শুক্রবার দিনটি রমজানের আর দশটি দিনের মতোই শুরু হয়েছিল ২১ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি তরুণী রাজান আল-নাজ্জারের। সূর্য ওঠার আগেই ঘুম থেকে উঠেছিলেন তিনি। সেহেরি খেয়ে, ফজরের নামাজ পড়ে অপেক্ষা করছিলেন কখন সূর্য উঠবে, আর প্রতিদিনের মতো কখন তিনি ছুটে যাবেন তার বাড়ির অদূরে গাজা উপত্যকার খান ইউনুসের ইসরায়েলের সীমান্ত সংলগ্ন অস্থায়ী ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে, যেখানে টানা নয় সপ্তাহ ধরে নিজেদের দখলকৃত ভূমি ফেরত পাওয়ার দাবিতে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে আসছে এলাকাবাসী ফিলিস্তিনিরা।
#RazanAlNajjar was a 21-year-old volunteer paramedic. The IDF shot + killed her for tending to wounded Palestinians on the Gaza border.
This is the cost of the occupation. This is the cost of a hyper-nationalist militarized vision of Jewish safety. It’s not worth it. Nothing is. pic.twitter.com/MSD4JX8HIK
— Sophie Ellman-Golan (@EgSophie) June 1, 2018
সকাল সাতটা বাজতেই উঠে দাঁড়ালেন রাজান। তার মা সাবরিন আল-নাজ্জারের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, “মা, আমি মিছিলে যাচ্ছি।” সাবরিনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চোখের পলকে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন রাজান। তাকে বিদায় দেওয়ার জন্য সাবরিন ছুটে গেলেন বারান্দার দিকে। কিন্তু ততক্ষণে চোখের আড়ালে চলে গেছেন রাজান। মা-মেয়ের কেউই জানতেন না, ওটাই ছিল তাদের শেষ দেখা। অথবা হয়তো জানতেন, কারণ স্বেচ্ছাসেবী চিকিৎসাকর্মী রাজানের কাজই ছিল জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইসরায়েলি স্নাইপারদের গুলিতে আহত বা নিহত ফিলিস্তিনিদেরকে উদ্ধার করা। প্রতিটি দিনই তাকে জীবনের শেষ দিন মনে করে বের হতে হতো।
খান ইউনুস হচ্ছে গাজা উপত্যকার পাঁচটি স্থানের একটি, যেখানে ইসরায়েলের কাঁটাতারের নিরাপত্তা বেষ্টনী সংলগ্ন এলাকায় গত ৩০ মার্চ থেকে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি অবস্থান কর্মসূচি পালন করতে শুরু করে। তাদের দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক, ইসরায়েলি বাহিনী কর্তৃক অবৈধভাবে দখলকৃত নিজেদের জমিতে ফেরত যাওয়া। আর তাদের আন্দোলনও ছিল নিরস্ত্র এবং শান্তিপূর্ণ। কিন্তু তারপরেও ইসরায়েলি স্নাইপাররা গত দুইমাসে গুলি করে হত্যা করেছে ১২৩ জনকে, আহত করেছে আরো ১৩ হাজার জনকে। শুধুমাত্র ১৪ই মে একদিনেই ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছিল ৫৯ জন এবং আহত হয়েছিল ২ হাজার জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি।
My first time seeing this sweet photo. I am so deeply grieved by the assassination of Palestinian Medic Razan al-Najjar who was just shot & killed by an Israeli sniper.
This is a war crime. She was an unarmed & non-violent medic. pic.twitter.com/Vl0ekUKZzo
— Shaun King (@ShaunKing) June 3, 2018
রাজান আল-নাজ্জার ছিলেন খান ইউনুসের প্রতিটি প্রতিবাদ মিছিলের এক পরিচিত মুখ। সেই প্রথম দিন থেকে শুরু করে প্রতিটি মিছিলে তিনি অংশ নিয়েছেন। প্রতিদিন সকাল সাতটার সময় তিনি ছুটে যেতেন মিছিলের উদ্দেশ্যে। সারাদিন ইসরায়েলের গুলিতে আর টিয়ার শেলে আহত ফিলিস্তিনিদেরকে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা, তাদেরকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া, আর অবসরে কখনো ফিলিস্তিনের পতাকার রংয়ে রঞ্জিত বেলুন হাতে, কখনো “আমি ফিরবই” লেখা ব্যানার হাতে মিছিলে অংশ নেওয়া শেষে বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায়ই তার রাত আটটা বেজে যেত। আর মিছিলে অংশ নেওয়া তো বটেই, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসক হিসেবে দীর্ঘ ১৩ ঘণ্টা পরিশ্রমের কাজটাও তিনি করতেন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে।
রাজান আশরাফ আব্দুল কাদের আল-নাজ্জারের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার খান ইউনুসের আল-খুজাআ গ্রামে। ইসরায়েলের সীমান্ত সংলগ্ন হওয়ায় গ্রামটিতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর আক্রমণ একটি নিয়মিত ঘটনা। গ্রামের একপ্রান্তে রাজানের বাবা আশরাফ আল-নাজ্জারের একটি মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশের দোকান ছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর আক্রমণে দোকানটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এরপর থেকে বেকার আশরাফের ছয় সন্তান-সন্ততি দারিদ্র্যের মধ্য দিয়েই বেড়ে উঠতে থাকে।
রাজান ছিলেন আশরাফের বড় সন্তান। মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল খুব বেশি ভালো না হওয়ায় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেননি। তার পরিবর্তে তিনি খান ইউনুসের নাসের হসপিটালে প্যারামেডিক কোর্সে ভর্তি হন। দুই বছরের প্রশিক্ষণ শেষে তিনি প্যালেস্টাইন মেডিক্যাল রিলিফ সোসাইটি নামের একটি বেসরকারি স্বাস্থ্য সংস্থায় স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যোগদান করেন। মার্চের ৩০ তারিখে ‘গ্রেট মার্চ অফ রিটার্ন’ আন্দোলন শুরু হলে তিনি স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে নিয়মিত সেখানে যোগ দিতে শুরু করেন।
Their hands are raised, her hands are raised, they’re wearing white coats, she’s wearing a white coat …. her hands raised. I repeat her hands were raised! This didn’t stop Israeli forces from killing another Palestinian – they shot #RazanAlNajjar in the chest with open fire. pic.twitter.com/WXL7I037FH
— Boutaïna Azzabi Ezzaouia (@Boutaina) June 2, 2018
বেকার আশরাফ নাজ্জারকে অনেকেই জিজ্ঞেস করত, তার নিজের ছেলেমেয়েদের খরচ চালাতেই যেখানে তার কষ্ট হয়, সেখানে তার মেয়ে কেন বিনা বিতনে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছে? আশরাফ উত্তর দিতেন, তিনি তার মেয়েকে নিয়ে গর্বিত, কারণ তার মেয়ে ফিলিস্তিনের ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করছে। গর্বিত ছিলেন রাজান নিজেও। তিনি মনে করতেন, তিনি যে কাজটি করছেন, সেটি শুধু পুরুষদের কাজ না, নারীদেরও কাজ। তিনি ছিলেন খান ইউনুসের প্রথম নারীদের মধ্যে একজন, যারা ইসরায়েলি সেনাদের গুলির মুখেও অবিচলভাবে আহতদের সেবা করে গেছেন।
শুক্রবারের আগেও রাজান একাধিকবার আহত হয়েছেন। নিঃশ্বাসের সাথে টিয়ার গ্যাস গ্রহণ করার কারণে তিনি এর আগে অন্তত দুইবার অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। এছাড়াও গত ১৩ এপ্রিল এক আহত ব্যক্তিকে উদ্ধার করতে গিয়ে তিনি নিজের হাতের কব্জি মচকে ফেলেন। কিন্তু তারপরও হাসপাতালে না গিয়ে সারাদিন তিনি উদ্ধার তৎপরতা চালিয়ে যান। এপ্রিলের মাঝামাঝি একবার একটুর জন্য গুলিবিদ্ধ হওয়ার হাত থেকেও বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি। তিনি সেবার বেঁচে গেলেও শুক্রবার তার শেষরক্ষা হয়নি।
Razan Al-Najjar the Martyr of the third Friday in #Ramadan. Razan shot in the chest by #Israeli snipers while she was trying to save the injured protesters at the eastern borders of #Gaza today. pic.twitter.com/hByZbiT3AF
— Palestine Observer (@PalObserver) June 1, 2018
নিজেদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে রত এবং অন্যায়ভাবে আহত ফিলিস্তিনিদের সেবা করাকে রাজান তার নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করতেন। আর সে দায়িত্ববোধ থেকেই অন্যান্য দিনের মতোই শুক্রবারেও তিনি হাজির হয়েছিলেন প্রতিবাদস্থলে। সেদিন সকাল থেকে ইসরায়েলি স্নাইপারদের গুলিতে এবং টিয়ার শেল গ্যাসের টিনের আঘাতে অন্তত ১০০ জন আহত হয়, যাদের অনেককেই উদ্ধার করেন রাজান এবং তার সহকর্মীরা।
সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে এক প্রতিবাদকারী যখন নিরাপত্তা বেষ্টনীর একটি অংশ কেটে সীমান্তের ওপারে প্রবেশ করতে গিয়ে ইসরায়েলি স্নাইপারদের গুলিতে আহত হয়, তখন তাকে উদ্ধার করার জন্য ছুটে যান রাজান আল-নাজ্জার। তার এক সহকর্মী তাকে নিষেধ করেন এই বলে যে, নিরাপত্তা বেষ্টনীর এত কাছে যাওয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক। কিন্তু তারপরেও রাজান এগিয়ে যান। অগত্যা তার সাথে এগিয়ে আসেন তার দুই সহকর্মীও।
#Palestinian volunteers medic weep tears for the loss of their colleague Razzan Alnajjar, murdered today in the Gaza Strip by Israeli Snipers. Razzan used to provide nursing services for wounded demonstrators before being murdered east of Khan Younis city #GreatMarchOfReturn pic.twitter.com/6IbNk0SbII
— Ramy Abdu| د. رامي عبده (@RamAbdu) June 1, 2018
রাজানের গায়ে ছিল চিকিৎসাকর্মীদের সাদা ইউনিফর্ম। ইসরায়েলি সেনারা যেন পরিস্কারভাবে বুঝতে পারে, তারা তাদের জন্য কোনো হুমকি না, সেজন্য রাজান এবং তার সহকর্মীরা দুই হাত উপরে তুলে রেখেছিলেন। তাদের আশেপাশে অন্য কোনো প্রতিবাদকারীও ছিল না, শুধু তারা তিন চিকিৎসাকর্মীই এগিয়ে যাচ্ছিলেন আহত ব্যক্তিকে উদ্ধার করার জন্য। কিন্তু তারপরেও তারা যখন বেষ্টনী থেকে ১০০ মিটার দূরে, তখন দুনিয়ার সকল নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে এক ইসরায়েলি স্নাইপার গুলি করে বসে ঠিক রাজানের বুক লক্ষ্য করে।
রাজান প্রথমে বুঝতেই পারেননি যে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু বুলেট তার পিঠ ভেদ করে বেরিয়ে যাওয়ার পরেই ব্যাথা অনুভব করেন। ‘আমার পিঠ, আমার পিঠ’ বলে চিৎকার করতে করতে তিনি মাটিতে ঢলে পড়েন। তাকে খান ইউনুসের ইউরোপীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও ডাক্তাররা তাকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হন। সন্ধ্যা সাতটার সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন গুলিবিদ্ধ শতশত প্রতিবাদকারীকে রক্ষা করা রাজান আল-নাজ্জার নিজেই। যে রাজান প্রতিদিন সন্ধ্যায় রক্তমাখা অ্যাপ্রনে ঘরে ফিরে তার মাকে অন্যদের জীবন বাঁচানোর গল্প শোনাতেন, শুক্রবার সন্ধ্যায় সেই রাজান নিজেই পরিণত হন অন্যদের বলা গল্পে।
রাজানের হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না। তিনি কাউকে আক্রমণ করতে যাননি, প্রতিবাদও করতে যাননি, গিয়েছিলেন আহত একজন মানুষকে বাঁচাতে। তার মায়ের ভাষায়, তার রক্তমাখা অ্যাপ্রনটাই ছিল তার অস্ত্র। আর তার পকেটে থাকা গজ এবং ব্যান্ডেজগুলোই ছিল তার গুলি। কিন্তু তারপরেও তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। ইসরায়েলের কাছে ফিলিস্তিনি মানেই সন্ত্রাসী, ফিলিস্তিনি মানেই আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে গুলি করে মেরে ফেলার ‘বৈধ’ লক্ষ্যবস্তু। গত দুই মাসেই ইসরায়েলের রাজান ছাড়াও ইসরায়েলের আক্রমণে নিহত হয়েছেন আরো এক স্বাস্থ্যকর্মী, আহত হয়েছেন আরো ২০০ স্বাস্থ্যকর্মী এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৭টি অ্যাম্বুলেন্স।
🇵🇸 The funeral of #RazanAlNajjar today in #KhanYounis. Tens of 1000s participation reflects that Razan became a national icon of peaceful #GreatReturnMarch & the huge anger towards #IsraelCrimes. #GazaMassacre #GazaBleeds #BDS pic.twitter.com/FTG5JOwBy3
— Great Return March (@GreatReturnMa) June 2, 2018
কিন্তু যে জনপদের মানুষ মৃত্যুকে ভয় পায় না, সে জনপদকে ইসরায়েল কতদিন ঠেকিয়ে রাখবে? যেখানে শুধু পুরুষরাই না, নারীরা, শিশুরা, রাজান এবং আহ্দ আল-তামিমির মতো কিশোরীরা মৃত্যুভয়কে অগ্রাহ্য করে বুক পেতে ইসরায়েলের বুলেটের সামনে, সে জনপদকে কি ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব? হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণে রাজানের জানাজা সম্পন্ন হওয়ার পরপরই তার সহকর্মীরা ফিলিস্তিনের পতাকা এবং রাজানের রক্তমাখা অ্যাপ্রন হাতে নিয়ে প্রতিবাদ করার জন্য ছুটে গেছে নিরাপত্তা বেষ্টনীর একেবারে সামনে, গুলিবিদ্ধ হওয়ার সম্পূর্ণ ঝুঁকি নিয়েই। শুধু যোগ্য নেতৃত্ব, প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন আর সহযোগিতা নেই বলেই, তা না হলে এরকম অদম্য সাহসী জাতির স্বাধীনতার দাবিকে দাবিয়ে রাখা কোনো শক্তির পক্ষে সম্ভব হতো না।
Featured Image Source: english.almanar.com