দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে দক্ষিণ আফ্রিকা-অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে আয়োজিত প্রথম টেস্ট ম্যাচকে ঘিরে যথেষ্ঠ উত্তপ্ত ছিল ক্রিকেট দুনিয়া। খেলার চতুর্থ দিনের চা-বিরতির সময়ে আয়োজক দেশের কুইন্টন ডি ককের সঙ্গে বিশ্রী বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন অস্ট্রেলিয়ার সহ-অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নার। এই জল গড়ায় ক্রিকেট প্রশাসকদের ঘর পর্যন্ত। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, স্টেডিয়ামের ড্রেসিংরুমে যাওয়ার সিঁড়িতে উত্তেজিত ওয়ার্নারকে সামলাচ্ছেন অধিনায়ক স্টিভ স্মিথ সহ তার দলের কয়েকজন খেলোয়াড়।
ঝগড়ার সূত্রপাত ঠিক কোথায়, তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও নানা সূত্রের খবর অনুযায়ী, চতুর্থ দিনে উইকেটরক্ষক কক যখন এইডান মার্করামের সঙ্গে জুটি বেঁধে দক্ষিণ আফ্রিকাকে লড়াইয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসছেন, তখন ওয়ার্নার নাকি তাকে নানাভাবে উত্যক্ত করেন। এরপর কক ওয়ার্নারের স্ত্রীকে নিয়ে পাল্টা কিছু বললে অস্ট্রেলীয় সহ-অধিনায়কও ককের বোনকে নিয়ে কিছু বলেন। আর এতেই বাদানুবাদ আরও দীর্ঘ হতে থাকে এবং ২২ গজের গণ্ডি ছাড়িয়ে তা ড্রেসিংরুম পর্যন্ত চলে আসে। ওয়ার্নার-কক ছাড়াও দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যান এবি ডি ভিলিয়ার্সকে রান আউট করে টিপ্পনি কাটার জন্যেও শাস্তির মুখে পড়েন অস্ট্রেলীয় স্পিনার নাথান লায়ন।
কিন্তু কক-ওয়ার্নারের এই কলহ তুলছে একটি বড় প্রশ্ন। ক্রিকেটে স্লেজিং নতুন কোনো ঘটনা নয়। বিশেষ করে সাদা চামড়ার ক্রিকেটপ্রভুরা আগাগোড়াই স্লেজিংকে খেলার একটি অলিখিত স্কিল হিসেবে ব্যবহার করে এসেছেন। স্লেজিং মাঝেমধ্যে মাত্রা ছাড়িয়ে বড় বিতর্কের আকারও ধারণ করেছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে স্লেজিং যেন আগাগোড়া কেবলই বিতর্কের বিষয় হয়ে উঠেছে। খেলায় টিপ্পনি কাটার মাধ্যমে সূক্ষ্ম রসবোধের আদানপ্রদান কি তবে অতীত?
ইতিহাস বলে ক্রিকেটে ব্যক্তিগত টিপ্পনিও অনেক ক্ষেত্রে রোষের চেয়ে রসকেই প্রাধান্য দিয়েছে। প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যেও খেলোয়াড়দের রসবোধ ক্রিকেটকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। বর্তমান সময়ে প্রচণ্ড পেশাগত চাপে যেন খেলা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সূক্ষ্ম রসবোধগুলো, সামান্য টিপ্পনি থেকে হয়ে উঠছে বড় বিতর্ক।
অতীতেও ক্রিকেট মাঠে টিপ্পনি কাটা হলেও তাতে ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে হাতাহাতির উপক্রম হবার নজির ছিল খুব কম। বিপক্ষের কেউ কিছু বললে, এমনকি তা ব্যক্তিগত পর্যায়ে হলেও, মুখে মুখেই তার যোগ্য জবাব দিয়ে দিতেন খেলোয়াড়রা। আর খেলা কভার করতে আসা সাংবাদিক কিংবা দেখতে আসা দর্শকরা সেসব উপভোগ করতেন রীতিমতো। এখনকার মতো কথায় কথায় আইনি পর্যবেক্ষকদের ডাক পড়ত না।
“আমার পরিবারে আমিই সেরা খেলোয়াড়”
যেমন- ২০০১ সালে ইংল্যান্ডের ওভালে অ্যাশেজ সিরিজের পঞ্চম টেস্ট ম্যাচের কথা ধরা যাক। ব্যাট করতে এসেছেন ইংল্যান্ডের অখ্যাত খেলোয়াড় জেমস অর্মন্ড। অস্ট্রেলিয়ার মার্ক ওয়াহ, যিনি তখন স্লিপে ফিল্ডিং করছিলেন, অর্মন্ডকে কটূক্তি করে বললেন, “এই যে! তুমি এখানে কী করছো? ইংল্যান্ডের হয়ে খেলার যোগ্যতা কি তোমার রয়েছে ?” অর্মন্ড এর তখন সপাট জবাব, “হতে পারে আমি যোগ্য নই, কিন্তু অন্তত নিজের পরিবারে আমিই সেরা।”
এখানে পাঠককে মনে করিয়ে দেওয়া ভালো যে, মার্ক ওয়াহ ভালো ব্যাটসম্যান হলেও অস্ট্রেলিয়া দলে তারই ভাই স্টিভ ওয়াহকে তুলনায় উন্নততর ব্যাটসম্যান হিসেবে দেখা হতো। সেদিন অর্মন্ড পাল্টা জবাব দেন ওয়াহ ভাইদের সেই তুলনাকে লক্ষ্য করেই। সিরিজটি অস্ট্রেলিয়া ৪-১ এ জিতলেও সেদিনের সেই বাগযুদ্ধে অর্মন্ডই যে বাজিমাত করেন, তা নিয়ে দ্বিমত নেই।
“তোমার স্ত্রী আর আমার সন্তানরা কেমন আছে?”
এর আগে, ১৯৮৬-৮৭ সালের অ্যাশেজ সিরিজেও দেখা গিয়েছিল আরও একটি স্লেজিং, যা পরে সর্বকালের সবচেয়ে আলোচিত স্লেজিং হিসেবে চিহ্নিত হয়। আর এই অধ্যায়ের দুই কুশীলব ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার উইকেটরক্ষক রডনি মার্শ এবং ইংল্যান্ডের প্রখ্যাত অলরাউন্ডার ইয়ান বোথাম।
দুরন্ত ফর্মে থাকা বোথামকে বিব্রত করতে মার্শ তাকে জিজ্ঞেস করেন, “তোমার স্ত্রী আর আমার সন্তানরা কেমন আছে?” বিন্দুমাত্র না থমকে বোথাম জবাব দেন, “স্ত্রী ভালোই আছে, তবে সন্তানগুলো হয়েছে গর্দভ।” আজকের দিনে হলে এই স্লেজিংয়ের প্রভাব বেরসিকরা কীভাবে নিতেন জানা নেই, কিন্তু একবাক্যে এর চেয়ে ভালো রসপূর্ণ স্লেজিং আর হয় না বললেই চলে।
“ক্রিকেট খেলার পক্ষে তুমি একটু বেশিই মোটা”
১৯৯০ সালে অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেড ওভালে অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হয় পাকিস্তান। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করছেন পাকিস্তানের জাভেদ মিয়াঁদাদ, ক্রিকেট বিশ্বে যিনি বদরাগী খেলোয়াড় হিসেবে বেশ কুখ্যাত। মিয়াঁদাদ টার্গেট করেন অস্ট্রেলিয়ার বিরাট গোঁফওয়ালা বোলার মার্ভ হিউজেসকে। ব্যাটিংয়ের ফাঁকে মিয়াঁদাদ হিউজেসকে ডাকেন ‘বাস ড্রাইভার’ বলেও। মিয়াঁদাদের কটূক্তিটি ছিল, “ক্রিকেট খেলার পক্ষে তুমি একটু বেশিই মোটা। তুমি বরং বাস ড্রাইভার হিসেবে বেশি উপযুক্ত।”
বেশ কিছুক্ষণ টিপ্পনি চলার পরে সেই হিউজেসের বলেই মিয়াঁদাদ ক্যাচ আউট হন। আর তিনি যখন ফিরছেন প্যাভিলিয়নে, তখন হিউজেস নেন তার মোক্ষম প্রতিশোধটি। মিয়াঁদাদের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বলেন, “টিকিটস প্লিজ!” পরবর্তীকালে অ্যালান বোর্ডার এবং সাইমন ডুলের সঙ্গে বসে সেই মিয়াঁদাদকাণ্ডের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে হাসিতে ফেটে পড়েন হিউজেস। আর এখানেই ক্রিকেটের জয়।
অতীতের এই স্লেজিংয়ের ঘটনাগুলোর কোনোটিই সীমা ছাড়ায়নি কারণ, সংশ্লিষ্ট খেলোয়াড়রা মাঠের জবাব মাঠেই দিয়ে এসেছেন। কিন্তু ডারবানে দেখা গেল, খেলোয়াড়রা মাঠের কাদা ছোঁড়াছুড়ির রেশ বয়ে বেড়াচ্ছেন মাঠের বাইরেও, আর তেড়ে যাচ্ছেন একে অপরের দিকে। এমনকি খেলোয়াড়দের পরিবারের সদস্যরাও জড়িয়ে পড়ছেন এই বিবাদে, যেমনটি পড়েছেন ডি ককের বোন ডালিয়ান। ভাইয়ের সঙ্গে ওয়ার্নারের কথা কাটাকাটির পর তিনিও টুইটে অস্ট্রেলীয় সহ-অধিনায়ককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি দেন। এই সমস্ত ঘটনার ফলে খেলা আর নিছক খেলা থাকে না। তা রীতিমতো ব্যক্তিগত মর্যাদার লড়াই হয়ে দাঁড়ায়।
কিন্তু ক্রিকেটের রসপূর্ণ ঝগড়া হারিয়ে গেলে তা খেলাটির জন্য মোটেই শুভকর কোনো ব্যাপার নয়। একদা ভদ্রলোকের খেলা নাম খ্যাত ক্রিকেট থেকে রসবোধ বিদায় নিলে তা থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেবেন রুচিসম্মত মানুষজন। ভিক্টরীয় নীতিবোধ কালের নিয়মে হারাবে তা জানা কথাই, কিন্তু তাই বলে খেলার মাঠে স্পোর্টিং স্পিরিটটাই হারিয়ে যাবে, এ কেমন কথা?
আমরা ক্রিকেটকে প্রতিনিয়ত আইনের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে দেখতে চাই না। রুচির বিসর্জন দিয়ে অমার্জিত কলহের মধ্যে এই সুন্দর খেলাটি হারিয়ে যাক, চাই না তা-ও। কিন্তু সেটি যাতে না হয় এবং ক্রিকেটের অপার সৌন্দর্য যাতে বেঁচে থাকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম, তার দায়িত্ব নিতে হবে বর্তমান কাণ্ডারিদেরই। ডেভিড ওয়ার্নাররা এই সময়ের ক্রিকেটের প্রতিষ্ঠিত নাম। তারাই যদি আজ খেলাটির সম্মানহানির খেলায় মাতেন, তবে ক্রিকেটের কৌলিন্যকে ভরসা যোগাবে কে?
ফিচার ইমেজ: bbc.com