পশ্চিম বাংলায় এই বছরের পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে খুন-জখমের রাজনীতি থেকে শুরু করে আদালত-আইনি জটিলতা সবই প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস প্রথম থেকেই এই নির্বাচনকে বিরোধী-শূন্য করার একটি প্রকল্প হিসেবে দেখে আসছিল। তাদের দাবি, যেহেতু তারা রাজ্যে উন্নয়নের জোয়ার এনেছে, তাই একশো শতাংশ জয়ের কৃতিত্ব তাদেরই পাওনা। আর এই নিয়ে অতি-আস্ফালন করতে গিয়ে এমন পরিবেশের সৃষ্টি হলো রাজ্যজুড়ে; বিরোধীদের এমন নির্মমভাবে লক্ষ্য করা হতে লাগল যে, দিনের শেষে দেখা গেল রাজ্যজুড়ে ত্রিস্তর পঞ্চায়েতে চৌত্রিশ শতাংশ আসনে তৃণমূল জিতে গিয়েছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই।
যদিও আদালতের হস্তক্ষেপে ব্যাপারটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ এখনও অনিশ্চিত, কিন্তু তৃণমূল স্তরে গণতন্ত্রকে যে এই সমস্ত ঘটনার মধ্যে দিয়ে চূড়ান্ত অসম্মান করা হলো, তা নিয়ে কোনোই দ্বিমত নেই। সরকারে থাকা দলের দাপটে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় দু’কোটি ভোটার তাদের মতামত জানানো থেকেই বঞ্চিত হলেন আর এই মানুষগুলোর মধ্যে রয়েছে সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণী- যেমন নারী, তফসিলি জাতি এবং আদিবাসী। এর পাশাপাশি অন্যান্য দলের প্রার্থী-প্রতিদ্বন্দ্বী তো রয়েছেনই।
পশ্চিমবঙ্গের এই নির্বাচনী সন্ত্রাস নতুন কিছু ঘটনা নয়। বা বলতে গেলে, পশ্চিমবঙ্গে কোনো নির্বাচনই সহজ-সরল ঘটনা নয়। এই রাজ্যে দলীয় রাজনীতির সংঘাত এক কথায় সাংঘাতিক, কোনো একটি দল দুর্বল হয়ে পড়লেও তার জায়গায় চটজলদি উঠে আসে আরেকটি দল। কিন্তু চলতেই থাকে সংঘর্ষ, সেখানে নির্বাচন যে খুব সহজে কাজ নয়, তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। তবে অন্যান্য বার তাও নাহয় যুযুধান কমিউনিস্ট এবং অকমিউনিস্ট পক্ষের সংঘর্ষ বোঝা যেত; বা ২০১৩ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারে থাকলেও তিনি তখন মাত্র দু’বছর ক্ষমতায় এসেছেন, অতএব বিরোধীদের রেশ পুরোপুরি না মিলিয়ে যাওয়ার ফলেও সংঘাতের সম্ভাবনা শেষ হয়নি বলা যেতে পারে।
একপেশে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব যেখানে, সেখানে এত রক্তারক্তি কেন?
কিন্তু এবারের এই অবিরাম সন্ত্রাস বেশ অবাক করে। কারণ,এই মুহূর্তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের অবিসংবাদিত নেত্রী। কোনো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দীর পক্ষে এই মুহূর্তে শ্রীমতি বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারানো সম্ভব নয়। আর বিশেষ করে ২০১৬ সালে যেভাবে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো মমতাদেবী একক হাতে তার দলকে নির্বাচনে জেতান, বিরোধীদের একপ্রকার জোট এবং শাসকদলের বেশ কিছু নেতার বিরুদ্ধে ঘুষের বড়সড় অভিযোগ ওঠা সত্ত্বেও, তারপরও তিনি বিরোধীদের ধরাছোঁয়ার বাইরে বললে অত্যুক্তি হয় না।
পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাপট এখন এতটাই যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টি দেশের অন্যান্য নানা প্রদেশে নিজেদের জয়ধ্বজা উড্ডীন করলেও পশ্চিমবঙ্গে তারা এখনও সুবিধা করতে পারছে না। আগের থেকে ভালো জায়গাতে এলেও তাদের স্থান খুব ভালো হলে দ্বিতীয় আর তাও প্রথম স্থানাধিকারী তৃণমূলের চেয়ে অনেকটাই পিছনে।
তা এহেন অনুকূল পরিস্থিতিতে এই মারামারি কেন? তৃণমূলের নেতৃত্ব যে ‘উন্নয়ন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে’ গোছের রাজনৈতিক হুমকি-কেন্দ্রিক স্লোগান দিচ্ছেন বিরোধীদের আরও কোণঠাসা করতে, তার প্রয়োজনই বা কী? গ্রামবাংলায় আজকের উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। রাস্তাঘাট বা বিদ্যুতের পরিস্থিতি অনেক ভালো আগের চেয়ে। সাত বছর ক্ষমতায় থাকা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এই নির্বাচন জিততে এমন কিছু বেগ পেতে হতো বলে মনে হয় না। কিন্তু তবুও তার দল এবং নেতৃত্ব প্রশ্রয় দিল গা-জোয়ারি নির্বাচনকে যেখানে বিরোধীদের দেওয়া হবে না সূচাগ্র মেদিনীও।
নির্বাচনী হানাহানি এখন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ
প্রথমত, এই সন্ত্রাসের প্রবণতা আজকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মজ্জাগত। বিগত বাম আমল থেকেই এর কুখ্যাতি জগৎজোড়া। তখনও গায়ের জোরে বিরোধীদের মুখ বন্ধ করা বা ভিটেমাটি ছাড়া করা জলভাত ছিল। মোটরবাইকে চড়ে, হাতে বা হ্যান্ডেলে দলের ঝান্ডা নিয়ে ঘোরা ভৈরববাহিনীকে দেখলে প্রাণ কাঁপত বিরোধী থেকে সাধারণ মানুষ সবার। কিন্তু তাদের ঠেকানোর মতো কোনো শক্তি দেখা যেত না।
বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী তখন প্রধান বিরোধী মুখ ছিলেন কিন্তু জনপ্রিয় হলেও তাকে সরকারি দলের কম রোষানলে পড়তে হয়নি, নারী হওয়া সত্ত্বেও। আজকে তিনি রাজ্যের মুখ্য প্রশাসক; আগেকার শাসক দল আজকে প্রায় নিশ্চিহ্ন; তাদের কর্মী-সমর্থকও আছে। কিন্তু সামনে থেকে লড়াই করার মতো নেতৃত্ব নেই; তার জায়গায় উঠে এসেছে নতুন বিরোধী দল।
কিন্তু এত কিছু পরিবর্তনের মধ্যেও নির্বাচনী সন্ত্রাসের সেই ট্র্যাডিশন বজায় রয়েছে আজও। এর থেকে সহজ মুক্তির পথ বোধহয় পাওয়া সম্ভবও নয়, তা সে ক্ষমতায় যে-ই থাকুন। অন্তত দলীয় রাজনীতির প্রাণঘাতী বিভাজনের সংস্কৃতি যতদিন থাকবে, এই প্রবণতাকে নির্মূল করা অসম্ভব।
পঞ্চায়েতের বিপুল অর্থসংস্থানের উপর নিয়ন্ত্রণের লোভ
দ্বিতীয়ত, পঞ্চায়েতের অর্থ। গত তিন বছরে ভারতে পঞ্চায়েতের জন্য সরকারি অনুদান বেড়েছে তিনগুণেরও বেশি। চতুর্দশ ফিন্যান্স কমিশনের কথামতো ভারতীয় মুদ্রায় ৬৫ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২০০ কোটি টাকা আর কেন্দ্রীয় অনুদানের ষাট শতাংশ যায় ত্রিস্তরীয় ব্যবস্থার সবচেয়ে নিচু তলায় অবস্থিত গ্রাম পঞ্চায়েতের কোষাগারে। তো স্বাভাবিকভাবেই, পঞ্চায়েত নির্বাচন জেতা মানে বিপুল অর্থের নিয়ন্ত্রক হওয়া আর এই মধুভাণ্ডেের স্বাদ চাখতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শুরু হয়ে যায় সাংঘাতিক রেষারেষি। লাশ পড়ে; রক্তগঙ্গা বয়ে যায়; কিন্তু যেকোনো প্রকারে জেতার তাগিদ কমে না।
পঞ্চায়েত অধিকার করা মানে তৃণমূলস্তরে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব কায়েম রাখা
অর্থ ছাড়াও রয়েছে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব লাভের হাতছানি। যেহেতু ভারতে এখনও সিংহভাগ মানুষ শহরের বাইরে থাকেন, সেহেতু রাজনৈতিক দলগুলো লক্ষ্য করে গ্রামাঞ্চলে নিজেদের তৃণমূল শক্তিকে আরও মজবুত করতে।
আর পশ্চিমবঙ্গের গ্রামজীবনে যেহেতু দলীয় রাজনীতি একটি বড় বিভাজনের কাজ করে (বিগত বাম জমানার ‘আশীর্বাদ’ স্বরূপ মানুষের হেঁশেলেও ঢুকে পরে রাজনীতি এখানে ভাগ করে গৃহস্থ-পরিবারকেও), তাই বিরোধীকে ঢিট করে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ফলানোর প্রবণতার প্রভাব প্রতিফলিত হয় আরও বেশিভাবে।
রাজনীতি যখন ডাল-ভাত-জলের মতোই রোজকার জীবনের অস্তিত্বরক্ষার আরেকটি পাথেয় হয়ে ওঠে, তখন তাকে কেন্দ্র করে অবিশ্রান্ত সংগ্রামের প্রবণতা সাধারণই বৈকি। আর এই সংগ্রামে জয় সুনিশ্চিত করতে অতিবড় শাসককেও রোজ মাঠে নামতে হয় লাঠিখেলা দেখতে। পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরে চলতে থাকা এবারের সংঘর্ষ এই ভয়ঙ্কর চিত্রটিকেই পরিস্কার করে আমাদের সামনে।
শাসকদলের অন্দরের কোন্দলও তৈরি করছে এই হিংসা
তবে এসবের পাশাপাশিও আরেকটি কারণ রয়েছে পশ্চিমবাংলায় এবারের নির্বাচনী সন্ত্রাসের। আর তা হলো শাসকদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল। যখন কমিউনিস্টরা শাসন করতেন, তখন তাদের শাসনকার্যকে মসৃণ এবং অবাধ করত তাদের শক্তিশালী সংগঠন বা মেশিনারি। বিশ্বের সব প্রান্তেই কমিউনিস্টরাই আদ্যোপান্ত ক্যাডার-ভিত্তিক কাজে বিশেষভাবে সমর্থ; সমাজের উপর সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার মন্ত্র তাদের মুখস্থ; পশ্চিমবঙ্গেও তার অন্যথা হয়নি। তাছাড়া, সেই সময়ে এত মিডিয়ার রমরমা ছিল না বা গণতন্ত্রের হাল-হকিকত পর্যবেক্ষণ করার এত মঞ্চও তৈরি হয়নি। রাতের অন্ধকারে গণতন্ত্রের গলা টিপে মারলেও টের পেত না কেউই।
আজকের শাসকদলের সেদিক থেকে দুটি বড় অসুবিধা রয়েছে। এক তো মিডিয়ার এখন পৌষমাস চলছে; পান থেকে চুন খসলেও তার খবর পৌঁছে যাচ্ছে বিশ্বের দরবারে। আর দ্বিতীয়ত, তৃণমূল কংগ্রেসের তার পূর্বসূরির মতো সংগঠন নেই, আজ ক্ষমতায় থাকার এতবছর পরেও। এই দলটি কমিউনিস্টদের কাজের ধরনের একেবারে উল্টো মতে ও পথে বিশ্বাসী। মিলিত সংগঠনের বদলে এর অস্ত্র হচ্ছে একনায়কতন্ত্র; যেখানে একজন ব্যক্তিই দলের মুখ, নীতি, সংগঠন, আদর্শ সব। আর এই কেন্দ্রীভূত চরিত্রের জন্যে তৃণমূলের প্রান্তিক সংগঠনের দুর্বলতা বেরিয়ে পড়ে অনেক সময়েই।
গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব আজকের পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের একটি বড় সমস্যা কারণ, সার্বিকভাবে দল চালনা করার মতো শক্তপোক্ত স্থানীয় সংগঠন তাদের নেই; রয়েছে শুধু সর্বোচ্চ নেত্রীর চোখরাঙানি, যা সবসময়ে দলের ভেতরের ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা আগুনকে পুরোপুরি প্রশমিত করতে পারে না। আর এই ভয়েই নির্বাচনের সময়ে শাসকদল আরও যুদ্ধংদেহী মনোভাব নেয়, যাতে দলের মধ্যকার খেয়োখেয়িতে তাদের শাসনকালের রূপকথা খর্ব না হয়। কয়েকটি ‘দুষ্ট গাছ’কে শাস্তি দিতে পুরো বনেই আগুন লাগানোতে শামিল হয় তারা।
অর্থ এবং রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হাতের মুঠোয় রাখতে গণতন্ত্রকে হেনস্থা করার খেলা চলতে থাকে দিনের পর দিন। সাংবিধানিক সংস্থা, যারা এই প্রবণতার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারে, তারাও অনেক ক্ষেত্রেই পঙ্গু হয়ে থাকে শাসকদলের অপরিসীম রাজনৈতিক দাপটের সামনে। নাগরিক সমাজ থেকে ইতিউতি সমালোচনা শোনা গেলেও তা সার্বিক রূপ নেয় না- কারণ সেই রাজনৈতিকের প্রতি অরাজনৈতিকের ভয়।
এই পরিস্থিতিতে সমস্যার সমাধান দূর অস্ত বলেই মনে হয়। অথচ, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে এদেশের তৃণমূলস্তরের গণতন্ত্রকে আরও প্রসারিত করে প্রান্তিক মানুষকে এই ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ করে তোলার একটি বড় সুযোগ কিন্তু আমাদের সামনে ছিল।
Featured Image Source: indiatoday.in