চলে গেলেন বিখ্যাত মার্কিন শেফ, লেখক ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব অ্যান্থনি বারডেইন। শুক্রবার সকালে নিজ হোটেল রুমে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। ধারণা করা হচ্ছে, আত্মহত্যাই করেছেন বারডেইন। ফ্রান্সের স্ট্রাসবার্গে সিএনএনের একটি টিভি সিরিজ ‘পার্টস আননৌন’ এর শুটিংয়ে ছিলেন তিনি। কেইসারবার্গের লা চ্যাম্বার্ড লাক্সারি হোটেলে বারডেইনের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে ফ্রান্সের অ্যালসেসের স্থানীয় প্রশাসন। এএফপির বরাতে জানানো হয়েছে, মৃত্যু সম্বন্ধীয় সন্দেহজনক কোনো আলামত সেখানে পাওয়া যায়নি। দীর্ঘ দুই দশক ধরে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করে সে দেশের সংস্কৃতি, রান্না ও জনজীবনকে খাবারের প্লেটে, বইতে, টেলিভিশনের ফ্রেমে তুলে ধরেছেন।
কেন এত বিখ্যাত বারডেইন
২০০০ সালে তিনি প্রথম খ্যাতি অর্জন করেন তার ‘Kitchen Confidential: Adventures in the Culinary Underbelly’ বইটি লিখে, যেটি হয়েছিল সে সময়ের বেস্ট সেলার। ‘ওউট’ (Haute) কুইজিন বা অতি-অভিজাত হোটেলের বহুমূল্য খাবারসমূহের বিব্রতকর অনেক হাঁড়ির খবর ফাঁস করেন বারডেইন। সেই সঙ্গে বইটিতে এসেছিল কোকেইন, হেরোইন, এলএসডির মতো মারণ-মাদকের অপব্যবহারের প্রসঙ্গ।
ফুড-ভ্লগার বারডেইন ছিলেন বিশ্ব পরিব্রাজক। নিজের ফুড-ট্র্যাভেল শো শ্যুট করতে গিয়ে বছরের ২৫০ দিনই দেশে-বিদেশে ঘুরে কাটিয়েছেন তিনি। এ কাজ করতে গিয়ে লিবিয়া, লেবানন, গাজার বিপজ্জনক উপত্যকায় পর্যন্ত দিন গুজরান হয়েছে তার।
টেলিভিশন পর্দায় তার প্রথম আবির্ভাব ২০০২ সালে, ‘আ কুকস ট্যুর’ শো নিয়ে। তিন বছর পর ‘অ্যান্থনি বারডেইন: নো রিজার্ভেশন’ নামক শো দিয়ে পান তুমুল দর্শকপ্রিয়তা। এরপর ২০১৩ সালে তিনি ‘পার্টস আননৌন’ নামে নতুন শো নিয়ে যোগ দেন সিএনএনে। বর্তমানে শো-টির ১১ তম সিজন চলছিলো। এ শো-র জন্য ২০১৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত টানা চারবার এমি অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন তিনি।
তাকে বলা হত রন্ধনজগতের ‘আসল রকস্টার’, ‘ব্যাডবয়’। এমনকি শেফদের ‘এলভিস’-ও বলা হত তাকে। ২০১৩ সালে সেরা টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি পান পিবডি অ্যাওয়ার্ড। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ছিলেন তার বিরাট ভক্ত। একবার ভিয়েতনামে বেড়াতে গিয়ে ওবামা শুনলেন যে বারডেইনও সেখানে আছেন। এরপর বারডেইনের সাথে হ্যানয়ের এক সস্তা রেস্তোরাঁয় ৬ ডলার দিয়ে গ্রিল্ড শূকর ও নুডলস খেয়েছিলেন ওবামা।
প্রারম্ভ ও ব্যক্তিজীবন
বারডেইনের জন্ম নিউ জার্সির লিওনিয়াতে। তার বাবা ছিলেন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট ও পেশায় নথি সংগ্রাহক। মা ছিলেন নিউ ইয়র্ক টাইমসের কপি এডিটর। কৈশোরকে তিনি নিজ ভাষায় বর্ণনা করেছিলেন, “আমি ছিলাম একজন সুখী ডিশ-ওয়াশার! জীবনে সবচেয়ে বেশি শিখেছি সেই সময়টাতেই।” অবশ্য কতটা ‘সুখী’ ছিলেন তা নিয়ে পাঠক বিভ্রান্ত হতেই পারেন, কারণ এই ব্যক্তির তারুণ্যের অসংখ্য সকালের শুরু হয়েছে হেরোইন সেবন করে। নিউ ইয়র্কের ভ্যাসার কলেজে ২ বছর পড়ে আর মন টেকাতে পারেননি তিনি, ভর্তি হয়েছিলেন কালনারি স্কুলে। সেখানেও ড্রপ আউট হয়ে তিনি পুরো মনঃসংযোগ দিলেন রান্নায়, বনে গেলেন রেস্তোরাঁর শেফ!
১৯৮৫ সালে তিনি বিয়ে করেছিলেন হাইস্কুলের প্রেমিকা ন্যান্সি পুতকোস্কিকে। ১৯৯৩ সালের ঘটনা, তার এক বন্ধু একবার তাকে একটি ‘ফ্রি অফার’ দিলেন। শর্ত ছিল, মুফতে মেক্সিকোর কজুমেলে ছুটি কাটাতে দেবেন বারডেইনকে, বিনিময়ে সেখান থেকে ফিরে লিখতে হবে একটি বই। বলা বাহুল্য, ভ্রমণ-পাগল বারডেইন সুযোগটি লুফে নিতে ভুল করেননি। সেই ছিলো তার লেখার শুরু। সেই সফর শেষের ছয় মাসেরও কম সময়ে তিনি লিখে ফেলেন তার প্রথম বই, ‘বৌন ইন দ্য থ্রোট’, যা ছিল একটি প্রহসনধর্মী অপরাধ-উপন্যাস। তখন তিনি নিউ ইয়র্কের ব্রডওয়ে অ্যাভিনিউয়ের বিখ্যাত সুলিভান’স হোটেলে বাবুর্চি ছিলেন। এর ৬ বছর পর ‘ডোন্ট ইট বিফোর রিডিং দিস’ নামে আরো একটি বই লিখলেও আলোচনায় আসতে ব্যর্থ হন। তার দুই বছর বাদে তিনি আলোচনায় আসেন বেস্ট সেলার বইটি দিয়েই, যার কথা ওপরে বলা হয়েছে।
ন্যান্সির সাথে ২০ বছরের সংসার ভাঙার দু’ বছর পর ২০০৭ সালে বারডেইন বিয়ে করেন মিক্সড মার্শাল আর্টিস্ট অটাভিয়া বুসিয়াকে। সে বছরই এক সন্তান আসে এ দম্পতির কোল আলো করে। ২০১৬ সালে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। বারডেইন অবশ্য এ বিচ্ছেদের জন্য নিজের অবিরাম ভ্রমণের ব্যস্ততাকেই দুষেছিলেন। গত বছর তিনি সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন ইতালিয়ান অভিনেত্রী এশিয়া আর্জেন্টোর সাথে। যারা হার্ভি ওয়েইনস্টেইনের যৌন কেলেঙ্কারির ঘটনা সম্পর্কে অবহিত আছেন, তাদের কাছে নামটি নিশ্চয়ই চেনা লাগছে? জি, এই অভিনেত্রীকেই ধর্ষণ করেছিলেন হলিউড প্রযোজক হার্ভি। উক্ত ইস্যুটি যখন নিউ ইয়র্ক টাইমস ও নিউ ইয়র্কারের মাধ্যমে পাদপ্রদীপের আলোয় এলো, তখন সামাজিক মাধ্যমে যৌন নিগ্রহ বিরোধী ‘মি টু’ আন্দোলনের অন্যতম কর্মী বনে যান বারডেইন।
হুট করেই কি আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা সেলেব জগৎ?
বিখ্যাত ব্যান্ড লিংকিন পার্কের ভোকাল চেস্টার বেনিংটনসহ বেশ কিছু তারকার আত্মহত্যার ঘটনা খুব বেশি পুরনো হয়নি। কিছুদিন আগেই আত্মহত্যা করেন আরেক মার্কিন সেলেব্রিটি, নিউ ইয়র্কের বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার কেট স্পেড (৫৫)। এসবের মধ্যেই এলো এই নতুন দুঃসংবাদ। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ঠিক তার আগের দিনই এক গবেষণায় জানিয়েছিল, ১৯৯৯ এর পর দেশটিতে আত্মহত্যার হার বেড়েছে শতকরা ৩০ ভাগ। শুধু ২০১৬ সালেই প্রায় ৪৫,০০০ মার্কিনী আত্মহনন করেছিলেন!
ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বারডেইন বেশ কড়া ভাষাতেই সবসময় সমালোচনা করতেন। তার মৃত্যুতে ট্রাম্পও জানিয়েছেন শোক। জি-সেভেন সম্মেলনের আগে দেশ ছাড়ার সময়ে ট্রাম্প সাংবাদিকদের কাছে স্মৃতিচারণ করে বলেন, “তিনি বেশ একটা চরিত্রই ছিলেন বটে!” শুধু ট্রাম্পই নন, রাজনীতি ও টেলিভিশন জগতের অনেক তারকা, ‘মি টু’ আন্দোলনের অসংখ্য কর্মীসহ বিশ্বজুড়ে অগণিত ভক্ত শোক প্রকাশ করেছেন এই কৃতির মৃত্যুতে। তার দু’টো উক্তিকে কিন্তু জীবন চলার পথে পাথেয় করতেই পারেন-
“সম্ভবত এতটুকু উপলব্ধিই যথেষ্ট যে, আদতে মনের কোনো চূড়ান্ত বিশ্রাম-গন্তব্য নেই, নেই চূড়ান্ত স্পষ্টতা বলে কোনো কিছু। সম্ভবত জ্ঞান একেই বলে, যখন আপনি বুঝবেন যে আপনি কতটা ক্ষুদ্র আর জ্ঞানহীন এবং জানবেন, আপনাকে কতদূর যেতে হবে!”
“আপনার শরীর মন্দির নয়, এটি একটি বিনোদন পার্ক। যাত্রা উপভোগ করুন।”
Featured Image Source: Getty Images