বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল বেরুনোর পর এক সপ্তাহ অতিক্রান্ত হবার আগেই উত্তর-পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে রাজনৈতিক সংঘর্ষ চরমে ওঠার যথেষ্ঠ নিদর্শন দেখা গিয়েছিল। ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এই ছোট্ট রাজ্যটিতে পঁচিশ বছরের বামশাসনের অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতায় আসতেই রাজ্যজুড়ে শুরু হয়েছিল সংঘাত। বিভিন্ন এলাকায় ১৪৪ ধারাও জারি করা হয়েছিল। আর সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি এসেছিল রাজধানী আগরতলা থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বেলোনিয়াতে, যেখানে ভ্লাদিমির লেনিনের একটি আস্ত মূর্তিকে বুলডোজার দিয়ে উৎখাত করা হয়। সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে সেই মুহূর্তটিকে ধরে থাকা ভিডিও; নিন্দার ঝড় ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে।
লেনিনের মূর্তি উৎখাত করার পিছনে রয়েছে এক ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক প্রবণতা
রুশ বিপ্লবের মহানায়ক লেনিনের মূর্তি উৎখাত করার পিছনে নিজেদের কোনো হাত নেই বলে বিজেপির তরফ থেকে সাফাই দেওয়া হলেও, বিজেপির বেশকিছু উচ্চপদাধিকারী নেতাদের গলায় শোনা গিয়েছে এর সমর্থন। এমনকি ত্রিপুরা রাজ্যের রাজ্যপাল তথাগত রায়, যিনি পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মহলে কট্টর বিজেপিপন্থী বলে পরিচিত, তিনিও নিজের পদের নিরপেক্ষতা ভুলে এই কাজের প্রশংসা করেছেন। এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে বলতে শোনা গেছে যে, ভারতের মাটিতে বিদেশ নেতাদের মূর্তিস্থাপন অপ্রয়োজন। আর এক বর্ষীয়ান নেতা তো সরাসরি লেনিনকে ‘উগ্রপন্থী’ বলতেও পিছপা হননি।
ত্রিপুরায় নতুন সরকার কীভাবে তার রীতিনীতি সাজাবে সেটি তার ব্যাপার। পূর্বতন সরকারের সঙ্গে নিশ্চয়ই তার কিছু আদর্শগত ফারাক থাকবে, নাহয় এই নির্বাচনের ফলের আর মানে কী। কিন্তু ত্রিপুরায় পটপরিবর্তনের পরপরই যে বিরোধীদের গুঁড়িয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তা বেশ উদ্বেগজনক। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শাসন ক্ষমতায় অধীনদের পরিভাষা এটি নয়। সিপিএম এর কার্যালয়ে ভাংচুরের অভিযোগ বা লেনিনের পূর্ণাবয়ব মূর্তিকে ভুলুণ্ঠিত করা কিংবা রাজ্যের বিভিন্ন রাস্তার নতুন নামকরণ করার পরিকল্পনার মধ্যে একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক হিংসা চরিতার্থ করার প্রবণতা চোখে পড়ছে। আর এগুলো গণতন্ত্রের পক্ষে শুভলক্ষণ নয়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বাম শাসনের অবসান ঘটিয়েছিলেন, কিন্তু তার লড়াইটা ছিল আলাদা
সাত বছর আগে পশ্চিমবঙ্গেও ৩৪ বছরের বামশাসনের ইতি টেনেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস। ভারতে তো বটেই, এমনকি বিশ্ব জুড়েও এই ঘটনা বিশেষভাবে আলোচিত হয়। কিন্তু প্রবল উল্লাসের মধ্যেও মূর্তি উপড়ে ফেলার কোনো চিত্র তখন পশ্চিমবঙ্গে পাওয়া যায়নি। বাম সমর্থকদের ওপর নতুন শাসকদলের অনুগতরা চড়াও হলেও মূর্তি ভাঙার মতো স্লোগান শোনা যায়নি। কলকাতার লেনিন মূর্তি ভাঙারও দরকার পড়েনি।
বিজেপির লড়াই দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে; তা আদর্শগত
আসলে বামদের সঙ্গে মমতার লড়াই আর বিজেপির লড়াইয়ের মধ্যে একটি প্রাথমিক পার্থক্য রয়েছে। মমতা বামদের সঙ্গে লড়েছিলেন একটি রাজনৈতিক লড়াই। তার লক্ষ্য ছিল মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি নামক রাজনৈতিক দলটির হাত থেকে পশ্চিমবঙ্গকে মুক্ত করা। বামপন্থা সেখানে ছিল অবান্তর। এমনকি মমতা নিজেও একথা স্বীকার করেছেন একাধিকবার যে, তিনি নিজেও বামপন্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কিন্তু সিপিএম এর কার্যকলাপের ঘোর বিরোধী তার রাজনৈতিক অবস্থান। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ তথা সমগ্র ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির ভিত্তি যত নড়বড়ে হয়েছে, ততই মমতা বামপন্থী রাজনীতির জায়গাটা ছিনিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ দেখিয়েছেন। এখন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বামদের জায়গা আরও সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছে। কারণ, আদর্শগতভাবে মমতা বামপন্থা রাজনীতিকেই অনেকাংশে হাইজ্যাক করে নিয়েছেন।
কিন্তু বিজেপির ক্ষেত্রে লড়াইটা শুধুমাত্র দলকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সংঘাত নয়। দক্ষিণ ভারতের কেরালা রাজ্যে আমরা দেখেছি কীভাবে বামদের সঙ্গে বিজেপি এবং আরএসএস এর রাজনৈতিক সংঘর্ষ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে প্রাণ হারিয়েছে দুই পক্ষের সমর্থকরাই। আর এর মূলে রয়েছে দুটি চরমপন্থী রাজনৈতিক মতাদর্শের সংঘাত, যেখানে কেউ কাউকে সূচাগ্র মেদিনী ছাড়তে রাজি নয়।
এবার ত্রিপুরাতেও দেখা গেল সেই একই ছবি। আদর্শগত শত্রু বামদেরকে সরাসরি লড়াইতে হারিয়ে বিজেপির এই জয়োল্লাস অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু যেটি ভাবায় তা হলো, দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদেরও এই অদ্ভুত উল্লাসে মেতে ওঠা। দেশের শাসক হিসেবে বিজেপির দায়িত্ব আজ শুধুমাত্র একটি বিশেষ মতাদর্শে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলেই আবদ্ধ থাকে না।
প্রতিপক্ষ যে-ই হোক না কেন, যে রাজনৈতিক রঙেরই হোক না কেন, বিজেপির উচিত সবাইকে সমান সম্মান দেখানো। তবেই দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাদের নেতা নরেন্দ্র মোদী সবার কাছে যোগ্য নেতা হয়ে উঠবেন। কিন্তু এই মুহূর্তে ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী দল হিসেবে বিজেপি যদি অন্যকে ব্রাত্য মনে করে, নিজেকে অপরাজেয় মনে করতে থাকে, তাহলে সারা দেশজুড়ে বিদ্বেষের রাজনীতি আরও বাড়বে বৈ কমবে না।
গণতন্ত্র মানে সংখ্যাগরিষ্ঠতার পৈশাচিক উল্লাস নয়
গণতন্ত্রকে শক্ত করার নামে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত দেশের উপরে চাপিয়ে দেওয়ার এই সর্বনাশা খেলার এক শক্তপোক্ত বিরোধিতার আজ আশু প্রয়োজন। একদিকে অযোধ্যায় রামমন্দির তৈরি করার হুঙ্কার, অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে দেওয়ার সাবধানবাণী- এসবই সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশের পরিপন্থী। আর যদি রাজ্যপালের মতো সাংবিধানিক পদাধিকারীই সংখ্যাগরিষ্ঠতার কদর্য রাজনীতিকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেন, তাহলে কিসের ভরসায় ভারতীয় গণতন্ত্র এগোনোর কথা ভাববে?
একথা ঠিক যে, অতীতে নিজেদের স্বর্ণযুগে বামেরাও যথেচ্ছাচার করেছে; প্রতিপক্ষকে তার ন্যূনতম সম্মানটুকু দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। কিন্তু অতীতে একদল ভুল করেছিল বলে আজ আরেক দলকেও ভুল করতে হবে, তার তো কোনো মানে নেই। বিজেপির এই রাজনীতি তাদের নিজেদের নির্বাচনী জয়রথকে আরও বেগবান করেছে ঠিকই, কিন্তু তার ফলে যে সামাজিক ক্ষতি ভারতের মতো বহুমাত্রিক দেশে হয়ে যাচ্ছে, তার খেসারত দেবে কে?
আজ একদিকে বিজেপি ভারতের নানা প্রান্তে নিজেদের জয়ধ্বজা উড়াচ্ছে; তাদের জাতীয় সভাপতি অমিত শাহ গর্বের সঙ্গে জানাচ্ছেন যে, বিজেপি এখন প্রকৃতই সর্বভারতীয় দল, যা আর শুধুমাত্র হিন্দি বলয়ে সীমাবদ্ধ নয়। অন্যদিকে একথাও অস্বীকার করা যায় না যে, পূর্ব, উত্তর-পূর্ব বা দক্ষিণ ভারতে, যেখানে বিজেপি কোনোদিনই সেরকম রাজনৈতিক শক্তি ছিল না, সেখানে তাদের প্রভাব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক সংঘর্ষেরও প্রাদুর্ভাব। দক্ষিণে কেরালা, পূর্বে পশ্চিমবঙ্গ বা উত্তরপূর্বে ত্রিপুরাতে বিজেপির রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে প্রতিপক্ষদের সঙ্গে তাদের সম্মুখ সংঘর্ষ।
যদি বিজেপি সত্যিই একটি সর্বভারতীয় দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে থাকে আজকে, তবে তাকে সর্বস্তরে নিজের গ্রহণযোগ্যতাকেও প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। নির্বাচন জেতা নিশ্চয়ই রাজনীতির এক বড় অঙ্গ কিন্তু তার চেয়েও বড় হচ্ছে রাজধর্ম পালনের ক্ষমতা। বিজেপি প্রথম কাজটি খুবই সাবলীলভাবে করছে ঠিকই, কিন্তু পরের দায়িত্বটি সেভাবে পালন এখনও করতে পারেনি, এমনকি নিজেদের শক্ত ঘাঁটি হিন্দি বলয়েও নয়।
ফিচার ইমেজ: Epw