‘ভূমিকম্প’ ও ‘সুনামি’ শব্দ দুটি কারও কাছেই নতুন নয়। এ বিষয়ে বিশদ জ্ঞান কিংবা বৈজ্ঞানিক যুক্তি সকলের জানা না থাকলেও এগুলোর মূল বিষয়টা সকলেরই জানা। বাংলাদেশে মাঝে মাঝেই এই ভূ-কম্পন অনুভব করা যায়। গত ১৩ই সেপ্টেম্বর আসামে রিখটার স্কেলে ৫.৩ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ে। আর ২০০৪ সালের সুনামি বাংলাদেশের মানুষকে এর আদ্যোপান্ত সবকিছু যে বুঝিয়ে দিয়েছে, তাও আর নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই।
সম্প্রতি এই বিষয় দুটি আবার নতুন আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। আর তা শুধু কোনো একটি দেশে নয়, বরং এগুলো নিয়ে আলোচনায় মেতে আছে সারা বিশ্ব। এর কারণ হলো ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি দ্বীপে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্প, যার সুবাদে ভয়াবহ সুনামির আগমন ঘটে এই দ্বীপে। একদিকে বিশ্বের সাধারণ মানুষজন এর ভয়াবহতা দেখে ভীত হয়ে পড়েছে, আর অন্যদিকে বৈজ্ঞানিকরা এর কারণ উদ্ভাবনের জন্য চেষ্টা করেও সফলতা পাচ্ছেন না। কীভাবে বা কেন হলো, তা কেমন যেন রহস্যঘেরা হয়েই থাকছে। তবে এ সম্পর্কে তারা কিছু নতুন ধারণা দিয়েছেন।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপ সুলাওয়েসিতে রিখটার স্কেলে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, যা বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও ভয়াবহ ভূমিকম্পের তালিকার অন্তর্ভুক্ত। তবে আতঙ্ক ও বিপদ বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ ছিল এই ভূকম্পনের ফলে সুনামির ধেয়ে আসা। সুনামির ফলে ৬ মিটার উঁচু ঢেউ ঘণ্টায় ৮০০ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানে সুলাওয়েসির শহর পালুতে।
এ সম্পর্কে জেন কানিন বলেন, “সুনামির ঢেউগুলো অন্তত দুই থেকে তিন মিটার উঁচু ছিল, আবার এর দ্বিগুণ উঁচু ঢেউও আঘাত হানে।” জেন হলেন পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার বেন্টলির কার্টিন ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের গবেষক। তিনি জাতিসংঘের আওতায় ভারতীয় মহাসাগরে সুনামি সতর্কীকরণ ব্যবস্থার সাথে কাজ করছেন।
বিপর্যস্ত শহরটির রাস্তাগুলো আনুভূমিকভাবে ফেটে যায়। একদিকে পায়ের তলার মাটির ভেঙে শেষ, আর অন্যদিকে সমুদ্রের পানি যেন তার জমে থাকা সব জঞ্জাল পালুকে দিয়ে দেয়। এরকম উভয় সংকটে বাঁচার উপায় না পেয়ে মারা যায় প্রায় ১,২০০ মানুষ, শত শত মানুষ আহত হয় এবং অনেকে নিজেদের বসতবাড়ি ও সকল সম্পত্তি হারায়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিবিজ্ঞান বিভাগের টেকটোনিক বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যাপ্টিস্ট গোমবার্ট বলেন, “অনেক সময় ভূমিকম্পের কারণে স্থলে যে কম্পন সৃষ্টি হয়, তার প্রভাব সমুদ্রতলেও পড়ে। এর ফলে সমুদ্রতলের প্লেট সরে যায় এবং সুনামির সৃষ্টি হয়।”
ইন্দোনেশিয়া ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় অবস্থিত এবং দেশটি ভারতীয় মহাসাগরে ঘেরা। তাই ইন্দোনেশিয়ার জন্য সুনামি কোনো অপরিচিত ঘটনা নয়। তবে এ ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার মাত্র ৩০ মিনিটের মাথায় এত ভয়াবহ সুনামি কেউ কল্পনাই করতে পারেনি।
কেন এই সুনামি হলো?
বিশেষজ্ঞরা এখনও এর মূল কারণ খুঁজে বের করতে পারেননি। তবে তারা যেসকল তথ্য পেয়েছেন, সেগুলোর উপর ভিত্তি করে পুরো বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করছেন। তাদের ধারণা মতে, ভূমিকম্পের পর সাধারণত সুনামি হওয়ার কারণ হলো সমুদ্রের তলদেশের টেকটোনিক প্লেটের উল্লম্বভাবে সরে যাওয়া। এর ফলে সমুদ্রের পানি নিজ স্থান থেকে সরে যায়, যা পরবর্তীতে বিশাল আকারের ঢেউয়ের রূপ নিয়ে তীরবর্তী এলাকায় আঘাত হানে।
এভাবে সুনামি সৃষ্টি হওয়ার প্রক্রিয়ার একটি বিশেষ নামও দিয়েছেন ভূমি বিশেষজ্ঞরা। একে ‘স্ট্রাইক-স্লিপ ফল্ট’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিষয়ের অধ্যাপক ফিল কামিনসের মতে, “এসব ভূমিকম্প শুধুমাত্র কিছু দুর্বল সুনামির সৃষ্টি করতে সক্ষম”। সাধারণত ভূমিকম্প যেখানে হয়, সে স্থান থেকে শত শত মাইল দূরে সমুদ্রের তলদেশে ভূমি সরে যায়। ফলে সেই স্থানের পানিতে ছোট আকারের ঘূর্ণন সৃষ্টি হয়, যা পরবর্তীতে দুর্বল প্রকৃতির সুনামির রূপ ধারণ করে। কামিনস বলেন, “এভাবে দুটি শক্তিশালী প্রাকৃতিক দুর্যোগ একসাথে হওয়া একটা অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল।” এ থেকে আসলে বোঝা যাচ্ছে, সুলাওয়েসির সুনামি সকলের নিকট কেন এত বিস্ময়ের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়া এ বিষয়ে ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক কিছু গবেষণা করেন। তিনি বলেন, “আমার প্রথম হিসাব অনুসারে ভূমিকম্পের ফলে সমুদ্রের তলদেশের ৪৯ সেন্টিমিটার বিকৃতি ঘটে।” তার মতে, এজন্য শুধুমাত্র এক মিটারের সুনামি হওয়া সম্ভবপর ছিল, তবে ৬ মিটারের সুনামি কখনই আশা করা যায় না। এর মানে অবশ্যই অন্য কোনো কিছু দায়ী এই দুর্যোগের জন্য। তার কাছে একটি ধারণা ন্যায়সঙ্গত মনে হচ্ছে। তা হলো অন্তঃসাগরীয় ভূমিধ্বস। এর সুবাদেই হয়তো এই সুনামি হয়।
সতর্কীকরণ ব্যবস্থায় কি ত্রুটি ছিল?
অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, ইন্দোনেশিয়ার আবহাওয়া ও ভূপ্রকৃতি বিষয়ক সংস্থা বিএমকেজি সুনামির বিপদসংকেত আগেই সরিয়ে ফেলে। এজন্য অনেকেই নিশ্চিন্তে বাড়ি ফেরা শুরু করে। আর এ কারণে হতাহতের পরিমাণ বেড়ে যায়। বিএমকেজির সুনামি শনাক্ত করার যন্ত্রপাতি বিগত ৬ বছরে সার্ভিসিং করা হয়নি। তাই হয়তো যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে সুনামি শনাক্ত করতে পারেনি বিএমকেজির যন্ত্রপাতি।
অবশ্য কামিনস এবং অ্যাডাম সুইজারের মতে, এটা আসলে প্রযুক্তির ব্যর্থতার জন্য নয়, বরং সঠিক শিক্ষার অভাবে হয়েছে। ২০০৪ সালের সুনামি যখন দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আঘাত হানে, তখন এর উৎপত্তি আকস্মিকভাবে ঘটে এবং উৎপত্তিস্থল ছিল উপকূলীয় অঞ্চল থেকে কয়েকশ মাইল দূরে। পক্ষান্তরে, সুলাওয়েসির সুনামি উপকূলীয় এলাকার নিকটবর্তী স্থানেই ঘটে। আর ভূমিকম্প এবং সুনামি হওয়ার মধ্যবর্তী সময়ও অনেক বেশি ছিল না। মাত্র ৩০ মিনিটের ব্যবধানে ঘটনা দুটি ঘটে। কামিনস ও সুইজারের মতামত অনুসারে, ৭.৫ মাত্রার এত ভয়াবহ ভূমিকম্পের পরপরই সুনামি না হোক, তবে আবার ভূকম্পনের আশঙ্কা তো থেকেই যায়। আর এটা বোঝার জন্য উচ্চশিক্ষাও লাগে না। শুধু প্রয়োজন হয় নিজের বুদ্ধি খাটানোর। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে সুলাওয়েসি এবং গোটা ইন্দোনেশিয়া এসকল দুর্যোগের সাথে পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও এরকম একটা কাজ করবে, তা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। আর ২০০৪ সালের ঘটনার পর বিশেষজ্ঞদের উচিত ছিল সাধারণ জনগণকে এ অবস্থায় কী করা উচিত, সেই সম্পর্কে অবগত করা। তারা বলেন, “শহরটির সাধারণ জনগণের জন্য ভূমিকম্পই সতর্কবাণী হওয়া উচিত ছিল।” উপকূলবর্তী এলাকার এত কাছের ভূকম্পনে সাথে সাথে সরকারিভাবে সতর্কবাণী প্রচার করা সম্ভব হয় না। নিজ দায়িত্বেই নিরাপদ স্থানে তাদের সরে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু কিছু ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, সেই স্থানের লোকজন তা করেনি। এ থেকে এই বিষয়ে তাদের অজ্ঞতা ও সঠিক শিক্ষার অভাব ধরা পড়ে।
সুনামি এত ধ্বংসাত্মক হওয়ার কারণ কী?
পালু শহরটির সরু আকারই এর সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কামিনসের মতে, “পালুর আকার এই দুর্যোগ এত ধ্বংসাত্মক হওয়ার কারণ হতে পারে। শহরটি সরু হওয়ার কারণে সুনামির ঘূর্ণন আরও প্রবল ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এছাড়া পালু উপসাগর গভীর হওয়ায় এখানে সুনামি দ্রুতবেগে ঘোরার সুযোগ পায়, যা একে আরও শক্তিশালী করে তোলে।” সুলাওয়েসির সুনামিতে অসচেতনতার জন্য ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়, তা সত্য, তবে ভৌগোলিক অবস্থান যে এই দুর্যোগের প্রধান কারণ, তা অস্বীকার করা যাবে না।
ভূমিকম্প ও সুনামির যুগলটি কি আসলেই অপ্রত্যাশিত ছিল?
সুইজার বলেন, “পালুর মধ্য দিয়ে বিশাল এবং শক্তিশালী ফল্ট সিস্টেম অতিক্রম করেছে। এটা প্রায় ২০০ কিলোমিটার লম্বা। এরকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ পালুতে ২০ শতকের শুরুতে ও ১৯৩৭ সালে ঘটে।” তবে এ সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি যে, সেই সময়ে সুনামিও ঘটে ছিল নাকি। ২০১৩ সালে একটি প্রতিবেদনে পালুর ফল্ট লাইন এবং এর দরুন যে ভবিষ্যতে কোনো বিপর্যয় ঘটতে পারে, তা উল্লেখ করা হয়। অর্থাৎ প্রতিবেদনটি প্রকাশের মাত্র ৫ বছরের মাথায় এই বিপর্যয় আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়।
তবে মূল প্রশ্ন হলো, ইন্দোনেশিয়া কিংবা এই গোটা মানবজাতি কি অতীত থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করতে পেরেছে? বোধহয় না। অতীতের অভিজ্ঞতা ও ইতিহাস অনেক বিপদ এবং দুর্যোগের আগাম বার্তা আগেই বলে দেয়। তবে আমরা তা কখনোই গুরুত্ব সহকারে দেখি না এবং সেগুলো মোকাবেলার জন্য কোনো ব্যবস্থাও গ্রহণ করি না, যা পরবর্তীতে আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।