আলবার্ট আইনস্টাইনকে বলা হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী। প্রকৃতির বাস্তবতাকে তিনি যেভাবে দেখেছেন এবং অন্য বিজ্ঞানীদের বাস্তবতা সম্পর্কে যে ধারণা দিয়ে গেছেন, তা সত্যি একজন সত্যিকার সৃজনশীল মানুষের পক্ষেই সম্ভব। কম বেশি সকলেই জানে, ছোটবেলায় আইনস্টাইন তেমন ভালো ছাত্র ছিলেন না। এমনও শোনা গেছে, তিনি গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান বাদে অন্য সব বিষয়ে ফেল করতেন। তবে ছোটবেলা থেকে তার ভাবনার জগৎ ছিল অন্যদের থেকে আলাদা। তিনি বিজ্ঞান নিয়ে ভাবতে ভালোবাসতেন এবং যেকোনো সমস্যার পেছনে সময় দিতে পছন্দ করতেন।
এ অধ্যবসায়ের কারণে তিনি পরবর্তীতে সফল হয়েছেন। আপেক্ষিকতা, ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট, ভর শক্তি সমীকরণ (E = mc^2) ইত্যাদি আবিষ্কারের কথা আমরা জানি। কিন্তু বিখ্যাত হবার আগে এই বিজ্ঞানীকেও কিন্তু পিএইচডি সম্পন্ন করে তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে হয়েছিল। আমরা তার ছোটবেলার নিয়ে অনেক লেখালেখি হলেও তার পিএইচডি নিয়ে তেমন বেশি আলোচনা হয়নি।
তার অন্যান্য আবিষ্কারের মতো পিএইচডি থিসিসটিও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মজার কথা হচ্ছে, তার থিসিসের পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল মাত্র ২৪। এখন যারা পিএইচডি করেন, তাদের কাছে এটা অবিশ্বাস্য লাগতে পারে। তবে এটা সত্যি যে গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানে থিসিসের পৃষ্ঠা সংখ্যা কম হতেই পারে।
আইনস্টাইনের পিএইচডি নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়েছিল। কয়েকবার করে তার থিসিসের বিষয় পরিবর্তন হচ্ছিল। তার প্রথম থিসিস সুপারভাইজর ছিলেন বিজ্ঞানী হেনরি ফ্রেড্রিক ওয়েবার। ১৯০০ থেকে ১৯০১ এর মধ্যে বেশ কয়েকবার তার থিসিসের বিষয় পরিবর্তন করেন। তাছাড়া আইনস্টাইনের কাছে ওয়েবারের লেকচার ভালো লাগেনি। তার লেকচারগুলো ছিল অনেক পুরনো ধাঁচের। এমনকি তার পদার্থবিজ্ঞানের লেকচারে ম্যাক্সওয়েলের গাণিতিক সমীকরণের কোনো উল্লেখ নাকি ছিল না।
প্রফেসরকে পছন্দ না হওয়ায় ১৯০১ সালে তিনি জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ক্লেইনের কাছে পিএইচডি করতে যান। সেখানেও প্রথমদিকে কয়েকবার তার থিসিসের বিষয় গ্রহণ করা হয়নি। পরে আবার জমা দিলে তা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু সেখানেও একটু সমস্যা ছিল। থিসিসটি ছিল অনেক ছোট। আইনস্টাইনের বোনের মারফত জানতে পারা যায়, সেইবার থিসিস বড় করার জন্য তাকে ফেরত দেয়া হলে সেখানে আইনস্টাইন শুধু একটি মাত্র বাক্য যোগ করেছিলেন এবং সেভাবেই আবারো জমা দিয়েছিলেন।
এবার ক্লেইনার এবং আরেকজন প্রফেসর সেটি মূল্যায়ন করেন এবং থিসিসটি গ্রহণ করেন। এরপর তিনি তার থিসিসটি Annalen der Physik জার্নালে পাঠান। কিন্তু তারাও সেটা বাদ দিয়ে দেয়। তারা বলে, যে তথ্য এবং উপাত্ত আইনস্টাইন ব্যবহার করেছে সেগুলো পুরনো হয়ে গেছে। আরও নতুন তথ্য দিতে হবে। আইনস্টাইন এরপর সেখানে যাবতীয় নতুন তথ্য সংযোজন করেন (Addendum) এবং পুনরায় সেই জার্নালে পাঠিয়ে দেন। এবার জার্নালটিতে গবেষণাটি প্রকাশ পায়। সে সময়টিতে আসলে কী হয়েছিল আইনস্টাইনের সাথে? কেন এতবার তার থিসিস বাতিল করা হয়? কী ছিল তার পিএইচডি থিসিসে?
ওয়েবারের কাছে যখন প্রথম পিএইচডি-র প্রজেক্টের বিষয়ের কথা হয়, তখন প্রথমে আইনস্টাইন ব্যাতিচার যন্ত্র ব্যবহার করে আলোর বেগ c পরিমাপ করতে চেয়েছিলেন। ততদিনে মাইকেলসন ও মর্লি সেটি করে ফেলেছিল। এ সম্পর্কে আইনস্টাইন জানতেন না। এরপর কোনো পদার্থে বিদ্যুৎ প্রবাহকালে এর উপর তাপের কী প্রভাব, তা নিয়ে কাজ করতে চান তিনি। কিন্তু এটাও বাদ দেয়া হয়। তারপর তিনি তাপ পরিবাহিতা নিয়ে কিছু গবেষণা করেন এবং ফলাফল বের করে ওয়েবারকে দেন। এটাও বাদ দেয়া হয়। উল্লেখ্য যে, আইনস্টাইনের করা এ গবেষণাটি ইতিহাস থেকে হারিয়ে গেছে।
এরপর ক্লেইনারের কাছে আইনস্টাইন প্রথমে তরল থেকে গ্যাসে পরিণত হওয়ার সময় আন্তঃআণবিক বলের পরিবর্তন নিয়ে কাজ করতে চান। কিন্তু বিজ্ঞানী বোলজম্যান এটা নিয়ে কিছু কাজ করে রেখেছিলেন এবং আইনস্টাইনের দেয়া প্রস্তাবনা অনেকটাই বোলজম্যানের সাথে মিলে যাচ্ছিল। সেজন্য এটা বাদ দিতে হয়। এরপরের বিষয়টি ছিল কোনো গতিশীল বস্তুর ইলেক্ট্রো-ডাইনামিক্স নিয়ে। কিন্তু সেটাও গ্রহণ করা হয়নি, কারণ এটা পুরোটুকুই ছিল শুধু তত্ত্বের উপর নির্ভরশীল। আর যে প্রফেসর এটা পর্যালোচনা করেছিলেন তারা এর মর্মই বুঝতে পারেননি।
এতকিছুর পর একদম শেষে তিনি তার পিএইচডি করতে পেরেছিলেন চিনির অণুর আণবিক মাত্রা বের করা সংক্রান্ত গবেষণায়। এখানে তিনি অ্যাভোগেড্রোর সংখ্যার মান বের করেছিলেন। সেই অ্যাভোগেড্রোর সংখ্যা, যেটা আমাদেরকে মুখস্ত করতে হয়, যার মান N = 6.023 × 10^23। কিন্তু এটি কীভাবে পাওয়া গিয়েছিল সে সম্পর্কে কোথাও কোনো তথ্য আমাদের দেয়া হয় না। যা-হোক, তার পাওয়া ফলাফলে পরে ভুল ধরা পড়েছিল। ভুল ধরার পরে তাত্ত্বিকভাবে আবারো আইনস্টাইন আরেকটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন।
এখানে অ্যাভোগেড্রোর সংখ্যার মানে কয়েক ইউনিট ভুল ছিল। তিনি যে উত্তর পেয়েছিলেন তার মান এসেছিল N = 2.1 × 10^23। পরে গাণিতিক হিসাবে তার ভুল বের করতে পেরেছিলেন এবং পরে আবার তার গবেষণাপত্র ভুল সংশোধন করে ছাপা হয়েছিল। সংশোধন করার পর তার মান এসেছিলো N = 4.15 × 10^23।
কিছুদিন পরে রসায়নের একটি ব্যবহারিক গবেষণায় অ্যাভোগেড্রোর সংখ্যার প্রকৃত মান পাওয়া যায়। যা থেকে আবারো প্রমাণিত হয় যে আইনস্টাইনের সমীকরণের কোথাও ভুল আছে। এরপর আইনস্টাইন আবারো তার গবেষণাপত্রটি পরীক্ষা করে দেখেন এবং আবারো তার ভুল সংশোধন করেন। এবার তাত্ত্বিকভাবে সেই মান আসে N = 6.56 × 10^23। দেখা যাচ্ছে এ মান মূল মানের অনেক কাছাকাছি পর্যন্ত ঠিক উত্তর দিতে পেরেছিল। অনেকে মনে করতে পারেন, ভুল থাকার পরেও কেন তাকে পিএইচডি দেয়া হলো?
তখনকার সময় জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি পাওয়ার জন্য এই কাজ যথেষ্ট ছিল। আইনস্টাইন নতুন একটি তত্ত্ব দিয়েছিলেন যেটা দিয়ে এই মান মোটামুটি সঠিকভাবে বের করা যাচ্ছিল। এটা অনেক বড় আবিষ্কার। তাছাড়া জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং জার্মানির অন্যান্য জায়গাতে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান থেকে ব্যাবহারিক পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে বেশি চর্চা করছিল সবাই। তাত্ত্বিক বিষয়ে গবেষণা তুলনামূলক কম হচ্ছিল। ক্লেইনার তাত্ত্বিক গবেষণা পছন্দ করতেন দেখে তিনি আইনস্টাইনকে এ বিষয়ে কাজ করতে দিয়েছিলেন।
১৯০৫ সালে তার থিসিস গবেষণাপত্রে প্রবন্ধ হিসেবে প্রকাশিত হয়। ১৯০৫ থেকে ১৯০৬ সালের মধ্যে তার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পেপার প্রকাশিত হয়, যেমন- Photoelectric Effect, Brownian motion, Electrodynamics of Moving Bodies, E=mc^2 এবং Molecular Dimension, যেটা তার থিসিসের বিষয় ছিল। শেষেরটির উল্লেখ গবেষণাপত্রগুলোতে অন্যান্যগুলোর তুলনায় সবচেয়ে বেশীবার হয়েছে।
আইনস্টাইনের নিজের কাছেও তার থিসিসের গুরুত্ব অনেক বেশি ছিল। তিনি যদি একটি অণুর আকার-আয়তন বের করার কোনো মাধ্যম বা পদ্ধতি দিতে পারেন তাহলে সেটার গুরুত্ব অনেক। কারণ এতে ম্যাক্স প্লাঙ্কের রেডিয়েশন ফর্মুলা আরো যথাযথভাবে পরীক্ষা করা যাবে। তাছাড়া তার এই থিসিসে এমন একটি কাজ করা হয়েছিল যেটা দিয়ে একটি আণবিক হাইপোথিসিস দাঁড় করানো গিয়েছিল। তার এই গবেষণার কারণে ব্রাউনীয় গতি নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ কিছু গবেষণা করা সম্ভব হয়েছিল।
আসলে আইনস্টাইনের পিএইচডির সময় বাধা আসার মূল কারণ ছিল পরিস্থিতি। তখন তাত্ত্বিক পারমাণবিক বিষয় নিয়ে গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খুব বেশী গ্রহণ করা হতো না। যদিও কেউ কেউ এসব বিষয় নিয়ে অন্যান্য জায়গায় গবেষণা করছেন, কিন্তু তখন ব্যবহারিক পদার্থবিজ্ঞানের এমন এমন সব আবিষ্কার হচ্ছিল যে, সবাই সেসব আবিষ্কার নিয়ে ব্যবহারিক গবেষণা করার পক্ষপাতি ছিলেন। ১৯১০ সাল পর্যন্ত এই ধারাটা চলছিল। এরপর ধীরে ধীরে সে অবস্থার পরিবর্তন এসেছে।
ফিচার ইমেজ- thenation.com