রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সাবেক ন্যাটো কর্মকর্তার ইউক্রেন সংকটের বর্ণনা | শেষ পর্ব

(পর্ব ১ এর পর থেকে)

সুইস ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসে দেখেছি তারা ইউক্রেনের সামরিক পরিস্থিতি নিয়ে সঠিকভাবে অবগত নয়। এটা দেখে আমার বিস্ময়ের চেয়ে দুঃখবোধই হয়েছে বেশি। টেলিভিশনের স্ক্রিনের সামনে আসা স্বঘোষিত ‘বিশেষজ্ঞরা’ একই বুলি আওড়ে যাচ্ছেন- রাশিয়া (এবং ভ্লাদিমির পুতিন) অযৌক্তিক আচরণ করছে। তাহলে দেখে নেওয়া যাক তাদের দাবি কতটা সত্যি।

যুদ্ধের শুরু

২০২১ এর নভেম্বর থেকে, আমেরিকানরা ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের হুমকি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রচার করে আসছিল। কিন্তু ইউক্রেনীয়দের এ ব্যাপারে দ্বিমত প্রকাশ করতে দেখা যায়। কেন?

আমাদের ফিরে যেতে হবে ২০২১ সালের ২৪ মার্চে। ওই দিন ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ক্রাইমিয়া পুনর্দখলের জন্য একটা ডিক্রি জারি করেন এবং দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে তার ফোর্স মোতায়ন করেন। একইসাথে কৃষ্ণ সাগর ও বাল্টিক সাগরের মাঝামাঝি অঞ্চলে ন্যাটোর বেশ কিছু মহড়া পরিচালনা করতে দেখা যায়। রাশিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে তাদের পর্যবেক্ষক বিমানের আনাগোনাও দেখা যায়। রাশিয়া তখন তার সেনাবাহিনীর অভিযান সম্পন্ন করার মতো প্রস্তুতি আছে কিনা, তা পর্যবেক্ষণের জন্য অনুশীলন শুরু করে। রাশিয়া দেখাতে চায় তারা কেবল পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়া থেকেই তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি; Image Source: AP

এরপর অক্টোবর-নভেম্বরের আগপর্যন্ত পরিস্থিতি শান্তই থাকে। কিন্তু জেডএপিএডি২১ (ZAPAD21) অনুশীলনের শেষ হওয়ার পর, তাদের সেনাদের গতিবিধিকে ব্যাখ্যা করা হয়, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে আক্রমণ শক্তিশালী করার কার্যক্রম হিসেবে। কিন্তু ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষ রাশিয়ার যুদ্ধের প্রস্তুতির ধারণা উড়িয়ে দেয়। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেকসি রেজনিকভ ঘোষণা দেন, বসন্তের পর থেকে তাদের সীমান্ত অঞ্চলে কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি।

মিনস্ক চুক্তি ভঙ্গ করে ইউক্রেন দনবাস অঞ্চলে বিমান অভিযান পরিচালনা করে। ২০২১ এর অক্টোবরে, ইউক্রেন দনেৎস্কের অন্তত একটি জ্বালানি ডিপোতে ড্রোন হামলা করে। আমেরিকান সংবাদমাধ্যম এটা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও ইউরোপীয়রা নীরব থাকে। কেউই ইউক্রেনের চুক্তিভঙ্গ নিয়ে নিন্দা প্রকাশ করেনি।

২০২২ এর ফেব্রুয়ারিতে দ্রুতবেগে ঘটনাপ্রবাহ ঘটতে থাকে। ৭ ফেব্রুয়ারি মস্কোতে সফরের সময়, ফ্রান্স প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ পুতিনকে আশ্বস্ত করে বলেন, তিনি মিনস্ক চুক্তির সাথেই আছেন। পরের দিন জেলেনস্কির সাথে সাক্ষাতের পরও তিনি একই কথা পুনরায় ব্যক্ত করেন। কিন্তু ১১ ফেব্রুয়ারি বার্লিনে, ‘নরম্যান্ডি ফরম্যাট’-এর নেতাদের রাজনৈতিক উপদেষ্টারা ৯ ঘণ্টার বৈঠক শেষেও কোনো গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছাতে পারেননি। ইউক্রেনীয়রা তখনও মিনস্ক চুক্তির বিরোধিতা করে আসছিল। আপাতদৃষ্টিতে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ছিল। ভ্লাদিমির পুতিন তখন মাখোঁকে দায়ী করে বলেন, তিনি কেবল ফাঁপা আশ্বাস দিয়েই গেছেন। পুতিন তখন বলেন, পশ্চিমা দেশগুলো আট বছর ধরে চুক্তি অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করতে প্রস্তুত হতে পারেনি।

ফেব্রুয়ারিতে পুতিন ও মাখোঁর বৈঠক; Image Source: AFP

এদিকে দনবাস অঞ্চলে ইউক্রেনীয়দের প্রস্তুতি চলতে থাকে। রুশ আইনসভা এটা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতে থাকে। ১৫ ফেব্রুয়ারি পুতিনকে অনুরোধ জানানো হয়, দনবাসের প্রজাতন্ত্রগুলোর স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিতে। পুতিন তা প্রত্যাখ্যান করেন।

১৭ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা দেন, রাশিয়া আসন্ন দিনগুলোর কোনো এক দিন ইউক্রেনে আক্রমণ করতে যাচ্ছে। তিনি কীভাবে জানেন? সেটা এক রহস্য … কিন্তু ওএসসিই (OSCE) পর্যবেক্ষকদের প্রতিদিনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে দনবাসের জনগণের ওপর কামানের গোলাবর্ষণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু মিডিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ন্যাটো কিংবা কোনো পশ্চিমা সরকারকেই এই প্রসঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়নি। পরবর্তীতে আমরা দেখতে পাই, একে রাশিয়ার গুজব বলে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কিছু দেশের কার্যক্রম দেখে মনে হয়, তারা দনবাসের গণহত্যা নিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এমন অবস্থান নিয়েছে, যেন তা রাশিয়ার হস্তক্ষেপে উসকানি দেয়। 

একই সময়ে দনবাসে অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডের প্রতিবেদন পাওয়া যায়। ১৮ জানুয়ারি দনবাসের যোদ্ধারা, পশ্চিমা সরঞ্জামে সুসজ্জিত পোলিশভাষী নাশকতাকারীদের আটক করে। তারা গোরলিভকাতে রাসায়নিক হামলার পরিকল্পনা করছিল। তারা সিআইএ মার্সেনারি সদস্য হতে পারে, যাদেরকে আমেরিকানরা নেতৃত্ব কিংবা ‘দিক নির্দেশনা’ দিয়ে থাকে। এই মার্সেনারিগুলো গঠিত হয়েছে ইউক্রেনীয় কিংবা ইউরোপীয় যোদ্ধাদের দ্বারা, যারা দনবাস প্রজাতন্ত্র অঞ্চলগুলোতে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে।

আসলে জো বাইডেন ১৬ ফেব্রুয়ারিতেই জানতেন ইউক্রেনীয়রা দনবাসে গোলাবর্ষণ করায় পুতিন এর প্রতিক্রিয়া দেখাবেন। পুতিনের সামনে তখন দুটি পথ খোলা ছিল- দনবাসের সামরিক বাহিনীকে সাহায্য করে আন্তর্জাতিক সংকট সৃষ্টি করা, অথবা চুপচাপ বসে থেকে দনবাসের রুশভাষী জনগণকে পালাতে দেখা।

ভ্লাদিমির পুতিন যদি এখানে হস্তক্ষেপ করতে আসেন, তিনি এখানে ‘রেসপন্সিবিলিটি টু প্রটেক্ট’ (R2P) নামের আন্তর্জাতিক বিধি দেখাতে পারবেন। কিন্তু তিনি জানতেন, রাশিয়ার জড়িয়ে পড়ার মাত্রা যা-ই হোক না কেন, এর বিনিময়ে তাকে নিষেধাজ্ঞার বৃষ্টির সম্মুখীন হতে হবে। তাই ইউক্রেন প্রসঙ্গে পশ্চিমাদের চাপ দেওয়ার জন্য তিনি দনবাস বা এর বাইরে যতই অগ্রসর হন না কেন, তাকে একই প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হবে। ২১ ফেব্রুয়ারি তার ভাষণেও এটা ব্যাখ্যা করেছেন।

২১ ফেব্রুয়ারির ভাষণ দিচ্ছেন রাশিয়া প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন; Image Source: Reuters

ওই দিন তিনি ডুমার অনুরোধে সম্মত হন এবং দনবাসের দুই প্রজাতন্ত্রের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেন। এই প্রক্রিয়ায় তিনি তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন এবং তাদের প্রতি সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব ব্যক্ত করেন।

দনবাসের জনগণের ওপর ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর গোলাবর্ষণ চলতে থাকে। ২৩ ফ্রেব্রুয়ারি দুই প্রজাতন্ত্র থেকে রাশিয়ার নিকট সামরিক সহায়তার আবেদন জানানো হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারি পুতিন জাতিসংঘের ৫১ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পারস্পরিক সামরিক সহায়তার বিধি অনুযায়ী রুশ সেনাবাহিনীকে ইউক্রেনে প্রেরণ করেন।

রাশিয়ার হস্তক্ষেপকে সাধারণ জনগণের চোখে অবৈধ দেখানোর জন্য আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে এই সত্যটা আড়াল করি যে, যুদ্ধ আসলে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকেই শুরু হয়েছিল। ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী দনবাসে ২০২১ সাল থেকেই আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়ে আসছিল, যে ব্যাপারে রুশ ও ইউরোপীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানত। এ ব্যাপারে বিচারের ভার আইনজীবীদের হাতেই ছেড়ে দিলাম।

২৪ ফেব্রুয়ারি পুতিন তার অভিযান প্রসঙ্গে দুটি শব্দচয়ন করেন। একটি হচ্ছে ইউক্রেনে ‘নিরস্ত্রীকরণ’ বা ডিমিলিটারাইজেশন, এবং অন্যটি হচ্ছে ‘বিনাৎসিকরণ’ বা ডিন্যাজিফিকেশন। বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, ইউক্রেন দখল করা কিংবা একে ধ্বংস করে দেওয়া তার উদ্দেশ্য নয়।

এরপর থেকে রাশিয়ার অভিযানের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আমাদের পর্যবেক্ষণ স্পষ্ট নয়। রুশদের পরিকল্পনা সম্পর্কে বিশদ ধারণা পাওয়া যায়নি। তবে অভিযানের ঘটনাপ্রবাহ লক্ষ্য করলে তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।

ডিমিলিটারাইজেশন 

  • ইউক্রেনীয়দের বিমানবাহিনী ধ্বংস করা, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করা, এবং নজরদারি সরঞ্জাম ধ্বংস করা।
  • এই অঞ্চলের রসদ পরিবহনের পথ ও গোয়েন্দা অবকাঠামোগুলো ধ্বংস করা।
  • দেশটির দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীকে ঘিরে ফেলা। 

ডিন্যাজিফিকেশন

  • ওডেসা, খারকিভ, মারিউপোল শহর ও দেশটির অন্যান্য অঞ্চলে অবস্থান নেওয়া স্বেচ্ছাসেবী ব্যাটালিয়নগুলো ধ্বংস করে দেওয়া কিংবা নিরপেক্ষ অবস্থানে নিয়ে আসা।

নিরস্ত্রীকরণ বা ডিমিলিটারাইজেশন

রাশিয়ার আক্রমণ খুব ‘ক্লাসিক’ ঘরানার ছিল। প্রথম ঘণ্টায় তারা বিমান বাহিনীর ওপর আক্রমণ করে, যা ১৯৬৭ সালে ইসরায়েলিদের করতে দেখা যায়। এরপর আমরা দেখতে পাই, কয়েক দিক দিয়ে ‘পানির প্রবাহ’ নীতি অনুসরণ করে আক্রমণ হয়। শহরগুলোকে ছেড়ে যেদিকে প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল, সেদিকে অগ্রসর হতে দেখা যায় রুশদের। উত্তরাঞ্চলে চেরনোবিল বিদ্যুৎকেন্দ্র দ্রুত দখল নেওয়া হয় অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ করার জন্য। ইউক্রেনীয় ও রুশ সেনাদের সম্মিলিতভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত থাকার ছবিগুলো স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমা গণমাধ্যমে দেখানো হয়নি।

জেলেনস্কিকে হত্যা করে রাশিয়ার কিয়েভ দখল করে নেওয়ার তথাকথিত পরিকল্পনা পশ্চিমারাই রটিয়েছে। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়াতে তারাই এমনটা করেছে। ইসলামিক স্টেটের সহায়তায় তারা সিরিয়াতেও এমনটা করতে চেয়েছিল। কিন্তু ভ্লাদিমির পুতিনকে কখনো জেলেনস্কিকে উৎখাত করার দিকে অগ্রসর হতে দেখা যায়নি। বরং, রাশিয়া কিয়েভের চারদিক ঘিরে তাকে মীমাংসায় এসে ক্ষমতা ধরে রাখায় সাহায্য করতে চেয়েছিল। কিন্তু তিনি তখন পর্যন্ত মিনস্ক চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে এসেছেন। এখন রুশরা ইউক্রেনকে নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়।

অনেক পশ্চিমা বিশ্লেষক রুশদের একইসাথে সামরিক অভিযান চলমান রেখে কূটনৈতিক সমাধান খুঁজতে দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। এর ব্যাখ্যা হচ্ছে, সোভিয়েত আমল থেকেই এটা রুশদের কৌশলের একটা অংশ। পশ্চিমাদের কাছে যখন রাজনীতি ব্যর্থ হয়ে যায়, তখনই যুদ্ধ শুরু হয়। কিন্তু রুশরা প্রুশিয়ান সমরবিদ ক্লসউইৎজের অনুপ্রেরণায় তাদের কৌশল সাজায়। ক্লসউইৎজের নীতি অনুসারে, যুদ্ধ হচ্ছে রাজনীতিরই একটা চলমান প্রক্রিয়া; এতে যুদ্ধরত অবস্থাতেও এক পক্ষ অন্য পক্ষকে আলোচনায় আনতে পারে। এতে প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলে কূটনৈতিক মীমাংসায় আসতে বাধ্য করা যায়।   

চেরনোবিলের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে একসাথে পাহারা দিচ্ছেন রাশিয়া ও ইউক্রেনের সেনারা; Image Source: Russian Defense Ministry

সামরিক অভিযানের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবেচনা করলে, রাশিয়ার আক্রমণ ছিল এরকম- তারা ছয় দিনের মাথায় যুক্তরাজ্যের সমান ভূখণ্ড দখল করে ফেলে, যার গতি ছিল ১৯৪০ সালের নাৎসি ওয়েরমাটের চেয়েও দ্রুততর।

ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর বড় অংশ নিয়োজিত ছিল দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে দনবাসের বিরুদ্ধে অভিযানে। এ কারণে রুশ বাহিনী মার্চের শুরুর দিকে তাদের ঘিরে ফেলতে সক্ষম হয়। পূর্বদিক থেকে খারকিভে, এবং দক্ষিণ দিকে ক্রাইমিয়া থেকে রুশ সেনাদের আগমন হতে থাকে। পূর্ব দিক থেকে দনেৎস্ক ও লুহানস্ক প্রজাতন্ত্রের সেনারা রুশ সেনাদের সাথে যোগ দেয়।

এই পর্যায়ে এসে রুশ বাহিনী ফাঁসের গিট শক্ত করতে থাকে, কিন্তু তাদের তখন সময় নিয়ে কোনো চাপ ছিল না। তাদের নিরস্ত্রীকরণের লক্ষ্য পূরণ হয়েছিল। ইউক্রেনের অবশিষ্ট থাকা সেনাদের অভিযান পরিচালনা করার জন্য কৌশলগত অবকাঠামো আর ছিল না।

রাশিয়ার অভিযানের ‘গতি কমিয়ে দেওয়া’ দেখে আমাদের ‘বিশেষজ্ঞরা’ সেটাকে রুশদের রসদ ফুরিয়ে যাওয়ার দিকে ইঙ্গিত করেন। কিন্তু রাশিয়া মূলত তাদের উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে যাওয়াতেই এমন অবস্থান নিয়েছিল। পুরো ইউক্রেন অঞ্চল দখল করে নেওয়ার দিকে রাশিয়াকে আগ্রহী মনে হয়নি। বরং, রাশিয়ার অগ্রসর হওয়া কেবল তাদের ভাষাগত সীমানাতেই সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করতে দেখা গেছে।

আমাদের মিডিয়াতে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর নির্বিচারে বোমা বর্ষণের খবর দেখা যায়, বিশেষ করে খারকিভ শহরে। কিন্তু সেখানে থাকা এক ল্যাটিন আমেরিকান বিখ্যাত অধিকারকর্মী গনজালো লিরা ১০ মার্চ ও ১১ মার্চ শান্তিপূর্ণ শহরের ভিডিও দেখতে পাই। হ্যাঁ, খারকিভ অনেক বড় শহর এটা ঠিক আছে। কিন্তু টেলিভিশনের স্ক্রিনে শহরটি নিয়ে যেভাবে খবর প্রচার করা হচ্ছে, এতটা যুদ্ধাবস্থার মধ্যেও নেই এই অঞ্চলটি।

দনবাসের প্রজাতন্ত্রগুলো তাদের অঞ্চলগুলো ‘মুক্ত করে’ এখন মারিউপোলে লড়ছে।

বিনাৎসিকরণ বা ডিন্যাজিফিকেশন

খারকিভ, মারিউপোল আর ওডেসা শহরগুলোতে প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত আছে প্যারামিলিটারি মিলিশিয়ারা। তারা জানে, ‘বিনাৎসিকরণ’ এর অভিযান মূলত তাদের লক্ষ্য করেই করা হচ্ছে।

শহুরে অঞ্চলে একজন আক্রমণকারীর জন্য বেসামরিক জনসাধারণের উপস্থিতি থাকা একটা উদ্বেগের বিষয়। এ কারণে রাশিয়া মানবিক করিডোর তৈরি করতে থাকে, যেন বেসামরিক জনগণরা শহর থেকে বের হয়ে আসতে পারে, এবং মিলিশিয়াদের সহজে মোকাবিলা করতে পারে।

উগ্র আজোভ মিলিশিয়া বাহিনী; Image Source: Getty Images

অন্যদিকে, এই মিলিশিয়ারা বেসামরিক জনগণদের শহরগুলোতে আটক করে রাখে, যেন রুশরা তাদের বিরুদ্ধে লড়তে আসতে না পারে। এ কারণে তারা এসব করিডোর দিয়ে বেসামরিক লোকদের বের হতে দিতে অনাগ্রহ দেখায়। তারা রুশদের সবরকম প্রচেষ্টা ভণ্ডুল করে দিতে থাকে। তারা এই বেসামরিক জনগণকে ‘মানব বর্ম’ হিসেবে ব্যবহার করে। আমরা অনেক ভিডিও দেখতে পাই, যেখানে মারিউপোল থেকে বের হতে চাওয়া বেসামরিক জনগণদের ওপর আজোভ রেজিমেন্টের যোদ্ধারা নির্যাতন চালাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমা গণমাধ্যমে এসব বিষয় সতর্কতার সাথে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

ফেসবুক তাদের ‘বিপজ্জনক ব্যক্তি ও সংস্থা নীতি’ অনুযায়ী আজোভ গ্রুপকে ইসলামিক স্টেটের মতোই বিবেচনা করে আসছিল। এ কারণে তাদেরকে মহিমান্বিত করা কিংবা তাদের পক্ষে যায় এমন ‘পোস্ট’ দেওয়া নিষিদ্ধ করে দেওয়া হতো। কিন্তু ২৪ ফেব্রুয়ারি ফেসবুক তাদের নীতিতে পরিবর্তন আনে। তারা এই মিলিশিয়াদের পক্ষে যায় এমন পোস্ট দেওয়ার অনুমতি দেয়। একইভাবে মার্চের দিকে, প্লাটফর্মটিতে রুশ নেতা ও সৈনিকদের হত্যা করার আলোচনা চালাতেও সম্মতি দেওয়া হয়।  

আমাদের মিডিয়া জনতার প্রতিরোধ নিয়ে একটা রোমান্টিক ভাবমূর্তি প্রচার করছে। এই প্রচারের কারণেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন বেসামরিক নাগরিকদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়ার জন্য আর্থিক সাহায্য দিচ্ছে। এটা একটা ফৌজদারি অপরাধ। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা অভিযান নীতির প্রধান হিসাবে আমি বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা নিয়ে কাজ করেছি। আমরা তখন দেখেছি, বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা কেবল নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। বিশেষ করে যখন অস্ত্রের সংখ্যা অধিক হয়ে পড়ে, এবং কোনো কমান্ড না থাকে।

বর্তমানে, এই কমান্ডগুলো তাদের সামরিক লক্ষ্য অনুযায়ী বাহিনীগুলোকে ব্যবহার করে থাকে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এলোমেলোভাবে অস্ত্রের যোগান দিয়ে বেসামরিক নাগরিকদের যোদ্ধায় পরিণত করতে চাচ্ছে। এতে তাদেরকে সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হচ্ছে। কোনো কমান্ড ও অভিযানের উদ্দেশ্য ছাড়া অস্ত্রের যোগান দিতে থাকলে তা প্রতিশোধমূলক কর্মকাণ্ড, ডাকাতি আর সহিংস কার্যক্রমের দিকে নিয়ে যায়। এতে কোনো উপকারের চেয়ে আরো বিপদ ডেকে আনে বেশি। যুদ্ধ পরিণত হয় তখন আবেগের বিষয়। সশস্ত্র বাহিনী তখন সহিংস হয়ে ওঠে। ২০১১ সালের ১১-১৩ আগস্ট লিবিয়ার তাওয়ারগাতে এমনটাই দেখা গিয়েছিল। সেখানে ফ্রান্সের প্যারাশুটের মাধ্যমে অবৈধভাবে অস্ত্র যোগান দেওয়ায় ৩০ হাজার কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানকে হত্যা করা হয়। ব্রিটিশ রয়্যাল ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (RUSI) এরকম অস্ত্র সরবরাহ করায় কোনো ফায়দা দেখতে পায়নি।

তাছাড়া যুদ্ধরত থাকা অবস্থায় কোনো দেশে অস্ত্র সরবরাহ করতে গেলে, অস্ত্র সরবরাহকৃত দেশটি নিজেই যুদ্ধের অংশ হয়ে যেতে পারে। ১৩ মার্চ মিকোলাইভ বিমান ঘাঁটিতে রাশিয়া আক্রমণ করে সতর্কতা জানিয়ে দেয় যে, ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ করতে আসা যানবাহনগুলোকেও শত্রু হিসেবে বিবেচনা করা হবে।

ইউক্রেন সংকটে দেশটির বেসামরিক নাগরিকরাও অস্ত্র হাতে তুলে নিচ্ছেন; Image Source: Genya Savilov/AFP via Getty Images

ইউরোপীয় ইউনিয়ন বার্লিনের যুদ্ধের শেষ দিকের সময়গুলোতে তৃতীয় রাইখের সর্বনাশা অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি করছে। যুদ্ধকে ছেড়ে দিতে হবে কেবল সামরিক বাহিনীগুলোর হাতে। যখন এক পক্ষ পরাজিত হবে, তখন তাদের পরাজয় মেনে নিতে হবে। যদি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হয়, তবে সেটা অবশ্যই উপযুক্ত নেতৃত্ব ও শৃঙ্খলার সাথে নিতে হবে। কিন্তু আমরা করছি একেবারে উল্টোটা। আমরা বেসামরিক নাগরিকদের যুদ্ধে ঠেলে দিচ্ছি, অন্যদিকে ফেসবুক রুশ নেতা আর সৈনিকদের হত্যা করতে উসকে দিচ্ছে। পুরো ব্যাপারটি ছাইপাঁশ ছাড়া কিছুই নয়।

কিছু গোয়েন্দা সংস্থা এই দায়িত্বহীন সিদ্ধান্ত দেখে মনে করছে, পুতিনের রাশিয়ার সামনে ইউক্রেনীয় নাগরিকদেরকে ব্যবহার করা হচ্ছে কামানের গোলার খাদ্য হিসেবে। এরকম খুনে মানসিকতা উরসুলা ফন ডার লিয়েন (ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট) এর দাদার সহকর্মীদের আমলেই সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। আগুনে ঘি না ঢেলে কূটনৈতিক আলোচনায় মীমাংসা করা আর বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বুঝে নেওয়াই যৌক্তিক কাজ হতো। অন্যের রক্তের ওপর ভিত্তি করে যুদ্ধাভিলাষী হওয়া খুব সহজ।         

মারিউপোল মাতৃসদন হাসপাতাল

মারিউপোলের প্রতিরক্ষায় ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী নয়, বরং বিদেশি মার্সেনারিদের নিয়ে গঠিত আজোভ মিলিশিয়াই দায়িত্ব পালন করছে। আমাদের এই বিষয় আগে উপলব্ধি করা গুরুত্বপূর্ণ।

গত ৭ মার্চ নিউ ইয়র্কে, জাতিসংঘে রাশিয়ার পক্ষ থেকে বিবৃতি দেওয়া হয়,

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ইউক্রেনীয় সশস্ত্র বাহিনী মারিউপোল শহরের ১ নং মাতৃসদন হাসপাতাল কর্মীদের সরিয়ে নিয়ে সেখানে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করেছে।

৮ মার্চ বিকল্পধারার রুশ মিডিয়া লেন্টা, মারিউপোলের বেসামরিক নাগরিকদের বিবৃতি প্রকাশ করে। তারা জানান, আজোভ রেজিমেন্টের মিলিশিয়ারা মাতৃসদন হাসপাতালটি দখল করে নেয় এবং বেসামরিক নাগরিকদের অস্ত্র দিয়ে ভয়-ভীতি দেখায়। এর সাথে কয়েক ঘণ্টা আগে জাতিসংঘে রাশিয়ার দূতের বক্তব্যের সাদৃশ্য পাওয়া যায়।

মারিউপোল হাসপাতালের অবস্থান, ট্যাংক বিরোধী অস্ত্র ও পর্যবেক্ষণের জন্য উপযুক্ত জায়গায় ছিল। ৯ মার্চ রুশ বাহিনী এই হাসপাতাল ভবনে আক্রমণ করে। সিএনএনের খবর অনুযায়ী, এতে ১৭ জন আহত হয়। কিন্তু ফুটেজে এই হামলার কারণে কোনো হতাহত ব্যক্তি দেখা যায়নি। আমরা শিশুদের নিয়ে কথা বলছি, কিন্তু বাস্তবে আমরা কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। এটা সত্যও হতে পারে, মিথ্যাও হতে পারে। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতাদের এই ঘটনাকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া আটকে রাখতে পারেনি। জেলেনস্কি এর পর পরই ইউক্রেনে ‘নো ফ্লাই জোন’ ঘোষণা নিয়ে মাতম শুরু করে দিলেন।

প্রকৃতপক্ষে, আমরা সঠিকভাবে জানি না আসলে কী ঘটেছিল। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহের ক্রম লক্ষ করলে এটা নিশ্চিত হওয়া যায় যে, রুশ বাহিনী আজোভ রেজিমেন্টকে লক্ষ্য করে আক্রমণ চালিয়েছিল, এবং ওই সময়ে হাসপাতালে বেসামরিক নাগরিকরা ছিল না।

রাশিয়ার হামলায় বিধ্বস্ত মারিউপোলের সেই হাসপাতাল; Image Source: New York Times

সমস্যা হচ্ছে, শহরগুলোর প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত থাকা আন্তর্জাতিক সমর্থনপুষ্ট এই মিলিশিয়া বাহিনীগুলো যুদ্ধের আন্তর্জাতিক রীতি মেনে চলছে না। ইউক্রেনীয়রা যেন ১৯৯০ এর কুয়েত সিটির মাতৃসদন হাসপাতালের ঘটনা আবার ফিরিয়ে এনেছে, যেটা ছিল জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান হিল অ্যান্ড নোলটনের ১০.৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটা নাটক ছাড়া কিছুই না। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ইরাকে অপারেশন ডেজার্ট স্টর্মের বৈধতা আদায়ের জন্যই মূলত এই নাটক মঞ্চস্থ করা হয়েছিল।

পশ্চিমা রাজনীতিবিদরা আট বছর ধরে দনবাসের বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলাকেও বৈধতা দিয়ে আসছেন। তারা এর জন্য ইউক্রেন সরকারের ওপর কোনো প্রকার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেননি। আমরা এখন এক অবস্থানে পৌঁছেছি, যখন পশ্চিমা রাজনীতিবিদরা রাশিয়াকে দুর্বল করার জন্য আন্তর্জাতিক আইনেরও তোয়াক্কা করছেন না।        

উপসংহার

একজন সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসাবে আমাকে যে বিষয়টি আহত করেছে সেটা হচ্ছে, এখানকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য এক বছর ধরে কোনো পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থার উপস্থিতি ছিল না। ইউক্রেন পরিস্থিতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় সুইজারল্যান্ডে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। আসলে পুরো পশ্চিমা বিশ্বের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোই যেন রাজনীতিবিদদের আখড়া হয়ে ওঠেছে। সমস্যা হচ্ছে- এখানে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কেবল রাজনীতিবিদদের হাতেই থাকে। বিশ্বের সেরা গোয়েন্দা সংস্থা হয়েও কোনো ফায়দা নেই যদি নীতিনির্ধারকরা কর্ণপাত না করেন। এই সংকটের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটেছে।

কিছু গোয়েন্দা সংস্থা যুক্তিসঙ্গত আচরণ করলেও অন্যরা আমাদের মিডিয়ার সুরেই ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে প্রচার করে যাচ্ছে। এই সংকটে ‘নব্য ইউরোপ’ এর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি তারা বিশ্লেষণ ক্ষমতার দিক দিয়ে খুবই দুর্বল। সামরিক গুণাগুণ দিয়ে একটা পরিস্থিতি বিবেচনা করার জন্য তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বা রাজনৈতিক স্বাধীনতা থাকে না, যা তাদের কাজের জন্য প্রয়োজনীয়। তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গণ্য করার চেয়ে শত্রু মনে করাই উত্তম।

কিছু ইউরোপীয় দেশের রাজনীতিবিদরা মনে হচ্ছে এই পরিস্থিতি নিয়ে গোয়েন্দা তথ্যগুলো ইচ্ছাকৃতভাবেই এড়িয়ে গেছেন। কারণ, এগুলো তাদের রাজনৈতিক আদর্শের সাথে যায় না। তাই শুরু থেকেই এই সংকটটা যুক্তিসঙ্গত ছিল না। সংকট চলাকালে রাজনীতিবিদদের দ্বারা যেসব নথি উন্মুক্ত করা হয়েছে, খুঁজলে দেখা যাবে এগুলো বাণিজ্যিক উৎসের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে।

কিছু পশ্চিমা নেতা স্পষ্টতই একটা সংকট সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন নিরাপত্তা পরিষদে আক্রমণ দৃশ্যকল্প নিয়ে আলোচনা করেছিলেন, সেটা তার অধীনে কাজ করা হোয়াইট হাউজের টাইগার টিমের কল্পনাপ্রসূত ফল ছাড়া কিছুই নয়। ব্লিনকেন এখানে ঠিক ২০০২ সালের ডোনাল্ড রামসফেল্ডের মতো কাজ করেছেন। রামসফেল্ড ইরাকের রাসায়নিক অস্ত্র সংক্রান্ত তথ্য নিয়ে সিআইএ ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ডিঙিয়ে গিয়েছিলেন।

আজ যে নাটকীয় পরিস্থিতি দেখতে পাচ্ছি, তার কারণগুলো সম্পর্কে আমরা জ্ঞাত থাকলেও স্বীকার করতে চাইনি:

–   কৌশলগত দিক থেকে, ন্যাটোর সম্প্রসারণ হওয়া (যেটা নিয়ে এখানে আলোচনা করিনি);

–   রাজনৈতিক দিক দিয়ে, পশ্চিমাদের মিনস্ক চুক্তি মেনে না চলা;

–   এবং যুদ্ধের ময়দানের দিক দিয়ে, বছরের পর বছর ধরে দনবাসের বেসামরিক নাগরিকদের ওপর নিরবচ্ছিন্নভাবে বারংবার হামলা করা, ফেব্রুয়ারির শেষ দিক থেকে যার মাত্রা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

অন্যভাবে বললে, আমরা রুশদের আক্রমণ নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই দুঃখপ্রকাশ করছি এবং নিন্দা জ্ঞাপন করছি। কিন্তু ‘আমরা’ (যাদের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন) এমন সব পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছি, যেন তা একটা বড় সংকটে পরিণত হয়। আমরা ইউক্রেনীয় জনগণ ও এর বিশ লক্ষ শরণার্থীদের নিয়ে সহানুভূতি প্রকাশ করছি, যা একটা ভালো বিষয়। কিন্তু নিজেদের সরকারের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে আট বছর ধরে দনবাসের প্রায় সমান সংখ্যক যে ইউক্রেনীয় নাগরিকরা রাশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছে, তাদের প্রতি যদি এর সামান্য পরিমাণ সহানুভূতিও দেখাতাম, তাহলে আজকের সংকট তৈরি হতো না।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতাদের সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন; Image Source: AFP

দনবাসের জনসাধারণ যে পরিমাণ নির্যাতনের শিকার হয়েছে, সেখানের পরিস্থিতিকে ‘জেনোসাইড’ বা গণহত্যা দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা হবে কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। এই সংজ্ঞা সাধারণত হলোকাস্টের মতো বিশাল হত্যাযজ্ঞের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। তবে জেনোসাইড কনভেনশনের সংজ্ঞানুযায়ী- এর ব্যপ্তি সম্ভবত আরো বিস্তৃত। একে কী বলবেন আইনজীবীরাই ঠিক করবেন আশা করি।

এই সংকটে আমরা অবিবেচকের মতো আচরণ করছি, এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে স্যাংশনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আমরা যদি ইউক্রেনকে মিনস্ক চুক্তির প্রতি সম্মান রাখতে জোর করতে পারতাম, তাহলে এগুলোর কিছুই ঘটত না। ভ্লাদিমির পুতিনকেও আমরাই দোষ দিচ্ছি। আমাদের যা আরো আগেই করা উচিত ছিল, তা নিয়ে তো এখন ঘ্যানঘ্যান করে লাভ নেই। ইমানুয়েল মাখোঁ (যিনি কিনা এই চুক্তির জামিনদার ছিলেন এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যও), ওলাফ শলৎজ, ভলোদিমির জেলেনস্কি- এরা কেউই তাদের অঙ্গীকার রক্ষার ব্যাপারে সম্মান দেখাননি। শেষ পর্যন্ত প্রকৃত পরাজয় ঘটেছে যাদের নিজেদের দুরাবস্থা নিয়ে কথা বলার ক্ষমতা নেই তাদের।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিনস্ক চুক্তি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে, দনবাস অঞ্চলে ইউক্রেনের নিজেদের জনগণের ওপরই বোমাবর্ষণ নিয়েও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। সেটা করলে পুতিনের প্রতিক্রিয়া দেখানোর প্রয়োজনই পড়ত না। কূটনৈতিক সমাধান থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সংকট আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ২৭ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন সরকার রাশিয়ার সাথে কূটনৈতিক আলোচনায় যেতে রাজি হয়। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৪৫০ মিলিয়ন ইউরোর বাজেট পাশ করে ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করার জন্য। তখন থেকেই ইউক্রেনীয়রা মনে করছে রাশিয়ার সাথে তাদের কোনো চুক্তিতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। মারিউপোলে আজোভ রেজিমেন্টের প্রতিরোধের জন্য আরো ৫০০ মিলিয়ন ইউরোর বাজেট আসতে পারে (বর্তমানে মারিউপোল প্রায় রাশিয়ার অধীনে চলে এসেছে)।

পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থনে, ইউক্রেনে যারা রাশিয়ার সাথে মীমাংসায় যেতে যাচ্ছে, তাদের হত্যা করা হচ্ছে। রুশদের সাথে আপস-আলোচনায় থাকা ইউক্রেনীয় প্রতিনিধিদের একজন ডেনিশ কিরিয়েভকে গত ৫ মার্চ ইউক্রেনীয় গোয়েন্দা সংস্থা এসবিইউ হত্যা করে। তার অপরাধ ছিল, তিনি রাশিয়ার প্রতি বেশি সহায়ক হয়ে পড়ছিলেন, যে কারণে তাকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিয়েভের এসবিইউয়ের মূল অধিদপ্তরের সাবেক সহকারী প্রধান দিমিত্রি দিমিয়ানিকোকেও একই পরিণতি বরণ করতে হয়। তার বিরুদ্ধেও অভিযোগ ছিল রাশিয়ার সাথে চুক্তিতে যাওয়ার ক্ষেত্রে বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠা। ১০ মার্চ তাকে হত্যা করে মিরতভরেতস মিলিশিয়া (‘শান্তি স্থাপনকারী’)। এই মিলিশিয়ারা তাদের ওয়েবসাইটে ‘ইউক্রেনের শত্রু’দের তালিকা তৈরি করে থাকে। এতে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য, ঠিকানা, ফোন নাম্বার সব দেওয়া থাকে। তাদের হয়রানি করা থেকে শুরু করে হত্যা করাও জায়েজ। অনেক দেশেই এমন কার্যক্রম শাস্তিযোগ্য অপরাধ, কিন্তু ইউক্রেনের ক্ষেত্রে নয়।

অনেক পশ্চিমা নেতা চাচ্ছেন রুশ অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাক, রুশ নাগরিকরা ভোগান্তি হোক, এমনকি প্রকাশ্যে পুতিনের হত্যাকাণ্ড ঘটানোর কথাও বলছেন। তারা দেখিয়ে দিচ্ছেন, আমরা যাদের ঘৃণা করছি, তারা নিজেরাও তার চেয়ে ভিন্ন কিছু নন। প্যারা-অলিম্পিক গেমসে রুশ অ্যাথলেটদের নিষিদ্ধ করা, কিংবা রুশ শিল্পীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা পুতিনের বিরুদ্ধে লড়ার কোনো অংশ হতে পারে না।

তাছাড়া, রুশ জনগণদের যদি আমরা এই যুদ্ধের জন্য দায়ী করি, তাহলে আমাদের স্বীকার করতে হবে রাশিয়ায় গণতন্ত্র আছে। যদি তা না হয়, তাহলে একজনের দোষের জন্য কেন পুরো দেশের জনগণকে শাস্তি দিচ্ছি? আমাদের মনে রাখতে হবে, জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী সম্মিলিত শাস্তির ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আছে।

এই সংকট থেকে আমাদের বাছাই করা মানবতাবোধ নিয়ে শিক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন আছে। আমরা যদি এতই শান্তি চাই, আর ইউক্রেনীয়দের দুরবস্থা নিয়ে আমাদের যদি এতই সহানুভূতি কাজ করে, তাহলে আমরা তাদেরকে চুক্তি মেনে চলার জন্য উৎসাহিত করতে পারলাম না কেন? যেখানে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদেরও সম্মতি ছিল?

মিডিয়ার সততা নির্ধারিত হয় তারা মিউনিখ সনদ অনুযায়ী কাজ করছে কিনা সেটা দেখে। মিডিয়া কোভিড সংকটের সময় চীনের প্রতি বিদ্বেষ ছড়াতে সাহায্য করেছে। তাদের মেরুকরণের বার্তার কারণে বর্তমানে রুশদের বিরুদ্ধেও একই মনোভাব দেখা যাচ্ছে। সাংবাদিকতা পেশাটা যেন ভেঙেচুরে ক্রমেই জঙ্গিবাদে রূপ নিচ্ছে।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে আমরা যতই অবরোধ আরোপ করছি, ততই আমাদের বর্ণবাদী আচরণ প্রকট হয়ে ওঠছে। দনবাসে যে ৮ বছর ধরে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা চালানো হলো, সেটা নিয়ে পশ্চিমা রাজনীতিবিদরা কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি কেন?

সর্বোপরি, ইউক্রেন সংকটকে কি ইরাক, আফগানিস্তান বা লিবিয়ার যুদ্ধের চেয়েও নিন্দনীয় কিছু মনে হয়? যারা খুনে আর অন্যায্য যুদ্ধ শুরু করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বলেছে, তাদের ওপর আমরা কোন স্যাংশন আরোপ করেছি? ইরাক যুদ্ধের আগে আমাদের মিথ্যা তথ্য দেওয়ায় আমেরিকান জনগণদের কি আমরা কোনো শাস্তি দিয়েছি (যেহেতু আমেরিকায় গণতন্ত্র আছে)? ‘বিশ্বের সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানবিক দুর্যোগ’ ইয়েমেন সংকটের জন্য দায়ী রাষ্ট্রসমূহ, প্রতিষ্ঠান, বা রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে কি একটা স্যাংশনও আরোপ করেছি? ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষায় যে অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হয়, তাদের বিরুদ্ধে কি কোনো স্যাংশন আরোপ করেছি?

প্রশ্নগুলো করছি উত্তর বের করার জন্য। কিন্তু উত্তরগুলো খুব একটা সুখকর নয়।

Related Articles

Exit mobile version