২০১৮ সালে পাবলিক সার্ভিস বা জনসেবা ক্যাটাগরিতে পুলিৎজার জিতেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস ও নিউ ইয়র্কার। তাদের এ প্রাপ্তি তুলনামূলক বেশি আলোচিত ও প্রশংসিত হচ্ছে, কেননা হলিউডের রঙচঙে চাকচিক্যের আড়ালে প্রভাবশালী পুরুষ কর্তৃক সংঘটিত হওয়া যৌন নিগ্রহের ঘটনাগুলোকে পাদপ্রদীপের আলোয় সর্বপ্রথম তারাই নিয়ে এসেছিল। ভুক্তভোগীদের তালিকায় যেমন বড় বড় নাম ছিল, তেমনি অপরাধীর তালিকায় ছিলো প্রথিতযশা প্রযোজক হার্ভে ওয়েইনস্টেইনের নাম! তারপর তো কেঁচো খুঁড়তে সাপের মতো দশা হলো, নিবন্ধসমূহের প্রভাবে অন্যান্য নারীরাও মুখ খুলতে লাগলেন আর একের পর এক মুখোশ খসে পড়তে শুরু করল প্রভাবশালী অনেক হলিউড পুরুষের। শুধু প্রায় ধামাচাপা পড়া একটি সংবেদনশীল ইস্যু সামনে আনাই নয়, বরং একটি সামাজিক আন্দোলন ‘মি টু’র সূচনা পাইয়ে দেবার মাধ্যমে হলিউডে কাজের পরিবেশের গুণগত পরিবর্তনের পথে সহায়ক হওয়ার জন্য জনসেবা ক্যাটাগরিতে পুরস্কার জেতাটা একরকম অবধারিতই ছিল নিউ ইয়র্ক টাইমস ও নিউ ইয়র্কারের জন্য। সেটি নিয়েই আজকের লেখা।
কারা জিতলেন পুরস্কার
১৬ এপ্রিল নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিৎজারের ১০২তম আসরে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেন প্রশাসক ড্যানা কেনেডি। পুলিৎজার পুরস্কার দেওয়া হয় ২১টি ক্যাটাগরিতে, তবে ‘পাবলিক সার্ভিস’ ক্যাটাগরির রয়েছে বিশেষ মর্যাদা। বাকিগুলোতে ১৫,০০০ ডলার করে প্রাইজমানি দেওয়া হলেও ‘পাবলিক সার্ভিস’ ক্যাটাগরিতে দেওয়া হয় গোল্ডমেডেল। এজন্য এই ক্যাটাগরি এমনিতেই থাকে আকর্ষণের কেন্দ্রে, তদুপরি যে ইস্যুতে কাজ করে নিউ ইয়র্ক টাইমস ও নিউ ইয়র্কার পুরস্কার পেলো, তাও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ! উল্লেখ্য, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভেসে আসার ছবি তুলে এবার ফটোগ্রাফি ক্যাটাগরিতে পুলিৎজার জিতেছেন রয়টার্সের আলোকচিত্রী দল, যে দলে আছেন একজন বাংলাদেশী আলোকচিত্রী, পনির হোসেন।
যা-ই হোক, পুরস্কার প্রাপ্ত নিউ ইয়র্ক টাইমস টিমের নেতৃত্বে ছিলেন জোডি ক্যান্টর ও মেগান টুহে এবং নিউ ইয়র্কার টিমের নেতৃত্বে ছিলেন রোনান ফ্যারো।
রোনান (৩০) হচ্ছেন অভিনেত্রী মিয়া ফ্যারো ও পরিচালক উডি অ্যালেনের পুত্র, শুধু পারিবারিকভাবেই নয়, কর্মগুণেও বনেদী এই সাংবাদিক। কাজ করেছেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের যুবোন্নয়ন বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে, কূটনীতিক হিসেবে চষে বেড়িয়েছেন আফগানিস্তান, পাকিস্তান। সাংবাদিক হিসেবে যৌন নিপীড়নের শিকার নারীদের পাশে দাঁড়ানোর সাহসটা কিন্তু রোনান নিজের ঘরের বেলাতেও দেখিয়েছিলেন। রোনান দাঁড়িয়েছিলেন তার বোন ডিলানের পাশে, যাকে ৭ বছর বয়সে ধর্ষণ করেন তারই বাবা উডি অ্যালেন। যদিও উডি অ্যালেন বরাবরই উক্ত অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছেন।
কেন এবং কীভাবে পুলিৎজার পেলো দুই পত্রিকা
গত অক্টোবরে এই দুই পত্রিকার নিবন্ধগুলোতে ১০০ এর অধিক নারী প্রকাশ্যে প্রযোজক হার্ভে ওয়েইনস্টেইনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি থেকে শুরু করে ধর্ষণের অভিযোগ করেন। যশ তো হারাতে হয়েছেই, হার্ভি ওয়েইনস্টেইনকে রুটিরুজি পর্যন্ত হারাতে হয়েছে! সংসার ভেঙেছে, লন্ডন-নিউ ইয়র্ক-লস এঞ্জেলেসে পুলিশি প্রক্রিয়ায় জেরবার হতে হয়েছে, এমনকি নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানটিও চলে গেছে নিলামে! সহকর্মীদের সাথে অতীত ‘কৃতকর্মের’ জন্য মাফ চাইলেও হার্ভি ওয়েইনস্টেইন অবশ্য যৌন অপরাধের অভিযোগসমূহ স্বীকার করেননি।
নিউ ইয়র্ক টাইমস ও নিউ ইয়র্কারের প্রতিবেদনে ওয়েইনস্টেইনকেই যে একতরফা বলির পাঁঠা হতে হয়েছে তা নয়, বরং অনুসন্ধান করতে গিয়ে অভিযুক্তের তালিকা আরো দীর্ঘতর হয়েছে এবং তাতে জুড়েছে হলিউডের ভেতরের-বাইরের সব প্রভাবশালী পুরুষের নাম! এদের মধ্যে আছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশ জুনিয়র, ‘টুডে’ অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ম্যাট লয়ের, অভিনেতা কেভিন স্পেসি, বেন অ্যাফ্লেক, ডাস্টিন হফম্যান, সাংবাদিক চার্লি রোজ, সেন এল ফ্রাঙ্কেন প্রমুখ।
এসব ঘটনাপ্রবাহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নতুন জোয়ারের জন্ম দেয়। নারী, পুরুষ, নামীদামি তারকা থেকে সাধারণ মানুষ নির্বিশেষে মুখ খুলতে শুরু করেন তাদের ওপর সংঘটিত হওয়া যৌন অপরাধসমূহের ব্যাপারে। ‘মি টু’ হ্যাশট্যাগের মাধ্যমে সে সমস্ত ‘কনফেশন’-এ আলোড়ন পড়ে যায় গোটা বিশ্বে। নতুন করে বিশ্ববাসী কর্মক্ষেত্রে লৈঙ্গিক অসমতা, যৌন সংবেদনশীলতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ভাবতে শুরু করে। সমস্যা সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে মানা হয় সেই সমস্যাকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসার কাজটিকে এবং সেই কাজটিই নিউ ইয়র্ক টাইমস ও নিউ ইয়র্কার করতে পেরেছে বলে তারাই জিতে নিয়েছে পুলিৎজার।
তবে একই উপলক্ষে টুইটারে ‘মি টু’ হ্যাশট্যাগের সূচনা হয়েছিল আসলে দীর্ঘ এক দশক আগে, তারানা বার্কের হাত ধরে। ওয়েইনস্টেইনের মুখপাত্র হোলি বেয়ার্ড তার ‘বস’ এর ব্যাপারে মুখ না খুললেও পুলিৎজার নিয়ে ঠিকই ‘বিশেষজ্ঞ’ মত দিয়েছেন। তার মতে, পুলিৎজার দিলে তারানা বার্কেকে দিন, নিউ ইয়র্ক টাইমস বা নিউ ইয়র্কারকে কেন!
হার্ভির সর্বশেষ হালচাল
মামলায় জর্জরিত হার্ভি ওয়েইনস্টেইন ২৪ মে নিউ ইয়র্ক পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এর পরপরই ১০ লাখ ডলারের বিনিময়ে জামিন পান তিনি। গত ৪ জুন নিউ ইয়র্কের আদালতে ৩টি মামলার যৌথ শুনানিতে তিনি নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেছেন। দোষী প্রমাণিত হলে ২৫ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে এই ‘মুভি মোগল’ এর।
এক নজরে ‘হার্ভি’নামা
৫ অক্টোবর প্রথম নিউ ইয়র্ক টাইমস অভিনেত্রী রোজ ম্যাকগোয়ান ও অ্যাশলে জুডকে উদ্ধৃত করে যৌন নিগ্রহের অভিযোগ আনে হার্ভির বিরুদ্ধে। অভিযোগসমূহের মধ্যে ছিল বডি ম্যাসাজে বাধ্য করা, নগ্নতা প্রদর্শন, ক্যারিয়ারের প্রলোভন দেখিয়ে যৌনকার্যে বাধ্য করা।
দুই দিনের মাথায় ব্যক্তিগত আইনজীবী লিসা ব্লুম হার্ভির পক্ষে আইনী লড়াই থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। তার পরদিনই হার্ভিকে তারই প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি বোর্ড সদস্যের পদ থেকে অব্যহতি প্রদান করে।
১০ অক্টোবর নিউ ইয়র্কারে আরো ১৩টি অভিযোগ ছাপা হয়, যার ৩টি ছিল স্পষ্ট ধর্ষণ। মেরিল স্ট্রিপ, জর্জ ক্লুনির মতো তারকারা একে একে ধিক্কার জানাতে থাকেন হার্ভির প্রতি।
নিউ ইয়র্কারের ১০ মাসের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে দুই অভিনেত্রী এশিয়া আর্গেন্তো ও লুসিয়া স্টোলারের নাম। ১৯৯৭ সালে এশিয়াকে এবং ২০০৪ সালে লুসিয়াকে ধর্ষণ করেন তাদের প্রযোজক হার্ভি।
হার্ভির একাধিক সিনেমার অভিনেত্রী মিরা সরভিনোও হার্ভির বিরুদ্ধে নিউ ইয়র্কারের কাছে দেগেছেন যৌন সম্পর্কে বাধ্য করবার অভিযোগ।
সবচেয়ে বড় বোমা এরপর ফাটান দুই সুপারস্টার গিনেথ প্যাল্ট্রো ও অ্যাঞ্জেলিনা জোলি! তারাও মিডিয়ার সামনে জানান, হার্ভির কাছে যৌন নিগ্রহের শিকার তারাও! ফলশ্রুতিতে বারাক ওবামা, বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচ, লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিওর মতো ব্যক্তিত্বদের কাছ থেকে হার্ভির জন্য আসতে থাকে নিন্দাবাদ!
এরই মধ্যে সংসার ছেড়ে চলে যান হার্ভির স্ত্রী।
লিসা রোজ, এলিস ইভান্সের মতো অভিনেত্রীদের কাছ থেকে যৌন হয়রানির অভিযোগ আসবার পর পুনরায় ধর্ষণের অভিযোগ আসে হার্ভির বিরুদ্ধে। ব্রিটিশ অভিনেত্রী লিসেট অ্যান্থনি, প্রোডাকশন-গার্ল মিমি হ্যালেয়ি, ডমিনিক হুয়েট, নাতাশিয়া মালতে, ড্যারেথ হ্যানাহ সহ প্রমুখ অভিনেত্রী ধর্ষণের অভিযোগে বিদ্ধ করেন হার্ভিকে।
ওদিকে কেট উইন্সলেট জানান আরেক তথ্য। ২০০৯ সালে অস্কার জয়ের দিন নাকি মঞ্চে ইচ্ছা করেই নিজ প্রযোজক হার্ভিকে তিনি ধন্যবাদ জানাননি তার লাম্পট্যের জন্য!
অক্টোবরের ১৬ তারিখ জানা যায়, এই ভদ্রলোকের বিরুদ্ধে ১৯৮০, ১৯৯২, ২০১০, ২০১১ ও ২০১৫ সালে পৃথক পৃথক যৌন কেলেঙ্কারির ঘটনায় মামলার কাজ চলছে লন্ডনে।
১৭ অক্টোবর গেম অব থ্রোন্সের ‘সেরসেই ল্যানিস্টার’ খ্যাত লেনা হেডিও যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করেন হার্ভির বিরুদ্ধে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় হার্ভিকে দেওয়া সম্মাননা প্রত্যাহার করে নেয় ১৮ তারিখ।
১৯ অক্টোবর টুয়েলভ ইয়ার্স আ স্লেইভ ছবির অস্কারজয়ী অভিনেত্রী লুপিতা নিয়োঙ্গেও নিউ ইয়র্ক টাইমসের কাছে হার্ভির যৌন লালসার শিকার হবার কথা জানান।
জেল্ডা পার্কিন্স নামক হার্ভির এক সহকারী অভিযোগ করেন, তাকে হার্ভি ১ লাখ ৬৬ হাজার ডলার দিয়েছিলেন মুখ ‘না খোলা’র শর্তে।
নভেম্বরের শেষ দিকে খ্যাতনামা অভিনেত্রী সালমা হায়েক জানান, তাকেও যৌন হয়রানি করেছেন হার্ভি।
উমা থারম্যান, অ্যাশলে জুডসহ বিভিন্ন অভিনেত্রীর পক্ষ থেকে আসা অভিযোগ ফেব্রুয়ারি জুড়ে টানা ছেপে চলে নিউ ইয়র্ক টাইমস।
২০১৭ এর শেষভাগে নিউ ইয়র্ক টাইমস ও নিউ ইয়র্কারের এই সংবাদগুলোর প্রণোদনাতেই ২০০৬ সালে শুরু হওয়া ‘মি টু’ হ্যাশট্যাগ পুনরায় জনপ্রিয় হতে শুরু করে এবং বিশ্বব্যাপী এই হ্যাশট্যাগের ব্যানারে প্রকাশ হতে থাকে সাধারণ অসংখ্য মানুষের তিক্ত যৌন অভিজ্ঞতার কথা!
সুস্থ এই ‘নিষ্ক্রমণ’ জনসচেতনতা তৈরিতে যে সহায়ক তা বলবার অপেক্ষা রাখে না। আর এক্ষেত্রে সচেতনতা বিস্তারের উপলক্ষ হয়েছিলেন হার্ভি ওয়েইনস্টেইন। নিন্দাবাদ জানানোর পর কিছুটা ধন্যবাদও তাকে দিতে পারেন, যদি তার বাহানায় বিশ্বজুড়ে কর্মক্ষেত্রে যৌন অপরাধ কিছুটা হলেও কমে!
Featured Image Source: BBC