একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম ভয়াবহ ভূমিকম্পের সাক্ষী হলো পৃথিবী। রোববার রাতে যখন ঘুমাতে যায় মানুষেরা, তারা কি জানতো যে পরদিন ভোর দেখতে পাবে না অনেকেই? সোমবার সকাল হাজির হয় বিভীষিকা নিয়ে, মূহুর্তে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় তুরস্ক ও সিরিয়া। আঘাত হানে ৭.৮ মাত্রার ভয়ংকর ভূমিকম্প।
ভূকম্পনের পর পরই তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে গাজিয়ান্তেপ প্রদেশ ও সিরিয়ার উত্তরে সোমবার ভোরে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পকে গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হিসেবে উল্লেখ করছেন বিশেষজ্ঞরা। ভূমিকম্পটি আঘাত হানার পর আরও বেশ কয়েকটি আফটারশক বা ভূমিকম্প-পরবর্তী কম্পন অনুভূতি হয় যার একটি একেবারে মূল ভূমিকম্পের মতোই শক্তিশালী। এখন পর্যন্ত প্রায় ১৯,০০০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। প্রায় আড়াই কোটি মানুষ বিপর্যস্ত হবে এর প্রভাবে, এমনটাই ধারণা করা হচ্ছে।
যেখান থেকে উৎপত্তি ঘটে ভয়াবহ এই ভূমিকম্পের
প্রধানত তিনটি বড় কারণে ভূমিকম্প হয়ে থাকে। ভূ-পৃষ্ঠের হঠাৎ পরিবর্তন, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত সংঘটিত হওয়া, ও শিলাচ্যুতির কারণে। পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠ আলাদা আলাদা বিট দিয়ে গঠিত। বিটগুলোকে প্লেট বলে। এসব প্লেট একে অপরের পাশাপাশি অবস্থান করে। এরা প্রায় নড়াচড়া করার চেষ্টা করে। পাশে থাকা অন্য প্লেটের সঙ্গে ঘর্ষণের মাধ্যমে নড়াচড়া প্রতিরোধ করে। কিন্তু কখনও কখনও চাপ বেড়ে গিয়ে কোনো একটি প্লেট হঠাৎ করে ঝাঁকুনি দিয়ে ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগ সরিয়ে ফেলে।
সোমবার ভোরের দিকে হওয়া ভূমিকম্পের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ইস্ট আনাতোলিয়া ফল্ট। ফল্টটি তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলের গাজিয়ান্তেপ প্রদেশের নুরগাদি শহর থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার পূর্বে এবং ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার গভীরে অবস্থিত। ফল্ট হলো মাটির নিচে থাকা পাথর ও অন্যান্য খনিজের বিশাল খন্ড, যেগুলোর দৈর্ঘ্য শত বা হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। চলমান অবস্থায় থাকে এগুলো। ইস্ট আনাতোলিয়া ফল্টে ফাটলের ফলে যে কম্পনের সৃষ্টি হয়, সেগুলো উত্তর-পূর্বে বেশ প্রবল ছিল। ফল্ট লাইন বরাবর প্রায় ১০০ কিলোমিটার ধরে ভূমিকম্পটি আঘাত হানে। ফলে তুরস্কের মধ্যাঞ্চল ও সিরিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়।
এলাকাটি ভূমিকম্প রোধে তৎপর নয়
দক্ষিণ তুরস্ক ও সিরিয়ার অবকাঠামোগুলো তেমন একটা ভূমিকম্পন প্রতিরোধী নয়। মূলত অঞ্চলগুলোতে গত দু’শো বছরে এত বড় ভূমিকম্প না হওয়াতে এদিকে নজর দেয়নি প্রশাসন। ছিল না ভূমিকম্প রোধে সতর্ক ব্যবস্থা। তাই এখানে প্রস্তুতির মাত্রা বেশ কম। যে ফল্টে ভূমিকম্পের সূত্রপাত, সেই ইস্ট আনাতোলিয়া ফল্টের তেমন একটা গতিবিধি ছিল না গত শতাব্দীতেও। ১৯৭০ সাল থেকে গত ৫২ বছরে একই অঞ্চলে তিনবার ৬ মাত্রার ভূমিকম্প রেকর্ড করা হলেও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি তেমন। সর্বশেষ ১৮২২ সালের ১৩ আগস্ট এখানে ৭.৪ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, যাতে প্রায় ২০ হাজার মানুষ নিহত হয়।
কতটা ভয়াবহ এই ভূমিকম্প?
তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও সিরিয়ার উত্তরাংশে এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ১৯ হাজার ছাড়িয়েছে। এই সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, দুই দেশের প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষ শিকার হয়েছে ভয়াবহ ভূমিকম্পের। প্রায় ১০ লাখের মতো শিশুর হতাহত হওয়ার আশঙ্কা করছে তারা। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উদ্ধার অভিযানে নানা অসুবিধা। সব মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা এবং হতাহতের সংখ্যা দুটোই বাড়বে সময়ের সঙ্গে।
গত বিশ বছরে মোট ছয়টি ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭ এর ঘরে। যার দুটি গত দশ বছরে, বাকি চারটি এর আগের দশ বছরে। এ সময় ইন্দোনেশিয়ায় তিনবার; হাইতি, ইরান ও পাকিস্তানে দুবার; ইকুয়েডর, জাপান, চীন, ভারত, নেপালে একবার করে ৭ ও এর বেশি মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। চলতি শতাব্দীর সবচেয়ে বড় ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটে জাপানে। ২০১১ সালে দেশটির উপকূলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে, যার কারণে সেখানে আঘাত হানে সুনামি। সুনামি ছাড়াও উপকূলের কাছে থাকা একটি পারমাণবিক কেন্দ্রে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটে।
মূলত প্রথম ধাক্কার পর পর আফটারশক ও ১২ ঘন্টা পর ফের মৃদু আঘাতে পুরোপুরি ধ্বংস হয় এলাকাগুলো। যেহেতু কোনো শক্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছিল না, সেহেতু এমন দুর্যোগে সহজেই তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে তুরস্ক ও সিরিয়ার আক্রান্ত অঞ্চলের স্থাপনাগুলো।