আজকের হিরোশিমাকে অনেকে বলেন বিশ্বের শান্তির ‘রাজধানী’। হিরোশিমা শহরের উপর ইতিহাস কম ধকল দেয়নি। দেশটিতে ভূমিকম্প আর বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও এসেছিল পারমাণবিক বোমার মতো নির্মম অভিশাপ। সেই হিরোশিমা শহরটিই পরিণত হয়েছে জাপানের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণে। দুই-দুইটি বিশ্ব ঐতিহ্যখ্যাত স্থান, মঠ-মন্দির আর সাগর হিরোশিমাকে করেছে অনন্য। হনসু দ্বীপের এই শহরে আছে দৃষ্টিনন্দন স্থান আর ইতিহাস। সেখানে গেলে আপনি হয়তো ক্ষমার সৌন্দর্য অনুভব করতে পারবেন।
১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট, বিশ্বযুদ্ধ চলছে সারা পৃথিবী জুড়ে। এতটুকু অস্থিরতা ছাড়া মোটামুটি আর পাঁচটা দিনের মতোই চলছিল হিরোশিমার জীবন। সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে সবকিছু ওলটপালট করে দিয়ে আকাশ থেকে নেমে এলো পারমাণবিক বোমা। এই বোমার আঘাতে ১০,০০০ এর বেশি মানুষ মারা যায়। শহরের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি ধ্বংস হয়ে যায়। পারমাণবিক বোমার ধ্বংসলীলা দেখে আঁতকে ওঠে পৃথিবী। বছর না পেরুতেও প্রায় অর্ধেক মানুষ মারা যায় রেডিয়েশনের প্রভাবে।
তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। এখন হিরোশিমার সেই জায়গাতে ৩০ একর জমির উপর তৈরি করা হয়েছে ‘হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল পার্ক’। বোমার আঘাতে নিহতদের স্মরণে এখানে আছে স্মৃতিস্তম্ভ আর স্মৃতিফলক। যুদ্ধবিদ্ধস্ত শহরটিতে এ যেন মূর্তিমান শান্তির সাধনা!
বর্তমানে যেটি ‘পিস মেমোরিয়াল’ বা শান্তির স্মৃতিসৌধ বলে পরিচিত, সেটি আসলে বিস্ফোরণের কেন্দ্রে বেঁচে যাওয়া একমাত্র ভবন। বিস্ফোরণের দিনটি থেকেই একে একইভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। ভবনটির উপরের গম্বুজটির সিমেন্ট খসে গিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল রডের কঙ্কাল। ১৯৬৬ সালে নগর পরিষদের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, “পারমাণবিক যুদ্ধ সহ সকল ধরনের হাইড্রোজেন ও পারমাণবিক বোমা বন্ধের দাবির মতোই, এই গম্বুজটির রক্ষা করাও বিস্ফোরণে বেঁচে থাকা সকল মানুষ আর জাপানের শান্তিকামী নাগরিকদের প্রার্থনা।” ১৯৬৬ সালে এটি ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ বা বিশ্বের ঐতিহ্যপূর্ণ স্থানসমূহের তালিকায় স্থান পায়।
শিশুদের জন্য এখানে আছে শান্তিস্তম্ভ। সেদিনের বিস্ফোরণে নিহত আর বিস্ফোরণ থেকে ছড়িয়ে পড়া রেডিয়েশনের প্রভাবে মারা যাওয়া শিশুদের স্মরণে এটি নির্মিত। বিস্ফোরণের পর রেডিয়েশনের কারণে অসংখ্য বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম নেয়। একই কারণে লিউকোমিয়ার মতো অসুখ একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। এমনই এক শিশু ছিল সাদাকো সাসাকি। বিস্ফোরণের সময় তার বয়স ছিল মাত্র দুই। বিস্ফোরণ থেকে বেঁচে গেলেও তার শরীরে ভর করেছিল লিউকোমিয়া। ছোট্ট সাসাকি পরবর্তী দশ বছর লড়াই করে গেছে এই অসুখের সাথে। একদিন তার বান্ধবী সিজুকো হাসপাতালে তার সাথে দেখা করে বলল কাগজের অরিগ্যামি সারস বানাতে, এক হাজার সারস বানানো হলে যা-ই চাইবে তা-ই পাবে। সাসাকির লক্ষ্য ছিল কাগজ দিয়ে এক হাজার সারস পাখি বানাবে। আশা করেছিল, এই কাজ হয়তো তার জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনবে। সে তৈরি করতে পেরেছিল সাড়ে ছয়শর মতো সারস।
তবু বাঁচেনি সাসাকি। কিন্তু বেঁচে আছে তার কাগজের সারসেরা, ক্ষমতার লড়াইয়ে সাধারণ মানুষদের একটি সাধারণ সুখী জীবনের স্বপ্ন হয়ে। এখানে একটি ভাস্কর্য আছে সাসাকি ও তার কাগজের সারসদের স্মরণে তৈরি করা। প্রতিবছর বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে মানুষেরা সাসাকি আর তার মতো শিশুদের স্মরণে এখানে নানা রঙের সারস তৈরি করে পাঠায়। সেগুলোকে কাঁচের পাত্রে প্রদর্শনী করা হয়।
পার্কটিতে আরও আছে স্মৃতি জাদুঘর, নিহতদের সমাধিমন্দির আর শান্তির অগ্নিশিখা। এছাড়া আছে বিস্ফোরণ থেকে বেঁচে যাওয়া ২৪টি গাছ। আগুন থেকে পুনর্জীবন পাওয়া কাল্পনিক পাখি ফিনিক্সের নামে এরা ফিনিক্স গাছ নামে পরিচিত। বহু যত্নে এদের বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।
হিরোশিমা প্রাসাদ নির্মিত হয়েছিল ১৫৯০ সালে। হান শাসকদের বাসস্থান ছিল এটি। ১৮৭১ সালে হান শাসন অবলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় প্রাসাদটিকে সামরিক ভবন বানানো হয়েছিল। বোমার আঘাতে জাপানের ঐতিহ্যবাহী এই ভবন ধ্বংস হয়। ১৯৫৮ সালে একদম আগের মতো করেই আবার তৈরি করা হয় প্রাসাদটিকে। বর্তমানে এটিকে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বিস্ফোরণের আগের হিরোশিমার খোঁজে ঘুরে আসতে পারেন এই জাদুঘরটি। সেখানে আছে পুরোনো দিনের চিত্রকরদের আঁকা শিল্পকর্ম, বোমার কিছু অংশ। প্রাসাদটির নিচে আছে তিনটি পারমাণবিক বোমার আঘাতে বেঁচে যাওয়া উইলো, হলি আর ইউক্যালিপটাস গাছ।
পারমাণবিক বোমার গম্বুজটির কাছেই আছে অরিগ্যামি সারস ‘ওরিজুরু’র নামে ‘ওরিজুরু টাওয়ার’। বসন্তে প্রায় সাড়ে চারশো চেরি গাছে ফুল ফোটে। টাওয়ারের উপর থেকে তখন স্বর্গীয় এক শহরের দৃশ্য উপভোগ করা যায়। কুয়াশা না থাকলে মিয়াজিমা পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায়। কে বলবে, এখানেই পুড়ে জমাট বেঁধে গিয়েছিল মানুষ আর কংক্রিট?
হিরোশিমা থেকে ফেরিতে দশ মিনিট গেলেই পাওয়া যাবে মনভোলানো দৃশ্যের সমাহারে ছোট্ট একটি দ্বীপ। এটি জাপানে বিখ্যাত তিনটি দৃশ্যের একটি। অন্তর্দেশীয় সাগর থেকে উঠে আসা দ্বীপটিকে ঘিরে আছে সবুজ পাহাড়ের সারি। সারাদিন দ্বীপটি ভরে থাকে পর্যটকদের কল্লোলে, সন্ধ্যা নামতেই এখানে নেমে আসে শুনশান নীরবতা। মিয়াজিমার মূল গ্রামে পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য রয়েছে নানারকম দোকান আর রেঁস্তোরা, যেখানে সাগর থেকে প্রতিদিন সকালে ধরা সামুদ্রিক মাছ রান্না করা হয়। আরো আছে ঐতিহ্যবাহী আবাসিক হোটেল। মিয়াজিমার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যারা রাতটা এখানেই কাটিয়ে দেওয়ার চিন্তা করে তাদের জন্যই বানানো হোটেলগুলো। দ্বীপে কিন্তু শুধু মানুষের বসতি নয়। শিন্তো ধর্মানুসারে, বিশেষ ধরনের হরিণ তাদের জন্য পবিত্র প্রাণী। দ্বীপের যেখানে সেখানে মুক্ত হরিণের দেখা পেতে পারেন মিয়াজিমায় গেলে। মিসেন পর্বত এখানকার সবচেয়ে উঁচু জায়গা। এর উচ্চতা ১,৭৩৯ ফুট। মিসেন পর্বত অভিযানে যেতে হলে কনিফারের ঘন জঙ্গল ভেদ করে এগুতে হবে আপনাকে।
কিন্তু এতকিছু ছাড়িয়ে মিয়াজিমা আসলে বিখ্যাত তার ইতসুকুশিমা মঠের কারণে। পানির ভেতর ভাসমান এই সিঁদুর রঙের মঠটি শুরু হয় ‘তোরি’ দরজা দিয়ে। সোজা পানি থেকে উঠে আসা এই দরজাটি জাপানের সবচেয়ে বড় ‘তোরি’ দরজা। ৫৫ ফুট এই দরজাটিকেও টকটকে লাল রং করে দেওয়া হয়েছে অতৃপ্ত আত্মাদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্য। ১১৬৮ সাল থেকে এখানে ‘তোরি’ দরজা তৈরি করে রাখার ঐতিহ্যে কর্পূর আর সিডার নির্মিত বর্তমান দরজাটি অষ্টম। জোয়ারের সময় মনে হয় যেন পানির উপর ভাসছে দরজা সহ মঠটি। ভাটার সময় পায়ে হেঁটেই দরজা পেরিয়ে মঠে যাওয়া যায়। শিন্তো ধর্মের পবিত্র এই মঠটি নির্মিত হয়েছিল ত্রয়োদশ শতাব্দীতে। বর্তমানে এটি ইউনেস্কো কর্তৃক ঘোষিত বিশ্বের ঐতিহ্যপূর্ণ স্থানের তালিকায় রয়েছে।
কাছেই আছে দেশটির অল্প কয়েকটি প্যাগোডার একটি। মিতাকি-দেরা নামের এই প্যাগোডাটি ৯০ ফুট উঁচু। এটি প্রথমে নির্মিত হয়েছিল ৮০৯ খ্রিস্টাব্দে। যুদ্ধের পর এটি পুননির্মাণ করা হয়। বৌদ্ধ ধর্ম আর জাপানের নিজস্ব ঘরানার স্থাপত্যকলার আকর্ষণীয় মিশ্রণ এই প্যাগোডা।
পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ যুদ্ধ চায় না। তারপরও যুদ্ধ হয়। ইতিহাস থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়ানক ক্ষতির কথা কখনো মুছে ফেলা সম্ভব নয়। কিন্তু হিরোশিমাবাসীরা, যারা প্রত্যক্ষ করেছিল পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম পারমাণবিক দুর্ঘটনা, তারাই অস্ত্রের বদলে ভালোবাসা দিয়ে পৃথিবীতে শান্তি চেয়েছে। তাদের প্রকৃতি, স্থাপত্যকলা আর ভাষ্কর্যের সৌন্দর্য হয়ে উঠেছে তামাম বিশ্বের কাছে শান্তির আকুতি।
ফিচার ইমেজ: GajinPot Travel