Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ভারতীয় বিয়ের সংস্কৃতি: মহামারিও যাকে পারেনি রুখতে

বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া যেকোনো মানুষের জীবনেই একটি স্মরণীয় ঘটনা। প্রণয় থেকে পরিণয় হোক কিংবা কথাবার্তা-দেখাশোনার মাধ্যমে আয়োজিত বিয়েই হোক- বিয়ে সবক্ষেত্রেই উৎসবের আরেক নাম। বিশ্বের নানা দেশের অসংখ্য সংস্কৃতিতে বিয়ের আয়োজনের ধরনও হরেক রকমের। তবে এই উপমহাদেশে বিয়ে যতটা ব্যাপক আকারে অনুষ্ঠিত ও উদযাপিত হয়, ততটা সম্ভবত বিশ্বের খুব কম দেশেই হয়ে থাকে। 

ভারতীয় বিয়ের সাধারণ চিত্র

বিয়ের ধারণার কথাই ধরা যাক। পশ্চিমা দেশগুলোতে বিয়ে বলতে দুজন মানুষের মনের মিলকে একটি সামাজিক রূপ দেওয়াকেই বোঝানো হয়ে থাকে। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে বিয়ে বলতে যা বোঝানো হয় তা পশ্চিমা দেশগুলোর ধ্যানধারণা থেকে অনেকটাই আলাদা। উন্নত বিশ্বে সাধারণত পাত্র-পাত্রীর সম্ভাবনা (Prospect) যাচাই-বাছাইয়ের বিষয়টি প্রায় অচল। সামাজিক মর্যাদা, আর্থ-সামাজিক অবস্থান, অর্থ-বিত্ত-বৈভব-বংশলতিকা ইত্যাদি বিষয় সেখানকার নাগরিকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভাবেন না। অন্যদিকে উপমহাদেশের রীতিনীতি পুরোপুরিভাবে বিপরীত। বাহ্যিক সৌন্দর্য, সামাজিক প্রতিপত্তি, ক্ষমতা, আর্থিক সামর্থ্য, বংশপরম্পরা ইত্যাদির নিরিখে একজন মানুষকে বিচার করে তবেই বিয়ের আয়োজন হয়ে থাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে। বিয়ে করতে যাওয়া দুজনের মানসিকতা, জীবনদর্শন, রুচির মিথষ্ক্রিয়া, যা কি না হওয়া উচিত ছিল বিয়ের প্রাথমিক এবং সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ উদ্দেশ্য, সেটিই একেবারে অবহেলিত হয়ে পড়ে। 

মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত রাসিকা ও আজিংকার বিয়েতে অভ্যাগতদের সংখ্যা নেমে এসেছিল ৭০০ থেকে ৫০-এ; Image Source: bbc.com  

একজন বিত্তশালী পুরুষের তথাকথিত একজন অনিন্দ্যসুন্দর নারীকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণের সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে একজন মধ্যবিত্ত পুরুষের চেয়ে। আবার শ্যামলা বর্ণের একজন তরুণীর জন্য সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠিতে খুব উঁচু অবস্থানে থাকা একজন পুরুষকে স্বামী হিসেবে আশা করাটা প্রায় সময়ই বাঞ্ছনীয় নয়। অর্থাৎ উপমহাদেশে বিয়ে যতটা না বিয়ের নিমিত্তে, তার চেয়ে অনেক বেশি সামাজিকতা রক্ষার উদ্দেশ্যে। শিক্ষাগত যোগ্যতা, আয়, ক্ষমতা, বংশ গৌরব, শারীরিক সৌন্দর্য ইত্যাদি নিতান্তই আপেক্ষিক বিষয়গুলো সবচেয়ে প্রাধান্য পেয়ে থাকে দুজন সম্ভাব্য নারী-পুরুষের মাঝে বিয়ে হওয়ার ক্ষেত্রে।

ভারতে বিয়ে বিষয়টা আক্ষরিক অর্থে খুব কমই বিয়ে। দু’জন মানুষের একত্রে থাকাটা সেখানে গুরুত্বের বিচারে তলানীতে গিয়ে ঠেকে; আর মেহমানদের প্রত্যাশা, দু’পক্ষের বাবা-মায়ের স্বপ্নের প্রতিফলন, ভোজন, কেনাকাটা ইত্যাদির ভীড়ে হবু স্বামী-স্ত্রীর নিজেদের অবস্থান জানানোর বা বক্তব্য পেশের কোনো সুযোগই হয়ে ওঠে না। দেখনদারি কী ও কত প্রকার সেটা পশ্চিমা দেশগুলো উপমহাদেশে এসে অনায়াসে শিখে নিতে পারে। ভারতে মোটামুটি মানের একটি বিয়ের আয়োজনে খরচ হয় ৬,০০০-১৩,০০০ ডলার, উচ্চ মধ্যবিত্তদের জন্য খরচের অংকটা দাঁড়ায় ৪১,০০০-৮০,০০০ ডলারের মাঝে, আর সমাজের একেবারে ভদ্রপল্লীর অধিবাসীরা ১,০০,০০০-১ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত খরচ করে থাকেন। 

ভারতে জাতপাতের ভেদাভেদ এতটাই তীব্র ও সূক্ষ্ম যে সেটির প্রভাব সন্দেহাতীতভাবে বিয়ের আয়োজনেও লক্ষ্যণীয়। প্রত্যেক অভিভাবক তাদের জীবনের সর্বশেষ সম্বলটুকু দিয়ে হলেও ধুমধাম করে সন্তানের বিয়ের আয়োজন করতে বদ্ধপরিকর থাকেন। আর সন্তান যদি মেয়ে হয় তাহলে তো কথাই নেই, কারণ চেষ্টার সামান্যতম ত্রুটিও মেয়ের সংসারে কালবৈশাখী ঝড় বইয়ে দিতে সক্ষম। সমাজের চাপে এবং লোকলজ্জার ভয়ে সাধ্যের বাইরে গিয়ে মা-বাবারা কার সাধ মেটান তারা নিজেরাই কি জানেন? ক’জন অভিভাবকেরই বা স্পর্ধা থাকে ‘সমাজ’ নামক জুজুর ভয়কে জয় করার? সাধ্যের বাইরে গিয়ে সাধ মেটানোর এই প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় শুধু জীবন বাজি রাখাটাই তারা বাকি রাখেন। বিয়ের ব্যয় মেটাতে গিয়ে তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিতেও পিছপা হন না। 

সমাজবিজ্ঞানী প্যাট্রিসিয়া উবেরয়ের ভাষ্যমতে,

অর্থের এতটা নিরর্থক খরচ ভারতীয় বিয়ে ছাড়া আর কোথাও হয় না। জলের দরে অর্থ খরচের এহেন দৃশ্যমান নাটক আর কোথাও মঞ্চায়িত হয় না।

বিয়ে বনাম মহামারি

ভারতীয় অভিভাবকরা সন্তানের জীবনে তাকে বিয়ে দেওয়াকে তাদের সবচেয়ে বড় অবদান হিসেবে মনে করে থাকেন। নিজেদের অভিভাবকত্বের এক সফলতম উপসংহার তারা টানেন সন্তানের বিয়েতে সাধ্যের বাইরে গিয়ে আয়োজন করার চেষ্টা করে। সারা জীবন নীরবে-নিভৃতে শত ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে তারা একটু একটু করে সন্তানের বিয়ের জন্য অর্থ সঞ্চয় করতে থাকেন, এবং তাতেও না কুলালে শেষাবধি ঋণ করেন। পরিসংখ্যান মোতাবেক, ভারতীয় পরিবারগুলো তাদের সন্তানের বিয়েতে সমগ্র জীবনের মোট সঞ্চিত সম্পদের এক-পঞ্চমাংশ খরচ করে থাকে। অবিশ্বাস্যই বটে!

সদ্য বিবাহিত মাস্ক পরিহিত তরুণ দম্পতি; Image Source: outlookindia.com

বিয়েকে ঘিরে গড়ে ওঠা এক চমৎকার শিল্পের প্রসার ঘটেই চলেছে ভারতে। আগামী এক বছরের মাঝে ধারণা করা হচ্ছে যে এই শিল্পের সামগ্রিক আয় হবে ৪০-৫০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত। তবে এই শিল্পের এহেন দুর্বার গতি কিছুটা হলেও থমকে গিয়েছে করোনা মহামারির কারণে। গেল বছরের প্রথমার্ধে ভারতে বেশ ক’মাস লকডাউন জারি ছিল, যার কারণে ওই সময়ের মাঝে যারা বিয়ে করার কথা ভাবছিলেন বা পরিকল্পনা করছিলেন তারা একপ্রকার বাধ্য হয়েই একেবারেই সীমিত পরিসরে মালা বদলের কাজটি সারেন। ছিল না সানাইয়ের সুর, অলংকারের ঝংকার, হাজারো লোকের সমাগম কিংবা অহেতুক অর্থব্যয়। 

চিন্তা করে দেখুন, ভারতে বিয়ের সংজ্ঞায়নে সহস্রাধিক মানুষের উপস্থিতি এতটাই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে যে এই মহামারির মাঝেই (লকডাউন তুলনামূলকভাবে শিথিল করে দেওয়ার পর) মানুষ আবার আগের প্রথায় ফেরত যাচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্য সংস্কৃতির যে পালাবদলকে অবশ্যসম্ভাবী মনে হচ্ছিল, সেটি পরমুহূর্তেই একেবারে দোর্দণ্ড প্রতাপে মিথ্যা প্রমাণিত হলো। সমাজের উচ্চবিত্ত, যারা অনায়াসে পাঁচ তারকা হোটেল বুক করতেন মহামারির আগে, তারা এখনও অর্থাৎ মহামারির মাঝেও একই কাজ করছেন। আর এদিক দিয়ে ওয়েডিং প্ল্যানার প্রতিষ্ঠানগুলো দিব্যি তাদের ব্যবসায় আমূল পরিবর্তন আনছে। বিবাহেচ্ছুক কেউ যদি অভ্যাগতদের করোনা টেস্ট বাধ্যতামূলক ঘোষণা করে, তাহলে ওয়েডিং প্ল্যানার কর্তৃপক্ষ নিজেই ডায়াগনোস্টিক কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে অনুষ্ঠানের আগেই অভ্যাগতদের করোনার ফলাফল নিয়ে নিচ্ছে এবং সেই অনুযায়ী কেউ কেউ বিয়ের দাওয়াত থেকে বঞ্চিতও হচ্ছেন। 

বিয়ের সাজে সজ্জিত এক ভারতীয় বাড়ি; Image Source: Wikimedia Commons

আবার যারা মধ্যবিত্ত পরিবারের, তাদের অনেকেরই সামর্থ্য নেই পাঁচ তারকা হোটেল ভাড়া করার। মহামারি না এলে তারা হয়তো মধ্যাহ্নভোজনের আয়োজন করতেন। সেই একই খাবার তালিকা তারা রান্না করে আত্মীয়দের বাসায় বাসায় পার্সেল করে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। বিশাল সংখ্যক লোকের ভোজনের আয়োজন করতে চেয়ার, টেবিল, প্লেট, হাত ধোয়ার ব্যবস্থা বাবদ যে বড় অংকের অর্থ প্রয়োজন হতো, সেই তুলনায় কম খরচ করে তারা সহজেই খাবারদাবারের পাঠ চুকিয়ে ফেলছেন। এতে অর্থের অপচয় যেমন রোধ হলো, তেমনি স্বাস্থ্যবিধিও মেনে চলা হলো।

করোনার প্রকোপ ধীরে ধীরে কমে আসছে আর সাথে পাল্লা দিয়ে উপমহাদেশীয় বিয়ে তার হাজার বছরের পুরনো ঢঙে ফিরে যাচ্ছে। বিয়ের এই স্থূল সংজ্ঞায়নের ফলে এই যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা, সেটি কি কোনো অংশেই মহামারির চেয়ে কম? করোনা থেকে পৃথিবী একদিন হয়তো মুক্ত হবে, তবে প্রশ্ন থেকেই যায় যে হাজার বছরের সুপ্রাচীন এই অনর্থক বিয়ের সংস্কৃতি থেকে উপমহাদেশ কি আদৌ কোনোদিন বের হয়ে আসতে পারবে? পারলে কবে?

This article is written in Bangla. It is about the Indian marriage culture during the COVID-19 pandemic. All the necessary references are hyperlinked within the article. 

Feature Image: bbc.com

Related Articles