মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রায়ই নিজেকে শিক্ষিত, বুদ্ধিমান, প্রতিভাবান ইত্যাদি দাবি করে থাকেন। তিনি এটাও দাবি করেন যে, তিনি সবচেয়ে ভালো শব্দগুলো জানেন। তার নিজের ভাষায়, “I know words, I have the best words.”। অর্থাৎ, “আমি শব্দ জানি, আমার কাছে সবচেয়ে ভালো শব্দগুলো আছে।” কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, তিনি বাচ্চাদের মতো খুবই সহজ, হাস্যকর এবং ব্যাকরণগতভাবে ভুল শব্দ ব্যবহার করেন।
এক গবেষণা অনুযায়ী, ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যবহৃত শব্দগুলো একজন ১১ বছর বয়সী বালকের শব্দভান্ডারের সমতুল্য। তার বক্তব্যে এবং টুইট বার্তাগুলোতে নির্দিষ্ট কিছু শব্দকেই ঘুরে ঘুরে বারবার ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। তবে সবসময়ই যে তিনি সহজ শব্দ ব্যবহার করেন, এমন না। তার ব্যবহৃত কিছু কিছু শব্দ মানুষকে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ফেলে দিয়েছিল যে, এই শব্দ আসলেই অভিধানে আছে কি না। চলুন দেখে নিই এমন কিছু শব্দ, যেগুলো প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কারণে আলোচনায় উঠে এসেছে বারবার।
মাগা (MAGA)
Great news! #MAGA pic.twitter.com/pirHR7lAyT
— Donald J. Trump (@realDonaldTrump) June 16, 2017
মাগা শব্দটি মূলত ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী শ্লোগান “মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন” (Make America Great Again) এর সংক্ষিপ্ত রূপ। ট্রাম্পের এই শ্লোগানটি আমেরিকার সাম্প্রতিক নির্বাচনের ইতিহাসের অন্যতম জনপ্রিয় শ্লোগান। ট্রাম্প নিজেও এর সাফল্যে এতই সন্তুষ্ট হয়েছেন যে, তিনি তার আইনজীবিকে ২০২০ সালের নির্বাচনী শ্লোগান হিসেবে ব্যবহারের জন্য এর কাছাকাছি একটি শ্লোগান “কীপ আমেরিকা গ্রেট” (Keep America Great) নিবন্ধন করার নির্দেশ দিয়েছেন।
শ্লোগানটি যদিও সফল, এবং ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হিসেবে জয়ের পেছনে যদিও শ্লোগানটির বিশাল ভূমিকা আছে, কিন্তু এর সংক্ষিপ্ত রূপ মাগা শব্দটিকে তার সমালোচকরা ব্যাঙ্গাত্মকভাবেই ব্যবহার করে থাকে। কারণ তাদের দৃষ্টিতে, ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পরে আমেরিকা আসলে মহান হয়নি, বরং বিভিন্নভাবে বিশ্বের কাছে বিতর্কিত, সমালোচিত এবং নিন্দিত হয়েছে। তাই মাগা সংক্ষিপ্ত রূপটি যদিও ট্রাম্প নিজেই সর্বপ্রথম উচ্চারণ করেছিলেন, কিন্তু এখন এটি বেশি ব্যবহৃত হয় তার সমালোচকদের দ্বারাই, শ্লোগানটিকে উপহাস করার কাজে। আরবান ডিকশনারিতে মাগা শব্দটির পূর্ণরূপ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, Morons Are Governing America!
বিগলি (Bigly)
We have a presidential candidate who uses the word “bigly” like he believes it’s a real word. Lol
— Geoff Schwartz (@geoffschwartz) May 4, 2016
২০১৬ সালের মে মাসে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন রিপাবলিকান পার্টির পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়নের জন্য লড়ছিলেন, তখন তার প্রতিদ্বন্দ্বী টেড ক্রুজ হার স্বীকার করে প্রতিযোগিতা থেকে সরে দাঁড়ানোর পর আত্মবিশ্বাসী ট্রাম্প তার ভক্তদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “আমরা হারব না, আমরা জয়লাভ করা শুরু করব এবং আমরা বিশালভাবে জয়লাভ করব।” কিন্তু বিশাল জয়লাভ করতে তিনি শব্দটি ব্যবহার করেন, সেটা নিয়েই শুরু হয় আলোচনা। কারণ তিনি বলেছিলেন, “We’re going to win bigly”। যদিও Bigly নামে একটি অভিধানে আসলেই একটি শব্দের অস্তিত্ব আছে, কিন্তু সেটি এতই কম ব্যবহৃত হয় যে, অধিকাংশ মানুষেরই এ বিষয়ে কোনো ধারণা নেই। সামাজিক গণমাধ্যমে হাস্যরস এবং সমালোচনা শুরু হলে মেরিয়াম-ওয়েবস্টার ডিকশনারী টুইট করে জানায় যে, আসলেই শব্দটি ডিকশনারীতে আছে।
ট্রাম্প অবশ্য এর আগে-পরেও একাধিকবার বিগলি শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। অবশ্য অনেকের মতে, তিনি বিগলি বলেননি, বলেছেন, বিগ লীগ (Big League)। বিগ লীগ সত্যিই একটি বহুল প্রচলিত শব্দ, যার অর্থ বড় কিছু। ট্রাম্প নিজেও স্বীকার করেন, তিনি আসলে বিগ লীগই বলেছেন। কিন্তু এতেও তিনি সমালোচনা এড়াতে পারেননি। কারণ বিগ লীগ শব্দটি অ্যাডজেকটিভ বা বিশেষণ, কিন্তু ট্রাম্প সেটিকে ব্যবহার করেছেন অ্যাডভার্ব বা ক্রিয়া বিশেষণ হিসেবে।
কোভফেফে (Covfefe)
that was the moment Trump became prsiduvhirw pic.twitter.com/fKVPPNVFH0
— Anthony Smith (@AnthonyBLSmith) May 31, 2017
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আবিষ্কৃত শব্দগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত, অদ্ভুত এবং হাস্যরস সৃষ্টিকারী শব্দ হচ্ছে কোভফেফে। গত বছর মে মাসের ৩১ তারিখে রাত ১২টার সময় হঠাৎ করেই ট্রাম্প টুইট করেন, “Despite the constant negative press covfefe”, যার অর্থ দাঁড়ায়, “নিরবিচ্ছিন্ন ঋণাত্মক সংবাদ কোভফেফে সত্ত্বেও”। স্পষ্টতই এটি একটি অসমাপ্ত টুইট। ট্রাম্প হয়তো লিখতে চেয়েছিলেন, নিরবিচ্ছিন্ন ঋণাত্মাক সংবাদ প্রচারণা সত্ত্বেও কিছু একটা। অর্থাৎ covfefe শব্দটির স্থানে হয়তো coverage শব্দটি বসার কথা ছিল, কিন্তু শব্দটি ঠিক করা কিংবা বাক্যটি সম্পূর্ণ টাইপ করার আগেই হয়তো টুইট বাটনে চাপ পড়ে বার্তাটি পোস্ট হয়ে যায়।
Does no one on staff have his password? Have they tried the most common ones? 123456, or 11111, or, like … “password”?
— Clive Thompson (@pomeranian99) May 31, 2017
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ভুলবশত পোস্ট হলেও ট্রাম্প টুইট বার্তাটি তাৎক্ষণিকভাবে ডিলিট করেননি। এটি ইন্টারনেটে রয়ে যায় ভোর ছয়টা পর্যন্ত। আর ততক্ষণে সারা দুনিয়া এটি নিয়ে জল্পনা-কল্পনা আর হাস্যরসে মেতে ওঠে। ব্যাপারটি আরও হাস্যকর হয়ে ওঠে, যখন ভোরে ট্রাম্প টুইটটি ডিলিট করে দেন, কিন্তু নিজের ভুল স্বীকার না করে পাল্টা আরেকটি টুইট করে বলেন, “কে বলতে পারে, কোভফেফে শব্দটির প্রকৃত অর্থ কী?” পরদিন হোয়াইট হাউজের নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে যখন একজন রিপোর্টার প্রেস সেক্রেটারি শন স্পাইসারকে ব্যাপারটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন, তখন তিনি উত্তর দেন, কোভফেফে শব্দটির অর্থ শুধু প্রেসিডেন্ট নিজে এবং তার খুব কাছের কিছু মানুষ জানে।
অল্টারনেটিভ ফ্যাক্টস (Alternative Facts)
Kellyanne Conway: Sean Spicer gave “alternative facts”@chucktodd: “Alternative facts are not facts. They’re falsehoods.” pic.twitter.com/QBkoDqoTdp
— Bradd Jaffy (@BraddJaffy) January 22, 2017
এটা অবশ্য সরাসরি ট্রাম্পের নিজের ব্যবহৃত শব্দ না, বরং ট্রাম্পের সাবেক ক্যাম্পেইন ম্যানেজার কেলিঅ্যান কনওয়ে প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন। এনবিসির এক প্রশ্নের উত্তরে প্রেসিডেন্টের অভিষেকের দিন জমা হওয়া লোকসংখ্যা নিয়ে প্রেস সেক্রেটারি শন স্পাইসারের দেওয়া মিথ্যা তথ্যকে ঢাকতে গিয়ে কনওয়ে সেটাকে মিথ্যা হিসেবে স্বীকার না করে বলেন, ওটা ছিল অল্টারনেটিভ ফ্যাক্টস বা বিকল্প সত্য। তার এই শব্দটি ইন্টারনেটে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। টুইটারে হ্যাশটাগ চালু করে মানুষ বিভিন্ন প্রমাণিত মিথ্যা তথ্যকে বিকল্প সত্য হিসেবে উল্লেখ করে তাকে ব্যঙ্গ করতে থাকে।
ফেক নিউজ (Fake News)
ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রিয় শব্দ সম্ভব ফেক নিউজ বা ভুয়া সংবাদ। বিবিসির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন পর্যন্ত ১০৩ বার ফেক নিউজ বা ভুয়া সংবাদ শব্দ দুটো টুইট করেছেন। এছাড়াও তার বিভিন্ন বক্তব্য এবং সাক্ষাৎকারে তো এর উল্লেখ ছিলই। ফেক নিউজ নিঃসন্দেহে বর্তমান সময়ের অন্যতম প্রধান সমস্যা। অনলাইন সংবাদের ওয়েবসাইট নির্মাণ খুব সহজ হয়ে যাওয়া যে কেউ খুব সহজেই এ ধরনের সাইট তৈরি করতে পারছে এবং সামাজিক গণমাধ্যমে সেগুলো ছড়িয়ে দিতে পারছে। ২০১৬ সালে মার্কিন নির্বাচনের আগে ইচ্ছাকৃতভাবে ছড়ানো ভুয়া সংবাদের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেলে ডোনাল্ড ট্রাম্প সেগুলোকে বোঝাতে ফেক নেউজ শব্দ যুগল ব্যবহার করতে শুরু করেন।
তবে তিনি সেখানেই থেমে না থেকে তার পছন্দের অল্প কয়েকটি সংবাদপত্র এবং টেলিভিশন চ্যানেল বাদে বাকি সব সংবাদ মাধ্যমকেই গড়ে ফেক নিউজ হিসেবে আখ্যা দিতে শুরু করলে ব্যাপারটি নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প সিএনএনের হোয়াইট হাউজ প্রতিনিধিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আমি তোমাকে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ দিব না। তোমরা ফেক নিউজ। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প হয়তো জেনে খুশিই হবেন যে, যুক্তরাজ্যভিত্তিক কলিন্স ডিকশনারী তার পছন্দের এই শব্দযুগলকে ২০১৭ সালের বর্ষসেরা শব্দ হিসেবে উপাধি দিয়েছে।
ব্রাগাডোশাস (Braggadocious)
📈 ‘Braggadocio’ is at the top of our lookups right now. https://t.co/tEkLd4PJz3
— Merriam-Webster (@MerriamWebster) September 27, 2016
বিগলিই ট্রাম্পের ব্যবহৃত একমাত্র শব্দ না, যেটা নিয়ে মানুষ সন্দেহে পড়ে গিয়েছিল যে শব্দটি আসলেই অভিধানে আছে কি না। হিলারীর সাথে নির্বাচনী বিতর্কে নিজের সম্পত্তির বর্ণনা দিতে গিয়ে ট্রাম্প বলেছিলেন, তার বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি আছে, কিন্তু সেটাকে তিনি ব্রাগাডোশাস পদ্ধতিতে বলতে চান না। ট্রাম্পের এই বক্তব্য শুনে শ্রোতাদের অনেকের পক্ষেই বোঝা সম্ভব হয়নি শব্দটি দিয়ে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন। অনেকেই তাই ছুটে যায় অনলাইন ডিকশনারীর কাছে।
জনপ্রিয় ডিকশনারি মেরিয়াম-ওয়েবস্টার জানায়, সেদিন তাদের ডেটাবেজ থেকে সবচেয়ে বেশিবার সার্চ করা শব্দ ছিল এই ব্রাগাডোশাস শব্দটি। ডিকশনারিটি জানায়, শব্দটি খুবই অপরিচিত হলেও আসলেই এর অস্তিত্ব আছে। এটি উনবিংশ শতাব্দীর একটি আঞ্চলিক শব্দ, যার অর্থ অহংকারী বা উদ্ধত।
ফিচার ইমেজ- Clevver News/ YouTube