টুইটার সম্রাট ডোনাল্ড ট্রাম্প!

সম্প্রতি ট্রাম্প আলোচনায় এসেছেন তার বিখ্যাত ‘পারমাণবিক বোতাম’ তত্ত্ব দিয়ে। কিম জং উনের এক টুইট বার্তার জবাবে তিনি মন্তব্য করেছিলেন তার ‘ পারমাণবিক বোতাম’ নাকি কিম জং উনের থেকেও বড় আর শক্তিশালী।

Source:twitter.com

এই টুইটটি প্রকাশের পর হাসির রোল পড়ে যায় গোটা টুইটার পাড়ায়। যে যতটা পারে, সৃষ্টিশীল উপায়ে কৌতুক করেছে সেটি নিয়ে। সবচেয়ে মজাদার কৌতুকটি বোধ হয় এসেছিলো কেএফসির যুক্তরাজ্য ও আয়ারল্যান্ডের অফিশিয়াল টুইটার একাউন্ট থেকে। সেখানে বলা হলো,

“ম্যাকডোনাল্ডস প্রধান রোনাল্ড মাত্র বলেছেন তার ডেস্কে নাকি একটি ‘বার্গার অব অলটাইমস’ রয়েছে। কেউ কি ঐ বড় জুতো, লাল নাকওয়ালা লোকটাকে জানাবেন, যে আমার কাছে আরো বড় ও শক্তিশালী খাবারের বাক্স আছে, এবং আমারটা তার থেকেও গ্রেভি?”

Source:twitter.com

টুইটারে ট্রাম্পের এমন হাস্যকর মন্তব্য কিংবা তাকে/তার কথাকে নিয়ে এমন কৌতুক কিন্তু মোটেও নতুন কিছু নয়। টুইটারের নতুন অবতার হয়ে যেন আবির্ভূত হয়েছেন বিশ্বের ক্ষমতাধর এই নেতা। ট্রাম্প কখন কী বলেন, সেই অনিশ্চয়তার চমক পেতে অপেক্ষমান ভক্তদের কল্যাণে তিনি পরিণত হয়েছেন ‘টুইটার সেলেব্রিটি’তে। কিন্তু অতিকথনের জেরে আবার অনেক রাজনীতিক বা বিশ্লেষক তার বুদ্ধিদীপ্ততা ও মানসিক সুস্থতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। আজ থাকছে সেসব নিয়েই দু’চার কথা ও নিকট অতীতের নির্বাচিত বচনের চর্বিতচর্বন।

জলবায়ু নিয়ে ‘টুইট-অমৃত’

ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে অনেকেই কৌতুক করেন; আবার ট্রাম্প সাধারণভাবে যা বলেন, অনিচ্ছাকৃতভাবে ও ঘটনাক্রমে তার অনেক কিছুই কৌতুক হয়ে যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজে কি সজ্ঞানে কৌতুক করেন না? উত্তরটি হচ্ছে, ‘করেন’। তবে সেগুলো বেশ বাজে কৌতুক হিসেবেই সমালোচকদের নিন্দে কুড়িয়েছে। এই যেমন, নিউ ইয়র্কের প্রবল শীত ও তুষারপাত নিয়ে তিনি বলেছিলেন, “আমাদের গ্লোবাল ওয়ার্মিং প্রয়োজন।” কৌতুকটি প্রেসিডেন্ট হবার আগে করেছিলেন ট্রাম্প, প্রেসিডেন্ট হবার পরও একই ধরনের কৌতুকই করেছিলেন। আমেরিকার শীতপীড়িত পূর্ব উপকূলের জন্য ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং’ কামনা করেছেন তিনি।

এগুলোকে বাজে কৌতুক বলা হচ্ছে, কেননা তাতে একটি প্রশ্ন উত্থিত হয়েছে। তা হলো, বিজ্ঞ প্রেসিডেন্ট কি তবে জলবায়ু আর আবহাওয়ার তফাতটাই জানেন না?

ওদিকে ট্রাম্প মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তন কোনো ঘটমান বাস্তবতা নয়, বরং তা আমেরিকার অগ্রযাত্রার বিঘ্ন সৃষ্টিতে চীনা অপলাপ!

Source:twitter.com

‘শিশুসুলভ’ ট্রাম্প

কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয়েছিলো মাইকেল উলফের লেখা বিস্ফোরক বই ‘ফায়ার এন্ড ফিউরি’। সেখানে লেখক বলেছিলেন, হোয়াইট হাউজের কর্তাব্যক্তিরা নাকি মনে করেন ট্রাম্পের মানসিক সক্ষমতা ঐ অর্থে জাগ্রত নয়। এমনকি বইটিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনের বরাতে বলা হয়, ট্রাম্প নাকি মানসিকভাবে অতটা ভারসাম্যপূর্ণ নন, যদিও টিলারসন বইয়ের এ উদ্ধৃতিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

অবশ্য অন্যরা তার মানসিক ভারসাম্য বা বুদ্ধি নিয়ে কী ভাবেন, তা গায়ে মাখতে বয়েই গেছে ট্রাম্পের। তার মতে, জগতে তার থেকে বেশি আইকিউ কারোর নেই।

Source:twitter.com

  • তবে ট্রাম্প যা-ই ভাবুন, সাধারণ মানুষ টুইটারে তার শিশুসুলভতা নিয়ে কৌতুক করতে ছাড়েন না। জিমি ফ্যালনের কৌতুকটিই যেমন-

“রাস্তায়  হাঁটছেন ট্রাম্প। সাথে প্রোটোকল হিসেবে দাঁড়ানো সিক্রেট সার্ভিসের দেহরক্ষীরা। পাশে এক কান্নারত বাচ্চাকে দেখে ক্ষেপে গিয়ে ট্রাম্প বললেন, ‘বাচ্চাটাকে এখান থেকে সরাও তো!’ ব্যস, দেহরক্ষীরা ট্রাম্পকে সরিয়ে দিলেন!”

  • প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণায় টুইটার ও বিভিন্ন মাধ্যমে ট্রাম্পের লাগামহীন কথা বলা নিয়ে ব্রায়ান জারও করেছেন কৌতুক,

“অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে একটা জ্বলজ্যান্ত ‘ইউটিউব কমেন্ট সেকশন’ প্রেসিডেন্ট পদে লড়ছে।”

  • “ট্রাম্প হচ্ছেন অনেকটা ‘স্নেক ইন দ্য প্লেন’ ছবির মতো। ছবিটি বিনোদনদায়ী, তবে একবার ভাবুন তো সত্যি সত্যিই আপনার বিমানে সাপ ঢুকলে কেমন হবে? আর এটাই তো হয়েছে। বর্তমানে সেই বিমানটা হচ্ছে আমেরিকার গণতন্ত্র। আর সাপটা হচ্ছে ট্রাম্প।” – সেথ মেয়ার্স

‘ফেইক নিউজ ট্রফি’ তত্ত্ব

গেলো বছরের ২৭ নভেম্বর ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি টুইট ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়। আমেরিকার ‘সেরা’ দুর্নীতিগ্রস্ত-অসৎ গণমাধ্যমকে ‘ফেইক নিউজ’ ট্রফি দেবার ঘোষণাওয়ালা সে টুইটটি রসিক পাঠকদের কাছে পেশ করছি।

Source:twitter.com

স্বাভাবিকভাবেই এমন টুইটের পর ট্রাম্প নিশ্চয়ই নিজেও এই আশা করবেন না যে, তাকে নিয়ে নতুন তামাশার জন্ম হবে না। ফলে যা হওয়ার তা-ই হলো। এই টুইট ঘিরে টুইটারে হিড়িক পড়ে গেলো, ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে কে কত উপাদেয় কৌতুক বানাতে পারে! কৌতুকের আগে একটি সম্পূরক তথ্য দিয়ে রাখি, এটাও হাসাবে আপনাকে। গ্যালাপের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী স্বঘোষিত ‘সকলের প্রিয় প্রেসিডেন্ট’ ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন আছে ৩৭% আমেরিকানের। যা-ই হোক, ফিরে আসি টুইটারে।

  • ট্রাম্পের টুইট রিটুইট করে ডেভিড লিওনহার্ডট ট্রাম্পের জাল বিশ্ববিদ্যালয় সার্টিফিকেটের ছবি দিয়ে ফোড়ন কাটলেন, “আমার তো মনে হয়, এটাই আসল ফেইক নিউজ”।
  • ব্রায়ান ক্র্যাসেন্টেইন তো এককাঠি সরেস।

“একটা ফেইক আমেরিকান বা ফেইক প্রেসিডেন্ট পুরস্কার চালু করলে কেমন হয়? কী মনে হয়, ‘গণতন্ত্র ধ্বংস’ ক্যাটাগরিতে কে এই পুরস্কার পেতে পারে?”

কৌতুকের অংশ যখন মেক্সিকো

মেক্সিকো নিয়ে ট্রাম্প একটু বেশিই চিন্তিত থাকেন, তা সবাইই জানেন। হয়তো দুশ্চিন্তার সেই বাড়াবাড়িতেই বলে বসলেন, দেশটির মেক্সিকো সীমান্ত নাকি ‘আনসিকিউর’! পাঠক, ঠিকই পড়ছেন, উনি ‘আনসিকিউর’-ই বলেছেন।

Source:twitter.com

মার্কিন-মেক্সিকো সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে তার আরেক টুইটও হয়েছে হাসির খোরাক, যেখানে তিনি এই ইস্যুতে এবিসি, সিএনএনসহ প্রথিতযশা সকল গণমাধ্যমের নেতিবাচক খবর প্রচার সম্পর্কে বলেছেন, “যত নেতিবাচক খবর হবে, সব ভুয়া।”

মেক্সিকো প্রসঙ্গে কোনান ওব্রায়েনের নিচের টুইটার কৌতুকটি বেশ মজার।

“ট্রাম্প টুইটারে বলেছেন হিলারি আবার ক্ষমতায় আসাটা নাকি হবে চার বছর মেয়াদী নির্বুদ্ধিতা! তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প লোকটা বেশ। উনি এক বছরের নির্বুদ্ধিতা দেখানোর সাথে তিন বছর মেক্সিকোর সাথে যুদ্ধ করেই কাটিয়ে দেবেন।”

নির্বাচনী প্রচার নিয়ে কৌতুক রঙ্গ

টেলিগ্রাফে প্রকাশিত একটি কৌতুকীয় প্রতিবেদনে একটি চুটকি ছিলো এমন-

“কৃষ্ণাঙ্গদের কাছে ভোট চাইতে গিয়ে ট্রাম্প বললেন, “আর কী কচুটাই বা হারানোর বাকি আছে আপনাদের?” কাকতালীয়ভাবে কথাটা মনে হলো ট্রাম্প তার তিন স্ত্রীকেই বললেন।”

ট্রাম্পের প্রতি স্পষ্টত পক্ষপাতের অভিযোগ রয়েছে মার্কিন গণমাধ্যম ফক্সের বিরুদ্ধে। যেকোনোভাবে ট্রাম্পের কাজের ইতিবাচকতা খোঁজার জন্য তাদের নিয়েও রয়েছে টুইটারে নানা বিদ্রুপ। রয়্যাল উইলসনই যেমন বললেন,

“ট্রাম্প: আমি আমেরিকাকে আবার গ্রেট বানাবো!

ব্যক্তি:  কীভাবে?

ট্রাম্প:  তুমি জাহান্নামে গেলে..

ফক্স:  অন্তত একজনকে (ট্রাম্প) পাওয়া গেলো, যিনি অন্তরের কথা অকপটে বলে দিতে পারেন।”

এবং ট্রাম্পের আরো কিছু ‘বিখ্যাত’ টুইট…

গোল্ডেন গ্লোবের অনুষ্ঠানে নাম উল্লেখ না করে ট্রাম্পকে কিছু খোঁচা দিয়েছিলেন কিংবদন্তি অভিনেত্রী মেরিল স্ট্রিপ। ব্যস, টুইটারে ঘোষণা দিয়ে দিলেন ট্রাম্প, অভিনেত্রী হিসেবে মেরিল নাকি ‘ওভাররেটেড’! কারণ, তিনি ‘ট্রাম্পকে না জেনে, না চিনেই’ কটু কথা বলেছেন। বেচারা, মেরিল আর তার সর্বোচ্চ ৩ অস্কার!

লিঙ্গ অসংবেদনশীল নানা বক্তব্যে নারী অবমাননার অভিযোগ আছে ‘পুরুষতান্ত্রিক’ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে। কিন্তু নিচের টুইটটি দেখুন, ট্রাম্প ধর্ষণের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাতে বিতর্কের আগুন জ্বলবার বদলে বিশ্রী রকমের হাসির খোরাক সৃষ্টি হয়েছে। তার মতে, সেনাবাহিনীতে এত নারী-পুরুষ একত্রে যেহেতু আছে, ধর্ষণ তো হবেই!

Source: twitter.com

টুইটার-কর্মে কি কেবল নিন্দাই কুড়োচ্ছেন ট্রাম্প?

সামাজিক মাধ্যমে ট্রাম্পের অতিকথনের উপযোগিতার ব্যাপারে কিন্তু ট্রাম্পের অনেক নিন্দুকও ইতিবাচক কথা বলেছেন। তাদের কথার সারমর্ম হচ্ছে, একটা সময় বিশ্বের ক্ষমতার চূড়ান্ত কেন্দ্রে থাকা এই পদটিকে ঘিরে সাধারণ মানুষ অনেক রকম ‘মিথ’ পুষতো মনে। কেননা, যোগাযোগের ভিত্তিতে জনগণের সাথে প্রেসিডেন্টের ছিলো আলোকবর্ষ ব্যবধান। কালের ব্যবধানে সেই দূরত্ব ঘুচিয়েছে সামাজিক মাধ্যম। হয়তো ট্রাম্প টুইটারে যা বলেন, সেটি যতটা না তথ্যসমৃদ্ধ ফ্যাক্ট, তার থেকে বেশি ব্যক্তি-সাফাই। কিন্তু এতে লাভ হচ্ছে দুটো। প্রথমত বিনামূল্যে ‘সেলফ-মার্কেটিং’ হচ্ছে, দ্বিতীয়ত আক্ষরিক অর্থেই প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন ‘জনগণের প্রেসিডেন্ট’। আর নিন্দা, সে কোন রাজনীতিকের ভাগ্যে না জোটে? সুতরাং ট্রাম্প যতই বিনোদনদায়ী হন, তিনি ঠিক পথে এগোচ্ছেন বলেই অনেকের মত।

রাস্তার পাশের দোকানে ঝুলছে ট্রাম্পের পিনাতাস বা বিশেষ পুত্তলিকা; Source:nydailynews.com

গত বছরের মাঝামাঝিতে ট্রাম্পের এই অতি-টুইটের টুটি চেপে ধরেছিলো সমালোচকদের অগ্নিবাণ! এসব নিন্দা-বিদ্রুপের একটাই সাধারণ বার্তা ছিলো, টুইটে এত বেশি কথা বলা মোটেও প্রেসিডেন্টসুলভ নয়। এর জবাবে ঠোঁটকাটা ট্রাম্পেরও ‘দাঁতভাঙা’ উত্তর, “আমার সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করাটা প্রেসিডেন্টসুলভ নয় ঠিকই; এটা আসলে আধুনিক প্রেসিডেন্টসুলভ”। এসবের পর ট্রাম্পকে যতই অপছন্দ করুন অথবা পুতিনকে ট্রাম্পের থেকে যতই শক্তিশালী ভাবুন না কেন, আপনি এটা মানতে অবশ্যই রাজি হবেন, টুইটার এখন ট্রাম্পই কাঁপাচ্ছেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার অধিপতি। অধুনা ডোনাল্ড ট্রাম্পও নিজেকে অধিপতি দাবি করতেই পারেন; দেশের, বিশ্বের ও টুইটারের!

ফিচার ইমেজ:facebook.com/sarcasticvibesofficia

Related Articles

Exit mobile version