ফেসবুকে যে কিছু একটা বড় পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে, সেটা বোধহয় পাঠকদের কারোর অজানা থাকার কথা নয়! আর জানবেন না-ই বা কেন! বেশ কিছুদিন ধরে এই খবরেই তো চাউর ফেসবুক পাড়া। ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গের তরফ থেকে ঘোষণা আসার পর থেকেই চলছে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা! কেউ এর পক্ষে তো অন্য কেউ বিপক্ষে! তবে আপনি পক্ষে থাকুন বা না থাকুন, ফেসবুকের এই সম্ভাব্য পরিবর্তন যে অবশ্যম্ভাবী সেটা ধরেই নেওয়া যায়। এই খবর জানার পর থেকেই হয়ত পাঠকদের মনে অনেক প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। আপনার মনে উঁকি দিতে পারে এমন কিছু সম্ভাব্য বিষয় নিয়েই সাজানো হয়েছে এই লেখা। চলুন, জানা যাক তাহলে!
কী বদলাবে?
বর্তমানে ফেসবুকের নিউজ ফিডে বন্ধুদের বিভিন্ন পোস্ট বা ছবির পাশাপাশি পেশাদারি বিজ্ঞাপনের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। কম হওয়া তো দূরে থাক, ফেসবুক ব্যবহারকারীর নিউজ ফিডে একরকম একাধিপত্য স্থাপন করেছে বিভিন্ন ব্র্যান্ড, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও নিউজ মিডিয়ার এসব পেশাদারি বিজ্ঞাপন। ফেসবুক মূলত এই ব্যাপারেই পরিবর্তন আনতে চাচ্ছে; যাতে এসব পেশাদারি বিজ্ঞাপনের বদলে আপনার নিউজ ফিডে বন্ধু-বান্ধব, পরিবারের লোকজনের পোস্টেরই আধিপত্য থাকে।
ফেসবুকের কাছ থেকে এই পরিবর্তনের ঘোষণা বেশ কিছুদিন আগে এলেও এখনো কার্যকর হয়নি। তাই কী কী পরিবর্তন আসতে পারে সেগুলোর সবকিছু হুবহু অনুমান করা সম্ভব নয়। তবে ধারণা করা হচ্ছে, এই পরিবর্তনটি হবে কিছুদিন আগে করা ফেসবুকের একটি পরীক্ষার মতো। ফেসবুক এই পরীক্ষাটি চালিয়েছিল শ্রীলঙ্কা, গুয়েতেমালা, বলিভিয়া, কম্বোডিয়া, সার্বিয়া ও স্লোভাকিয়া- এই ছয়টি দেশে। পরীক্ষার অংশ হিসেবে সেই দেশগুলোর ব্যবহারকারীদের নিউজ ফিড থেকে পেশাদার প্রচারকদের সব ধরনের পোস্ট সরিয়ে সেগুলোকে ‘Explore’ ফিড নামে আরেকটি ফিডে নিয়ে যায়। তাই ধারণা করা হচ্ছে, ফেসবুকের এই ভবিষ্যৎ পরিবর্তন হবে এই পরীক্ষার অনুরূপেই। যার ফলে নিউজ ফিডে আপনি আর কোনো পেশাদারি বিজ্ঞাপন কিংবা বিভিন্ন ফেসবুক পেজের কোনো পোস্ট দেখতে পাবেন না। সেগুলো দেখতে হলে আপনাকে যেতে হবে ‘Explore’ ফিডে। অন্যদিকে নিউজ-ফিডে আপনি দেখতে পাবেন শুধুমাত্র আপনার বন্ধুদের শেয়ার করা পোস্ট।
ফেসবুক কেন এই পরিবর্তন আনতে চাচ্ছে?
ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ এই প্রশ্নের উত্তর নিজেই দিয়েছেন। তিনি বলেন, নিউজ আর্টিকেল ও মার্কেটিং কন্টেন্টের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ব্যবহারকারীদের একে অপরের সাথে ব্যক্তিগত মুহূর্তের পরিমাণ কমে যাচ্ছে এবং সর্বোপরি এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। ফেসবুক পরিচালিত কিছু গবেষণার উপর ভিত্তি করে তিনি আরও বলেন, মানুষ যখন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে তখন তাঁরা নিজের প্রিয় মানুষদের সাথে সংযুক্ত হতেই বেশি পছন্দ করে।
জাকারবার্গ নিজে না বললেও আরও কিছু কারণ সহজেই অনুমান করা যায়। ফেসবুক গত কয়েক বছর ধরে সংবাদ মাধ্যমগুলোর সাথে তাদের সম্পর্কের জন্য বেশ বিতর্কের শিকার হয়েছে। ভুল তথ্য, ভুয়া সংবাদ ইত্যাদির প্রচার ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ায় বেশ সমালোচনার শিকার হতে হয়েছে ফেসবুককে। বিশেষ করে, ২০১৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকালীন সময়ে ভুয়া সংবাদের জন্য সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয় ফেসবুক।
ফেসবুক আরেকটি ভুল সিদ্ধান্ত নেয় ২০১৬ সালেই। নরওয়ের একটি সংবাদপত্রের সম্পাদক ভিয়েতনাম যুদ্ধের একটি বিখ্যাত ছবি পোস্ট করতে চেয়েছিলেন ফেসবুকে। কিন্তু নগ্নতার অজুহাতে ফেসবুক সেটিকে ব্লক করে দেয়। পরবর্তীতে তীব্র সমালোচনার মুখে ফেসবুক তাদের ভুল স্বীকার করে ছবিটিকে প্রকাশের অনুমতি দেয়। ভুল স্বীকার করলেও সেসময় ফেসবুকের ভাবমূর্তি যে ভালোভাবেই ক্ষুণ্ণ হয়েছিল সেটা বলা বাহুল্য!
ফেসবুক নিউজ ফিডে পরিবর্তন আনলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রভাব স্বভাবতই কমে যাবে। একইসাথে বিগত কয়েক বছরে যে কারণে তারা সমালোচিত হয়েছিল, সেগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটার সম্ভাবনাও অনেকটা হ্রাস পাবে।
কিভাবে ফেসবুকের নিউজ ফিডের পরিবর্তন সংবাদ খাতে প্রভাব ফেলবে?
আগেই বলেছি, ফেসবুকের এই সম্ভাব্য পরিবর্তনের ফলে সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন প্রকাশকরা, যারা তাদের সংবাদ কিংবা আর্টিকেল পাঠকদের কাছে পৌঁছানোর জন্য ফেসবুকের উপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে তাঁরা, যারা ফেসবুকের ‘Organic Reach’ এর উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। প্রসঙ্গত, ফেসবুকে পেজ থেকে শেয়ার করা পোস্ট টাকার বিনিময়ে এবং বিনামূল্যে- দু’ভাবেই পাঠকদের কাছে পৌঁছানো যায়। বিনামূল্যে একটি পোস্ট কতজন ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছেছে- সেটার মোট সংখ্যাই হল ‘Organic Reach’। বলা বাহুল্য, ফেসবুকে এরকম পেজের সংখ্যাই সবথেকে বেশি। তাই স্বভাবতই, নিউজ ফিডের পরিবর্তনের পর ব্যবহারকারীদের নিকট সহজে পৌঁছানোর এই রাস্তা অনেকটাই সংকীর্ণ হয়ে যাবে। সোজা কথায়, বিনে পয়সায় ব্যবহারকারীর নিউজ ফিডে সরাসরি পৌঁছে যাওয়ার সেই সুবিধা আর থাকছে না।
বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা বর্তমানে অনেক ধরনের কন্টেন্ট তৈরি করছে যাতে সেগুলো ফেসবুকে ব্যবহারকারীদের কাছে জনপ্রিয়তা পায়। স্বল্পদৈর্ঘ্যের ভিডিও বা এ ধরনের অন্যান্য কন্টেন্ট বেশ জনপ্রিয়তাও লাভ করেছে। তবে নিউজ ফিডের পরিবর্তন হলে পাঠক টানতে এগুলো কতটুকু কার্যকর থাকবে সেটা হয়ত সময়ই বলে দেবে।
ফেসবুক কিছুদিন আগে যে ছয়টি দেশে Explore Feed পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করেছিল, গুয়াতেমালা ছিল সেগুলোর একটি। সেখানকার কয়েকজন সাংবাদিক রিপোর্ট করেছিলেন, ফেসবুকের এই পরিবর্তনের পর একরাতের মধ্যেই কিছু ওয়েবসাইটের হিট ব্যাপকহারে কমে গিয়েছিল।
এই সিদ্ধান্ত সাধারণ ব্যবহারকারীদের উপর কেমন প্রভাব ফেলবে?
সাধারণ ব্যবহারকারীরা যে কতটুকু প্রভাবিত হবেন সেটা বলা একটু মুশকিল। কারণ, এই ব্যাপারে একেকজন একেকরকম মত প্রকাশ করতে পারেন। কারোর হয়ত বন্ধুদের পোস্ট দেখতেই বেশি ভালো লাগে। কিন্তু বিভিন্ন পেজে লাইক দেওয়া থাকায় বন্ধুদের সব পোস্ট দেখা হয় না। বন্ধুদের পোস্ট ও পেজের পোস্ট আলাদা আলাদা জায়গায় থাকলে এমন কারোর জন্য সেটা ভালো হতে পারে। অন্যদিকে কেউ যদি সারাদিন বিভিন্ন পেজের পোস্টেই বুঁদ হয়ে থাকতে পছন্দ করে থাকেন, তার জন্যও এই পরিবর্তন ইতিবাচক হতে পারে।
আবার এমন কেউ, যিনি বন্ধুদের পোস্ট এবং বিভিন্ন পেজের পোস্ট- দুটোকেই সমান গুরুত্ব দেন, তার জন্য এই পরিবর্তন বিরক্তির উদ্রেক করতে পারে।
এই সিদ্ধান্তে ফেসবুক কি ক্ষতিগ্রস্ত হবে?
এই ঘোষণার পরপর ফেসবুকের শেয়ার মূল্য ৬ শতাংশ কমে যায়! এ ঘটনা থেকেই অনুমান করা যাচ্ছে যে, ফেসবুকের এই ঘোষণা বিনিয়োগকারীদের কাছে কতটা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে! বিনিয়োগকারীরা ধরেই নিয়েছেন, এই পরিবর্তনের পর ব্যবহারকারীরা আগেকার মতো ফেসবুকে সময় ব্যয় করবেন না। কম সময় মানে কম বিজ্ঞাপন। আর কম বিজ্ঞাপন মানে কম আয়!
কীভাবে ব্যবহারকারীদের ফেসবুকে আটকে রাখা যায়- সেটা নিয়ে যেখানে এই টেক জায়ান্ট কোম্পানি অসংখ্য পদক্ষেপ নিয়েছে, সেখানে এই পরিবর্তনের কথা শুনে অনেকের চোখই কপালে উঠেছে। বর্তমানে এই টেক জায়ান্টের মূল্য ৫২২ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এই পরিবর্তনের পর এই মূল্য বাড়লেও খুব দ্রুতগতিতে যে বাড়বে না সেটা সহজেই অনুমেয়।
তবে ফেসবুক ভাবছে অন্য কথা। তারা মনে করছে, প্রাথমিকভাবে কিছু ক্ষতির শিকার হলেও দূরপাল্লায় তাদের লাভই হবে। অবশ্য ফেসবুকের এই আশা কতটুকু পূরণ হবে সেটা জানতে হলে আপনাকে আরও কয়েক মাস তো অপেক্ষা করতেই হবে।
ফিচার ইমেজ: qz.com