প্রতি বছরের মতো এবারও মর্ত্যে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে মহিষাসুর। দুর্গার সাথে লড়াইয়ে প্রতিবারই সে হারে, তারপরও মর্ত্যে তার যাওয়া চাই-ই। নিজের পরিকল্পনাগুলো ঝালিয়ে নিচ্ছিল- এমন সময় কোত্থেকে যেন উদয় হলো নারদ। বীণায় একটা ঝংকার তুলে একগাদা কাগজ মহিষাসুরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নাও, ঝটপট কয়টা সই করে দাও দেখি”। মহিষাসুর অবাক হয়ে জানতে চাইল সই কীসের জন্য।
– তুই একটা গাড়ল! বর্ষা পোয়ালে যে মর্ত্যে যাবি, তার পেপারওয়ার্ক থুড়ি ডিজিটাল ওয়ার্ক লাগবে না?
— (অবাক গলায়) কই এতকাল তো এসব ছিল না!
– এতকাল কি আর এসব লোকের রাজত্ব ছিল রে! তুই কে এটা তোকে এখন প্রমাণ করতে হবে।
— হোয়াট ডু ইউ মিন? আমি মহিষাসুর এটা আমাকে প্রমাণ করতে হবে!
– এক্সাক্টলি। হুঁ, হুঁ, বাবা! সেই মা দুর্গাই তোকে লিখে দেবেন ১৯৭১ সালের আগে তুই যে মহিষাসুর ছিলি, এখনও তুই সেই মহিষাসুর।
— উনিশশো একাত্তর, মানে নাইন্টিন সেভেন্টি ওয়ান! কিন্তু কেন?
– ভেরিয়েবেল বুঝিস, ভেরিয়েবেল? ওটা র্যান্ডম।
কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার ‘মহিষাসুর পালা ২০১৯’-এ এভাবেই ভারতের চলমান জাতীয় নাগরিকপঞ্জীকে কটাক্ষ করা হয়েছে। মর্ত্যে এতকালের পরিচিত মুখ হওয়া সত্ত্বেও মহিষাসুরের রক্ষা নেই, তাকেও প্রমাণ করে ছাড়তে হবে ১৯৭১ সালের আগে থেকেই সে মর্ত্যে দুর্গার সাথে যুধ্যমান ছিল। প্রমাণ করতে না পারলে কী হবে, সেটা এখনও নিশ্চিত নয়। যদি কোনো ফন্দিফিকির করে নিজেকে খাঁটি মর্ত্যবাসী (পড়ুন ভারতবাসী) বলে চালিয়ে দিতে না পারে, তাহলে হয়তো বাকি জীবনটা হতভাগ্য মহিষাসুরকে পাতালের অন্ধকারেই কাটাতে হবে।
বর্তমানে ভারতের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি ঝড় তুলছে, তা হলো দেশটির জাতীয় নাগরিকপঞ্জী। এই ঝড়ের তাণ্ডব শুধু ভারতেই সীমাবদ্ধ থাকবে- তা নিশ্চিত করে বলা যায় না, বরং বাংলাদেশেও এর সমান শক্তিতে আঘাত হানার প্রভূত সম্ভাবনা রয়েছে। তার ফলে আমাদের রাজনৈতিক আবহে কী পরিবর্তন আসবে- তা এখনো ভবিতব্য হলেও এই পরিবর্তন যে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টির সরকার যেন পণ করেছে ভারতবর্ষকে পুনরায় আর্যাবর্তের হারানো গৌরব ফিরিয়ে দেবে। ভারত যে স্রেফ একটি নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের মাতৃভূমি নয় বা কোনো একসময় থাকলেও এই একুশ শতকে সেটা সম্ভব নয়- তা এই দলটিকে কে বোঝাবে!
ভারতের নানা জাতি ও ধর্মের সাংস্কৃতিক, সামাজিক, আচরণিক ইত্যাদি ভিন্নতাই যে ভারতকে বৈচিত্র্যপূর্ণ করে তুলেছে, তাকে পরিবর্তন করার মানে হচ্ছে ভারতের অন্তর্গত সত্তাটাকে বিনষ্ট করে ফেলা। এই সম্প্রীতির মেলবন্ধনকে ভাঙার মধ্য দিয়ে এই ভারত ও ভারতীয় উপমহাদেশে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে- তার পরিণাম ভোগ করতে হবে এখানে বসবাসকারী সংখ্যালঘু মানুষদের।
ভারত সরকার বর্তমানে নাগরিকপঞ্জী তৈরি শুধু আসামে সীমাবদ্ধ রাখলেও দেশটি পর্যায়ক্রমে সবগুলো প্রদেশে এই নাগরিকপঞ্জী তৈরির ইঙ্গিত দিয়েছে। আসামে ইতোমধ্যে চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জী তৈরি করে ফেলা হয়েছে।
এই তালিকায় ১৯ লক্ষ মানুষকে ঠাঁই দেওয়া হয়নি। তার মানে হচ্ছে এই লোকগুলো সামনে আরও কয়েকটি অগ্নিপরীক্ষায় যদি উত্তীর্ণ হতে না পারে, তাহলে শেষমেশ তারা স্বীকৃত ‘এলিয়েন’ হয়ে যাবে। তারা হারাবে তাদের মাতৃভূমির অধিকার। যে দেশকে মা ভেবে এতদিন বাস করে এসেছিল, সে দেশের রাজনীতিবিদ নামক কিছু জীব তাদের সেই মাকে তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেবে।
এই সার্বিক প্রক্রিয়াটিকে তামাশা হিসেবে ভেবে নিয়ে তা উপভোগ করার কোনো সুযোগ প্রতিবেশী বাংলাদেশের নেই। কারণ নগর পুড়িলে যেমন দেবালয় এড়ায় না, তেমনি প্রতিবেশী দেশের কিছু জনগণের কপাল পুড়লে বাংলাদেশিদের কপাল যে অক্ষত থাকবে তা ভাবা অর্বাচিনতা।
নাগরিকপঞ্জীর খুঁতগুলো
নাগরিকপঞ্জীর দরুন বাংলাদেশ কী কী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে, তা নিয়ে কথা বলার আগে চলুন জেনে নেওয়া যাক এই পুরো প্রক্রিয়াটির বিদ্যমান অসঙ্গতিগুলো।
আসামের সাথে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের সীমান্ত সংযোগ থাকায় এই অঞ্চলে অভিবাসন অনেককাল আগে থেকেই চলে এসেছিল। এই ধরনের অভিবাসন প্রথম দেখা যায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সময়। এরপর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিশাল সংখ্যক শরণার্থী আসামে প্রবেশ করে।
এসবের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আসামে অভিবাসন-বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। প্রায় বছর দশেক জোরদার আন্দোলনের (সাময়িক) ইতি ঘটে ১৯৮৫ সালে। সে বছর সদৌ আসাম ছাত্র সংস্থা ও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যকার এক চুক্তি সাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিটিই আসাম চুক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
আসাম চুক্তির একটি অন্যতম শর্ত হচ্ছে ১৯৭১ সালের পরে আসামে আসা বাংলাদেশি ব্যক্তিদের শনাক্ত করা ও আসাম থেকে বহিষ্কার করা। বর্তমান নাগরিকপঞ্জী সে হিসেবেই কাজ করার কথা। কিন্তু এই নাগরিকপঞ্জী থেকে অনেক হিন্দুর নাম বাদ পড়ে যাওয়ায় তা বিজেপির জন্য অনেকটা শাঁখের করাতের মতো হয়ে গেছে।
হিন্দুদের প্রতি তীব্র সহানুভূতিশীল বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার চায় না, তালিকা থেকে বাদ পড়া হিন্দু, বৌদ্ধ বা শিখরা কোনো অকূল পাথারে পড়ুক। ওদিকে ঐতিহাসিকভাবে মুসলিমদের প্রতি বৈরিতা বিজেপির রাজনৈতিক চরিত্র। এ দুই মিলিয়ে ২০১৬ সালে লোকসভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস করিয়েছে তারা।
বিজেপি সভাপতি ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন,
হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান শরণার্থীদের ভারত ছাড়তে জোর করা হবে না। আপনার গুজবে কান দেবেন না। নাগরিকপঞ্জীর আগে আমরা নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল আনব, যাতে করে এই লোকগুলো ভারতের নাগরিকত্ব পায়।
এই সংশোধনী বিলের সমর্থনকারীদের ভাষ্য, এই বিল থেকে মুসলমানদের বাদ দেওয়া হয়েছে, কেননা বিলটির লক্ষ্য হলো প্রতিবেশী দেশের নিপীড়নের শিকার ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এই বিল রাজ্যসভায় পাস হলে সরকার বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে আগত অবৈধ সংখ্যালঘু অভিবাসীদের নাগরিকত্ব দিতে পারবে।
কিন্তু আসাম বা সেভেন-সিস্টার্সের মানুষ এমনটা চায় না। অবৈধ অভিবাসীর বিচারে তাদের চোখে হিন্দু-মুসলমান সবাই সমান। এখানেই নাগরিকপঞ্জী নিয়ে কেন্দ্র সরকারের সাথে আসামের ভিন্নমতের উত্থান!
আসামের বাসিন্দারা নাগরিকপঞ্জীকে দেখছে বিদেশিদের অধিকরণ থেকে তাদের অস্তিত্ব রক্ষার উপায় হিসেবে- এখানে ধর্মের কোনো সংস্রব নেই। অন্যদিকে বিজেপির কাছে নাগরিকপঞ্জী স্রেফ তাদের ধর্মদূষিত-রাজনৈতিক মতাদর্শ বাস্তবায়নের হাতিয়ার।
আসাম আন্দোলনের অন্যতম নেতা, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল কুমার মহন্ত বিজেপি সরকারের এই প্রচেষ্টার একজন তীব্র বিরোধিতাকারী। এক সাক্ষাৎকারে তিনি আসামের নাগরিকপঞ্জীর হিসেবে গরমিল আছে বলে উল্লেখ করেছেন। নাগরিকপঞ্জীতে অনেক অনুপ্রবেশকারী ঢুকে পড়েছে মন্তব্য করে তিনি জানান, বিজেপির এই নাগরিকত্ব মেরুকরণের প্রচেষ্টা আসামে খাটবে না। তার সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ এখানে তুলে ধরা।
– আপনি কি বলতে চাচ্ছেন যে নাগরিকপঞ্জীতে নাম আসা একটা বিশাল অংশই আদতে ভারতীয় নন এবং নাগরিকপঞ্জীর বাইরে থাকা ৪০ লাখ লোকের অনেকেই প্রকৃতার্থে ভারতীয়?
— প্রতীক হাজরা (নাগরিকপঞ্জী সমন্বয়ক) খোদ স্বীকার করেছেন কিছু লোকের উত্তরাধিকার সংশ্লিষ্ট তথ্যসমূহ জাল হতে পারে। আমি বলেছিলাম নাগরিকত্বের ব্যাপারটা শুধু বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে প্রযোজ্য, কারণ ভুটান ও নেপালের অভিবাসীদের জন্য আমাদের আলাদা নীতি রয়েছে। শুধু বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য ভেরিফিকেশন দরকার, কারণ বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। তারা হিন্দু, মুসলিম বা বৌদ্ধ নির্বিশেষে বাংলায় কথা বলে। সুতরাং নাগরিকত্ব নির্ধারণের জন্য ভাষাটাই হওয়া উচিত ছিল মূল মানদণ্ড। কিন্তু কর্তৃপক্ষ বেশ বিস্তৃত পরিসরে তাদের অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে আর সেখানেই যত গন্ডগোল।
– সুতরাং আপনি বিশ্বাস করেন বৃহৎ সংখ্যক বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী নাগরিকপঞ্জীতে ঢুকে পড়েছে?
— দেখুন ১৯৭১-এর পর করা প্রতিটি আদমশুমারীর হিসেবে ভারতের জনসংখ্যা বেড়েই চলছে। নাগরিকপঞ্জীর ক্ষেত্রে সরকারের উচিত ধর্মকে না টেনে এটাকে আরও দুর্ভেদ্য করে তোলা। ১৯৫১ সালে অবিভক্ত আসামের জনসংখ্যা ছিল ৮৮ লাখ। সেই আসামকে সাত ভাগ করার পর এখন শুধু আসাম রাজ্যের জনসংখ্যাই সাড়ে তিন কোটি ছুঁইছুঁই। এই হিসেবটা গড় জাতীয় বৃদ্ধির সাথে কিছুতেই যায় না। এটা পরিষ্কার যে এই জনসংখ্যা বিস্ফোরণ স্বাভাবিক নয়, এটা অনুপ্রবেশকারীদেরই অবদান। সরকারের উচিত ব্যাপারটাকে গুরুত্বের সাথে নেওয়া। এখানে (আসামে) এমন লোকও আছে যাদের ঢাকা ও সিলেটে জায়গাসম্পত্তি আছে। তারপরও এরা নাগরিকপঞ্জীর ফাঁকফোকর গলে ঢুকে পড়েছে। আমি বিশ্বাস করি পুরো প্রক্রিয়াটি আগাগোড়া ত্রুটিমুক্ত নয়। অনেক ভারতীয় নাগরিকই তালিকায় জায়গা করে নিতে পারেনি এবং একটা বড় সংখ্যক অনুপ্রবেশকারী পার পেয়ে গেছে। তারা যেভাবে হোক কাগজপত্র জোগাড় করেছে।
– এই ডামাডোলের মাঝে আপনার মিত্র রাজনৈতিক দল বিজেপি মনে হচ্ছে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল দিয়ে তাদের হিন্দু বাংলাদেশি ভোটারদের ভোট নিশ্চিত করে ফেলছে…
— আমরা এই বিলের বিরোধিতা করি। রাজনৈতিক দলগুলো ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চাইছে। বিজেপি ভাবছে তারা হিন্দুদের ভোট পাবে। এদিকে কংগ্রেস আর মমতা ব্যানার্জী চাচ্ছেন সংখ্যালঘুদের ভোট পেতে। কিন্তু আসামে অসমীয়া মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে দারুণ সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে, সমস্যাটা শুধু অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে। বর্তমান পরিস্থিতির সুযোগে কেউ যেন সাম্প্রদায়িক সুবিধা না নিতে পারে- সেটি খেয়াল রাখবে আমার দল ও জনগণ।
নাগরিকপঞ্জীতে নাম তোলার জন্য অসমীয়াদের সাত দশক আগের কাগজপত্র খুঁজতে হয়েছে। ১৯৫১ সালের তালিকায় পূর্বপুরুষদের নাম মেলানোর জন্য নিজেদের জায়গাজমির দলিল হাতড়ে মরতে হয়েছে আসামের লোকজনকে, যাদের প্রতি চারজনের একজন নিরক্ষর। সুতরাং দলিল বা কাগজপত্র পড়তে না পারলেও তাদেরকে সেসব কাগজপত্রের পেছনে দৌড়াতে হয়েছে। এছাড়া রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সত্তর বছরের পুরনো কাগজপত্র স্বভাবতই অনেক পরিবার হারিয়ে ফেলেছে।
পুরো প্রক্রিয়াটিতে যে যথেষ্ট আপত্তিকর খুঁত রয়েছে- তা বোঝা যায়, যখন দেখা যায় তালিকায় ছেলের নাম এলেও বাবার নাম আসেনি অথবা বোন ভারতের নাগরিক বলে গণ্য হলেও তার যমজ দুই ভাই বিদেশি বলে গণ্য হয়েছে। এছাড়া স্রেফ পিতামহের নামের বানান ভুল হওয়ার দরুণ নাতিকে ভারতীয় নাগরিকত্ব হারাতে হয়েছে।
প্রসঙ্গ বাংলাদেশি অভিবাসী
ভারতে ‘অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীর’ সঠিক সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ২০১৬ সালে বিজেপি সরকার এই সংখ্যাকে দুই কোটি বলে অভিহিত করে। এছাড়া ২০০৪ সালে কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা এক কোটি বিশ লাখ বলে বিবেচনা করা হয়।
২০১৬ সালে এক নিবন্ধে র-এর একজন প্রাক্তন প্রধান সঞ্জীব ত্রিপাঠি স্বীকার করেন অভিবাসীদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে কোনো বস্তুনিষ্ঠ তথ্য তাদের হাতে নেই। তবে তিনি ১৯৮১ সালের পর থেকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও জনতাত্ত্বিক ধারণা বিশ্লেষণ করে এই সংখ্যাটি দেড় কোটি বলে মত প্রকাশ করেন।
ভারতীয় সংবাদ চ্যানেল টাইম নাও-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল কালাম আব্দুল মোমেনকে নাগরিকপঞ্জী থেকে বাদ পড়া মানুষগুলো বাংলাদেশি কিনা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন-
আমার তা মনে হয় না। বাংলাদেশিদের ভারতে স্থানান্তরিত হওয়ার কোনো কারণ আমি দেখি না। বাংলাদেশে এখন যথেষ্ট উন্নয়ন হচ্ছে। সুতরাং কোনো বাংলাদেশির ভারতে গিয়ে বাস করার প্রয়োজন পড়বে না। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ের হিসেব দেখলেই বোঝা যায়, বাংলাদেশিদের ভারতে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
কী বলছে ওপার বাংলা
নাগরিকপঞ্জী নিয়ে ভিন্ন ধারণা পোষণ করছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে সরাসরি তিনি বলে দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গে নাগরিকপঞ্জী তৈরির কোনো প্রয়োজন নেই। তার মতে, আসামের নাগরিকপঞ্জীর প্রক্রিয়াটি কোনো নিখুঁত প্রক্রিয়া নয়।
আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে একটি চিঠি দিয়েছি। আসামের নাগরিকপঞ্জী থেকে বাদ পড়া উনিশ লাখ লোকের মধ্যে বাঙালি, হিন্দুস্তানি, গোর্খা, স্থানীয় অসমীয়া সবাই আছে। আমরা বলেছি আসল ভোটারদের একটা সুযোগ দেওয়া উচিত, যাতে তারা নিজেদের ভারতীয় ভাবতে পারে। এজন্য আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে আলোচনায় বসেছি। তিনি পশ্চিমবঙ্গে নাগরিকপঞ্জী প্রসঙ্গে কিছু বলেননি এবং বস্তুতপক্ষে এখানে এসবের কোনো প্রয়োজন নেই।
ব্যানার্জির মতে, পশ্চিমবঙ্গে বাস করা প্রতিটি মানুষই ভারতের নাগরিক। তিনি বলেছেন পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের মধ্যে কোনো বিভেদ সৃষ্টি করতে তিনি দেবেন না। তার মতে, পশ্চিমবঙ্গের মানুষেরা ভারতের নাগরিকত্ব অর্জন করেছে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বাংলা রেঁনেসায় তাদের অবদানের মাধ্যমে। সমাজের প্রতিটি মানুষের বাংলায় বাস করার অধিকার রয়েছে উল্লেখ করে তিনি কাউকে জোর করে বাংলা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে না বলে নিশ্চয়তা দিয়েছেন।
নাগরিকপঞ্জীর বিরোধিতা করে পশ্চিমবঙ্গে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। রাজ্যের প্রতিটি জেলায় অনুষ্ঠিত হয়েছে মিছিল ও সভাসমাবেশ। এছাড়া কলকাতার সচেতন নাগরিক সমাজও নাগরিকপঞ্জী প্রসঙ্গে সরব। তারা বিভিন্ন সভা-সেমিনারের আয়োজন করছেন নিয়মিত। এছাড়া স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী নিজেও বিভিন্ন মিছিলে অংশ নিয়েছেন। কলকাতার বুদ্ধিজীবী শ্রেণীও রাষ্ট্রের এই প্রক্রিয়াটিকে স্বাগতম জানাননি। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেছেন,
কবে সীমানা পেরিয়েছি, সেটা তো আমার স্মৃতিতে আছে। কোন স্কুলে কতবছর পড়েছি, সেটাও আমার মনে আছে। কিন্তু এসবের যদি কাগজপত্র দিতে বলে, তা তো পারব না! তবে কি আমাকে বার করে দেবে? সেটাই বা আমি মানব কেন? আর আসামে তো দেখছি অনেকে বৈধ কাগজপত্র জমা দেওয়ার পরেও তাদের নাম বাদ দিয়ে দিয়েছে।
বলবার অপেক্ষা রাখে না, ওপার বাংলার বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর একটা বিশাল অংশের শেকড় এপার বাংলায়। যদি তাদেরকেও বের করে দেওয়া হয় নানান ছলছুতোয়, তাহলে পশ্চিমবঙ্গ তার রত্নভাণ্ডারের একটা বিশাল অংশ হারাবে বৈকি।
বাংলাদেশের ওপর সম্ভাব্য প্রভাবসমূহ
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এ বছরের জুলাই মাসে রাজ্যসভায় এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, সরকার দেশের আনাচে-কানাচে থাকা প্রতিটি অভিবাসীকে খুঁজে বের করে আন্তর্জাতিক আইন মোতাবেক দেশ থেকে বিতাড়িত করবে। এই বিতাড়ন বলতে তিনি স্বভাবতই বাংলাদেশে পাঠানো বুঝিয়েছেন। আসামের অর্থমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেছেন, ভারতের উচিত বাংলাদেশকে তাদের নাগরিক ফিরিয়ে নিতে উদ্বুদ্ধ করা। তিনি আরো বলেন-
চূড়ান্ত রায়ের পর আমাদের উচিত হবে বাংলাদেশের সাথে আলোচনা শুরু করা। যাতে তারা এখানকার অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়। একশ-দেড়শ’র মতো বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানোর ঘটনা আগেও ঘটেছে কিন্তু এবারের সংখ্যাটা অনেক বেশি।… তারা রাজি না হলে আমাদের অন্য পথ দেখতে হবে।
কিন্তু ভারত থেকে বাংলাদেশে কাউকে এভাবে পাঠাতে হলে বাংলাদেশকে প্রথমে স্বীকার করে নিতে হবে যে, এই অভিবাসীরা বাংলাদেশি এবং তারা এতদিন ভারতে অবৈধভাবে বাস করছিল। সরকারি হিসেব অনুযায়ী, আসাম ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ১৪৭ জন অভিবাসীকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে। কিন্তু জাতীয় নাগরিকপঞ্জীর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন, কারণ এটা লাখ লাখ লোকের মামলা। এছাড়া এই লোকগুলো কয়েক দশক ধরে আসামে বসবাস করে এসেছে এবং তারা নিজেদেরকে ভারতের নাগরিক বলেই জানে।
গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ বরাবরই ভারতের অভ্যন্তরে তাদের নিজেদের নাগরিক থাকার কথা অস্বীকার করে এসেছেন। তার ওপর ভারতের পক্ষ থেকেও নাগরিকপঞ্জীর সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের ওপর তেমন জোর দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী গতবছর কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেছেন,“বাংলাদেশ ভারতে অবৈধভাবে বাস করা বাংলাদেশিদের ফেরত নেবে, যদি ভারত প্রমাণ করতে পারে যে তারা আসলেই অবৈধ বাংলাদেশি।”
কিন্তু যেহেতু নাগরিকপঞ্জী থেকে বাদ পড়া লোকদের ভারতীয় নাগরিকত্বের কোনো প্রমাণ নেই, সুতরাং তারা যে বাংলাদেশের নাগরিক সেটি প্রমাণও নেই। অর্থাৎ বাংলাদেশের কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই এই কুড়ি লাখ মানুষের ভার বহন করার। এমতাবস্থায় ভারতের সামনে একটাই পথ খোলা আছে – দেশের অভ্যন্তরে বন্দিশিবির খুলে সেখানে নাগরিকত্ববিহীন লোকদের আটকে রাখা, যা হবে মানবতাবিরোধী।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে প্রভাব
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি ভারত সফর করেছেন। এ সফরে তিনি ভারতের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে সাতটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। বাংলাদেশের মানুষ যে চোখে এই সফর বা চুক্তিগুলোকে দেখুক না কেন, ভারত কিন্তু এ সফরকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখেছে বলে প্রতীয়মান হয়।
সফর চলাকালীন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রমানিয়াম জয়শঙ্কর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এক সৌজন্য সাক্ষাতে বলেন, ভারত সবসময় বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ককে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখে। এছাড়া দু’দেশের প্রধানমন্ত্রীর চুক্তিস্বাক্ষর অনুষ্ঠানের পূর্বে ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়, দুটো দেশই তাদের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে অন্য মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ-ভারতের বর্তমান সুসম্পর্ককে দুটো বিষয় কখনো কখনো চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে। একটি হচ্ছে সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং অন্যটি হচ্ছে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী। সীমান্ত হত্যা প্রসঙ্গে অবশ্য ভারত সরকারের মন্তব্য হচ্ছে, দুই দেশের পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে এই হত্যার ঘটনাগুলো নাকি বর্তমানে বহুলাংশে কমে এসেছে। যদিও বাস্তবে এসব মন্তব্য কখনো কখনো ফাঁকা বুলি বলেই মনে হয়।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতরে বিএসএফের অনৈতিক প্রবেশ ও তার জেরে বিজিবির গুলিতে একজন বিএসএফ সদস্য নিহত হওয়ার ঘটনায় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে কোনো প্রকার আঁচ পড়বে বলে ভাবা হলেও কূটনৈতিকমহল ও বিশেষজ্ঞরা তা ভাবছেন না। এদিক থেকে বলা যায়, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে এখন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হচ্ছে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী।
গত সেপ্টেম্বর মাসে নিউইয়র্কে সেপ্টেম্বর মাসে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর এক সাক্ষাৎকারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নাগরিকপঞ্জী নিয়ে নিশ্চিত করে বলেছেন, এটি ভারতের নিজস্ব বিষয় এবং বাংলাদেশকে এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।
বাংলাদেশের অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও নাগরিকপঞ্জীকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে অভিহিত করে নিশ্চিন্ত হয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যেখানে ভারতের বিভিন্ন মন্ত্রী বা রাজনীতিবিদেরা নাগরিকপঞ্জী থেকে বাদ পড়া লোকদের ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ বলে মন্তব্য করেছেন, সেখানে বাংলাদেশের এই ব্যাপারটি নিয়ে নিরুদ্বেগ থাকা কতটা সমীচীন?
ভারত সরকারের লক্ষ্য হলো, ‘অবৈধ বাংলাদেশিদের’ দেশ থেকে তাড়ানো। সোজা কথায়, তাদের ঈপ্সিত লক্ষ্য হলো, এই কয়েক লাখ মানুষকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া। সুতরাং যদি কখনো নাগরিকপঞ্জীর প্রক্রিয়া শেষ হয় এবং তারপর এই বাদ পড়া লোকদের যদি বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করে, এমনকি যদি বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক তখন যে অন্য মাত্রা নেবে- তা তো চোখ বুজে বলা যায়! বাকিটা সময়ই বলবে।
সন্ত্রাসবাদ
আসামের পর নিখিল ভারতে নাগরিকপঞ্জী তৈরি করবে বলে নির্বাচনী ইশতেহারে কথা দিয়েছিল বিজেপি। তাদের এই অঙ্গীকারকে প্রথম দিকে অনেকে স্রেফ নির্বাচনী ভাঁওতা বলে মনে করলেও বর্তমানে আসামের পরিস্থিতি দেখে অনেক সমালোচক বলছেন, বিজেপি সরকার সুযোগ পেলে প্রকৃতপক্ষেই পুরো ভারতে নাগরিকপঞ্জীর নাম দিয়ে মুসলমানদের দেশছাড়া করার পাঁয়তারা করবে।
ভারতের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় একশ ত্রিশ কোটি। এদের মধ্যে বিশ কোটি মানুষ মুসলমান। সুতরাং এই বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে নাগরিকপঞ্জীর জালে পেঁচিয়ে যদি ভারত সরকার তাদের সকল নাগরিকে অধিকার কেড়ে নিতে চায়, তাহলে ভারতবর্ষে যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে তা সামলাবে কে?
এই ধাক্কাটা শুধু ভারতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং বলা যায় পুরো উপমহাদেশই চরম অস্থিরতার সম্মুখীন হবে। এতে করে যে এই অঞ্চলে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ ঘাঁটি গেড়ে বসবে- তা বুঝতে হলে বড় মাপের বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। ইতোমধ্যে আল-কায়েদা উপমহাদেশে তাদের রক্তাক্ত থাবা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে।
২০১৪ সালের ০৩ সেপ্টেম্বর আল-কায়েদা নেতা আয়মান আল জাওয়াহিরি ইন্টারনেটে একটি ৫৫ মিনিটের ভিডিও পোস্ট করে ‘আল কায়েদা ইন দ্য ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট’ (একিউআইএস) প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। এই নব্য সন্ত্রাসী সংগঠনটির লক্ষ্য আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, মায়ানমার, ও বাংলাদেশে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এ সময়ের মধ্যেই সংগঠনটি বিভিন্ন হামলার দায় স্বীকার করেছে। বাংলাদেশে অনেক মুক্তমনা লেখক, ব্লগার, অধ্যাপক হত্যার দায়ও স্বীকার করেছে একিউআইএস।
ইসলামিক স্টেট জঙ্গিগোষ্ঠীও বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। এ বছরের অক্টোবর মাসের ২৬ তারিখ মার্কিন বিশেষ বাহিনীর অভিযানে আবু বকর আল বাগদাদি সিরিয়ায় নিহত হন। অবশ্য পূর্বের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে মনে হয় না বাগদাদির মৃত্যুর সাথে সাথে ইসলামিক স্টেটের দিন শেষ হয়ে গেছে। কারণ দেখা গেছে, আইএস খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাদের নেতৃত্বের শূন্যস্থানগুলো পূরণ করে।
আবার এসব নবনিযুক্তি এতই দ্রুত ঘটে যে, মার্কিন কমান্ডো বাহিনীগুলোতে প্রায়শই মজা করে বলা হয়, আল-কায়েদা বা ইসলামিক স্টেটের নেতাদের নিকেশ করা স্রেফ ঘাসে নিড়ানি দেওয়া বৈ আর কিচ্ছু নয়! তথাপি বাগদাদির মৃত্যু এবং ইরাক ও সিরিয়ায় দখল হারানোর পর থেকে ঐ অঞ্চলের আইএসবিরোধী দলগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে নতুন খিলাফত সেখানে তৈরি করা হয়তো ইসলামিক স্টেটের পক্ষে সম্ভব হবে না।
এর বদলে আইএস তাদের উপস্থিতি দক্ষিণ এশিয়ায় বাড়াতে চাইবে এখানকার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও মেরুকরণকে পুঁজি করে। এ বছরের মে মাসে ইসলামিক স্টেটের পক্ষ থেকে ভারতের জম্মু-কাশ্মীর অঞ্চলে খিলাফত তৈরির ঘোষণা দেওয়া হয়।
এছাড়া শ্রীলঙ্কায় ইস্টার সানডে হামলার দায় ঘোষণা করে ভিডিওবার্তা প্রকাশ করেন আইএস প্রধান আবু বকর আল বাগদাদি। সুতরাং উপমহাদেশ যে জঙ্গিদের শ্যেনদৃষ্টিতে পড়েছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ওদিকে এসব বহিরাগত জঙ্গিসংগঠনের বাইরে পাকিস্তান-আফগানিস্তান ভিত্তিক উপমহাদেশের ‘একান্ত নিজস্ব’ জঙ্গিসংগঠনগুলো তো আছেই।
এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নাগরিকপঞ্জীর মতো বিতর্কিত বিষয় যদি ভারতের বিশ কোটি মুসলমানকে ক্ষেপিয়ে দেয়, তাহলে তা হবে এই সন্ত্রাসবাদ বিস্তারের একটি ইতিবাচক ও শক্তিশালী প্রভাবক। কারণ নাগরিকপঞ্জী-বিক্ষুব্ধ সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের একটা অংশ যে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠবে না- তা কে বলতে পারে!
তাদেরকে লুফে নেওয়ার চেষ্টা করবে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলো। এর ফলে ভারতের পরিস্থিতি পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের মতো হয়ে পড়তে পারে। এরই মধ্যে ভারত বেশ কয়েকটি শক্তিশালী জঙ্গি হামলার শিকার হয়েছে। নাগরিকপঞ্জীর বিষবাষ্প এই অপঘাতের মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
এবার আসা যাক বাংলাদেশে এর প্রভাব সম্পর্কে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ হওয়ায় বাংলাদেশের প্রতি অনেক জঙ্গিসংগঠনেরই লোলুপদৃষ্টি রয়েছে। আবার ভারতের নাগরিকপঞ্জী বিষয়ে বাংলাদেশের একটা বিশাল অংশই বীতশ্রদ্ধ। ফলে স্রেফ নাগরিকপঞ্জীর দোহাই দিয়ে যদি কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার প্রয়াস করা হয়, তাহলে দেখা যাবে বাংলাদেশের একটা বিশাল জনগোষ্ঠী সেটাকে সচেতনে বা অচেতনে সমর্থন দিয়ে যাবে।
ভারতের নাগরিকপঞ্জী মুসলিমদের নাগরিক অধিকার হরণ করেছে দাবি করে সে অধিকার পুনরুদ্ধারে যদি কোনো দল বা গোষ্ঠী সশস্ত্র ‘জিহাদ’কে অবলম্বন করে, তাহলে সেটায় শরিক হতে অনেক বাংলাদেশি মুসলমানও দ্বিধা করবে না! দুই প্রতিবেশী দেশে একটি অভিন্ন সমস্যা নিয়ে উগ্রবাদের উত্থান ঘটে, তাহলে তার নেতিবাচক প্রভাব ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে কোনো অংশে কম পড়বে না।
ভারত সরকারকে এখনই বুঝতে হবে, নাগরিকপঞ্জী নামক এই সাম্প্রদায়িক খাঁড়া যদি তারা সত্যিই ব্যবহার করে, তাহলে সে খাঁড়ার ঘা সন্ত্রাসবাদে রূপ নিয়ে তাদেরকেও আচ্ছন্ন করবে, যার জের ভোগ করতে হবে প্রতিবেশী বাংলাদেশকেও।
সীমান্ত সঙ্কট
প্রশ্ন হলো, গত কয়েক দশকে কীভাবে এত সংখ্যক লোক ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম করে ওদেশে আশ্রয় নিয়েছে। ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তদৈর্ঘ্য চার হাজার কিলোমিটারেরও বেশি। আসাম সীমান্তে বিএসএফের সাথে আসাম পুলিশের বিশেষ স্কোয়াডও সীমান্তপ্রহরায় সহায়তা করে। তা সত্ত্বেও এত সংখ্যক মানুষ কী করে ভারতে পাড়ি জমাল, তার দায়ভার কিন্তু ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও আমলাদের কাঁধেও পড়ে।
এটা সত্য যে, এত বিশাল সীমান্ত সুরক্ষিত করা চাট্টিখানি কথা নয়। আসামের জলসীমান্ত দিয়ে অনেক অবৈধ অভিবাসন হয়ে থাকে। ২০১৬ সালে বিশ্বব্যাংকের এক প্রকাশনার হিসেবে মেক্সিকো-যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেন-রাশিয়া সীমান্তের পর বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত ‘অভিবাসন করিডোর’। বর্ষাকালে নদীতে পানি বৃদ্ধি পেলে ও শীতকালে অতিরিক্ত কুয়াশার কারণে বিএসএফ বা বিজিবি উভয়ই সীমান্তরক্ষায় বাড়তি অসুবিধার মুখোমুখি হয়।
কিন্তু তারপরও এর দায়ভার কিছুটা আসাম সরকারের ওপর বর্তায়। কারণ তাদের নাকের ডগার ওপর দিয়েই এতদিন এই লোকগুলো বাস করছিল। সরকারি লোকেরা কি কিছুই টের পায়নি অথবা তারা কি সব জেনেবুঝেও চুপ করে ছিল? সুতরাং অবৈধ অভিবাসনের জন্য শাস্তি যদি পেতেই হয়, তাহলে আসাম সরকার ব্যবস্থাকেও সে শাস্তি সমানভাবে পেতে হবে।
আগের আলোচনায় আমরা নাগরিকপঞ্জীর সাথে সন্ত্রাসবাদের সম্পর্ক দেখিয়েছি। এই সন্ত্রাসবাদের একটি শক্তিশালী প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকাগুলোতে। এ দুই দেশের সীমান্তাঞ্চলে অনেক দুর্গম স্থান রয়েছে, যা দুর্ভেদ্য। এসব স্থান সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর জন্য অভয়ারণ্য হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের সীমান্তরক্ষীদের হয়তো এসব সন্ত্রাসীদের সাথে লড়াইয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে, যার প্রভাব পড়বে সীমান্ত ব্যবস্থাপনায়। সীমান্ত দিয়ে তখন শুধু অবৈধ অভিবাসন নয় বরং মাদক, অস্ত্র, মানব ইত্যাদিও পাচার শুরু হতে পারে। এর আগে আমরা দেখেছি নাগরিকপঞ্জীর চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের সময় বাংলাদেশের সিলেট সীমান্তে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছিল। এ থেকেই অনুধাবন করা যায় নাগরিকপঞ্জীর সাথে সীমান্ত নিরাপত্তা কতটা জড়িত।
ধরা যাক, ভারত তাদের অবৈধ অভিবাসীদের জোর করে বাংলাদেশ সীমান্তের নো-ম্যান্স-ল্যান্ডে পাঠিয়ে দিলো। ফলে সীমান্ত এলাকায় একটি অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়ে যাবে। বাংলাদেশ তাদেরকে গ্রহণ না করলে এই মানুষগুলোর ঠিকানা হবে নো-ম্যান্স-ল্যান্ড। এই নিরাপত্তাহীন পরিবেশে যেকোনো সময় উগ্রবাদী সংগঠনগুলো হামলা চালাতে পারে।
এসব পরিস্থিতিতে এমনও হতে পারে যে দুই দেশ তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দেবে। যার ফলে এসব সীমান্ত দিয়ে যাতায়াতকারী মানুষেরা যেমন অকূল পাথারে পড়বেন, তেমনি বন্ধ হয়ে যাবে দুদেশের বাণিজ্যিক ব্যবস্থা। যার প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। ভারত পেঁয়াজের চালান বন্ধ করে দেওয়াতেই তো বাংলাদেশের মানুষের পেঁয়াজ খাওয়া বন্ধ হওয়ার জো হয়েছিল! আর নাগরিকপঞ্জীর জেরে সীমান্তে যে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে, তার সম্ভাব্য প্রভাবের মুখোমুখি হওয়ার জন্য কি বাংলাদেশ প্রস্তুত অথবা অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে প্রস্তুত হতে পারবে? এর উত্তর অবশ্যই ‘না’।
আরেকটি রোহিঙ্গা সঙ্কট ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়
ভারতের নাগরিকপঞ্জী প্রক্রিয়ার সাথে রোহিঙ্গা সঙ্কটকে তুলনা করা যায়। দুক্ষেত্রেই আমরা দেখতে পাই স্বয়ং রাষ্ট্র কর্তৃক এর সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার ঘৃণিত প্রচেষ্টা। আরও অদ্ভুত মিল হলো, দুটো সমস্যার সাথেই বাংলাদেশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দুই দেশই সমস্যার সমাধান প্রশ্নে বাংলাদেশকে উত্তর হিসেবে মেনে নিয়েছে। সমাধানের প্রশ্নে বাংলাদেশ এখন একটা রেনডাভু পয়েন্ট (Rendezvous Point)।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে রোহিঙ্গা সঙ্কটের চেয়ে নাগরিকপঞ্জী সঙ্কট তীব্রতর হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ মিয়ানমারের চেয়ে ভারতের সাথে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বেশি সক্রিয় এবং রোহিঙ্গাদের সংখ্যার চেয়ে আসামের নাগরিকপঞ্জী-ছুট জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃহত্তর। কয়েক দশক ধরে চলা রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে বিশ্বের যখন টনক নড়লো, ততদিনে রোহিঙ্গাদের যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। তাই আসামের এই নতুন ‘রোহিঙ্গাদের’ কপালও যেন মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের মতো না পোড়ে, তা নিশ্চিত করতে বিশ্বনেতৃত্বকে এখনই যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে।
মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা প্রত্যর্পণ চুক্তি থাকলেও ভারতের সাথে এরকম কোনো চুক্তি নেই। সুতরাং ভারত যদি তাদের তথাকথিত অভিবাসীদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে চায়, তার কোনো কূটনৈতিক উপায় নেই। আবার মিয়ানমারের সাথে চুক্তিটি যে এখন পর্যন্ত খুবই ফলপ্রসূ হয়েছে, তা কিন্তু বলা যায় না। বাংলাদেশ এখনো সিকিভাগ রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠাতে পারেনি। এদিকে রোহিঙ্গাদের উদ্বাস্তু হিসেবে উল্লেখ করলেও ভারত তাদের অবৈধ অভিবাসীদের উদ্বাস্তু হিসেবে উল্লেখ না করে বরং অনুপ্রবেশকারী হিসেবে উল্লেখ করেছে।
অমিত শাহ’র অবৈধ অভিবাসী তাড়ানোর শপথ আর মোদির নিশ্চয়তা- ভারতের এই দ্বিচারিক অবস্থান অদূর ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা নিয়ে বাংলাদেশকে আরও সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে। ভারত কি সত্যিই রোহিঙ্গাদের মতো অবস্থা তৈরি করবে তার দেশের অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষগুলোর জন্য? যদি তা-ই করে তাহলে বাংলাদেশের ভূমিকা কী হবে?
বাংলাদেশ যদি আবারও মানবতার খাতিরে সীমান্ত খুলে দেয়, তাহলে তা হবে আত্মঘাতী। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের ভারে জর্জরিত। তার পক্ষে আর নতুন করে কোনো শরণার্থীর ভার বহন করা সম্ভব নয়। ২০১৯ সালের অগাস্ট মাস পর্যন্ত হিসেব অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের পেছনে ২ বছরে বাংলাদেশের খরচ ৭২ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ যদি নতুন করে শরণার্থী আশ্রয় দেয় তাহলে দেশটির অর্থনীতি পুরোপুরিভাবে মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। উন্নয়নশীল এ দেশটি বর্তমানে যেভাবে ধীরে ধীরে নিজেদের উন্নতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে, নতুন কোনো উদ্বাস্তুসমস্যা তা থামিয়ে দিতে যথেষ্ট। সুতরাং দেশের মানুষের কথা বিবেচনা করে হলেও বাংলাদেশের উচিত হবে নাগরিকপঞ্জী নিয়ে খুবই সাবধানতার সাথে পদক্ষেপ নেওয়া।
বাংলাদেশ সরকারের কর্তব্য
বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গত পয়লা সেপ্টেম্বর ২০১৯ তারিখে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে এক অনুষ্ঠানে নাগরিকপঞ্জীকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মন্তব্য করেন। তার এ মন্তব্য কূটনৈতিক বা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে আপাতদৃষ্টিতে ঠিক মনে হলেও বাস্তবে বাংলাদেশের নেতাদের নাগরিকপঞ্জী নিয়ে ঝাড়া হাত-পা হওয়ার কোনো উপায় নেই।
কিন্তু ওই অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন-
ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করছি না এবং করতে চাই না। তাঁরা যদি আমাদের ব্যাপারে কিছু জানতে চায়, তাহলে আমাদের প্রতিক্রিয়াটা আমরা জানাব।
তার মানে হচ্ছে সবকিছু ভারতের ওপর নির্ভর করছে। ভারত কিছু না বললে আমাদেরও চিন্তার কিছু নেই! অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাথে এটাও বলেছেন ১৯৭১ সালের পরে বাংলাদেশ থেকে আর কেউ ভারতে বাস করতে যায়নি।
আমরা সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, ১৯৭১ সালের পরে আমাদের বাংলাদেশ থেকে কোনো লোক ভারতে যাননি। যারা গিয়েছেন, তারা আগেই গিয়েছেন। ঐ দেশ থেকে লোক যেমন এ দেশে এসেছেন, তেমনি আমাদের দেশ থেকেও গিয়েছেন। কাজই এ নিয়ে আমাদের চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই বললেও সরকারের পক্ষে নাকে তেল দিয়ে ঘুমানোরও কোনো উপায় নেই। নাগরিকপঞ্জীকে যেভাবে বারবার ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে, বাস্তবেই ব্যাপারটি যেন তা-ই থাকে, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী হতে হবে বাংলাদেশ সরকারকে।
প্রিয় পাঠক, রোর বাংলার ‘বিশ্ব’ বিভাগে এখন থেকে লিখতে পারবেন আপনিও। সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবেন রোর বাংলাকে আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর মাধ্যমে। আমাদের সাথে লিখতে চাইলে আপনার পূর্বে অপ্রকাশিত লেখাটি সাবমিট করুন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/