“যতবার তুমি জননী হয়েছো, ততবার আমি পিতা,
কত সন্তান জ্বালালো প্রেয়সী তোমার আমার চিতা।
বারবার আসি আমরা দু’জন, বারবার ফিরে যাই,
আবার আসবো, আবার বলবো- শুধু তোমাকেই চাই।”
কবীর সুমনের ‘জাতিস্মর’ গানের শেষের এই লাইনগুলো শুনেছেন নিশ্চয়। হ্যাঁ, বলছি দুই বাংলায় সমান বিখ্যাত সঙ্গীতকার কবীর সুমনের কথা। একই সাথে তিনি একজন গায়ক, গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক, কবি, সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী, টিভি উপস্থাপক ও নৈমিত্তিক অভিনেতা। অনেকে তাকে বাংলার বব ডিলানও বলে থাকেন। বব ডিলানের ‘ব্লোইং ইন দ্যা উইন্ড’ এর বাংলা রুপান্তর ‘কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়’ দিয়ে বব ডিলানকে বাংলায় একটা অতি চেনা নামে পরিণত করেছেন কবীর সুমন। বাংলা গানে পশ্চিমা প্রভাবের সংমিশ্রণে এক নতুন ধাঁচের গান প্রবর্তনের জন্য বিখ্যাত তিনি। চলুন জানা যাক তার অজানা কিছু কথা, কিছু অজানা অভিব্যক্তি।
সুমন চট্টোপাধ্যায়, ১৯৫০ সালের ১৬ মার্চ ওড়িষার কটকে এক বাঙালি হিন্দু ব্রাহ্মন পরিবারে জন্ম তার। বাবা সুধীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, মা উমা চট্টোপাধ্যায়। বাবার কাছে ক্লাসিক্যাল মিউজিকের তালিম নেয়া সেই ছোট্টবেলাতেই। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক শেষ করে ফ্রেঞ্চ ও জার্মান ভাষায় ডিপ্লোমা নেন সুমন। এরপর কিছুদিন অল ইন্ডিয়া রেডিও আর ইউনাইটেড ব্যাংক অব ইন্ডিয়াতে কাজ করেন। সত্তরের মাঝামাঝি সুমন গুয়াতেমালায় চলে যান। এক জায়গায় বেশিদিন তিনি থিতু হননি। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তিনি স্থান বদল করেছেন। দেখেছেন বিভিন্ন ধাঁচের মানুষ, এসেছেন ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক ধারার সংস্পর্শে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সাল অবধি তিনি ভয়েস অব জার্মানীর বাংলা বিভাগে কাজ করেন। ফ্রান্সে থাকাকালে সুমন বব ডিলানের গানের ছোঁয়ায় আসেন। সে ছিল তার জন্য এক যুগান্তকারী অভিজ্ঞতা।
১৯৮০ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত কবীর সুমন আমেরিকায় ছিলেন। সেখানে তিনি ওয়াশিংটন ডিসিতে ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগে কাজ করেছেন। এখানে কাজ করার সময় তিনি পিট সিগার, মায়া অ্যাঞ্জেলোসহ বেশ কিছু গুণী সাহিত্যিক ও সঙ্গীত বিষয়ক ব্যক্তিত্বের সাথে পরিচিত হন। আশির দশকের মাঝামাঝিতে সুমন নিকারাগুয়ায় স্যান্ডিনিস্টা বিপ্লব নিয়ে বেশ আগ্রহী হয়ে পড়েন। পিট সিগারের বদৌলতেই সুমনের পরিচয় হয় আর্নেস্টো কার্ডেনালের সাথে। একইসাথে ধর্মযাজক, কবি ও মুক্তিসংগ্রামী আর্নেস্টো কার্ডেনাল ছিলেন সেসময় নিকারাগুয়ার সংস্কৃতি মন্ত্রী। কার্ডেনালের আমন্ত্রনেই সুমন ১৯৮৫ সালে নিকারাগুয়ায় যান। সেখানে গিয়ে ল্যাটিন আমেরিকার সঙ্গীত জগতে যে নতুন বিপ্লব চলছিল, তার সংস্পর্শে আসেন সুমন।
পশ্চিমের বিভিন্ন দেশের আলাদা সংস্কৃতির ছোঁয়া আর আলাদা ধাঁচের সঙ্গীতের নির্যাস নিয়ে এসে সুমন যুক্ত করেন বাংলা গানে। ১৯৮৯ সালে জার্মান ইন্টারন্যাশনাল রেডিওর সাথে দ্বিতীয় চুক্তির মেয়াদ পূর্ণ করে সুমন কলকাতায় ফিরে আসেন। এরপর শুরু হয় তার দীর্ঘ প্রবাস সঞ্চিত সাঙ্গীতিক অভিজ্ঞতার সৃজনশীল স্ফূরণের উন্মেষ। তার নগর জীবন আর সামাজিক সচেতনতামূলক গানগুলো মানুষের বোধের জগতকে সজজেই নাড়া দেয়। কলকাতায় তিনি প্রথম যোগ দিয়েছিলেন ‘নাগরিক’ ব্যান্ডের সাথে। এই ব্যান্ডের সাথে বের হয় তার দু’টি অ্যালবাম- ‘অন্য কথা অন্য গান ১’ ও ‘অন্য কথা অন্য গান ২’।
১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল প্রকাশিত হয় তার প্রথম অ্যালবাম ‘তোমাকে চাই’। বাংলা গানে নতুন মাত্রা যোগ করলো এই অ্যালবাম। এখনও দুই বাংলায় সমান আবেদনময়ী ‘তোমাকে চাই’সহ এই অ্যালবামের বাঁকি গানগুলো। ২০১০ সাল অবধি সুমনের কুড়িটির বেশি অ্যালবাম বের হয়েছে। তার গানগুলো বাংলা গানের ক্রমবিবর্তনে এক বিশাল প্রভাব রেখেছে। ‘চন্দ্রবিন্দু’র মতো বেশ কিছু ব্যান্ড তার দ্বারা সম্যক প্রভাবিত হয়ে পথ চলেছে, চলছে। বলা যায়, আধুনিক বাংলা গানে একটা চিরস্থায়ী প্রভাব রাখা বিপ্লব ঘটে গেছে কবীর সুমনের হাত ধরে।
’৯০ এর পরে গায়ক ও গীতিকারদের একটা পুরো প্রজন্মকে প্রভাবিত করেছেন কবীর সুমন। তার অনুসারীদের মধ্যে আছেন নচিকেতা, অঞ্জন দত্ত, লোপামূদ্রা মিত্র, শ্রীকান্ত আচার্য্যসহ আরও অনেকেই। সুমনের বেশিরভাগ গানই শুধু পিয়ানো, গিটার বা সিনথেসাইজার এর একক তানে তৈরি। ২০১২ এ বের হয় সুমনের ‘৬৩ তে’। এরপর থেকে তিনি রাজনৈতিক ইস্যুতে বেশী নিমগ্ন হয়ে পড়েন। ২০০৯ এর মে থেকে ২০১৪ পর্যন্ত তিনি ইন্ডিয়ান পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
রোজকার জীবনযাত্রা, অচেতন মনের চিন্তাধারা, নগর জীবনের বাস্তবতা আর এর সাথে জড়ানো অনুভূতিগুলো বিস্ময়কর এক দ্যুতি নিয়ে ফুটে ওঠে সুমনে গানে। অনেকে তাকে ডাকেন ‘নাগরিক কবিয়াল’। অনেকে তার গানকে বলেন ‘জীবনমুখী’। এত শত বিশেষণে আগ্রহ নেই সুমনের। তার কাছে তার গান হলো শুধুই আধুনিক বাংলা গান। তার গানের আরেক বৈশিষ্ট্য হলো প্রেম। প্রেমকে তিনি বরাবর উপস্থাপন করেছেন কোনো তরুণের সেই প্রথম শিহরণের সাথে, ফুটিয়ে তুলেছেন সেই চিরন্তন আকাঙ্খা, চিরকালের বাসনা, লজ্জাহীন আকুতি আর ব্যার্থতার দীর্ঘশ্বাস; যার ফলে তার গানে প্রেমানুভূতি হয়েছে আরও শক্তিশালী, আরও বাস্তব, আরও সুন্দর আর কালজয়ী। এই যেমন-
“নাগরিক ক্লান্তিতে তোমাকে চাই
এক ফোঁটা শান্তিতে তোমাকে চাই
বহুদূর হেঁটে এসে তোমাকে চাই
এ জীবন ভালোবেসে তোমাকে চাই…”
অথবা,
“রাস্তায় পড়ে আছে স্বপ্নের লাশ
বাতাসে লুকোনো তার দীর্ঘশ্বাস
খুন হওয়া স্বপ্নের চোখ ঢেকে দেওয়া চাই-
বিদায় পরিচিতা, আকাশ বিষণ্ন, তার কাছে যাই…”
কবীর সুমনের মন কেড়ে নেওয়া সব অ্যালবামের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো তোমাকে চাই (১৯৯২), ইচ্ছে হলো (১৯৯৩), গানওয়ালা (১৯৯৪), ঘুমাও বাউন্ডুলে (১৯৯৫), চাইছি তোমার বন্ধুতা (১৯৯৬), জাতিস্মর (১৯৯৭), নিষিদ্ধ ইশতেহার (১৯৯৮), যাবো অচেনায় (২০০১), লালমোহনের লাশ (২০১০) ইত্যাদি।
সুমন চট্টোপাধ্যায় বর্তমানে প্রখ্যাত বাংলাদেশি গায়িকা সাবিনা ইয়াসমিনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ। তাকে বিয়ে করার সময়ই সুমন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং নাম পরিবর্তন করে কবীর সুমন রাখেন। তার ভাষ্যমতে কবীর নামটি ‘বৈষ্ণব পদাবলি’র রচয়িতা মধ্যযুগীয় বাঙালি কবি শেখ কবীরের নাম থেকে নেয়া।
জাত প্রেমিক কবীর সুমন; জীবনে বহুবার প্রেমে পড়েছেন। প্রেমের ব্যাপারে তার চিন্তাধারা যেমন আধুনিক, তেমনই সত্য। একই সময়ে একাধিকজনের প্রেমে পড়াটা বিড়ম্বনাকর কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন,
“আপনি যদি একই সময়ে একাধিক বই পড়তে পারেন, তবে একাধিক নারীকে ভালোবাসতে পারবেন না কেন? যে নারীরা তাদের মন ও দেহ দিয়ে আমায় সমৃদ্ধ করেছেন, তাদের প্রতি আমার অকুন্ঠ শ্রদ্ধা রয়েছে।”
কতবার প্রেমে পড়েছেন জানতে চাইলে সুমন বলেন,
“আমার একটা জেট প্লেন ভাড়া করা উচিৎ যাতে আকাশজুড়ে আমার প্রেমিকাদের নাম লিখে দিতে পারি।” “কখনো প্রেমে কোনো পাগলামো করেছেন কি?”
জিজ্ঞাসা করলে জবাব দেন, “প্রেমে পড়াটাই তো একটা পাগলামো।” প্রেম তার কাছে সঙ্গীতের আলাদা আলাদা রাগের মতো। তিনি আরও বলেন,
“আমার প্রিয়তমা শুধু আমার নাম ধরে সুমন, সুমন… বলে ডাকছে, এটা শুনতে শুনতেই আমি মরে যেতে পারি। অল্প বয়সে আমরা প্রেমে গন্তব্য খুঁজি, এখন আমি জানি যে মৃত্যুই শুধু সেই গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারে।”
কতটা সূক্ষ্ম, কতটা গভীর তার জীবনবোধ, শুধু এ কথাটি থেকেই বুঝা যায়।
নিজের আলাদা চিন্তাধারার জন্যে বহুবার আলোচিত- সমালোচিত হয়েছেন সুমন। কিন্তু একজন কবীর সুমনের মধ্যে দিয়েই গড়ে ওঠে সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন- পৃথিবীর এক প্রান্তের সাথে আরেক প্রান্তের, গঙ্গার সাথে রাইনের। সমাজ ও সংস্কার থেমে যাওয়ার হাত থেকে নিস্কৃতি পায়। এখন তিনি ৭২। আরও অনেকদিন বেঁচে থাকুন আধুনিক বাংলা গানের এই কিংবদন্তী। তার বন্ধনহীন চিন্তাধারা আর উচ্চতর জীবনবোধ নিয়ে আরও প্রভাবিত করতে থাকুন পরবর্তী প্রজন্মকে।