কেউ মিথ্যা কথা বলছে কিনা, সেটা বোঝা সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয় আদালতে। যদি এমন কোনো পদ্ধতি থাকতো যে, আদালতে কেউ মিথ্যা সাক্ষ্য দিলেই সাথে সাথে ধরা পড়ে যাবে? এমন দিন হয়তো খুব বেশি দূরে না। বিজ্ঞানীরা এমন একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন সফটওয়্যার আবিষ্কারের দাবি করছেন, যা কেউ মিথ্যা কথা বলছে কি না, তা নির্ণয় করতে পারবে।
সফটওয়্যারটি তৈরি করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ডের (UMD) গবেষকরা। তারা এর নাম দিয়েছেন ডিসেপশন অ্যানালাইসিস অ্যান্ড রিজনিং ইঞ্জিন (Deception Analysis and Reasoning Engine) বা সংক্ষেপে DARE। তাদের দাবি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন এ সফটওয়্যারটি কোর্টরুমের ভিডিও দেখে বলে দিতে পারে সাক্ষী সত্য বলছে, নাকি মিথ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছে।
মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের গবেষক দলের প্রধান ল্যারি ডেভিস, যিনি সেন্টার ফর অটোমেশন রিসার্চের চেয়ারম্যান, তিনি জানান, ডেয়ার নামক এই সফটওয়্যারটিকে আদালতের বিভিন্ন ভিডিও বিশ্লেষণের মাধ্যমে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। সাধারণত মানুষ যখন মিথ্যা কথা বলে, তখন তার চেহারায় বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন আসে। যেমন ভ্রু কুঁচকে যায়, ঠোঁটের কোণা বেঁকে যায়, গলার স্বরের তীব্রতা পরিবর্তিত হয়ে যায়। অনেক সময়ই এই পরিবর্তনগুলো এত সূক্ষ্ম হয় যে, মানুষ তা ধরতে পারে না।
কিন্তু সফটওয়্যারটিকে এই পরিবর্তনগুলো শেখানোর পর বিভিন্ন ভিডিওর সাহায্যে প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত করা হয়েছে। এসব ভিডিওতে আগে থেকেই জানা ছিল বক্তা মিথ্য কথা বলছে। প্রশিক্ষণ শেষে যখন পরীক্ষা করার জন্য নতুন ভিডিও দেওয়া হয়েছে, তখন দেখা গেছে সফটওয়্যারটি আশাতীতভাবে মিথ্যা বক্তব্য শনাক্ত করতে পেরেছে। গবেষণা দলের সদস্য অধ্যাপক ভারত সিং বলেন, মানুষকে মিথ্যা শনাক্ত করার নিয়মগুলো শিখিয়ে দেওয়ার পরও মানুষ যেখানে র্যাংকিং অনুযায়ী ০.৫৮ নাম্বার পায়, সেখানে ডেয়ার সফটওয়্যারটি পায় ০.৯২২। সফটওয়্যারটি নিঃসন্দেহে মানুষের চেয়ে আরো নির্ভুলভাবে মিথ্যা শনাক্ত করতে পারে।
মিথ্যা শনাক্ত করার প্রচেষ্টা অবশ্য এটিই প্রথম নয়। অপরাধীরা সত্য বলছে কিনা, তা নির্ণয় করার জন্য তদন্ত কর্মর্তারা বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেন। কিন্তু সেগুলো আদালতে গ্রহণযোগ্য হয় না। যেমন ট্রুথ সেরাম পান করিয়ে সত্য বলতে বাধ্য করা আইনগতভাবেই নিষিদ্ধ। অন্যদিকে পলিগ্রাফ ব্যবহার করে তদন্ত কর্মকর্তারা জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন একটি সম্যক ধারণা পাওয়ার জন্য কিন্তু আদালত সেটাকে নিশ্চিত প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করে না।
ডেয়ারের উদ্ভাবকরা আশা করেন, তাদের সফটওয়্যারটি এক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সূচনা করতে পারবে। তাদের আশা, আদালত তাদের সফটওয়্যারটিকে ব্যবহারের অনুমতি দিবে। অবশ্য ডেয়ার সম্পর্কিত গবেষণাপত্রটি এখনও পিয়ার রিভিউড কোনো জার্নালে প্রকাশিত হয়নি। কেবলমাত্র সেটা হওয়ার পরেই বোঝা যাবে সফটওয়্যারটির ভবিষ্যত কতটুকু। তাদের গবেষণার ফলাফল এবং সফটওয়্যারটি এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে Association for the Advancement of Artificial Intelligence (AAAI) এর ২০১৮ সালের কনফারেন্সে উপস্থাপন করার কথা আছে।
সবাই অবশ্য গবেষণাটির উদ্ভাবকের মতো একই রকম আশাবাদী না। ইনস্টিটিউট অফ ইলেক্ট্রিকাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার্সের Global Initiative for Ethical Considerations in Artificial Intelligence and Autonomous Systems এর নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান রাজা চাতিলা বলেন, সফটওয়্যারটি হয়তো খুবই ভালো ফলাফল দিচ্ছে, কিন্তু খুবই ভালো আর সম্পূর্ণ নিখুঁত এক কথা বলা যায় না। কাজেই এটিকে সাবধানে ব্যবহার করতে হবে। তবে তিনি নিজেও বিশ্বাস করেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন সফটওয়্যারের মাধ্যমে চেহারা এবং অঙ্গভঙ্গি শনাক্ত করার প্রযুক্তি যেভাবে দ্রুত উন্নত হচ্ছে, তাতে নির্ভুলভাবে মিথ্যা শনাক্ত করতে পারা আর মাত্র কয়েক বছর সময়ের ব্যাপার।
ফিচার ইমেজ- standard.co.uk