জ্যাকস বাউদ একজন সাবেক সুইস গোয়েন্দা কর্মকর্তা। তিনি ন্যাটোর বিপরীতে গঠিত সাবেক ওয়ারশ প্যাক্টের আর্মড ফোর্সের দায়িত্বে ছিলেন, যার হয়ে তিনি আফগানিস্তান, কিউবা, এবং অ্যাংগোলাতে কাজ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে গোয়েন্দা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। স্নায়ুযুদ্ধের পর সুইস প্রতিরক্ষা বিভাগে কাজ করেন। একপর্যায়ে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বিভিন্ন দেশে কাজ করেন। ২০১৪ সালে ইউক্রেন সংকট শুরু হলে, ন্যাটোর হয়ে তিনি দনবাসে কাজ করেন ক্ষুদ্র পাল্লার অস্ত্র পর্যবেক্ষণ করার জন্য। সেখানে তিনি ইউক্রেনীয় সশস্ত্র বাহিনীকে সাহায্য করার কাজে নিয়োজিত থাকায় এই সংকট প্রত্যক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছেন।
তিনি একাধিক বইও লিখেছেন, যার মাঝে ‘দ্য নাভালনি এফেয়ার’, ‘পুতিন, মাস্টার অব দ্য গেম?’ উল্লেখযোগ্য। গত মার্চে তিনি ফ্রেঞ্চ ইন্টেলিজেন্স রিসার্চ সেন্টারে ফরাসি ভাষায় ইউক্রেন যুদ্ধের পরিস্থিতি নিয়ে একটি নিবন্ধ লেখেন, যার ইংরেজি অনুবাদ বিভিন্ন বিকল্পধারার গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এখানে তিনি ইউক্রেন সংকট নিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যমের তুলনায় একটু ভিন্ন সুরে আলোচনা করেছেন। পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোতে অনেকটা একপাক্ষিকভাবে রাশিয়া বা পুতিনের সমালোচনা করা হচ্ছে। কিন্তু ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে রুশভাষী দনবাসের বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ইউক্রেন সেনাবাহিনীর ৮ বছর ধরে চলে আসা অত্যাচার-নিপীড়ন নিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো নীরবতা পালন করে আসছে। সাবেক এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা এখানে মূলত রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গিতে ইউক্রেন সংকট নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং পশ্চিমা গণমাধ্যম ও রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করেছেন। রোর বাংলার পাঠকদের জন্য তার নিবন্ধটি বাংলায় অনুবাদ করে দেওয়া হলো।
যুদ্ধের প্রারম্ভ
বহু বছর ধরে, আমি মালি থেকে আফগানিস্তানে শান্তি রক্ষায় কাজ করেছি; এবং এর জন্য নিজের জীবন বাজি দিয়ে লড়েছি। আমি যা বলতে চাচ্ছি, তা আসলে যুদ্ধের সাফাই গাওয়ার জন্য নয়। বরং, আজকের ইউক্রেন-রাশিয়া সংকট কীভাবে এই পরিস্থিতিতে আসলো, সেটা বোঝানোর চেষ্টা করব। আমি দেখতে পাই, টেলিভিশনে ‘বিশেষজ্ঞরা’ যুদ্ধ পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশ্লেষণ করেন এমন সব তথ্যের ভিত্তিতে, যার উৎসগুলো সন্দেহজনক। অনেক সময় এসব হাইপোথিসিস সত্যও হয়; কিন্তু সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না আসলে কী ঘটছে। এভাবেই আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। এই সংকটে কার অবস্থান ঠিক, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হচ্ছে আমাদের নেতারা কীভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
এবার তাহলে সংকটের উৎস নিয়ে আলোচনা করা যাক। এটার শুরুটা হচ্ছে, গত আট বছর ধরে দনবাস প্রসঙ্গে যারা আমাদের বলে আসছেন, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বা ‘স্বাধীনতা’, তাদের নিয়ে। এটা একটা ভুল ব্যাখ্যা। ২০১৪ সালে দনেৎস্ক ও লুহানস্কে যে স্ব-ঘোষিত প্রজাতন্ত্রগুলোর গণভোট অনুষ্ঠিত হয়, তা ‘স্বাধীনতা’ নিয়ে কোনো গণভোট ছিল না। কিন্তু কিছু অবিবেচক সাংবাদিক ঘটনাটাকে এভাবেই বর্ণনা করেন। বরং, এটা ছিল ‘রাজনৈতিক স্বাধীনতা’ বা ‘স্বায়ত্বশাসন’ নিয়ে। এছাড়া, তাদের প্রসঙ্গে কথা বলার সময় ‘রুশপন্থী’ শব্দটা ব্যবহার করা হয়। এতে মনে হয়, এই সংকটে রাশিয়ারও ভূমিকা ছিল, যা আসলে সত্য নয়। এই অঞ্চলের মানুষদের কথা বলতে গেলে ‘রুশভাষী’ শব্দটি ব্যবহার করাই যৌক্তিক বলে মনে হয়। এমনকি, এই গণভোটগুলো ভ্লাদিমির পুতিনের পরামর্শের বিপক্ষে গিয়ে করা হয়েছিল।
প্রকৃতপক্ষে, এই প্রজাতন্ত্রগুলো ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায়নি। তারা একটা স্বায়ত্বশাসিত আইনের নিশ্চয়তা চেয়েছিল, যার মাধ্যমে রুশ ভাষাকে একটা দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে। ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকভিচের সরকারের পতন হলে নতুন সরকার শুরুতেই ২০১২ সালের কিভালোভ-কলেশনিচেঙ্কো আইন বাতিল করে, যা রুশ ভাষাকে দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদা দেয়।
এই সিদ্ধান্ত রুশভাষী জনসংখ্যার ওপর বিপর্যয় নিয়ে আসে। এতে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে রুশভাষী অঞ্চলে তীব্র দমন-পীড়ন শুরু হয়। পরিস্থিতি সামরিকায়নের দিকে চলে যায়, এবং কিছু হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় (বিশেষ করে ওডেসা আর মারিউপল অঞ্চলে)। ২০১৪ সালের গ্রীষ্মের শেষ দিকে শুধুমাত্র লুহানস্ক ও দনেৎস্ক প্রজাতন্ত্রই অক্ষত থাকে।
এরকম পরিস্থিতিতে ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা শত্রুর আক্রমণের শিকার হতে থাকেন। ২০১৪-১৬ সালের দিকে দনবাস অঞ্চলে দেখা যায়, ইউক্রেনীয় জেনারেলরা একই পরিকল্পনায় অপারেশন পরিচালনা করে এসেছেন। কিন্তু স্বায়ত্বশাসনের সমর্থকরা হালকা অস্ত্র নিয়ে মোবাইল অপারেশন পরিচালনা করে। এরকম অপারেশন আমরা আফ্রিকার সাহেলে দেখতে পেয়েছি। বিদ্রোহীরা ইউক্রেনীয় বাহিনীকে বারংবার ফাঁদে ফেলতে সক্ষম হয়।
২০১৪ সালে আমি ন্যাটোতে কাজ করছিলাম। আমাদের দায়িত্ব ছিল হালকা অস্ত্রের সরবরাহ কমানো। আমরা সেখানে রুশ অস্ত্র সরবরাহ চিহ্নিত করে খুঁজে দেখার চেষ্টা করছিলাম, মস্কো এখানে জড়িত আছে কিনা। আমরা যা তথ্য পাচ্ছিলাম তা মূলত সবই ছিল পোল্যান্ডের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো থেকে, যার সাথে ইউরোপীয় নিরাপত্তা ও সহযোগিতা সংস্থার (ওএসসিই) তথ্যের মিল পাওয়া যাচ্ছিল না। বরং অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও আমরা রুশ সেনাবাহিনীর অস্ত্রের বণ্টন দেখতে পাইনি।
বিদ্রোহীরা অস্ত্র পাচ্ছিল ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর রুশভাষী সৈনিকদের পক্ষ ত্যাগ করে বিদ্রোহী দলে যোগ দেওয়ায়। ইউক্রেনীয়দের পরাজয় ঘটতে থাকায় তাদের ট্যাংক, কামান, অ্যান্টি এয়ারক্রাফট ব্যাটালিয়ন চলে আসে স্বায়ত্তশাসনের পক্ষের বাহিনীর কাছে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইউক্রেনীয়রা মিনস্ক চুক্তিতে সম্মত হতে বাধ্য হয়।
কিন্তু প্রথম মিনস্ক চুক্তি স্বাক্ষরের পর পরই ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট পেত্রো পরোশেঙ্কো, দনবাসের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বিরোধী অভিযানের ঘোষণা দেন। ন্যাটো কর্মকর্তাদের দুর্বল নির্দেশনার কারণে দেবালতসেভোর যুদ্ধে ইউক্রেনীয়দের পরাজয় ঘটলে, ইউক্রেনকে দ্বিতীয় মিনস্ক চুক্তিতে যেতে বাধ্য হতে হয়।
এখানে লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে- প্রথম মিনস্ক চুক্তি (সেপ্টেম্বর ২০১৪) ও দ্বিতীয় মিনস্ক চুক্তির (ফেব্রুয়ারি ২০১৫) কোথাও প্রজাতন্ত্রদ্বয়ের বিচ্ছিন্নতা বা স্বাধীনতার কথা বলা হয়নি। বরং, এই অঞ্চলগুলোকে ইউক্রেনের অভ্যন্তরেই স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে কার্যক্রম চালানোর কথা বলা হয়। যারা চুক্তিপত্রটি পড়ে দেখেছেন (তারা সংখ্যায় অনেক অনেক অনেক কম), তারা দেখতে পাবেন, সেখানে স্পষ্টভাবে বলা আছে- এই প্রজাতন্ত্রগুলোর স্বীকৃতি সম্পর্কে কিয়েভ ও প্রজাতন্ত্র দুটির প্রতিনিধিদের মধ্যে নিষ্পত্তি করা হবে, ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ সমাধান হিসাবে।
এ কারণে রাশিয়া ২০১৪ সাল থেকে কূটনৈতিক মধ্যস্থতার কোনো পক্ষ হিসাবে থাকতে রাজি হয়নি। কারণ, একে তারা ইউক্রেনের একটা অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হিসাবেই দেখছিল। কিন্তু ফ্রান্সের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব মিনস্ক চুক্তিকে ‘নরম্যান্ডি সংস্করণ’-এ রূপান্তরিত করার চেষ্টা করছিল, যে কারণে রাশিয়া-ইউক্রেন মুখোমুখি আসতে হয়। তবে আমাদের মনে রাখা উচিত, ২০২২ সালের ২৩-২৪ ফেব্রুয়ারির আগে দনবাসে কখনোই রুশ সেনাদের দেখা যায়নি। ওএসসিই পর্যবেক্ষকরাও দনবাসে রাশিয়ার কোনো ইউনিটের সমরযুদ্ধ পরিচালনা করার প্রমাণ পাননি। ২০২১ সালের ৩ ডিসেম্বর ওয়াশিংটন পোস্টে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা একটি মানচিত্র প্রকাশ করে, যেখানে দনবাসে রুশ সেনাদের উপস্থিতির কথা উল্লেখ ছিল না।
২০১৫ সালের অক্টোবরে ইউক্রেনের নিরাপত্তা সংস্থা (এসবিইউ) এর পরিচালক, ভাসিল রিতসাক স্বীকার করেন, দনবাসে মাত্র ৫৬ জন রুশ যোদ্ধার উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। একে নব্বই দশকে সপ্তাহান্তে বসনিয়ার যুদ্ধে যাওয়া সুইশরা, কিংবা আজকের ইউক্রেন যুদ্ধে যাওয়া ফরাসিদের সাথে তুলনা দেওয়া যেতে পারে।
ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী তখন খুব শোচনীয় অবস্থার মধ্যে ছিল। যুদ্ধের চার বছর পর ২০১৮ সালের অক্টোবরে, ইউক্রেনের প্রধান সামরিক প্রসিকিউটর আনাতোলি মাতিয়স জানান, দনবাসে ইউক্রেন ২,৭০০ সেনার প্রাণ হারিয়েছে। এদের ৮৯১ জন রোগাক্রান্ত হয়ে, ৩১৮ জন সড়ক দুর্ঘটনায়, ১৭৭ জন অন্যান্য দুর্ঘটনায়, ১৭৫ জন বিষক্রিয়ায় (অ্যালকোহল, ড্রাগ), ১৭২ জন অসতর্ক অস্ত্র পরিচালনায়, ১০১ জন নিরাপত্তা আইন ভঙ্গ করায়, ২২৮ জন হত্যাকাণ্ডে, এবং ৬১৫ জন আত্মহত্যা করে মৃত্যুবরণ করেন।
বাস্তবে, দুর্নীতিগ্রস্ত ইউক্রেন সেনাবাহিনী দেশবাসীর খুব একটা সমর্থন পায় না। যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের (হোম অফিস) এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সালের মার্চ-এপ্রিলে সংরক্ষিত সেনাদের তলব করলে প্রথম সেশনে শতকরা ৭০ ভাগ সেনাকেই দেখা যায়নি। দ্বিতীয় সেশনে ৮০ ভাগ, তৃতীয় সেশনে ৯০ ভাগ, এবং চতুর্থ সেশনে ৯৫ ভাগ সেনাসদস্যই অনুপস্থিত ছিলেন। ২০১৭ সালের অক্টোবর-নভেম্বরের ‘অটাম২০১৭’ কলব্যাক ক্যাম্পেইনে ৭০ ভাগ সেনাই অনুপস্থিত ছিলেন। এই সংখ্যাগুলো আত্মহত্যা আর সেনাবাহিনী ছেড়ে দেওয়া সদস্যদের বাদ দিয়েই হিসাব করা হয়েছিল। এতে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে মাত্র ৩০ ভাগ সেনা অবশিষ্ট ছিলেন। তরুণ ইউক্রেনীয়রা দনবাসে গিয়ে যুদ্ধে অংশ নিতে আগ্রহী নন। তারা বরং ইউক্রেন ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন, যা দেশটির জনসংখ্যা ঘাটতির অন্তত একটা আংশিক কারণ।
ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তখন ন্যাটোর দ্বারস্থ হয়, তাদের সশস্ত্র বাহিনীকে আরো ‘আকর্ষণীয়’ করে তোলার জন্য। জাতিসংঘে অনেকটা এরকম প্রকল্পে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকায় ন্যাটোর পক্ষ থেকে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার জন্য। কিন্তু এটা একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া, যা ইউক্রেনীয়রা খুব দ্রুত সম্পন্ন করতে চাচ্ছিল।
সৈনিক স্বল্পতার কারণে ইউক্রেন সরকার তখন প্যারামিলিটারি মিলিশিয়া বাহিনীর অবলম্বন নেয়। তারা ছিল মূলত বিদেশি ভাড়াটে সৈনিক, যার মাঝে অনেকেই কট্টর ডানপন্থী কর্মী। রয়টার্সের তথ্যমতে, ২০২০ সালে ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর ৪০ শতাংশই এই মিলিশিয়াদের দিয়ে গঠিত। তাদের অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও ফ্রান্স। এখানে ১৯টিরও বেশি দেশের মিলিশিয়ারা কাজ করছে, যার মাঝে সুইশরাও আছে।
সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, ইউক্রেনের কট্টর ডানপন্থী মিলিশিয়াদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে পশ্চিমা দেশগুলোই। ২০২১ সালের অক্টোবরে জেরুজালেম পোস্টে সেঞ্চুরিয়া প্রজেক্টের নিন্দা জানিয়ে সতর্কতামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। পশ্চিমাদের সমর্থনে এই মিলিশিয়া বাহিনী ২০১৪ সাল থেকে দনবাসে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। আমরা যদি তাদের কথা বলতে গিয়ে ‘নাৎসি’ শব্দটি ব্যবহার করি, তাহলে এই মিলিশিয়াদেরকে উগ্র ইহুদি বিদ্বেষী আদর্শের অনুসারী বলতে হবে। কিন্তু তাদের ইহুদি বিদ্বেষ রাজনৈতিক অবস্থানের চেয়ে বেশি সংস্কৃতিকেন্দ্রিক, যে কারণে ‘নাৎসি’ সংজ্ঞাটি তাদের সাথে পুরোপুরি যায় না। তাদের ইহুদি বিদ্বেষের শুরুটা হয় ১৯২০-১৯৩০ এর সময়ে ইউক্রেনের দুর্ভিক্ষ থেকে। স্ট্যালিন তার রেড আর্মির আধুনিকায়নের পেছনে খরচ করার জন্য ইউক্রেনের ফসলগুলো বাজেয়াপ্ত করেছিলেন, যে কারণে এই অঞ্চলের মানুষরা দুর্ভিক্ষের শিকার হয়। ইউক্রেনীয়রা এই গণহত্যাকে হলদমর বলে থাকে। এই গণহত্যার পরিকল্পনা করে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির পূর্বসূরি এনকেভিডি। এর উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা ছিলেন ইহুদি। জেরুজালেম পোস্টের রিপোর্টে দেখা যায়, এই কারণেই ইউক্রেনীয় উগ্রবাদীরা ইসরায়েলকে ক্ষমা চাইতে বলে তাদের অপরাধের জন্য। সুতরাং এখানে কেবল ভ্লাদিমির পুতিন একাই নতুন করে ইতিহাস রচনা করছেন না।
ডানপন্থী এই মিলিশিয়ারাই ২০১৪ সালে ইউরোমাইদান আন্দোলন সংঘটিত করেছিল। এই বাহিনীতে উগ্র আর নিষ্ঠুর লোক দিয়ে ভর্তি। সবচেয়ে কুখ্যাত বাহিনী হচ্ছে আজোভ রেজিমেন্ট। এদের প্রতীকের সাথে দ্বিতীয় এসএস রাইখ প্যানজার ডিভিশনের প্রতীকের মিল পাওয়া যায়। ১৯৪৩ সালে সোভিয়েতদের কাছ থেকে খারকিভ শহরকে মুক্ত করার কারণে ইউক্রেনে এই প্রতীককে সম্মানের সাথে দেখা হয়।
আজোভ রেজিমেন্টের বিখ্যাত সদস্যদের একজন হচ্ছেন রোমান প্রোতাসোভিচ, যাকে ২০২১ সালে বেলারুশ কর্তৃপক্ষ রায়ানএয়ারের বিমান থেকে গ্রেপ্তার করে। ২০২১ সালের ২৩ মে, প্রোতাসেভিচকে গ্রেপ্তার করার জন্য তাকে বহনকারী বিমানকে হাইজ্যাক করার জন্য একটা মিগ-২৯ বিমান অনুসরণ করে। এতে পুতিনের সম্মতি ছিল, যদিও এই তথ্যের নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না।
কিন্তু বেলারুশ প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কোকে তখন দুর্বৃত্ত হিসেবে উপস্থাপন করা হলো। আর প্রোতাসোভিচকে দেখানো হলো কেবলই ‘সাংবাদিক’ হিসেবে, যিনি একজন গণতন্ত্রমনা। ২০২০ সালে আমেরিকান এক এনজিওর তদন্ত প্রতিবেদনে প্রোতাসোভিচের সাথে কট্টর ডানপন্থী মিলিশিয়া কার্যক্রমের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া যায়। শেষ পর্যন্ত ২০২২ সালে, আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চালনা সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, কিছু প্রক্রিয়াগত ত্রুটি থাকলেও বেলারুশ আইন মেনেই তার কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল। রায়ানএয়ারের পাইলট মিনস্কে অবতরণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ১৫ মিনিট পর মিগ-২৯ বিমানটি উড্ডয়ন শুরু করে। সুতরাং, সেখানে বেলারুশ কর্তৃপক্ষ বা পুতিনের ষড়যন্ত্র থাকার অভিযোগের ভিত্তি নেই।
ইউক্রেনীয় প্যারামিলিটারি বাহিনীদের ‘নাৎসি’ বা ‘নব্য নাৎসি’ সম্বোধন করাকে রুশ প্রোপাগান্ডা হিসেবে দেখা হয়। সেটা হতে পারে। তবে টাইমস অব ইসরায়েল, সিমন ওয়াইসেন্থাল সেন্টার, কিংবা ওয়েস্ট পয়েন্ট একাডেমির কাউন্টারটেরোরিজম সেন্টার বিষয়টাকে কেবল রাশিয়ার প্রোপাগান্ডা হিসেবে দেখে না। ২০১৪ সালে নিউজউইক ম্যাগাজিন তাদের সাথে ইসলামিক স্টেটেরও সংযোগ দেখতে পায়। তবে এগুলো বিতর্কিত বিষয়।
পশ্চিমা বিশ্ব এই মিলিশিয়া বাহিনীকে অস্ত্রের সরবরাহ দিতে থাকে, যারা ২০১৪ সাল থেকে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ধর্ষণ, নির্যাতন, হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটিয়ে আসছে। সুইশ সরকার রাশিয়ার ওপর দ্রুত স্যাংশন অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করলেও নিজেদের জনগণের ওপর পাশবিকতা চালানো ইউক্রেনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ইউক্রেনে মানবাধিকার নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা দীর্ঘদিন ধরেই এই বাহিনীর কার্যক্রম নিয়ে নিন্দা জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু আমাদের সরকারগুলোর পক্ষ থেকে সেগুলোকে আমলে নেওয়া হয়নি। কারণ, বাস্তবে আমরা ইউক্রেনকে সাহায্য করছি না। বরং, রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাদের লড়তে সাহায্য করছি।
অনেকে দাবি করেন, প্যারামিলিটারি বাহিনীকে ইউক্রেনের ন্যাশনাল গার্ডের অন্তর্ভুক্ত করে ‘নাৎসিমুক্তকরণ’ করা হয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবে সেটা সত্য নয়। আজোভ রেজিমেন্টের প্রতীক দেখলেই সেটা বোঝা যায়।
২০২২ সালে রাশিয়ার আক্রমণকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর সংগঠিত হয়েছে এভাবে:
- প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা সেনাবাহিনী। এটা গঠিত হয়েছে তিনটি আর্মি কর্পস এবং ট্যাঙ্ক, ভারী কামান, মিসাইলের সমন্বয়ে।
- স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা ন্যাশনাল গার্ড, যা পাঁচটি আঞ্চলিক কমান্ডের সমন্বয়ে গঠিত।
ন্যাশনাল গার্ড আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা বাহিনীতে কাজ করছে, যা ইউক্রেন সেনাবাহিনীর অংশ নয়। এটা প্যারামিলিটারি বাহিনী নিয়ে গঠিত, যাদের বলা হয় “স্বেচ্ছাসেবী ব্যাটালিয়ন”। এগুলো পদাতিক বাহিনী দিয়ে গঠিত। এরা মূলত শহুরে যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষিত। তারা বর্তমানে খারকিভ, মারিউপোল (লেখকের বর্ণনার সময় মারিউপোলের পতন হয়নি), ওডেসা, কিয়েভের প্রতিরক্ষায় কাজ করছে।