ব্যবহারকারীদের তথ্য সুরক্ষা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ইস্যুতে ব্যর্থ হচ্ছে ফেসবুক, সমসাময়িককালের অন্যতম মুখরোচক বিতর্ক এটি। বিতর্কের তেজ স্তিমিত না হতেই চলে এলো নতুন বিতর্ক। ৭ জুন প্রকাশিত এক বিবৃতিতে ফেসবুক জানিয়েছে, এক সফটওয়্যার ত্রুটির কারণে ১৪ মিলিয়ন ব্যবহারকারীর প্রাইভেট পোস্ট সেটিংস বদলে ‘পাবলিক’ পোস্টে পরিণত হয়েছিলো! এ ঘটনায় আবারও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে ফেসবুকের তথ্য-নিরাপত্তার প্রসঙ্গটি।
ঘটনার বিস্তারিত
বিবৃতিটি থেকে জানা যায়, প্রায় ১৪ মিলিয়ন ফেসবুক ব্যবহারকারী ফেসবুক পোস্টের প্রাইভেসি সেটিংসে ‘ফ্রেন্ডস’ দিয়ে রেখেছিলেন। অর্থাৎ বন্ধুতালিকার নির্ধারিত ব্যক্তিদের বাইরে তাদের সেই পোস্ট অন্য কেউ দেখতে পারত না। কিন্তু ফেসবুকের নিজস্ব কারিগরি একটি ত্রুটির (Bug) জন্য ‘ফ্রেন্ডস’ পোস্টগুলো ‘পাবলিক’ পোস্টে পরিণত হয়, অর্থাৎ লগ-ইন ছাড়াই যে কেউ সেই পোস্টগুলো দেখতে পায়। ফলে ১৪ মিলিয়ন ব্যবহারকারীর এসব তথ্য বন্ধুতালিকার বাইরে সকলের জন্য উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রাইভেসি বদলে যাবার পর পোস্টগুলো অবশ্য ‘পাবলিক’ আইকন চিহ্নিতই ছিলো। কিন্তু যারা ডিফল্টে ‘ফ্রেন্ডস’ সেটিং দিয়ে রেখেছেন এবং সবসময় প্রাইভেট পোস্টই করেন, স্বাভাবিকভাবেই ‘পাবলিক’ আইকনটি সেইসব ব্যবহারকারীদের চোখ এড়িয়ে গেছে । অর্থাৎ ব্যবহারকারীদের একটা বড় অংশ টেরও পাননি যে তাদের পোস্টের গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হয়েছে।
কীভাবে ঘটলো এই ‘ত্রুটি’?
গত ১৮ মে থেকে ২২ মে অবধি ব্যবহারকারীর প্রোফাইলে ছবি ও অন্যান্য ফিচার আইটেম শেয়ারের নতুন পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর সময় ঘটে এই ত্রুটি। ভুলক্রমে ডেভেলপাররা ফিচার আইটেমগুলোকে পাবলিক করবার বদলে সকল নতুন পোস্টের প্রাইভেসিই ‘পাবলিক’ সেট করে দেন। ২২ তারিখই ফেসবুক প্রাইভেট পোস্টসমূহের এভাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ‘পাবলিক’ পোস্ট হয়ে যাবার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে সক্ষম হয়। কিন্তু পোস্টগুলোকে পূর্বতন সেটিংসে ফিরিয়ে নিতে অর্থাৎ ‘প্রাইভেট পোস্ট’ বানাতে লেগে যায় আরো ৫টি দিন। ফেসবুক অবশ্য এটা জানায়নি যে কীভাবে তারা এই ত্রুটির অস্তিত্ব আবিষ্কার করলেন এবং কীভাবেই বা নিশ্চিত হয়ে তারা বলছেন, ভুক্তভোগীর সংখ্যাটা কার্যকরভাবে ১৪ মিলিয়নই!
ওদিকে ফেসবুকের প্রধান গোপনীয়তা কর্মকর্তা এরিক ইগান বলেছেন, “যারা যারা সে সময়ে ভুক্তভোগী হয়েছিলেন, আজ থেকে তাদেরকে আমরা জানিয়ে দিচ্ছি উক্ত ব্যাপারে এবং সে সময়ে করা পোস্টগুলোর ব্যাপারে তাদের রিভিউ চাইছি।” বক্তব্যের শেষটিতে যথারীতি মাফ চাইলেন ইগান। এ নিয়ে অবশ্য ফেসবুক কর্তাব্যক্তিরা কম মাফ চাইলেন না বিগত কয়েক মাসে!
অধুনা ফেসবুকের পূর্বতন কেলেঙ্কারিনামা
মার্চ মাসে সূত্রপাত হয় এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় তথ্যপ্রযুক্তিগত কেলেঙ্কারির। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ট্রাম্পের জন্য ডিজিটাল প্রচারণার কাজ যখন চালাচ্ছিলো ক্যাম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা নামক রাজনৈতিক পরামর্শ প্রদানকারী সংস্থা, তখন তাদের কাছে প্রায় ৮৭ মিলিয়ন ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য পাচার করেছিলো ফেসবুক। অভিযোগ আসবার ৫ দিনের মাথায় ২২ মার্চ জাকারবার্গ ক্ষমা চান সকল ফেসবুক ব্যবহারকারীর কাছে। এ ঘটনায় ফেসবুকের শেয়ারের দাম পড়ে যায় ৮% এবং ৪,৬০০ কোটি মার্কিন ডলার বাজারমূল্য হ্রাস পায়! ব্রিটিশ সংসদে তলব করা হয় তাকে। একই প্রসঙ্গে জাকারবার্গকে মার্কিন সিনেটেও তলব করা হয়েছিলো ৯ এপ্রিল। সেখানে জাকারবার্গ ক্ষমা চান এবং ব্যবহারীদের তথ্য নিরাপত্তাবিধানে ফেসবুককে আরো সুরক্ষিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবার প্রতিশ্রুতি দেন।
এ ঘটনার অব্যবহিত পরেই জন্ম নেয় নতুন বিতর্ক। গত সপ্তাহেই টাইমস এ ফের রিপোর্ট আসে, অ্যাপল, স্যামসাং, হুয়াওয়ের মতো মোবাইল নির্মাতাদের কাছে ফেসবুক তার ব্যবহারকারী ও বন্ধুদের ব্যক্তিগত তথ্য ভাণ্ডারে প্রবেশাধিকার দিয়েছে। চীনা মোবাইল নির্মাতা হুয়াওয়ের নাম নিয়েই বাঁধলো মূল বিপত্তি। এর জের ধরে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যরা ফেসবুকের কাছে জবাবদিহিতা চাইছেন।
আস্থা হারাচ্ছে ফেসবুক?
ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও তথ্য সুরক্ষায় কাজ করা একটি স্বাধীন সংস্থা পনেমোন ইনস্টিটিউটের জরিপ অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুক নিয়ে এতসব নেতিবাচক সংবাদের তোড়ে এর প্রতি মানুষের আস্থা নেমে এসেছে মাত্র ৬৬ ভাগে!
কার্নেগি মেলোন বিশ্ববিদ্যালয়ের গোপনীয়তা প্রকৌশল কর্মসূচির সহ-পরিচালক নরম্যান স্যাডের মতে, ফেসবুক ইতোপূর্বে তথ্য নিরাপত্তা ইস্যুতে ইমেজ সংকটে পড়েছিলো, আবার সেটি থেকে উঠে দাঁড়াতেও পেরেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে যা হচ্ছে, তা হয়ত সামাজিক মাধ্যমের প্রতি ব্যবহারকারীদের স্থায়ী অনাস্থার কারণ হয়েই দাঁড়াবে। ফেসবুক উক্ত সমস্যাসমূহের সমাধান হিসেবে সাইটে একাধিক নতুন ‘সিকিউরিটি কন্ট্রোল’ যোগ করেছে। এমনকি পূর্ণ একটি পাতাই খুলে ফেলেছে কেবল প্রাইভেসি ও সিকিউরিটি সেটিংসের জন্য! কিন্তু সেই পাতাকেও ‘বিভ্রান্তিকর’ বলে মন্তব্য করেছেন স্যাডে।
ফেসবুকের সেই বিবৃতির শেষভাগে বলা হয়েছিলো, “কীভাবে আমরা পণ্য তৈরি করি, কীভাবে সেগুলো আপনাদের তথ্য ব্যবহার করে এবং কীভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত বিভ্রাট দেখা দেয়- এ ব্যাপারে যে আমাদের আরো স্বচ্ছ হওয়া প্রয়োজন, সে সম্পর্কে আমরা পূর্ণ অবগত আছি।” আরো বলা হয়, “যেহেতু এ ধরনের সমস্যায় পড়বার আগেই আমরা সে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি ও করবো, তাই সামনের কয়েক মাসে ব্যবহারকারীরা এ ধরনের অন-প্ল্যাটফর্ম বিজ্ঞপ্তি আরো পেতে পারেন।”
শেষতক কী বুঝলেন পাঠক? ফেসবুকের হয়ত ব্যবহারকারীদের কাছে আস্থা ফিরে পাবার চেষ্টায় কমতি নেই, কিন্তু বারবার ব্যর্থ হওয়া ফেসবুক তথ্য সুরক্ষা ও নিরাপত্তা বিধানের ক্ষেত্রে কি একরকম অসহায়ই হয়ে পড়ছে না? অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে কি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভবিষ্যত? প্রশ্নগুলো তোলা থাক। আপাতত যেটা করণীয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতি-ব্যক্তিগত বা সংবেদনশীল কিছু শেয়ার করা থেকে বিরত থাকুন।
ফিচার ইমেজ: New York Times