আফগানিস্তানের কুন্দুজ প্রদেশের একটি মসজিদ সংলগ্ন মাদ্রাসায় বিমান হামলায় বিপুল সংখ্যক হতাহতের ঘটনাটি পৃথিবীর বুকে চলমান বর্বরতার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ। আফগান বিমান বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত এই হামলায় আহত ও নিহতদের একটি বড় অংশ বেসামরিক নাগরিক এবং পবিত্র কুরআন শরিফের হাফেজ, যাদের মধ্যে মাত্র ১১-১২ বছরের শিশুরাও আছে। তালেবানদেরকে লক্ষ্য করে হামলা চালানোর দাবি করা হলেও শিশু-কিশোরসহ বিপুল সংখ্যক হতাহতের এ ঘটনা তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। একইসাথে সমালোচিত হচ্ছে গণমাধ্যমের ভূমিকাও, যেখানে হামলার ঘটনাটি যথাযথ গুরুত্বের সাথে উঠে আসেনি।
এই ভয়ঙ্কর হামলার ঘটনাটি ঘটেছে গত সোমবার, আফগানিস্তানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় কুন্দুজ প্রদেশের দাস্ত-ই-আর্চি জেলার একটি মসজিদ সংলগ্ন মাদ্রাসায়। সে সময় মাদ্রাসাটিতে ‘দাস্তার বান্দি’ অনুষ্ঠান চলছিল, যেখানে পবিত্র কুরআন শরিফ সফলভাবে মুখস্ত করা কিশোরদেরকে পাগড়ি পরিয়ে ও শিক্ষা সমাপনী সনদ প্রদান করে আনুষ্ঠানিকভাবে হাফেজ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছিল। এ উপলক্ষ্যে মাদ্রাসাটির চত্বরে ছাত্রদের আত্মীয় এবং আশেপাশের অন্যান্য শিশু-কিশোরসহ প্রায় এক হাজার মানুষ উপস্থিত হয়েছিল।
অনুষ্ঠান চলাকালীন দুপুর ১২টার দিকে আফগান এয়ারফোর্সের হেলিকপ্টার থেকে অনুষ্ঠানের স্থান সংলগ্ন মসজিদটির উপর পরপর তিনটি বোমা বর্ষণ করা হয়। ফলে মসজিদটি ধ্বংস হয়ে যায় এবং বিপুল সংখ্যক মানুষ আহত ও নিহত হয়। এলাকাটি তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। বিভিন্ন সূত্র থেকে বিভিন্ন রকম সংখ্যা দাবি করা হচ্ছে। নাসরুদ্দিন সাদী নামে এক জেলা প্রশাসকের বরাত দিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, এ হামলায় অন্তত ৭০ জন নিহত হয়েছে। অন্যদিকে স্থানীয়দের বরাত দিয়ে আলজাজিরা নিহতের সংখ্যা প্রায় একশ এবং তালেবানের এক মুখপাত্রকে উদ্ধৃত করে আহত এবং নিহতের সংখ্যা মিলিয়ে সর্বমোট সংখ্যা ১৫০ বলে দাবি করে।
নিহতদের মধ্যে ঠিক কতজন বেসামরিক নাগরিক বা শিশু, তা নিয়েও ভিন্ন ভিন্ন দাবি আছে। আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ রাদমানিশ প্রথমে ২১ জন সন্ত্রাসীকে হত্যার দাবি করলেও বেসামরিক জনগণের হতাহতের কথা অস্বীকার করেছিলেন। তিনি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া আহতদের শরীরে বোমার আঘাতের পরিবর্তে বুলেটের ক্ষতচিহ্ন থাকার কথা দাবি করে ইঙ্গিত দেন যে, বেসামরিক জনগণ তাদের বোমায় না, বরং তালেবানদের গুলিতে হতাহত হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে স্থানীয় জনগণ এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্যে তার দাবির অসারতা প্রমাণিত হয়।
পরবর্তীতে মঙ্গলবার আফগান কর্তৃপক্ষ বেসামরিক জনগণের হতাহতের সংবাদের সত্যতা স্বীকার করে। আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণি বলেন, আফগান ন্যাশনাল আর্মি তাদের কাছে থাকা ‘সঠিক তথ্য’ অনুযায়ী তালেবানদেরকে ধ্বংস করে জনগণকে রক্ষা করতে চেয়েছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাদের আক্রমণে বেসামরিক জনগণও হতাহত হয়েছে। তিনি ঘটনার তদন্ত করারও আশ্বাস দেন। আফগানিস্তানে নিযুক্ত জাতিসংঘের সহায়তা প্রকল্পও এ ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে বলে জানিয়েছে।
#Kunduz airstrike video provide by #AfghanAirForce release by #AfghanMoD Public Relation Department
watch the video: https://t.co/AnKaejJZkz
Read the report : https://t.co/ZBCkwEs9cIMojGen. Mohammad Radmanish #AfghanMoD spokesman pic.twitter.com/thg10Awq9k
— Afghan Army 🇦🇫 (@ArmyAFG) April 3, 2018
আফগানিস্তানে তালেবান, আল-কায়েদা বা আইএসের উপর অধিকাংশ বিমান আক্রমণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোট দ্বারা পরিচালিত হলেও এবারের এই হামলাটি পরিচালনা করেছে স্বয়ং আফগান বিমানবাহিনী। আফগান সামরিক বাহিনী অবশ্য মার্কিন সেনাবাহিনীরই একটি বর্ধিত রূপ। তাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্রশস্ত্র সবই মার্কিন সেনাবাহিনী থেকেই এসেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা মার্কিন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এবং তাদের সাথে যোগাযোগ করেই অভিযান পরিচালনা করে থাকে। তবে এবারের হামলার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছে।
মাদ্রাসায় বিমান হামলার কারণ হিসেবে আফগান কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, উচ্চপদস্থ তালেবান যোদ্ধারা এ অনুষ্ঠানের আড়ালে বৈঠক করছিল এবং পরবর্তী আক্রমণের পরিকল্পনা করছিল। মোহাম্মদ রাদামিশ দাবি করেন, এ হামলায় ২০ জন তালেবান যোদ্ধা নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে তাদের রেড ইউনিটের কমান্ডার এবং কোয়েটা শুরা কাউন্সিলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাও আছে। আফগান সামরিক বাহিনী তালেবান যোদ্ধাদের কিছু ভিডিও প্রকাশ করেছে, যেখানে তাদের দাবি অনুযায়ী যোদ্ধাদেরকে বৈঠকে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে দেখা গেছে। তালেবানরা অবশ্য তাদের কোনো সদস্যের উপস্থিত থাকার দাবি অস্বীকার করেছে।
UNAMA actively looking in to disturbing reports of serious harm to civilians yesterday from airstrike at #DashtiArchi, #Kunduz. Human Rights team on ground establishing facts. All parties reminded of obligations to protect civilians from impact of armed conflict. #Afghanistan pic.twitter.com/aRANBzOBzO
— UNAMA News (@UNAMAnews) April 3, 2018
কুন্দুজে হামলার এ ঘটনাটি আবারও গণমাধ্যমের পক্ষপাতিত্বমূলক ভূমিকাটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। প্রথম সারির সবগুলো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সংবাদটি উঠে এলেও তা ছিল খুবই সাদামাটাভাবে। বিশেষ করে এর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই সংঘটিত ইউটিউব অফিসে হামলার সংবাদটি গণমাধ্যম যেভাবে প্রচার করেছে, মিনিটে মিনিটে আপডেট দিয়েছে, বিশ্লেষণমূলক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে, সে তুলনায় কুন্দুজের মাদ্রাসার ঘটনাটি বলতে গেলে প্রায় অনুপস্থিতই ছিল। অথচ ইউটিউব অফিসে আহত হয়েছিল মাত্র তিনজন, অন্যদিকে কুন্দুজে নিহত হয়েছে কমপক্ষে ৭০ জন, যাদের মধ্যে অনেকেই নিষ্পাপ শিশু-কিশোর।
অন্যদিকে প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমগুলো তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করার সুযোগে অন্যান্য অনেক ঘটনার মতোই কুন্দুজ হামলার ব্যাপারেও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে প্রচুর ভুয়া তথ্য এবং ছবি। অনেকেই একে মার্কিন হামলা বলে দাবি করছে, যদিও এটি মার্কিন সমর্থনপুষ্ট আফগান বাহিনীর হামলা। নিহতের সংখ্যা হিসেবে ১০১ জন হাফেজের কথা উল্লেখ করা হচ্ছে, যদিও অধিকাংশ বক্তব্য অনুযায়ী নিহতের সংখ্যা ৭০ থেকে ১০০, এবং তার মধ্যেও সবাই হাফেজ না- কিছু সংখ্যক হাফেজ, কিছু অন্যান্য বেসামরিক নাগরিক এবং কিছু তালেবান নেতা। এছাড়া সামাজিক গণমাধ্যমে যে ছবিগুলো ছড়িয়ে পড়েছে, সেগুলোর কয়েকটিও পুরানো ছবি। এমনকি রক্তমাখা যে কুরআন শরিফটির ছবি অনেকেই শেয়ার করছে, সেটিও বাস্তবে কুরআন শরিফের ছবি না, বরং ২০১৪ সালে ইহুদীদের উপর হামলায় রক্ত মাখা একটি বইয়ের ছবি।
These children had been memorizing the holy Quran for past few years and today was the day to receive their rewards…. but fell pray to “war on terror” after the religious ceremony was hit by airstrikes killing over 80 students/teachers/parents & critically wounding 100s #Kunduz pic.twitter.com/p0O568lrmW
— Mirwais Afghan (@miirwais) April 2, 2018
তবে কিছু ভুয়া তথ্য এবং ছবি ছড়ালেও আফগান সরকার যে তালেবানদের উপর হামলা করতে গিয়ে আবারও বেসামরিক জনগণকে এবং কিশোর হাফেজদেরকে হত্যা করেছে, সেটি নিশ্চিত। আফগান সরকার যতই ছবি এবং ভিডিও প্রমাণ হাজির করুক যে ঘটনাস্থলে তালেবান নেতারা উপস্থিত ছিল, তাতে তাদের নিরীহ মানুষ হত্যা বৈধতা পায় না। আফগান বাহিনীর এ বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর কাছ থেকে পাওয়া প্রশিক্ষণ এবং নীতিবিহীন আদর্শেরই প্রতিফলন। দখলকৃত রাষ্ট্রের সাধারণ জনগণের প্রতি দখলদার ও তাদের সহায়ক শক্তির যে বিন্দুমাত্র মমত্ববোধ থাকে না, সেটিই আবারও ফুটে উঠেছে এই বর্বর আক্রমণে।
Featured Image Source: NBC News