যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও দ্রুত যাতায়াতের জন্য অনেকে বিমানকে পছন্দ করে থাকেন। কিন্তু তারপরও নদী বা সমুদ্র ভ্রমণ কিংবা উপকূলবর্তী দ্বীপ ভ্রমণের জন্য অনেকে এখনও জাহাজকে পছন্দ করে থাকেন। টাইটানিকের মতো বিলাসবহুল প্রমোদতরী আটলান্টিক মহাসাগরে ডুবে যাওয়ার পরও ভ্রমণপিপাসু মানুষদেরকে জাহাজ ভ্রমণ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়নি। বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির এই উৎকর্ষতার যুগে বর্তমানে নির্মিত হচ্ছে অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন সব জাহাজ।
টাইটানিক জাহাজের নানা ভুলত্রটি থেকে শিক্ষা নিয়ে এখন প্রমোদতরীগুলোতে সুরক্ষার সবধরনের ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। কী নেই প্রমোদতরীগুলোতে? নাগরিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন আধুনিক সব ব্যবস্থা ছাড়াও সমুদের নীল জলরাশি ও দিগন্ত বিস্তৃত আকাশের মিতালি উপভোগ করার আকর্ষণীয় ব্যবস্থাসহ নানা ধরনের আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা রাখা আছে বিলাসবহুল ক্রুজগুলোতে। এসব আধুনিক প্রমোদতরীতে ভ্রমণের জন্য মুখিয়ে থাকেন বিশ্বের বিভিন্ন জায়গার পর্যটক। অনেকে আবার জীবনের দীর্ঘ ব্যস্ততাময় সময় থেকে ছুটি নিয়ে অবসরের মুহূর্তগুলো প্রিয়জনের সাথে কাটানোর জন্য প্রমোদতরীতে ভ্রমণ করা পছন্দ করে থাকেন।
আর পর্যটকদের এই বিপুল চাহিদার কথা মাথায় রেখেই বিভিন্ন দেশে তৈরি হচ্ছে নানা বিলাসবহুল জাহাজ। বিলাসবহুল শীর্ষ পাঁচটি প্রমোদতরীর বিশালত্ব ও তার সুযোগ-সুবিধার কথা এবার তাহলে জেনে নিই।
১. কুনার্ডস কুইন মেরি ২
বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম জাহাজ এটি। ২০০২ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ২০০৪ সালে জাহাজটি তার প্রথম আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। কুইনার্ড কোম্পানি এই জাহাজটির নির্মাতা। জাহাজটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ৩৪৫ মিটার এবং এর উচ্চতা প্রায় ৭২ মিটার। এর মোট টনেজ ১,৪৮,৫২৮।
দারুণ দ্রুতগতিতে চলাচল করতে সক্ষম এই জাহাজ। ঘণ্টায় প্রায় ৩০ নটিকেল মাইল গতিতে সাগর অতিক্রম করতে পারে ক্রুজটি। একসাথে সর্বোচ্চ ২,৬২০ জন ভ্রমণপিপাসু মানুষ জাহাজটিতে ভ্রমণ করতে পারবেন।
জাহাজটিতে ১০ ধরনের কেবিনসহ মোট কেবিনের সংখ্যা ১,৩১০টি। ট্রান্স আটলান্টিক ক্রসিং ছাড়াও গোটা বিশ্বের ভ্রমণের জন্য জাহাজটির সুখ্যাতি রয়েছে। আটলান্টিক মহাসাগরের প্রতিকূল আবহাওয়াও জাহাজটির যাতে কোনোরূপ ক্ষতি করতে না পারে তার জন্য আধুনিক সব সুরক্ষা ব্যবস্থা রাখা আছে।
জাহাজটিতে রয়েছে বিস্তৃত ডাইনিং হল, বলরুম, থিয়েটার, সুইমিং পুল, আন্তর্জাতিক মানের রেস্টুরেন্ট, ক্যাসিনো ও অত্যাধুনিক কেবিন। সবকিছুতেই যেন বিলাসবহুল পাঁচ তারকা হোটেলের ব্যবস্থা বিদ্যমান ক্রুজটিতে।
২. রয়েল ক্যারিবিয়ান, অ্যালুর অব দ্য সিস
রয়েল ক্যারেবিয়ান ক্রুজ প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ‘অ্যালুর অব দ্য সিস’ বিশ্বের বৃহত্তম জাহাজ। জাহাজটি দৈর্ঘ্যে ৩৬২ মিটার এবং উচ্চতায় ৭২ মিটার। এর টনেজ ২,২৫,২৮২। বিলাসবহুল এই জাহাজটির নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ১২০ কোটি ডলার। এই জাহাজের ধারণক্ষমতা সর্বোচ্চ ৬,৭৮০ জন।
২০ নভেম্বর, ২০০৯ সালে জাহাজটি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। জাহাজটির গতি প্রতি ঘণ্টায় ২২.৬ নটিকেল মাইল। জাহাজটিতে সাধারণত ইউরোপ ও এশিয়ার পর্যটকদের সংখ্যাই বেশি হয়ে থাকে।
বিলাসবহুল এ ক্রুজ পর্যটকদেরকে মূলত ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলগুলো এবং ক্যারিবীয় বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে দেখানোর ব্যবস্থা করে। জাহাজটিতে বয়সভেদে নানা সুযোগ-সু্বিধা ও বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে। কাঠ ও কাঁচের আধুনিক সব নকশা ও স্থাপত্যশৈলীতে সাজানো হয়েছে প্রমোদতরীটি। বর্তমান যুগের আধুনিক সব সুযোগ সুবিধা বিদ্যমান ক্রুজটিতে।
৩. হারমোনি অব দ্য সিজ
৩৬২ মিটার দীর্ঘ এবং ৭০ মিটার উচ্চতা সম্পন্ন জাহাজটি নির্মাণ করেছে ফ্রান্সের প্রতিষ্ঠান এসটিএক্স। এটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১১০ কোটি ডলার। বিলাসবহুল এই জাহাজের ওজন ২ লক্ষ ২৭ হাজার টন।
নানা নান্দনিক শিল্পকর্মে সজ্জ্বিত জাহাজটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালে। টাইটানিকের চেয়েও ৩৩০ ফুট লম্বা এই প্রমোদতরী। প্রায় ১২ হাজার প্রজাতির গাছপালা দিয়ে ক্রুজটিতে সাজানো হয়েছে এক প্রমোদ উদ্যান।
ক্রুজটিতে প্রায় ছয় হাজার যাত্রী এক সাথে ভ্রমণ করতে পারে। যাত্রীদের সেবা দিতে ক্রুজে নিয়োজিত রয়েছে প্রায় ২,৩০০ জন ক্রু। জাহাজটি ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মধ্যে যাতায়াত করে থাকে।
এতে রয়েছে আধুনিক সব কেবিন, রোপ স্লাইড, মিনি গলফ কোর্স, আকর্ষণীয় দশ তলা বিশিষ্ট ওয়াটার স্লাইড, থ্রিডি থিয়েটার এবং ক্যাসিনো। জাহাজটির বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখতে হলে ভ্রমণকারীকে অবশ্যই জিপিএস সিস্টেমের সাহায্য নিতে হবে। না হলে সেসব যাত্রী পথ হারিয়ে ফেলতে পারেন!
৪. ডিজনি ফ্যান্টাসি
ফ্যান্টাসিকে বাস্তবে রূপ দেওয়া হয়েছে এই ক্রুজে। এই জাহাজের যারা ভ্রমণ করেন তাদেরকে স্বপ্নের মায়াবী জগতে নিয়ে যাওয়ার যাবতীয় ব্যবস্থা করা হয়েছে এখানে। স্বপ্নের মতো করে সাজানো হয়েছে জাহাজটি। আড়াই হাজারের মতো যাত্রী নিতে সক্ষম জাহাজটির ওজন ১,২৮,৬৯০ টন। ২০১২ সালে এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়।
সময়ের সাথে পাল্লা দিতে ক্রুজটিতে আধুনিক নানা সংস্কার করা হয়েছে। ডিজনি ক্রুজ লাইনের সবচেয়ে নবীন জাহাজটি প্রথম যাত্রা শুরুর পর থেকেই ভ্রমণপিপাসুদের প্রধান আকর্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাহাজটিতে করে পর্যটকদের নিয়ে যাওয়া হয় পূর্ব-পশ্চিম ক্যারিবীয় সাগর পর্যন্ত।
জাহাজটিতে রয়েছে বিলাসবহুল নানা ব্যবস্থাপনা। আকর্ষণীয় ও মনমাতানো উপাদেয় খাবারের রেঁস্তোরা, মিউজিক্যাল পারফর্মেন্স, সুইমিং পুল, থ্রিডি সিনেমা দেখাসহ নানা অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন কেবিন ও ডেকের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে জাহাজটিতে।
৫. ওয়েসিস অফ দ্য সিজ
রয়্যাল ক্যারিবিয়ান ইন্টারন্যাশনালের এক অভিজাত জাহাজ ‘ওয়েসিস অফ দ্য সিজ’, যার অর্থ সমুদ্রের বুকে একখানি মরুদ্যান। আটলান্টিক সাগর পরিভ্রমণের উদ্দেশ্যে ১.৪ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে জাহাজটি নির্মাণ করেছে এসটিএক্স কোম্পানি। ৩৬১.৬ মিটার দীর্ঘ এবং ৭২ মিটার উচ্চতাসম্পন্ন জাহাজটির টনেজ ২,২৫,২৮২।
২০০৭ সালের ১২ নভেম্বর জাহাজটির নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং ২০০৯ সালের ১ নভেম্বর জাহাজটি তার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। ঘণ্টায় জাহাজটির গতিবেগ ২২.৬ নটিকেল মাইল। জাহাজটি একসাথে ৫,৪০০ যাত্রী পরিবহনে সক্ষম। বিশাল আকৃতির এই বিলাসবহুল জাহাজে রয়েছে আধুনিক সব ব্যবস্থা।
বিনোদনের জন্য এতে আইস স্কেটিং, বাস্কেটবল কোর্ট, পুল খেলার ব্যবস্থা, ডিসকো, ক্যাসিনো, থ্রিডি মুভি থিয়েটারসহ বিলাসবহুল রেস্টুরেন্টে রয়েছে নানা রকম মুখরোচক খাবারের ব্যবস্থা। এছাড়াও রয়েছে আধুনিকতম সেলুন ও ম্যাসেজ পার্লার। রাতের বেলায় চলে মিউজিক্যাল নানা প্রোগ্রাম।
প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে সূর্যস্নান উপভোগ করার জন্য রয়েছে সুইমিং পুল, পুল ডেক এবং লাউঞ্জ চেয়ারের ব্যবস্থা। ক্রুজটির ব্রডওয়ার্ক এবং সেন্ট্রাল পার্ক ফিচার অন্য সব ক্রুজের চেয়ে ব্যতিক্রম। বিশাল আকৃতির সেন্ট্রাল পার্ক দেখে যেকোনো যাত্রীই হতবাক হয়ে পড়েন। সবধরনের পর্যটকের কাছেই এই প্রমোদতরীতে ভ্রমণ অত্যন্ত আকর্ষণীয় এক ব্যাপার।
ফিচার ইমেজ: travelzoo.com