অঙ্কিত আর শেহজাদি। পশ্চিম দিল্লির রঘুবীর নগরের প্রেমিক-যুগল। হিন্দু ছেলের সাথে সম্পর্ক মেনে নিতে পারেনি মুসলিম শেহজাদির পরিবার। সম্মানের দোহাই দিয়ে অঙ্কিতকে হত্যা করেছে মেয়ের পরিবার। ওদিকে সন্তান হারাবার ব্যথা বুকে চাপিয়ে অঙ্কিতের পরিবার দেখালো ভালোবাসা আর মানবতার মহত্ব।
গত ৩ জুন অঙ্কিত সাক্সেনার বাবা যশপাল সাক্সেনা আয়োজন করেছিলেন এক অভিনব ইফতারের। অভিনবত্ব তার আয়োজনের উদ্দেশ্যে নিহিত। যশপাল ছেলের জন্য ন্যায়বিচার চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি দেখছিলেন এই হত্যাকে ঘিরে সাম্প্রদায়িকতা উসকানো হচ্ছে, ঘৃণা ছড়িয়ে ফায়দা লুটছে বজরং দলের মতো কিছু স্বার্থান্বেষী চক্র। তাই এত শোক আর থমথমে অবস্থার মাঝেও সবার মধ্যে ভালোবাসার বারতা ছড়িয়ে দিতে তিনি হিন্দু, মুসলিম, শিখ প্রতিবেশীদের নিয়ে আয়োজন করেন এক আন্তঃধর্মীয় ইফতারের।
যশপালের বক্তব্য, “হ্যাঁ, আমার সন্তানকে যারা হত্যা করেছে, তারা মুসলমান। কিন্তু তাই বলে সকল মুসলমানকে আপনি দায়ী করতে পারেন না। দাঙ্গা ছড়ানোর জন্য এ ঘটনাকে ইস্যু করবেন না দয়া করে।”
ইফতারে সাক্সেনা বাড়িতে সমাগম হয়েছিলো প্রায় ৩০০ লোকের। আমন্ত্রণসহ কিংবা ছাড়াই সাধারণ মানুষ উৎসাহভরে যোগ দিয়েছিল এ সম্প্রীতির আয়োজনে। তাদের আপ্যায়ন করা হয় ফল, বিরিয়ানি আর কোমল পানীয় দিয়ে। এ ঘটনাটিকে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে তুলে ধরছেন মূলধারার ভারতীয় প্রগতিশীল গণমাধ্যম ও সমাজকর্মীরা। শোক বা প্রতিহিংসাকে ছাপিয়ে বৃহত্তর স্বার্থচিন্তা করতে পারা কিংবা সকল সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে ভালোবাসাকে স্থান দেবার যে শিক্ষা সাক্সেনার পরিবার দেখিয়েছেন, তা প্রশংসিত হচ্ছে সর্বত্রই।
যেভাবে প্রাণ গিয়েছিল অঙ্কিতের
অঙ্কিত ও শেহজাদির ছিল তিন বছরের প্রেম। অঙ্কিত হিন্দুধর্মী হওয়ায় এ সম্পর্ক মেনে নিতে পারেনি শেহজাদির পরিবার। যোগাযোগে বারবার মানা করা সত্ত্বেও একদিন ভাইয়ের কাছে মোবাইলে রোমান্টিক এসএমএস-সহ ধরা পড়ে শেহজাদি। স্বাভাবিকভাবেই এ নিয়ে বাসায় হুলস্থূল বেধে যায়। এরপর মুসলিম এক ছেলের সাথে জোরপূর্বক শেহজাদির বিয়ে ঠিক করা হলে ঘর ছেড়ে একেবারে বেরিয়ে আসে সে। ফোন দিয়ে টাগোর গার্ডেন মেট্রোস্টেশনে অঙ্কিতকে আসতে বলে সে। অঙ্কিতও বাইক, টাকা নিয়ে বাসা থেকে বেরোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সেদিন ছিল পহেলা ফেব্রুয়ারি সকালবেলা।
মামলার চার্জশিটে বলা হয়েছে, এ হত্যাকাণ্ড হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। শেহজাদির বাবা আকবর আলী বিছানার নিচ থেকে ৮ ইঞ্চি ছুরি বের করে বেরিয়ে পড়েন ঘটনার সময়। বাসার কাছে একটি স্টুডিওতে ফোন করে ডেকে নেন অঙ্কিতকে, জিজ্ঞেস করেন মেয়ে কোথায়। এরপর কথায় কথায় লেগে যায় হাতাহাতি। ওদিকে মারামারির শুরুর দিকে অঙ্কিতের বন্ধু অন্মোল সিং বাধা দিতে এলে আকবর বলেন ওঠেন, “এখানে নাক না গলিয়ে নিজেদের বোনেদের দিকে মনযোগ দাও।” এই ফাঁকে ফিসফিসিয়ে অন্মোলের কানে অঙ্কিত বলে টাগোর মেট্রোস্টেশন থেকে শেহজাদিকে নিয়ে থানায় অপেক্ষায় করবার জন্য। উল্লেখ্য, অঙ্কিত আগে থেকেই চাইছিলেন বিষয়টির একটি পুলিশি সুরাহা করতে।
বাসার কাছে ছেলেকে কে বা কারা পেটাচ্ছে এই খবর পেয়ে ছুটে যান অঙ্কিতের মা। প্রত্যক্ষদর্শী মতে, অঙ্কিতের মা কমলেশ সন্তানকে বাঁচাতে ছুটে যেতে চাইলেও তাকে ধরে রাখেন শেহজাদির মা, ভেঙে যায় তার পাঁজরের হাড়। অন্যদিকে অঙ্কিতকে ধরাশায়ী করতে লাথি-ঘুষিতে আকবরের সাথে যোগ দিয়েছিল শেহজাদির মামা আর ভাইও। মায়ের করুণ প্রাণভিক্ষাকে উপেক্ষা করে অঙ্কিতের গলায় ছুরি দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করেন শেহজাদির বাবা। রক্তাক্ত অঙ্কিতকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেনি, পুলিশও ডাকেননি, অথচ অনেকেই দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলেন। অঙ্কিতের মা চেষ্টা করছিলেন আঁচল চাপিয়ে ছেলের রক্তপাত বন্ধ করার। শেষে রিকশাযোগে হাসপাতালে নেওয়া হয় অঙ্কিতকে। ডিডিইউ হাসপাতালে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
চার্জশিটে আকবর নিজেই স্বীকার করেছেন, “আমি ছুরি নিয়ে বেরিয়েছিলাম কেননা আমি জানতাম আমার মেয়ে ওর সাথেই দেখা করতে গেছে। হ্যাঁ, হত্যা করতেই গিয়েছিলাম, কেননা প্রতিবেশীদের থেকে রোজ খোঁটা শোনা লাগছিলো আমার।”
শুরুতে হত্যাস্থলে নিজেকে অনুপস্থিত দাবি করলেও পরবর্তীতে দায় স্বীকার করেছেন শেহনাজ। ওদিকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় হত্যায় শেহজাদির বাবা ও মামার মধ্যে কোনো অনুশোচনাই নাকি ছিল না! উল্লেখ্য, হত্যার পর খায়ালা পুলিশ স্টেশনে দণ্ডবিধি ৩০২ ও ৩২৩ ধারায় বাদী হয়ে মামলা করেন অঙ্কিতের বাবা। মামলার এজাহারে অভিযুক্ত করা হয় শেহজাদির মা-বাবা-মামা ও ১৬ বছর বয়সী ভাইকে। বর্তমানে শেহজাদির মা-বাবা-মামা রয়েছেন তিহার কারাগারে আর কিশোর ছোট ভাইটিকে পাঠানো হয়েছে সংশোধন কেন্দ্রে। আর শেহজাদি আছেন একটি আশ্রয়কেন্দ্রে।
বেড়েই চলেছে অনার কিলিং
আলজাজিরার এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে ২০১৬ সালে অনার কিলিং বেড়ে যাবার হার ৮০০%! সে বছরের ডিসেম্বরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী হংসরাজ অহিরের সংসদে দেওয়া বক্তব্য অনুযায়ী, ভারতীয় পুলিশ যখন থেকে সাধারণ হত্যা থেকে ‘অনার কিলিং’ পৃথকভাবে তদারক শুরু করল, এরপর ২০১৪ সালে ২৮টি রিপোর্ট এসেছে অনার কিলিংয়ের, যেটি ২০১৫ গিয়ে ঠেকে ২৫১তে! ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর মতে, এসব ঘটনা বেশি ঘটছে উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানার প্রত্যন্ত অঞ্চলে। উপমহাদেশীয় সমাজে নারীদের সমান চোখে দেখা এবং বিয়ে-সম্পর্কের ক্ষেত্রে মত দেবার অধিকারকে খর্ব করা হয় বলেই অনার কিলিং এভাবে জেঁকে বসেছে বলেই মতামত বিশেষজ্ঞদের।
ন্যায়বিচারের অরণ্যে রোদন
এ ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে ইদানিংকালে সামাজিক মাধ্যমে দু’টো বাজে প্রবণতা ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান। অপরাধীদের প্ররোচিত করা হয়েছে, এই বাহানায় অপরাধকে একরকম বৈধতা দেওয়া হচ্ছে হরহামেশা। অন্যদিকে ভুক্তভোগীকেই দোষারোপ করা হচ্ছে তার ভোগান্তি বা ক্ষতির জন্য। একই ব্যাপার ঘটছে দিল্লির ঘটনায়। মুসলিম মৌলবাদীদের চোখে ‘অবৈধ সম্পর্ক’-ই যেহেতু হত্যার মূল কারণ, তাই শেহজাদির পরিবারকে তারা সম্পূর্ণ দোষী ভাবতে নারাজ। অন্যদিকে সমাজের হিন্দু রক্ষণশীল একটা অংশের কাছে ‘শেহজাদি’-ই যত অঘটনের মূল!
তো শেহজাদি কেমন আছে? শেহজাদি ঠিকই প্রিয়জন হারাবার বেদনায় আকুল, জেলে যাওয়া স্বজনদের কৃতকর্মে স্তব্ধ। জেলে দিনরাত পড়ে পড়ে বিলাপ করছিলেন তিনি, ওদিকে একই কলোনি এবং উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুর, গোরখপুরে থাকা তার আত্মীয়রাও শেহজাদিকে গ্রহণে পাচ্ছে ভয়। পাছে না এই মেয়ে তাদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলার উপলক্ষ্য হয়! অবশ্য এই ভয়ও যে খুব অনায্য তা নয়, কেননা বজরং দলের মতো হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর হুমকিধামকির শিকার তারা নিয়মিতই হচ্ছেন।
ফেব্রুয়ারির ৪ তারিখেই দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল জানিয়েছিলেন, অঙ্কিতের পরিবারকে ন্যায়বিচার পাইয়ে দিতে যা করা লাগে, তিনি করবেন। সেই কথামতো মে’র প্রথম সপ্তাহে মামলার চার্জশিটও দায়ের করা হয়। হয়তো অঙ্কিতের পরিবার নায্য বিচার পাবেন, সর্বোচ্চ সাজা হবে দোষীর। কিন্তু শেহজাদিকে আশ্রয় দিতে কতটা প্রস্তুত সমাজ? হয়তো ‘অপয়া’/’খারাপ মেয়ে’র তকমা আর নিরাপত্তা ঝুঁকি মাথায় নিয়েই আজীবন চলতে হবে তাকে। অথচ কোনো দোষ না থাকার পরও প্রিয়জন হত্যা ও প্রিয়জনের জেলে যাওয়ার মতো দু’টো বড় ধাক্কা এসেছে তার জীবনে।
অঙ্কিত একবারই মরেছেন, শেহজাদি হয়তো সারাজীবন মরবেন। ন্যায়বিচার শুধু আদালতেই হয় না, আমাদের মানসিকতাতেও হয়- এই উপলব্ধিটি যদি অঙ্কিতের মহাত্মা পরিবারের মতো আমাদেরও আসে, তবেই শেহজাদি ন্যায়বিচার পাবে, আর দিনশেষে জয় হবে মানবতা-ভালোবাসারই।
Featured Image Source: The Guardian