মুখরিত ২০১৭: বছরজুড়ে আলোচিত ঘটনাগুলো

শেষের অপেক্ষায় আরো একটি গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি। নানা ঘটনায় মুখর ছিল একবিংশ শতাব্দীর ২০১৭ সাল। রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশ্ব পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ, তার বিভিন্ন সময়ে নেওয়া ও বলা কাজে উত্তাল বিশ্ব রাজনীতি, রোহিঙ্গা সংকট ও বাংলাদেশের মানবতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বিচ্ছেদ, সৌদি সাম্রাজ্যে তরুণ রাজকুমার সালমানের প্রভাব প্রতিষ্ঠা, জিম্বাবুয়ের স্বৈরশাসক রবার্ট মুগাবের শাসনাবসান, ইসলামিক স্টেটের পতন ও সহিংস মধ্যপ্রাচ্য, কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার প্রশ্নে আন্দোলন ও গণভোট, তরুণ কিমের নেতৃত্বে উত্তর কোরিয়ার দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র অভিলাষ সহ নানা ঘটনায় সমৃদ্ধ ছিল পৃথিবীর অন্যতম উষ্ণতম বছর ২০১৭। বিদায়ের লগ্নে আসুন দেখে নিই ২০১৭ সালের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তাল বিশ্ব রাজনীতি

আমেরিকানদের বলা যায়, জাতে মাতাল তালে ঠিক। গত বছরের পুরোটা সময় হট ফেবারিট থাকা হিলারি ক্লিনটনকে ঠিকই কাঁচকলা দেখিয়ে তারা বুঝিয়ে দিল, ডোনাল্ড ট্রাম্পই তাদের ‘যোগ্য’ নেতা। তাদের কাছে মেইড ইন চায়নার সেই ক্যাপগুলোই পছন্দ যেগুলো তাদের আমেরিকাকে গ্রেট এগেইন করবে! ফলাফল: ২.৯ মিলিয়ন ভোট কম পেয়েও যুক্তরাষ্ট্রের ‘সাদা বাড়ি’র বাসিন্দা এখন একজন ধনকুবের রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী। ২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিয়ে উদ্বোধনী ভাষণেই মোটামুটি বুঝিয়ে দেন, কি করতে চলেছেন তিনি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প; Source: Christopher Morris

আর তারপর একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ডে সারা বছর জুড়েই আলোচনায় রাখেন নিজেকে। দায়িত্ব নিয়েই তিনি শুরু করে দেন তার প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন। ২৩ জানুয়ারি অফিসে বসেই এক নির্বাহী আদেশে আন্তঃপ্রশান্ত মহাসাগরীয় বাণিজ্য চুক্তি (টিপিপি) থেকে তার দেশকে সরিয়ে নিয়ে আসেন। ২৭ জানুয়ারি নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে সাতটি দেশের নাগরিকদের আমেরিকা ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।

কলমের এক খোঁচাতেই টিপিপি থেকে বেরিয়ে আসছে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র; Source: nypost.com

২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ আরো ১৯৫টি দেশ ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের মতো সংগঠন মিলে অঙ্গীকার করেছিল যে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মাত্রা তারা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম রাখবে; এমনকি দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি নামিয়ে আনার চেষ্টা করবে। জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পাবে বাংলাদেশসহ আরো অনেক নিম্নভূমির দেশ। ‘জনাব’ ট্রাম্প এই চুক্তি থেকে বের করে আনেন তার দেশকে!  মূলত ট্রাম্পের লক্ষ্য ছিল বারাক ওবামার আমলে নেওয়া বিভিন্ন পরিকল্পনা ও উদ্যোগের অপসারণ। সাবেক রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার গৃহীত ওবামা কেয়ার বাতিল তার মধ্যে ছিল অন্যতম। প্রকৃতপক্ষে ২০১৭ সালের পুরোটা জুড়েই একের পর এক অগ্রহণযোগ্য, উদ্ভট আর উন্মাদতুল্য কর্মকাণ্ডে নিজেকে আলোচনায় রেখেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বছরের একবারে শেষভাগে এসে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে উত্তাল করে তোলেন বিশ্ব পরিস্থিতি। শুধু তা-ই নয়, তেল আবিব থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তরেরও প্রস্তুতি নিতে বলেন তার প্রশাসনের লোকজনদের। বিশ্বনেতারা মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেন। একমাত্র ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বাদে আর কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকেই এই পদক্ষেপের পক্ষে কথা বলতে দেখা যায়নি।

ডোনাল্ড ট্রাম্প বাদে যুক্তরাষ্ট্রের আর কোনো রাষ্ট্রপতিই ১৯৪৮ সাল থেকে তেল আবিবে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের এই দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তর করতে চাননি; Source: AFP

এর সপ্তাহখানেক পরে এক পাল্টা প্রস্তাবে ৫৭টি মুসলিম রাষ্ট্রের সংগঠন ওআইসি পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।  এর কিছুদিন পরে জাতিসংঘ থেকেও বড় একধরনের চপেটাঘাত পায় ট্রাম্প প্রশাসন। জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রত্যাখ্যান করে জাতিসংঘ। ২১ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বিপুল ভোটে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করে একটি প্রস্তাব পাশ হয়। ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের সাধারণ পরিষদের বৈঠকে উপস্থিত ছিল ১৭২টি রাষ্ট্র, যার মধ্যে ১২৮টি রাষ্ট্রই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। এর আগে গত সোমবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একই রকম একটি প্রস্তাবের পক্ষে ১৫টি রাষ্ট্রের মধ্যে ১৪টি রাষ্ট্রই ভোট দিয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর কারণে তা বাতিল হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্র এই ব্যাপারটি ভালোভাবে নেয়নি। ফলশ্রুতিতে জাতিসংঘের নতুন দ্বিবার্ষিক অর্থবছরের বাজেটে ২৮.৫ কোটি ডলারের বিশাল সংকোচন সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়

রোহিঙ্গা সংকট

বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে অত্যাচারিত জাতিগোষ্ঠী হিসেবে রোহিঙ্গাদের আখ্যায়িত করা যেতে পারে। ২০১৭ সালের আগস্ট মাস থেকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই জাতিগোষ্ঠীর উপর মায়ানমার সেনাবাহিনী নারকীয় অত্যাচার চালায়। শুধু তা-ই নয়, দশজনের নয়জনই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মায়ানমারে অনেকেই এই অত্যাচার নিপীড়নকে সমর্থন করে। মায়ানমারের সরকারী বার্তা সংস্থাগুলোর দাবি মোতাবেক, ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের আক্রমণে পুলিশ চেকপোস্টে ১২ পুলিশ নিহত হবার জের ধরেই শুরু হয় এই জাতিগত নিপীড়ন।

১৩৫টির মতো জাতিগোষ্ঠী মায়ানমার সরকারের নেক নজরে আসলেও রোহিঙ্গারা রয়ে যায় পরিচয়হীন; Source: AL JAZEERA

মূলত রোহিঙ্গাদের মায়ানমার সরকার ও সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ সেদেশের নাগরিক হিসেবে মানতে নারাজ। পাশবিক নির্যাতনে জর্জর রোহিঙ্গারা দলে দলে ছুটতে থাকে বিভিন্ন দিকে। তাদের বেশিরভাগেরই গন্তব্য ছিল নাফ নদীর ওপারের বাংলাদেশ।

নাফ নদী পেরিয়ে দলে দলে বাংলাদেশ পানে ছুটে আসছে অত্যাচারিত রোহিঙ্গারা; Source: Sergey Ponomarev

যদিও প্রথমদিকে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে প্রবেশের ব্যাপারে কড়াকড়ি মনোভাব দেখায়, কিন্তু পরবর্তীতে পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনমনে রোহিঙ্গাদের প্রতি ঢাকা তাদের মানবতার হাত বাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলায় শরণার্থী শিবির খোলা হয়; নির্মাণ করা হয় শত সহস্র বাড়িঘর।

কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে কান্নায় ভেঙে পড়া এক রোহিঙ্গা নারীকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা; Source: AP Photo

কক্সবাজারের বালুখালির মতো এরকম শত শত ঘর নির্মাণ করা হয় পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য; Source: Sergey Ponomarev

এই ন্যাক্কারজনক জাতিগোষ্ঠী নিধনে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অং সাং সুচির নির্লজ্জ নিশ্চুপ অবস্থান বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় তোলে।

ব্রিটেনের ব্রেক্সিট কান্ড

ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়া (ব্রেক্সিট) ছিল পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে ইউরোপের জন্য ২০১৭ সালের অন্যতম ধাক্কালিসবন চুক্তির ৫০ নাম্বার ধারা অনুযায়ী, ইউরোপীয় ইউনিয়নের যেকোনো দেশ চাইলে এই সংগঠন থেকে বের হয়ে যেতে পারবে। আর এই ধারার উপর ভিত্তি করে ৫২% ব্রিটিশ নাগরিক (১৭.৪ মিলিয়ন ভোটার) এই মর্মে রায় দেয় যে, তারা আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে থাকবে না।

এই চিঠিতেই আছে আনুষ্ঠানিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা অর্থাৎ ব্রেক্সিট; Source: Emmanuel Dunand/AP

ব্রেক্সিটের ফলে ডেভিড ক্যামেরন পদত্যাগ করেন আর তার স্থলাভিষিক্ত হন থেরেসা মে। ব্রেক্সিট বিতর্কে অত্যন্ত কঠিন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন মে। অগ্রীম নির্বাচনের আয়োজন করে তিনি বারবার কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন। কিন্তু সবকিছুকে শক্ত হাতে মোকাবেলা করে এখনও তিনি বহাল তবিয়তে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। শুধু তা-ই নয়, ২০১৭ সালে ফোর্বসের দৃষ্টিতে থেরেসা মে দ্বিতীয় ক্ষমতাবান নারী।

হাউস অব কমনস-এ ব্রেক্সিটের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিচ্ছেন থেরেসা মে; Source: youtube.com

সৌদি সাম্রাজ্যে ঝড়

২০১৭ সালকে বলা যায় সৌদি রাজতন্ত্রের জন্য এক ঝড়ের বছর। এ বছরের জুনে সৌদি বাদশাহ রাজতন্ত্রের উত্তরাধিকারীর ক্রমধারায় এক পরিবর্তন ঘটান। তিনি ভাতিজা মোহাম্মদ বিন নায়েফকে সরিয়ে তার পুত্র মোহাম্মদ বিন সালমানকে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে মনোনিত করেন; প্রকারান্তরে নিজ পুত্রকে তিনি সৌদি সিংহাসনের পরবর্তী বাদশাহ হিসেবে মনোনয়ন দেন। ৩২ বছর বয়সী সালমান ইতোমধ্যেই সৌদি আরবের প্রতিরক্ষার দিকটি দেখভাল করতেন।

সৌদি রাজকুমার মোহাম্মদ বিন সালমান; Source: Reuters

২০১৫ সালে প্রণীত “ভিশন ২০৩০” ছিল তার গৃহীত উল্লেখযোগ্য একটি পদক্ষেপ। কিন্তু সম্প্রতি রাজকুমার সালমান আবারো বিশ্ব মিডিয়ায় আসেন তার বেশ কিছু কাজের জন্য। সৌদি নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি প্রদান ও তেলনির্ভর অর্থনীতির উপর একক নির্ভরতা হ্রাস ছিল অন্যতম। তবে যে কাজের জন্য তিনি সবচেয়ে বেশি আলোচিত (বা সমালোচিত) হয়েছেন তা হল- নভেম্বরে পুরো সৌদি আরব জুড়ে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে’ ব্যাপক ধরপাকড়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে চালানো এই অভিযানে তিনি এগারোজন রাজকুমারকে গ্রেফতার করেন যার ভিতর ধনকুবের আল ওয়ালিদ বিন তালালও ছিলেন।

গ্রেফতারকৃত রাজকুমারদের রিয়াদের রিটজ কার্লটন হোটেলে রাখা হয়- ছবিতে এরকমই দাবি করা হয়েছে; Source: geo.tv

ডোনাল্ড ট্রাম্প তার এক টুইটার বার্তায় সালমানের এই অভিযানকে স্বাগত জানালেও অনেকেই একে সালমানের ভবিষ্যতের ক্ষমতার শিখরে যাওয়ার রাস্তা পরিস্কারের একটি পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। অনেকেই ইয়েমেনে মানবিক বিপর্যয়ের পিছনে যে সৌদি আগ্রাসন দায়ী তার প্রভাবক হিসেবে রাজকুমার সালমানকে অভিযুক্ত করেন।

ইমরান ফারাজের মতো এরকম অসংখ্য ইয়েমেনি শিশুর অপুষ্টি, রোগবালাইয়ের পেছনে রাজকুমার সালমানের ভূমিকাকে অনেকে দায়ী করেন; Source: Reuters

রবার্ট মুগাবের শাসনাবসান

জিম্বাবুয়ের স্বৈরশাসক রবার্ট মুগাবে ছিলেন বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বয়স্ক রাষ্ট্রপ্রধান। দীর্ঘ ৩৭ বছর তিনি জিম্বাবুয়ে শাসন করেছেন। তার এই সুদীর্ঘ শাসনামল ছিল জিম্বাবুয়ের অর্থনৈতিক পঙ্গুত্ব ও রাজনৈতিক নগ্নতার নির্লজ্জ উদাহরণ। অথচ এককালে এই লোকটিই ছিলেন জিম্বাবুয়ের কৃষ্ণাঙ্গদের স্বাধীনতাকামী জনপ্রিয় নেতা। অত্যাচারিত কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ে নিজেও হয়েছিলেন অত্যাচারিত, নিপীড়িত মানুষের জন্য খেটেছেন জেল। কিন্তু ক্ষমতার দম্ভে আর অর্থের লোভে পরবর্তীকালে এই মানুষটিই হয়ে ওঠেন জিম্বাবুয়ের মানুষদের জন্য সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ।

১৯৭৪ সালে জেনেভায় রবার্ট মুগাবে। জিম্বাবুয়ের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুগাবের ভূমিকা অনস্বীকার্য; Source: AP

কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার মুগাবে পরবর্তীতে শ্বেতাঙ্গদের একের পর এক অধিকার হরণ করতে থাকেন। প্রথমদিকে কৃষ্ণাঙ্গরা তার এই নীতির সুফল ভোগ করলেও ধীরে ধীরে সবাই এক সময় বুঝতে শুরু করে একনায়কতন্ত্রের বিভীষিকা। মুগাবের অত্যাচারে অতিষ্ঠ জনগণ তাই হারারের রাস্তায় সামরিক বাহিনীর সাঁজোয়া যানকে হর্ষধ্বনির মাধ্যমে স্বাগত জানায়। নভেম্বরের মাঝামাঝি জিম্বাবুয়ের সামরিক বাহিনী রবার্ট মুগাবেকে একঘরে করে দেশের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে তুলে নেয়।

হারারের রাস্তায় সামরিক বাহিনীর সাঁজোয়া যান; Source: Jekesai Njijizama/AFP

সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট এমারসন নানগাওয়াকে তার উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচনা করা হলেও হঠাৎ করে সরকার ও দলীয় পদ থেকে তাকে বরখাস্ত করেন রবার্ট মুগাবে। স্ত্রী গ্রেস মুগাবেকে ক্ষমতায় আনার পরিকল্পনা থেকেই নানগাওয়াকের মতো অভিজ্ঞ নেতাকে সরিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ ওঠে।

স্ত্রী গ্রেস মুগাবেকে ক্ষমতায় বসানোর পরিকল্পনা রবার্ট মুগাবের শাসনাবসানের অন্যতম কারণ ছিল; Source: Jekesai Njikizana/AFP

দলের উত্তরসূরি নিয়ে চলা এই দ্বন্দ্বের মধ্যেই সেনাবাহিনী জিম্বাবুয়ের নিয়ন্ত্রণ নেয়। এরপর সেনাবাহিনীর পাশাপাশি মুগাবের দল জিম্বাবুয়ের ক্ষমতাসীন জানু-পিএফ পার্টির পক্ষ থেকে জনপ্রিয়তা হারানো এই নেতাকে পদত্যাগের আহ্বান জানানো হয়। এমনকি তার পদত্যাগ দাবিতে ব্যাপক বিক্ষোভ হলেও ক্ষমতা ছাড়তে অস্বীকৃতি জানান মুগাবে। পদত্যাগ না করায় তাকে অভিশংসনের সিদ্ধান্ত নেয় জিম্বাবুয়ের পার্লামেন্ট। কিন্তু বেশিদিন নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেননি ৯৩ বছর বয়সী এই স্বৈরশাসক। ২১ নভেম্বর স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন রবার্ট মুগাবে। শেষ হয় তার ৩৭ বছরের দীর্ঘ শাসনামল।

জিম্বাবুয়ের পার্লামেন্টের সামনে উল্লাসরত সাধারণ জনতা; Source: Ben Curtis/AP

মসুল ও রাক্বা: পতন না মুক্তি?

২০১৪ সালের জুনে আইসিস ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মসুল দখল করে নেয়। এক মাসের ভিতর তারা সিরিয়া ও মসুলে খিলাফতের ঘোষণা দেয়। সেখানে কায়েম করে তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের রাজত্ব। সময়ের সাথে সাথে ভয়ংকর হয়ে উঠতে থাকে তারা। দখল করে নিতে থাকে একের পর এক অঞ্চল।

জুন ২৩, ২০১৪: মসুল দখলের পর এক আইএস যোদ্ধার উল্লাস; Source: REUTERS/Stringer

২০১৬ সালের অক্টোবরে ব্রিটেন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র এমনকি ইরানের সহায়তায় কুর্দি ও ইরাকি সামরিক বাহিনী আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যৌথ বাহিনীর মুহুর্মুহু আক্রমণে অবশেষে পিছু হটে ইসলামিক স্টেটের যোদ্ধারা।

২৬ অক্টোবর, ২০১৬: মসুলে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের লক্ষ্য করে ইরাকের ফেডারেল পুলিশ ফোর্সের রকেট হামলা; Source: Reuters

আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ইরাকের বিশেষ বাহিনীর সদস্যগণ; Source: Goran Tomasevic/Reuters

অবশেষে দখলের ঠিক তিন বছর পর ২০১৭ সালের জুন মাসে আইএসের দখল থেকে মুক্ত করা হয় ইরাকের মসুল শহরের আল-নুরি মসজিদকে। সমাপ্তি ঘোষণা করা হয় আইএসের নেতা বাগদাদীর স্বঘোষিত খিলাফতের। তবে মসুলের মুক্তি এত সহজে হয়নি। প্রায় ৪০ হাজার নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু আর লক্ষ লক্ষ মানুষের বাস্তুহারা হবার করুণ গল্প মসুলের ‘স্বাধীনতা’। ধ্বংস হয় হাজার বছরের প্রাচীন সব সভ্যতা।

লক্ষ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হয় মরুর মধ্যপ্রাচ্যে; Source: Bulent Kilic/AFP

যুদ্ধের নগ্নতায় রেহাই পায়নি নিমরুদের প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যও। নিমরুদ মসুলের ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত এক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান; Source: Safin Hamed/AFP

তবে আইএস হটিয়ে ইরাক যে খুব একটা স্থিতিশীল হয়েছে তা বলা যাবে না। সেপ্টেম্বরে ইরাকি কুর্দিরা স্বাধীনতার প্রশ্নে ভোট দেয় যা ইরাকি সামরিক বাহিনীর সাথে কুর্দি সেনাদের বিবাদকে উস্কে দেয়। ইরানের সহায়তায় ইরাকি সরকার কুর্দিদের হাত থেকে তেলসমৃদ্ধ কিরকুক দখল করে নেয়।

কিরকুক দখলের পথে ইরাকের সামরিক বাহিনী; Source: Ahmad Al-Rubaye/AFP

মসুল থেকে আইএস হটানোর কিছুদিন পর ইসলামিক স্টেটের কথিত রাজধানী সিরিয়ার রাক্বাও মুক্ত হয়। ১৭ অক্টোবর রাক্বার রাস্তায় রাস্তায় মানুষজন উল্লাস করতে থাকে। কিন্তু ততদিনে রাক্বা পরিণত হয়েছে এক মৃত্যু আর ধ্বংসের নগরীতে।

২০ অক্টোবর ২০১৭: আইএসের হাত থেকে রাক্বা দখলের পর প্রহরারত সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সের দুই সদস্য; Source: Bulent Kilic/AFP

ড্রোন ভিডিওতে ধ্বংস নগরী রাক্বা; Source: Guardian News

উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র উচ্চাভিলাষী ও জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা

উত্তর কোরিয়ার সর্বময় তরুণ নেতা ৩৩ বছর বয়সী কিম জং-উনের খামখেয়ালীর মাত্রা ছাড়িয়ে যায় গত ৩ সেপ্টেম্বরের বিকেলে। এদিন উত্তর কোরিয়া হাইড্রোজেন বোমার সফল পরীক্ষা চালায় বলে দাবী করে। উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম কেসিএনএ দাবি করে যে, তাদের কাছে আগের চেয়ে শক্তিশালী হাইড্রোজেন বোমা আছে। আর এই সংবাদ প্রচারের কিছু পরেই যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-জরিপ অধিদপ্তর উত্তর কোরিয়ার পানগেয়ি-রি পারমাণবিক কেন্দ্রের কাছে ৬.৩ মাত্রার ভূমিকম্প রেকর্ড করে। উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে এই ভূকম্পনের কারণ হিসেবে ষষ্ঠবারের মতো চালানো পারমাণবিক বোমার পরীক্ষাকে উল্লেখ করা হয়।

উত্তর কোরিয়ার ষষ্ঠবারের মতো চালানো পারমাণবিক পরীক্ষা; Source: Center for Strategic and Informational Studies

নিউ ইয়র্ক টাইমসের তথ্যানুযায়ী, সর্বশেষ ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে চালানো পঞ্চম পারমাণবিক পরীক্ষার চেয়ে ষষ্ঠ এই পরীক্ষাটি প্রায় ১৬ গুণ বেশি শক্তিশালী এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমা আর নাগাসাকি শহরের উপরে নিক্ষিপ্ত বোমার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি শক্তিশালী।

গত ২৯ নভেম্বর উত্তর কোরিয়া নতুন করে আরো একটি আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালায়। তাদের দাবি, এটি যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত আঘাত হানতে সক্ষম। এরই জের ধরে উত্তর কোরিয়ার উপর নতুন করে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে জাতিসংঘ। আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালানোয় গতকাল শুক্রবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সর্বসম্মতভাবে এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তুত করা এই নিষেধাজ্ঞা খসড়া প্রস্তাবে উত্তর কোরিয়ার দুই প্রধান ব্যবসায়িক অংশীদার রাশিয়া ও চীনসহ নিরাপত্তা পরিষদের ১৫টি রাষ্ট্রের সকলেই পক্ষে ভোট প্রদান করে।

স্বাধীনতার দাবিতে কাতালোনিয়া

স্পেনের উত্তর-পূর্বদিকে অবস্থিত কাতালোনিয়া প্রদেশটি দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীনতার দাবি করে আসছিল। এ বছরের ৯ জুন কাতালোনিয়ার পার্লামেন্ট কর্তৃক স্বাধীনতা ইস্যুতে গণভোটের তারিখ হিসেবে ১ অক্টোবরকে চূড়ান্ত করা হয়। ৬ সেপ্টেম্বর এই নির্বাচনের বৈধতা প্রদানের অনুকূলে একটি আইনও পাশ হয় তাদের পার্লামেন্টে।যথারীতি ১ অক্টোবর ভোট গ্রহণ শুরু হয়। মাত্র ৪৩.০৩ ভাগ ভোটার এতে অংশ নিলেও ভোটারদের ৯২.০১% (২০,৪৪,০৩৮ জন) স্বাধীনতার পক্ষে; অন্যদিকে মাত্র ৭.৯৮% (১,৭৭,৫৪৭ জন) এর বিপক্ষে ভোট দেয়।

স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার কাতালানবাসী; Source: barcelonaexperience.com

অন্যদিকে আগাম এই নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণা করতে স্পেনের সাংবিধানিক আদালতও কালক্ষেপণ করেনি। কারণ হিসেবে তারা ১৯৭৮ সালের স্পেনের সংবিধানকে উল্লেখ করে। সেখানে বলা আছে, বিচ্ছিন্নতার প্রশ্নে স্পেনের কোনো অঞ্চলে গণভোটের অনুমোদন নেই। স্পেনের রাজা ষষ্ঠ ফিলিপও এই গণভোটকে স্বীকৃতি দেননি। ওদিকে প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রাখোয় গণভোটকে অবৈধ বলে ঘোষণা দেন। সেই সাথে কাতালানবাসীদের উপর চলতে থাকে দমন পীড়ন।

স্বাধীনতার প্রশ্নে আয়োজিত গণভোটের দিন পুলিশি ধরপাকড়; Source: REUTERS/David Gonzalez

তবে স্বাধীনতার প্রশ্নে খোদ কাতালানবাসীরাও দ্বিধান্বিত ছিল। তাদের অনেকেই এই স্বাধীনতা চায়নি। গত ২৯ অক্টোবর বার্সেলোনার কেন্দ্রস্থলে প্রায় লাখ তিনেক লোকের সমাবেশ ছিল স্বাধীনতার বিপক্ষে। তবে কি ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে পড়ছে কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার দাবি? এ প্রশ্নের উত্তর ২০১৭ দিতে পারেনি; সমাধানের অপেক্ষায় ২০১৮।

এই জনতারা আবার স্বাধীনতা চায় না, তারা স্পেনের সাথেই থাকতে চায়; Source: Jordi Bataller

এছাড়াও

১ জানুয়ারি জাতিসংঘের নবম মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন পর্তুগালের সাবেক রাজনীতিবিদ অ্যান্তোনিও গুতেরেস।

পাঁচ বছরের জন্য জাতিসংঘ মহাসচিবের দায়িত্ব পালনের জন্য শপথ নিচ্ছেন গুতেরেস; Source: UN Photo/Eskinder Debebe

চার মাসের বিক্ষোভে অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে লাতিন আমেরিকার ভেনেজুয়েলা। বামপন্থী প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে কেন্দ্র করে গত এপ্রিল থেকে শুরু হয় এই বিক্ষোভ

বিক্ষোভে উত্তাল ভেনেজুয়েলা; Source: CNN.com

মে মাসে ফ্রান্স নির্বাচিত করে তাদের সর্বকনিষ্ঠ প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁকে। ৬৫.৫ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন ৩৯ বছর বয়সী তরুণ রাজনীতিবিদ।

নির্বাচনী প্রচারনায় ৩৯ বছর বয়সী মাখোঁ; Source: Robert Pratta/Reuters

জুনে ন্যাটোর ২৯তম সদস্য হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগদান করে মন্টেনেগ্রো। যদিও ২০১৫ সাল থেকেই মন্টেনেগ্রোকে ন্যাটোতে যোগদানের প্রস্তাব করা হয়েছিল; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট এই ব্যাপারে কালক্ষেপণ করছিল।

মন্টেনেগ্রো এখন ন্যাটোর ঊনত্রিশতম সদস্য; Source: euronews.com

জুলাই মাসে পৃথিবীর বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোর সংগঠন জি-২০ জার্মানির হামবুর্গে তাদের বার্ষিক সভায় মিলিত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় করা প্যারিস চুক্তি থেকে সরে আসা যুক্তরাষ্ট্রের কারণে এই সভা শেষতক ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

এ যেন দ্বিধাবিভক্ত বিশ্বনেতাদের সমাবেশ; Source: Reuters/Ian Langsdon

অক্টোবরে চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির ১৯তম কংগ্রেসে দলটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন গণচীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। প্যারিস চুক্তি, আধুনিক চীন গঠন থেকে শুরু করে আরো অনেক যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত তাঁকে বিশ্বনেতৃত্বের আসনে বসিয়েছে।

ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির ১৯তম কংগ্রেসে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং; Source: Reuters/Jason Lee

পরিশেষে আমাদের এই পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা ও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর দিকের ব্যাপারে ২০১৭ সাল কোনো সুখকর বার্তা দিয়ে যেতে পারছে না। পৃথিবীর উষ্ণতম তিনটি বছরের একটি এই ২০১৭ খ্রিস্টাব্দ। প্যারিস চুক্তি থেকে ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়ার ঘোষণা আর বছর জুড়ে সংগঠিত প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড় আর দাবানল আমাদেরকে সামনের কঠিন ভবিষ্যতের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে বিদায় নিচ্ছে ২০১৭…

পৃথিবীকে কোনো ভালো বার্তা দিয়ে বিদায় নিচ্ছে না ২০১৭; Source: noaa.gov

ফিচার ইমেজ: Edited by writer

Related Articles

Exit mobile version