় পাকিস্তান ডিএইচএ, পরবর্তীতে উচ্চ দামে বিক্রি করে বেসামরিক নাগরিকদের কাছে।
১৯৬৫ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রায় বিশ লাখ একর জমি তার সদস্যদের বরাদ্দ দিয়েছে, ডিএইচএ-র তৈরি করা বাণিজ্যিক ভবন আর প্লটগুলোও থাকে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের নাগালের মধ্যে। বর্তমানে একজন মেজর পদমর্যাদার অফিসার শহর অঞ্চলে একটি প্লট নিতে পারেন, কর্নেল হিসেবে প্রমোশন পাওয়ার পর নিতে পারেন আরেকটি প্লট। ব্রিগেডিয়ার পদে প্রমোশন পাওয়ার পর আরো দুটি আবাসিক ও বাণিজ্যিক প্লট নিতে পারেন অফিসাররা, লেফটেন্যান্ট জেনারেলরা পান কোটি রুপি মূল্যের প্লট। লেফটেন্যান্ট জেনারেলদের মধ্যে যারা কোর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, তারা পান আরো অর্ধকোটি রুপির বেশি সম্পদ।
দেশপ্রেম বনাম ভূমিপ্রেম
পাকিস্তানের ভূমি অসীম না, রয়েছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ। ফলে, ডিফেন্স হাউজিং অথোরিটির ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যগুলোকে সফল করতে বিভিন্ন সময়ে সরকারকে নামমাত্র মূল্যে খাস জমি হস্তান্তর করতে হয়েছে, কখনো আবার ডিএইচএ স্থানীয় বাসিন্দাদের সরিয়ে গড়ে তুলেছে নিজেদের এস্টেট। এসব প্রক্রিয়া অনেক সময়ই মসৃণ হয়েছে, অনেক সময়ই বিভিন্ন স্বার্থের সংঘাত ঘটেছে। এই স্বার্থের সংঘাত যেমন ঘটেছে স্থানীয়দের সাথে, একইভাবে বিভিন্ন সময়ে স্বার্থের সংঘাত উপস্থিত হয়েছে সরকার বনাম সামরিক বাহিনীর মধ্যেও।
১৯৯৩ সালে পাঞ্জাব সরকারের কাছ থেকে ৩৩,৮৬৬ একর জমি নিয়েছিল ডিফেন্স হাউজিং অথোরিটি, যার মধ্যে ছিল এক ক্ষুদ্র কৃষকের তিনটি খালও। ২০০৬ সালে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট ডিএইচএকে নির্দেশ দেন সেই জায়গাগুলো ফেরত দিতে। আবার, ইসলামাবাদে ডিএইচএ-র প্রজেক্টের অংশ হয়ে যায় দুই বিধবার জমি। সেই দুই বিধবার জমি ফেরত পেতে লড়াই করতে হয়েছে হাইকোর্ট পর্যন্ত। লাহোরেও ডিএইচএ-র কর্মকাণ্ড সমালোচিত হয়েছে বিভিন্ন কারণে। করাচিতে ডিফেন্স হাউজিং অথোরিটির কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয়ে পাকিস্তানের সাবেক প্রধান বিচারপতি বিদ্রূপের সুরে মন্তব্য করেছিলেন,
আপনারা পুরো সাগর দখল করে নিন, সাগরে আমেরিকা পর্যন্ত আপনাদের দখল বর্ধিত করুন, এবং পুরো জায়গায় আপনাদের পতাকা লাগিয়ে দিন।
যোদ্ধা হিসেবে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সামর্থ্যের বিশ্বজোড়া স্বীকৃতি রয়েছে, বিভিন্ন সময়ে সাহসিকতার প্রমাণ দিয়েছেন পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। কিন্তু, ডিফেন্স হাউজিং অথোরিটির কর্মকাণ্ড আর পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ভূমিপ্রেম একটি প্রশ্নকেই সামনে আনে- পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের জন্য কোনটি আগে- দেশপ্রেম নাকি ভূমিপ্রেম?