ভাবুন তো দেখি একবার কেমন লাগত, যদি নিজেকে হঠাৎ করে আবিষ্কার করতেন মৃত্যুপুরীতে? মৃতের দেশে পরপারে ঘুরে বেড়ানো আত্মাদের মাঝে আপনি একজন। তার মানে কি আপনি মৃত? কিন্তু আপনি তো এখনই নিজের প্রিয়জনদের বিদায় দিতে প্রস্তুত নন! ধীরে ধীরে যখন সত্যটা বুঝতে পারেন তখন এক বিষাদ নেমে আসে মনে। কিন্তু প্রিয়জনদের দেখবার একটা উপায় আছে এখনো। আর সেটি হলো বছরের একটি উৎসবের দিন যখন জীবন্ত মানুষেরা ছবি টানিয়ে স্মরণ করে পরপারে পাড়ি জমানো মৃতজনদের, তখন আপনি অশরীরী আত্মা হয়ে ভোরের আলো ফোটা পর্যন্ত ঘুরে আসতে পারেন রক্ত-মাংসের পৃথিবীতে। কিন্তু আপনি কি নিশ্চিত আপনাকে স্মরণ করে কেউ না কেউ ছবি টানাবেই? কয়েক বছরের মাঝে আপনি যে বিস্মৃত হবেন না তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে?
ঠিক এমন একটি চিরন্তন প্রশ্ন জাগিয়ে তুলে দর্শক মনে যে ছবিটি সেটি হলো ‘কোকো’- সেরা অ্যানিমেশন ছবির অস্কার পুরস্কার জিতে নিয়েছে যে ছবিটি! আজকে আমাদের সে ছবিটি নিয়েই আয়োজন।
আমাদের গল্পের নায়ক ১২ বছরের বালক মিগুয়েল। কিন্তু কাহিনীর শুরু কিন্তু তাকে দিয়ে নয়। মেক্সিকোর সান্তা সিসিলিয়াতে এক গায়কের স্ত্রী ছিল ইমেলদা রিভেরা নামের এক মেয়ে। তাদের তিন বছরের মেয়ে কোকো-কে রেখেই একদিন সে গায়ক বা মিউজিশিয়ান চলে যায়, আর ফিরে আসেনি। রাগে-ক্ষোভে ইমেলদা তার পরিবারে সংগীত নিয়ে কিছু উচ্চারণ করাই বন্ধ করে দিল, গান করা তো দূরের কথা। গান বাদ দিয়ে সে জুতোর ব্যবসা শুরু করল।
৯৬ বছর পর, ইমেলদার কয়েক বংশ পরের নাতি ১২ বছরের মিগুয়েল কোকোর সাথেই থাকে তার একান্নবর্তী পরিবারে। তার পরিবার এখনো জুতোর ব্যবসাই করে। কিন্তু মিগুয়েলের স্বপ্ন জুতো নিয়ে না, বরং সে চায় একদিন সে হবে বিখ্যাত এক গায়ক। ঠিক আর্নেস্তো দে লা ক্রুজের মতো বিখ্যাত এক গায়ক। একদিন ভুল করে মিগুয়েল আবিষ্কার করে বসে যে বহু কাল আগে যে ইমেলদাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল, তার এক ছবি; রাগে-দুঃখে ছবি থেকে লোকটির মাথা কেটে ফেলা, কিন্তু হাতে দেখা যাচ্ছে একটি গিটার; যে সে গিটার নয়, একেবারে আর্নেস্তোর বিখ্যাত গিটার! তার মানে আর কিছুই নয়, আর্নেস্তো আসলে মিগুয়েলের পর-পর-দাদা।
এটা বুঝবার পর দাদীর মানা না শুনেই এক মেধা প্রতিযোগিতায় সংগীত করবার জন্য নাম লেখায় মিগুয়েল। প্রতিযোগিতাটি হবে ডে অফ দ্য ডেড এর জন্য, সেদিন মেক্সিকোতে স্মরণ করা হয় মৃত পরিজনদের। তো, প্রতিযোগিতায় জিততে হলে তার দরকার গিটার, আর সে গিটার সে চুরি করে আর্নেস্তোর স্মৃতিকবর থেকেই- আর্নেস্তোরই গিটারখানা! যেই না সে গিটারে হাত লাগায়, সেই সে আবিষ্কার করল, সে আসলে আর নিজের জগতে নেই- সে এখন মৃত আত্মাদের দেখতে পাচ্ছে! কিন্তু জীবিত কেউ তাকে দেখতেই পাচ্ছে না!
শীঘ্রই সে মৃত্যুপুরীতে বন্ধু খুঁজে পায়, খুঁজে পায় আর্নেস্তোকেও। কিন্তু ভাগ্যের খেলা সে তখনও দেখেনি! জড়িয়ে পড়ে এক খুনের রহস্যে, যে রহস্য মৃত্যুর আগের-পরের দু’জগত জুড়েই! সে কি পারবে আবার ফিরে আসতে জীবন্ত পৃথিবীতে? সে কি পারবে গান করতে? আর কেনই বা ছবিটির নাম কোকো, অর্থাৎ মিগুয়েলের স্মৃতিভ্রষ্ট অসুস্থ দাদীর নামে?
জানতে হলে দেখে নিন অসম্ভব সুন্দর এ অ্যানিমেশন ফিল্মটি। পরিচালক লি উনক্রিচ যখন ২০১০ সালে ‘টয় স্টোরি ৩’ ছবি পরিচালনা করছিলেন, তখন ‘কোকো’ ছবিটির কাহিনীর ধারণা প্রস্তাব করেন। শুরুতে এক আমেরিকান বালককে নিয়ে ছবিটি করবার চিন্তা করা হয়েছিল (নাম মার্কো), যার পূর্বপুরুষ মেক্সিকান ছিল, কিন্তু শীঘ্রই তারা বুঝতে পারেন, আসলে মেক্সিকান বালককে নিয়েই করা উচিত। তাছাড়া এ ছবিতে যে সংস্কৃতি দেখানো হয়েছে, সেটি বাস্তব। এমনকি ডে অফ দ্য ডেডও (স্প্যানিশ Día de Muertos) সত্যি পালিত হয় মেক্সিকোতে। এদিন মৃত পরিবার পরিজনদের স্মরণ করে তারা। অক্টোবর ৩১ তারিখ শুরু হয়ে চলে নভেম্বরের ২ তারিখ পর্যন্ত। ডে অফ দ্য ডেডে কিন্তু মেক্সিকোতে সরকারি ছুটি চলে।
কোকোর কাহিনী আর চরিত্র বানাবার জন্য পিক্সারের টিম মেক্সিকোতে পাঁচবার ভ্রমণে যান। অ্যানিমখোররা কিন্তু এ ছবির সাথে হালকা মিল পেয়ে যাবেন বিখ্যাত এক অ্যানিমের, আর সেটি হলো Hayao Miyazaki-র Spirited Away (2001)! তাছাড়া Howl’s Moving Castle (2004) থেকেও অনুপ্রাণিত ছিল কোকো। পরিচালক ২০১৬ সালের ১৩ এপ্রিল ঘোষণা দেন যে, ছবির কাজ শুরু হয়েছে।
কংকালও যে এরকম মজা করে উপস্থাপন করা যায় কোকো না দেখলে হয়ত সেটা বোধগম্য হতো না। নিশ্চিতভাবেই মেক্সিকোর সংস্কৃতি, সেটা বাস্তব হোক আর পরাবাস্তব হোক, ঠিকভাবে ফুটিয়ে তোলাটা কঠিন ছিল, পিক্সার বুঝি সে কাজটিই নিখুঁতভাবে করতে পেরেছে অ্যানিমেশনের মাধ্যমে। লাইভ অ্যাকশনে কখনোই এগুলো ফুটিয়ে তোলা যেত না। টয় স্টোরি আর ফাইন্ডিং নিমোর স্টুডিও থেকে এটুকু আশা বিফলে যায়নি একদমই! এরকম রঙিন, আকর্ষণীয়, মজাদার পরকাল আর কীভাবে দেখানো সম্ভব?
উল্লেখ্য, আমেরিকায় মুক্তি পাবার সাড়ে তিন সপ্তাহ আগেই ছবিটি বের হয় মেক্সিকোতে। বর্তমানে মেক্সিকোতে মুক্তি পাওয়া সবচেয়ে আয় করা ছবিটি হলো কোকো। ২০১১-১৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ছয় বছর লাগিয়ে মুভিটি নির্মাণ করে পিক্সার। মেক্সিকোর Guanajuato শহরের আদলে ছবির শহরটি দেখানো হয়েছে।
এটি পিক্সারের ১৯তম পূর্ণদৈর্ঘ্য আনিমেশন ফিল্ম। ব্রাজিলে কিন্তু ছবিটির নাম কোকো নয়, বরং নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘ভিভা’। কারণ, ব্রাজিলে পর্তুগিজ ভাষায় ‘কোকো’ (cocô) অর্থ হলো ‘মানুষের মল’। এ নাম রাখলে কি আর ছবি চলবে ব্রাজিলে? মিগুয়েলের দাদীর নাম দেয়া হয় লুপিতা।
পিক্সারের Cars 3 (2017) ছবিটি সাড়ে পাঁচ মাসে যা আয় করেছে, কোকো বিশ্বজুড়ে ১৯ দিনেই তত আয় করে নিয়েছিল। মাত্র তিন সপ্তাহে, বিশ্বজুড়ে ৪০০ মিলিয়ন ডলার আয় করে কোকো। পুরোটা সময় জুড়েই মার্কিন বক্স অফিসে এক নাম্বারে ছিল ছবিটি। ২২ বছর আগে যে দিন টয় স্টোরি (১৯৯৫) মুক্তি পায়, সেদিনই মুক্তি দেয়া হয় কোকো। মেক্সিকোতে ২০১৭ সালের অক্টোবর ২৭, যুক্তরাষ্ট্রে ২২ নভেম্বর আর যুক্তরাজ্যে ২০১৮ সালের ১৯ জানুয়ারি মুক্তি পায় ছবিটি। Thor: Ragnarok, Justice League, Star Wars: The Last Jedi আর Ferdinand এর ভিড়ে অনেক ভালো করে কোকো। ১৭৫-২০০ মিলিয়ন ডলার বাজেটের ছবিটি এখন পর্যন্ত আয় করে নিয়েছে ৭৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার!
ছবিতে মিগুয়েলের কুকুরের নাম দান্তে। ইতালীয় কবি দান্তে জীবিত ছিলেন ত্রয়োদশ শতকে। তাঁর ডিভাইন কমেডি কাব্যে প্রধান চরিত্র দান্তে স্বর্গ নরক ভ্রমণ করে আসেন। আর কোকো ছবিতে দান্তে ভ্রমণ করে আসে পরকাল।
২০১৮ সালে ৯০তম অস্কার বা একাডেমি অ্যাওয়ার্ডে সেরা অ্যানিমেটেড ফিচার হিসেবে পুরস্কার জিতে নেয় কোকো। এছাড়া রিমেম্বার মি গানটি জিতে নেয় সেরা অরিজিনাল সং এর পুরস্কার। তাছাড়া, সেরা অ্যানিমেশন ফিল্ম হিসেবে BAFTA Award, Golden Globe Award, Critic’s Choice Movie Award এবং Annie Award-ও জিতে নেয় ছবিটি।
রটেন টমেটোজের টমেটোমিটারে ১০৯ মিনিট দীর্ঘ ছবিটির স্কোর ৯৭%, আর অডিয়েন্স স্কোর ৯৫%! আর আইএমডিবি রেটিং এখন ৮.৫/১০।
ফিচার ইমেজ: Wallpaper Cave