আলফা জিরো (AlphaZero) নামে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম দাবা খেলার জগতে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন কম্পিউটার প্রোগ্রাম নির্মাতা প্রতিষ্ঠান গুগলের ডিপ মাইন্ড (DeepMind) জানিয়েছে, তাদের নির্মিত আলফা জিরো সফটওয়্যারটি বিশ্বের এক নম্বর দাবা খেলার সফটওয়্যার স্টকফিশ ৮কে (Stockfish 8) হারিয়ে দিয়েছে। আর এই কাজ আলফা জিরো করেছে তাকে দাবা খেলার নিয়ম-কানুনগুলো শেখানোর মাত্র চার ঘণ্টার মধ্যেই!
নির্মাতারা আলফা জিরোকে শুধুমাত্র দাবা খেলার মৌলিক নিয়মগুলো শিখিয়ে দিয়েছিলেন। কোনো কৌশল বা বিশেষ পরিস্থিতিতে কীরকম চাল দিতে হয় কিংবা দাবা খেলার প্রচলিত কোনো বুদ্ধি শেখাননি। এমনকি, কোনো মানুষ বা অন্য কোনো সফটওয়্যারও এর সাথে দাবা খেলার অনুশীলন করেনি। কিন্তু শুধুমাত্র মৌলিক নিয়ম শেখার পর মাত্র চার ঘণ্টা ধরে নিজের সাথে নিজে অনুশীলন করতে করতে সফটওয়্যারটি এত দক্ষতা অর্জন করেছে যে, এটি বিশ্বের প্রথম স্থানে থাকা সফটওয়্যারকে প্রথমবারের চেষ্টাতেই হারিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে।
ঘটনাটিকে দাবা খেলার ইতিহাস তো বটেই, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগ্রগতির ক্ষেত্রে মাইলফলক হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর নির্মাতারা আলফা জিরোর এই দক্ষতাকে ‘অতিমানবীয় দক্ষতা’র সাথে তুলনা করেছেন। কারণ, মাত্র চার ঘণ্টার মধ্যেই এটি দাবা খেলার বিষয়ে যে পরিমাণ দক্ষতা অর্জন করেছে, তা মানুষের প্রায় দেড় হাজার বছরের ক্রমযোজিত জ্ঞানকেও ছাড়িয়ে গেছে।
স্টকফিশ ৮ এর সাথে আলফা জিরো মোট ১০০টি গেম খেলেছে। এর মধ্যে আলফা জিরো জিতেছে ২৫টি গেম, আর ড্র হয়েছে ৭৫টি গেম। বিশ্বের এক নম্বরে থাকা স্টকফিশ ৮ একটি গেমও জিততে পারেনি।
আলফা জিরোর বিশেষত্ব হলো, এটি সম্পূর্ণ নিজে নিজে দাবা খেলার অনুশীলন করে এর যাবতীয় দক্ষতা অর্জন করেছ। যেখানে বিশ্বের অন্যান্য দাবা খেলার সফটওয়্যার সাধারণত মানুষের সাথে খেলার সময় তাদের চালগুলো এবং তাদের কৌশল দেখে দেখে সেসব কৌশল আয়ত্ব করে। নিজে নিজে শেখার এই পদ্ধতিকে বলা হয় রিইনফোর্সড লার্নিং মেথড।
আলফা জিরো হচ্ছে ডিপ মাইন্ড কর্তৃক এর আগে নির্মিত আলফা গো জিরো (AlphaGo Zero) সফটওয়্যারের উন্নততর সংস্করণ। আলফা গো জিরো ছিল চাইনিজ গেম ‘গো’ খেলায় দক্ষ। আলফা জিরো সফটওয়্যারটি ডেভেলাপ করার পর এটি তার পূর্ববর্তী সংস্করণ আলফা গো জিরোকে ১০০টি ‘গো’ গেমের টুর্নামেন্টের সব ক’টিতে হারিয়ে আলোচনায় এসেছিল। আলফা জিরোর দক্ষতা শুধুমাত্র দাবা আর ‘গো’তেই না, এটি জাপানিজ বোর্ড গেম শোগি খেলাতেও অত্যন্ত দক্ষ।
যে গবেষণা পত্রে আলফা জিরোর এই অসাধারণ কৃতিত্বের কথা প্রকাশ করা হয়েছে, তার লেখক এবং গুগলের ডিপ মাইন্ডের প্রতিষ্ঠাতা হলেন ডেমিস হাসাবিস। তিনি নিজে মাত্র ১৩ বছর বয়সে দাবা খেলায় অসাধারণ দক্ষতার জন্য ‘মাস্টার’ উপাধি অর্জন করেছিলেন।
কম্পিউটার বিজ্ঞানী নিক হাইন্স বলেন, “এটি হচ্ছে অনেকটা এরকম যে, কোনো এলিয়েন সভ্যতা তাদের নিজেদের গণিত আবিষ্কার করছে।” তিনি বলেন, এটি হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া, যা মানুষের পক্ষপাত দোষ, সংস্কার, পূর্ব নির্ধারিত ধারণা প্রভৃতি থেকে মুক্ত। এটি তাই শিখতে পারে, সেটাই আমরা সবচেয়ে বেশি চাই।
দাবার ড্যানিশ গ্র্যান্ডমাস্টার পিটার হেইন নিলসেন বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমি সব সময়ই ভাবতাম, যদি মহাকাশ থেকে কোনো অতি বুদ্ধিমান প্রজাতির প্রাণী এসে পৃথিবীতে নামতো এবং আমাদেরকে দেখাতো যে তারা কীভাবে দাবা খেলে, তাহলে কেমন হতো? এখন আমি বুঝতে পারছি।”
দাবা বিশেষজ্ঞ এবং দাবা বিষয়ক ওয়েবসাইট Chessable এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ডেভিড ক্র্যামার্লি এ বিষয়ে বলেন, “আমরা এখন জানি, কে আমাদের নতুন দাবার সম্রাট।” তিনি আরো বলেন, এটি দাবার ক্ষেত্রে বিপ্লব সৃষ্ট করবে। তবে শুধু দাবা না, এর বাইরেও এই অ্যালগরিদমের ব্যাপক প্রয়োগ হতে পারে।
ফিচার ইমেজ: Chess.com