অবশেষে আসামে প্রকাশিত হলো বহুল প্রতীক্ষিত ও আলোচিত ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনের বৈধ নাগরিক শনাক্তকরণের প্রথম খসড়া তালিকা। উক্ত তালিকায় ১.৯ কোটি মানুষকে ‘বৈধ’ তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। আসামের মোট ৩.২৯ কোটি অধিবাসীর ভেতর চালানো এ আদমশুমারিতে একাধিক দফায় খসড়া প্রস্তুতের মাধ্যমে বৈধ নাগরিকদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুতের কাজ চলছে। রাজ্যে থাকা অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসী বিতাড়নের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে একে মনে করা হচ্ছে।
রেজিস্টার জেনারেল মি. শৈলেশ জানিয়েছেন, বাকি ১.৩৯ কোটি নামের ব্যাপারে যাচাই বাছাই চলছে, নিরীক্ষণের সমস্ত প্রক্রিয়া শেষ করে সুপ্রিম কোর্টের আদিষ্ট তারিখের মাঝে শীঘ্রই আরেকটি খসড়া তালিকা প্রকাশ করা হবে। প্রথম ‘বৈধ’ তালিকায় যাদের নাম আসেনি তাদের উদ্বিগ্ন না হয়ে পরবর্তী তালিকার জন্য অপেক্ষা করতে বলেছেন এনআরসির রাজ্য সমন্বয়ক প্রতীক হাজেলা। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালও তালিকায় নাম না আসা ‘প্রকৃত নাগরিক’দের দুশ্চিন্তা করতে বারণ করে আশ্বস্ত করেছেন। এদিকে ‘বৈধ’ তালিকায় স্থান না পেয়ে বিতাড়নের আশঙ্কায় দিন পার করছেন রাজ্যটিতে ‘অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসী’ তকমাধারী লক্ষ লক্ষ বাঙালি, যাদের বেশিরভাগই মুসলিম।
এর আগে শুমারীর ফল প্রকাশকে কেন্দ্র করে পুরো রাজ্য, বিশেষত সীমান্তবর্তী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছিলো। অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসী বিরোধী জনরোষ ও বৈধ-অবৈধ দোলাচলের মাঝে মুসলিমদের সন্ত্রস্ততা ও উদ্বিগ্নতার দরুন চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছিলো সবখানেই। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে রাজ্য কর্তৃক নিয়োগকৃত ২৫০ কোম্পানি ও কেন্দ্র কর্তৃক নিয়োগকৃত আরো ২২০ কোম্পানি আধা-সামরিক বাহিনী দায়িত্বরত ছিলো। এছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় মোতায়েন ছিলেন ৪৫ হাজার সেনাসদস্য।
উল্লেখ্য, ভারতে আসামই একমাত্র রাজ্য যাদের ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন রয়েছে, ১৯৫১ সালের পর এই রাজ্যেই আবারও এনআরসির নিবন্ধন হলো।
প্রায় ৬৭ বছর পর আসামে আবার এনআরসি: কেন ও কীভাবে
বহুদিন ধরেই আসামে অবৈধ ‘বাংলাদেশী’ অভিবাসীদের বিতাড়নের জন্য আন্দোলন করে আসছে বিভিন্ন সংগঠন। এদের মধ্যে নেতৃত্বস্থানীয় ‘অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস ইউনিয়ন’ ১৯৭৯ সাল থেকে আন্দোলন চালিয়ে আসছে। আন্দোলনের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে ১৯৮৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি আসামের নঁগাও জেলার নেলী নামক স্থানে এক ভয়াবহ দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছিলেন দুই হাজারের অধিক ‘বাংলাদেশী অভিবাসী’ আখ্যায়িত বাঙালি মুসলিম। বেসরকারি কোনো কোনো হিসেব মতে, সংখ্যাটি প্রায় ৫,০০০। ১৯৮৫ সালে নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর উপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের সাথে আন্দোলনকারীদের ‘আসাম চুক্তি‘ স্বাক্ষরিত হয়, এতে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে গেলেও অভিবাসন সংকটের অনেক ইস্যুই থেকে যায় অমীমাংসিত। ২০০৫ সালে কংগ্রেস আমলে পুনরায় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের সাথে ‘অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস ইউনিয়ন’ এর একাধিক বৈঠকে অমীমাংসিত ইস্যুগুলো চাঙ্গা হয় এবং অবৈধ অভিবাসীদের ব্যাপারে নতুন করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। ২০১৩ এর ডিসেম্বর থেকে নাগরিকশুমারির প্রস্তুতি গ্রহণের সাথে গত সাড়ে তিন বছর যাবত ৪০ এর অধিক শুনানী হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে এ সংকট সমাধান প্রসঙ্গে।
এদিকে এত সব উদ্যোগের পালে নতুন হাওয়া হয়ে আসে বিজেপির আগমন। আসামে বাংলাদেশী অভিবাসীদের বিরুদ্ধে থাকা ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়ে এ রাজ্যে ২০১৬-তে প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় আসে বিজেপি। নরেন্দ্র মোদী নিজেও নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হিসেবে বাংলাদেশী অভিবাসীদের বিতাড়নের কথা বলেছিলেন। তাই ক্ষমতায় আসার পর দৃশ্যত কোনো উদ্যোগ নেবার তাগাদা বিজেপির ভেতর আগে থেকেই ছিলো। আর যেহেতু কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারেই বিজেপি ক্ষমতাসীন, তাই মোটামুটি নির্বিঘ্নেই অভিবাসী সংকট সমাধানের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ‘বৈধ’ নাগরিকদের তালিকা প্রকাশের এ শুমারী আয়োজন করা সম্ভবপর হয়। সুপ্রিম কোর্ট পুরো প্রক্রিয়া তদারকের পাশাপাশি ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বৈধ নাগরিকদের প্রথম তালিকার খসড়া প্রকাশ করার আদেশ দেয়। এর সূত্র ধরেই ৬৭ বছর পর আসামে আবার এনআরসি শুমারী লব্ধ ‘বৈধ’ নাগরিকদের নামের প্রথম খসড়া তালিকা ৩১ ডিসেম্বর রাতে প্রকাশিত হয়।
কারা বৈধ নাগরিক আর কারা অবৈধ বাংলাদেশী
১৯৫১ সালের আদমশুমারীর পরও পূর্ববঙ্গ (তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তান) থেকে অনেকে আসামে চলে যান। এ স্থানান্তর দেশ বিভাগের পরে হলেও ‘৪৭ পরবর্তী অভিবাসীদের একটি বড় অংশকে ছাড় দেয়া হয়। কেননা ১৯৬৪ সালের পাক-ভারত যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়েছিলো। ঐ যুদ্ধ বা যুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতির পর যারা আসামে এসেছেন, তাদের অভিবাসনকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে/হচ্ছে বৈধ নাগরিকত্বের মাধ্যমে। তবে অভিবাসনের এই ঢলকে ১৯৭১ এর ২৪ মার্চ পর্যন্ত বৈধতা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করার দিনটি থেকে আজ অবধি বাংলাদেশ ভূখণ্ড থেকে যারাই এসেছেন আসামে, সকলকে অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসী গণ্য করা হয়/হবে।
এই প্রক্রিয়ার অধীনে ১৯৫১ এর শুমারীতে নাগরিক ঘোষিত কিংবা একাত্তরের পূর্বে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের অধীনে সরকারি কর্মকাণ্ডে নথিভুক্ত কোনো না কোনো আত্মীয়ের সাথে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করতে হয়েছে পরবর্তী প্রজন্মের সকলকে। এ প্রক্রিয়ার নিয়মের গ্যাঁড়াকলে ফাঁসতে চলেছেন অসংখ্য মানুষ, যারা কয়েক পুরুষ ধরে আসামে বাস করলেও নিজেদের শিক্ষার অভাব কিংবা পূর্ব পুরুষ অশিক্ষিত থাকার দরুণ উপযুক্ত বৈধতার নথি প্রমাণ হাজির করতে পারেননি।
২০১৫ এর মে মাসে আবেদন প্রক্রিয়া শুরু হয়। আসাম জুড়ে ৬৮.২৭ লক্ষ পরিবার থেকে সাড়ে ছয় কোটি নথি সংগ্রহ করা হয়েছে।
মুসলিমদের মাঝে শঙ্কা
আসামে অবৈধ অভিবাসী ইস্যুকে ঘিরে সকল দাঙ্গাতেই মুসলিমরা সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হয়েছেন। পাশাপাশি রাজ্যে ডানপন্থী রাজনীতির উত্থানের ফলে সংখ্যালঘুরা স্বাভাবিকভাবেই খানিকটা কোণঠাসা। জাতি বা ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে নথিপ্রমাণের ভিত্তিতে শুমারী চালানো হচ্ছে বলে দাবি করা হয়েছিলো আসামের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হতে। কিন্তু একেবারে ধর্ম বা জাতের ঊর্ধ্বে যে সরকারী নীতিগত অবস্থান থাকছে না, তা-ও স্পষ্ট অর্থমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার কথায়-
“অবৈধ বাংলাদেশীদের সনাক্ত করে বাংলাদেশে পাঠানো হবে। হিন্দুরা বাংলাদেশে নির্যাতিত। কেন্দ্রীয় নীতি মেনে তারা ছাড় পাবেন।”
এ বক্তব্য থেকে এটি সুস্পষ্ট যে, অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসী বিতাড়নের কথা বলা হলেও মূল খড়গ মুসলিমদের ওপরেই পড়বে। এই প্রক্রিয়ায় বা তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় রাজ্যের প্রকৃত মুসলিমরাও মোটাদাগে মূল ধারার অন্যান্য অসমিয়া বা ভারতীয়দের কাছে বাঁকা চোখে চিত্রায়িত হবেন, আল জাজিরার কাছে সাক্ষাৎকারে এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন রাজ্যটির মানবাধিকার আইনজীবী আমান ওয়াদুদ।
অন্যদিকে বিজেপির মুখপাত্র সুধাংশু মিত্তাল, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও অবৈধ অভিবাসন বিরোধী ‘প্রবজন বিরোধী মঞ্চ’র প্রতিষ্ঠাতা উপমন্যু হাজারিকা দুজনই আলাদা আলাদাভাবে একটি সাধারণ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, তা হলো, রাজ্যটিতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা বেড়ে যাচ্ছে, যাদের বেশিরভাগই অবৈধ বাংলাদেশী মুসলিম। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া হিন্দু অভিবাসীদের ব্যাপারে কিছুটা নরম ভূমিকায় রয়েছে বিজেপি সরকার ও সরকারপন্থীরা। তাই জমি আর চাকরিতে ভাগ বসানো এসব অবৈধ অভিবাসীদের ব্যাপারে যতটা ধর্ম নির্বিশেষে ‘বাংলাদেশী’ পরিচয়টি উঠে আসছে, রাজনৈতিক কারণে তার থেকে বেশি উঠে আসছে ‘মুসলিম’ পরিচয়টি। আর এ কারণেই আসামের ‘প্রকৃত’, ‘অপ্রকৃত’ সব ধরনের মুসলিম বাসিন্দাই কিছুটা চাপে আছেন।
তবে খসড়া বা আসন্ন চূড়ান্ত তালিকায় নাম না আসা, অর্থাৎ ‘অবৈধ’ স্বীকৃতদের বিতাড়নের প্রক্রিয়াটি কীরূপ হবে বা তাদের আদৌ বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে কিনা, তা এখনো নিশ্চিত নয়। এমনকি এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের ভূমিকাই বা কী হবে, এ ব্যাপারটিও ধোঁয়াশায় রয়ে গেছে। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, বিতাড়ন পরিকল্পনা সম্পর্কে তারা কিছু জানেন না৷ রয়টার্সকে তিনি বলেন-
‘‘আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কোনোভাবেই ভারতের সরকারের কাছ থেকে আমরা এ ব্যাপারে কোনো তথ্য পাইনি।’’
ফিচার ইমেজ: thenortheasttoday.com