প্রতিভা বিষয়টি অনেক মানুষের মাঝেই থাকে, তবে খুব কম মানুষই তার প্রতিভার সঠিক পরিচর্যা করতে পারে। সব প্রতিভাবান মানুষই জীবনে সফলতা পান না। আবার সফলতা পাবার জন্য শুধু প্রতিভা থাকলেই হয় না, সেটিকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে জানতে হয়। আজ আমরা বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এমন একজনের গল্প শুনব, যিনি তার ক্যারিয়ারের নানা সময়ে শিল্পের বিভিন্ন জায়গায় হাত দিয়েছেন এবং মোটামুটি যেখানে হাত দিয়েছেন, সেখানেই সোনা ফলেছে।
প্রতিভাবান এই মানুষটার নাম বিপাশা হায়াত। চলুন ঘুরে আসি তার বর্ণিল জীবনের নানা অধ্যায় থেকে।
সময়টা ১৯৮৩ সাল। একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে বিটিভিতে ‘খোলা দুয়ার’ শীর্ষক একটি নাটক প্রচারিত হবে। নাটকের রচয়িতা মামুনুর রশীদ, প্রযোজক ছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান। সেই নাটকে আবুল হায়াতের মেয়ের চরিত্রে ১২-১৩ বছরের একজনকে প্রয়োজন। হাতের কাছে পাওয়া গেল যে মেয়েকে তিনি সত্যিই আবুল হায়াতেরই মেয়ে। বিপাশা হায়াত।
আবুল হায়াত ভাবতেন, তার মেয়ে হয়তো তার মতো ইঞ্জিনিয়ার হবেন। হয়তো সেটাই হতেন। কিন্তু ভাগ্য তার অন্যভাবে লেখা ছিল। সেজন্য বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষার ওয়েটিং লিস্টে থাকার পর লিস্টে তার ঠিক আগেরজন সুযোগ পেলেও তিনি আর সুযোগ পাননি। পরবর্তীতে তিনি ইডেন কলেজে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। সেখানে তিন মাস পড়াশোনা করার পর এক পর্যায়ে আর্ট কলেজে পরীক্ষা দেন। সেখানে প্রথম হন বিপাশা। শুরু হয় তার শিল্পী হয়ে ওঠার জীবন।
ছোটবেলা থেকেই বিপাশার আগ্রহ ছিল সংস্কৃতি জগতের প্রতি। মঞ্চে তার যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৫ সালে। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় দলে অভিনয় শিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। একটা পর্যায়ে অভিনয়ের পাশাপাশি সেট ডিজাইনার হিসাবেও ছোটখাটো কাজ করতে থাকেন বিপাশা। এরই মধ্যে ১৯৮৯ সালে বিটিভিতে অভিনয় শিল্পী হিসেবে নিবন্ধিত হন তিনি। তবে বিপাশা দর্শকদের নজরে পড়েন হুমায়ূন আহমেদের ‘অয়োময়’ নাটকে ‘লবঙ্গ’ চরিত্রে অভিনয় করে।
বিপাশা হায়াতের ভাষায়,
“অয়োময় ছিল টিভি নাটকের একটি মাইলফলক। এই নাটকে লবঙ্গ মুখ্য চরিত্র ছিল তা নয়, আর দশটা চরিত্রের মধ্যে একটি। নাটকের সব ক’টি চরিত্রই জাগতিক ভাবনা নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু লবঙ্গ স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। স্বপ্নের মধ্যে বাস করে। খুব রোমান্টিক। এই ব্যাপারগুলো অন্য সব চরিত্র থেকে লবঙ্গকে আলাদা করেছিল। তার মধ্যে যে রোমান্টিকতা ছিল, তা ছুঁয়ে গিয়েছিল ওই সময়ের দর্শকের হৃদয়।
আমার অভিনয়জীবনের একেবারে গোড়ার দিকের এই একটি মাত্র চরিত্র আমাকে দর্শকের সামনে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে। দর্শকের হৃদয়ে আমার অবস্থান দৃঢ় হয়। লবঙ্গ বদলে দিয়েছিল আমাকে।”
এরপরেই ধীরে ধীরে শুরু হয় তার সফলতার পথে এগিয়ে চলা।
টিভি অভিনেত্রী হিসাবে বিপাশা তার প্রজন্মের প্রথম সারিতেই ছিলেন। ‘৯০ এর দশকটা বিপাশা-শমী-মিমিতে বুঁদ ছিল বাংলাদেশের টিভি দর্শক। বিখ্যাত নাটকগুলোর মাঝে ‘রূপনগর’, ‘হারজিত’, ‘একজন অপরাধিনী’, ‘নাইওরি’, ‘ছোট ছোট ঢেউ’, ‘প্রত্যাশা’, ‘দোলা’, ‘হাসুলি’ ইত্যদি উল্লেখযোগ্য। সেই সময়টাতে ‘তৌকির-বিপাশা’ এবং ‘জাহিদ হাসান-বিপাশা’ জুটি খুবই জনপ্রিয় ছিল দর্শকদের কাছে।
বাংলাদেশের প্রথম প্যাকেজ নাটকের নায়িকা ছিলেন বিপাশা হায়াত। কাজী আনোয়ার হোসেনের বিখ্যাত চরিত্র ‘মাসুদ রানা’ অবলম্বনে সেই নাটকের নাম ছিল ‘প্রাচীর পেরিয়ে’।
আজকের সময়ে এসে অভিনয় কম করলেও, বিশেষ বিশেষ দিবসের কিছু নাটকে তার উপস্থিতি আবারও দর্শকদের যেন ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই পুরনো সময়ে। অসংখ্য জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনেও দেখা গেছে তাকে।
বিপাশা সিনেমা করার প্রস্তাব পেয়েছেন অনেক আগেই। এই কথা হয়তো অনেকেই জানেন যে, ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমার নায়ক চরিত্রের জন্য প্রথম পছন্দ ছিলেন তৌকির আহমেদ। কিন্তু এটি হয়তো অনেকেই জানেন না যে, সেই সিনেমার নায়িকার চরিত্রের জন্য প্রথম প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল বিপাশা হায়াতকে। কিন্তু প্রথাগত চলচ্চিত্রে তিনি আগ্রহী ছিলেন না। এমনকি মুম্বাই থেকেও তাকে সিনেমাতে নেবার চেষ্টা করা হয়েছিল বলে জানা যায়। কিন্তু বিপাশা হায়াতের চরিত্র পছন্দ না হওয়া কিংবা অনাগ্রহের জন্য বিষয়টি আর এগোয়নি।
পরবর্তীতে বিপাশা হায়াত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। প্রথম চলচ্চিত্র হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক সিনেমা ‘আগুনের পরশমণি’। এই চলচ্চিত্রে তিনি ‘রাত্রি’ নামক এক তরুণীর চরিত্রে অভিনয় করেন, যার পরিবার যুদ্ধের সময় ঢাকা শহরের একটি বাসায় আটকে যায়। যুদ্ধের সময় গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা বদি চরিত্রের আসাদুজ্জামান নূর তাদের বাসায় আসে, সেখান থেকে এগোয় পরিবারটির কাহিনী। এই সিনেমার জন্য ১৯৯৪ সালে বিপাশা হায়াত জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার পান শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে।
পরবর্তীতে বিপাশা তৌকির আহমেদ পরিচালিত জয়যাত্রা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এই সিনেমাটিও মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ছিল। এখানে তিনি এক মধ্যবয়স্ক নারীর ভূমিকায় অভিনয় করেন, যেখানে পাকিস্তানী হানাদারদের আক্রমণে পালিয়ে যাওয়ার সময় সন্তানকে হারিয়ে ফেলেন।
দুটো সিনেমাতেই বিপাশা দর্শক আর সমালোকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছেন দারুণভাবে, যা খুব কম অভিনয় শিল্পীর পক্ষেই অর্জন করা সম্ভব।
বিপাশা হায়াত ১৯৯৮ সালে চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে এমএফএ পাশ করেন। অভিনয় নিয়ে ব্যস্ততা থাকলেও আঁকাআঁকিটা তিনি কখনো একেবারে ছেড়ে দেননি। ১৯৯৬ সালে গ্যালারি টোনে তিনি মিনিয়েচার পেইন্টিং এক্সিবিশন করেন। ১৯৯৮ সালে গ্রুপ এক্সিবিশন করেন হোটেল সোনারগাঁওয়ের ডিভাইন আর্ট গ্যালারিতে। ২০০১ সালে জয়নুল গ্যালারিতে চিত্র প্রদর্শনী করেন ৯ জন তরুণ শিল্পীর সাথে। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকীতে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও ইতালিয়ান রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীতেও অংশ নেন তিনি। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন ও অরনীর আয়োজনে ২০১০ ও ২০১১ সালের দুটি আর্ট ক্যাম্পে অংশ নেন বিপাশা।
বিপাশা হায়াতের নিজের ভাষায়, তিনি আঁকার কাজটি করেন রাতের বেলায় যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে তখন। আঁকাআঁকিই নিজের আবেগের জায়গা বলে ভাবেন তিনি।
২০০৯ সালের মে মাসে তিনি এসিড আক্রান্ত নারীদের সাহায্যার্থে আয়োজিত প্রদর্শনীতে নিজের আঁকা ছবি দান করেন। ২০১৬ সালে তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজিত প্রদর্শনীতে সম্মাননা লাভ করেন। সেখানে ৫৪টি দেশের ২৯৮ জন চিত্রশিল্পী তাদের ৪৩৪টি ছবি প্রদর্শন করেছিলেন। বইমেলায় প্রচ্ছদ শিল্পী হিসেবেও সরব উপস্থিতি রয়েছে বিপাশার।
বিপাশা হায়াতের মনে টিভি নাটক লেখার ভাবনাটা আসে অনেক আগেই। ১৯৯৭ সালে তিনি ‘শুধু তোমাকে জানি’ নামের একটি সিরিয়াল লেখা শুরু করেন। তবে ইচ্ছে করেই তিনি তার নাম প্রকাশ করেননি তখন। ছদ্মনাম ব্যবহার করেছিলেন, যাতে করে শুধুমাত্র তার নামের কারণে নাটকটি জনপ্রিয়তা না পায়। কিন্তু টেলিভিশনে প্রচারিত হবার পর যখন সিরিয়ালটি তুমুল জনপ্রিয় হয়, তখন বিপাশা হায়াত তার লেখক সত্তা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেন। ‘ভালোবাসা জেগে থাকে প্রাণে’, ‘ডাইনোসর’, ‘মরা জোছনা’, ‘মধ্যরাত ও ঝরা পাতার গল্প’, ‘ছায়া’, ‘এ কী খেলা’- এরকম প্রায় অর্ধশত জনপ্রিয় নাটকের রচয়িতা বিপাশা হায়াত।
গায়িকা বিপাশা হায়াতকে হয়তো মানুষ খুব একটা চেনে না। অনেকেই জানেন না, বিপাশা হায়াতের সংস্কৃতি চর্চার শুরুটা হয়েছিল মূলত গান দিয়ে। ওস্তাদ খালিদ হোসেন, আখতার সাদমানী কিংবা মিতা হকের মতো বরেণ্য সংগীতজ্ঞদের কাছে তার গানের হাতেখড়ি। কিন্তু একটা সময় এসে গানের ভুবনে তাকে আর সেভাবে পাওয়া যায়নি। শেষপর্যন্ত নিয়মিত হয়েছিলেন অভিনয়েই।
বিপাশা হায়াতের নিজের ভাষায়,
“গানের জন্য আমি না, আমার জন্য গান। গানকে কখনো আমলে নিয়ে আমি সাধনা করিনি যতটা না অভিনয় আর আঁকাআঁকি নিয়ে সাধনা করেছি। তবে এটা সত্য আমি প্রচুর গান শুনি।”
তবে বিটিভির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিভিন্ন সময় তাকে গাইতে দেখা গিয়েছে। হানিফ সংকেতের ইত্যাদিতে গেয়েছিলেন ‘আকাশ এত মেঘলা যেও নাকো একলা’, আব্দুন নূর তুষারের শুভেচ্ছাতে গেয়েছিলেন ‘নিটোল পায়ে রিনিক ঝিনিক’ এবং বিটিভির একটি অনুষ্ঠানে গেয়েছিলেন ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’। সর্বশেষ বছর দুই আগে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশনে বিশেষ বৈশাখী সঙ্গীতানুষ্ঠানে গেয়েছেন ফেরদৌসী রহমানের গাওয়া ‘আজি বাহাল করিয়া বাজান গো দোতরা সুন্দরী কমলা নাচে’ গানটি।
আবৃত্তিকার হিসেবেও বিপাশা হায়াতের সুনাম রয়েছে। তার অনেক নাটকের আবহ সঙ্গীতের কাজ তিনি নিজেই করেছেন। এগুলো ছাড়াও বাংলাভিশন চ্যানেলের হয়ে ‘বিপাশার অতিথি’ নামে একটা টক-শো উপস্থাপনা করেছেন তিনি, যেটি তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল।
অনেক সম্মাননা পেয়েছেন বিপাশা দীর্ঘ শিল্পী জীবনে। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কারের কথা তো আগেই বলেছি। মেরিল-প্রথম আলো পুরষ্কারে ১৯৯৮, ১৯৯৯ আর ২০০০ সালে টানা তিনবার জনপ্রিয় বিভাগে শ্রেষ্ঠ টিভি অভিনেত্রী নির্বাচিত হন তিনি।
এছাড়া বাচসাস পুরষ্কার, যায় যায় দিন পুরষ্কার, অন্যদিন-ইমপ্রেস টেলিফিল্ম পুরষ্কার, ইউনেস্কো পুরষ্কার, কালচারার রিপোর্টস পুরষ্কার, ঢালিউড পুরষ্কারও অর্জন করেছেন বিপাশা।
সুখের সংসার চলছে তার তৌকির আহমেদের সাথে, আছেন কন্যা আরিশা আহমেদ এবং পুত্র আরিব আহমেদকে নিয়ে।
বিপাশা হায়াতকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, এতগুলো সত্তার মাঝে কোন পরিচয়টি দিতে তিনি আনন্দ বোধ করেন। বিপাশা হায়াতের মুখেই শোনা যাক উত্তরটি:
“অনেকেই আমাকে অভিনয় শিল্পী বলেন, অনেকে চিত্রশিল্পী, অনেকে স্ক্রিপ্ট রাইটার। তবে আমি নিজেকে আরিশা আর আরিব এর মা পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। মাঝে মাঝেই ওদের স্কুলে আমাকে ফোন করতে হয়। ফোনে কখনো আমি বলিনা যে আমি বিপাশা হায়াত বলছি, বলি আরিশা আর আরিব এর মা বলছি।”
এটাও কি বিপাশা হায়াতের আরেকটি প্রতিভার বহিঃপ্রকাশ নয়?
ফিচার ইমেজ: ICE Today