উগান্ডার গ্রাম মাওয়াঙ্গার রাস্তায় হাঁটছেন জেমস লুগুললি নামের এক বৃদ্ধ; তার বর্তমান বয়স ৮১ বছর। তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন একটি স্থানীয় বৈশিষ্ট্যে তৈরি ঘরের দিকে। ঘরের চারপাশ ঘিরে আছে বেশ কিছু কফি গাছ। ভেতরে প্রবেশ করে তিনি একটি ঝুড়ি নিয়ে আসলেন। ঝুড়িতে অনেকগুলো শিঙা আকৃতির ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র জড়ো করেছেন তিনি। এই বাদ্যযন্ত্রগুলোকেই বলা হয় ‘বিগওয়ালা’। প্রায় বিলুপ্ত এই বাদ্যযন্ত্রটিকে বর্তমানে পুনর্জীবিত করার লড়াই চলছে উগান্ডায়; জেমস লুগুললি সেই লড়াইয়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।
জেমস লুগুললির বাড়িতে মোটরসাইকেল হাঁকিয়ে আরও কয়েকজন বিগওয়ালা প্রেমিক হাজির হয়েছেন। তারা শিঙা আকৃতির বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি বেশ কিছু ড্রামও নিয়ে এসেছেন। তারপর সবাই বিগাওয়ালা বাজানোর প্রস্তুতি নিলেন। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এবং বয়সের পার্থক্য ভুলে সবাই অধীর আগ্রহে বিগাওয়ালার সুর শুনতে লাগলেন। এভাবেই সবার মাঝে বিগওয়ালা ফিরে আসতে শুরু করেছে।
উগান্ডার রাজধানী কাম্পালায় অবস্থিত কিম্বোগো বিশ্ববিদ্যালয়ের পারফর্মিং আর্টস বিভাগের অধ্যাপক জেমস ইসাবিরিয় ২০১২ সাল থেকে এই বিগওয়ালা সংরক্ষণের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন
বর্তমানে প্রতিদিন এখানে বিগওয়ালার আসর বসে, যা মানুষ প্রায় ভুলে যেতে বসেছিল।
বিগওয়ালা হারিয়ে যাওয়ার পেছনে প্রধান কারণ হলো এটি রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ করে দেয়া। কয়েক দশক যাবত উগান্ডায় এই ঐতিহাসিক বাদ্যটি নিষিদ্ধ ছিল। জেমস ইসাবিরিয় যখন ছোট ছিলেন, তখন তিনি এই বাদ্য বাজাতে দেখেছেন। বর্তমান উগান্ডার অন্তর্গত বুসোগা সাম্রাজ্যের রাজকীয় বাদ্য হিসেবে এই বাদ্য যন্ত্রটি ব্যবহৃত হতো। ঐতিহাসিকভাবে উগান্ডায় মোট ৫টি ক্ষমতাধর রাজবংশ ছিল। এর মধ্যে বুসোগাওরা অন্যতম। জেমস ইসাবিরিয় বলেন
প্রত্যেক সাম্রাজ্যের আলাদা আলাদা ও নিজস্ব বাদ্য যন্ত্রের ঐতিহ্য ছিল। আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন আমাদের এক প্রতিবেশী মারা গেলে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় শিঙার ন্যায় লম্বাটে আকৃতির এই বাদ্য যন্ত্রটি বাজানো হতো, উক্ত শিঙাই হলো বিগওয়ালা।
যেকোনো রাজকীয় অনুষ্ঠানে এই বাদ্যযন্ত্র বাজানো হতো। এছাড়া রাজ্যের অভ্যন্তরে অনুষ্ঠিত যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটলে এই বাদ্যের আসর বসতো। বাদ্যের তালে তালে সহশিল্পী ও দর্শকরা নৃত্য করতেন। যখন রাজ্যের কোনো অঞ্চলে বিগওয়ালা বেজে উঠতো, তখন রাজ্যের সকল প্রজাদের মাঝে উচ্ছ্বাস দেখা দিতো। কিন্তু উগান্ডার রাজ্যপ্রথা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে এই ঐতিহ্যও ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়।
১৯৬৬ সালে উগান্ডার প্রধানমন্ত্রী মিল্টন অবোটি সাংবিধানিকভাবে এই বাদ্য বাজানো নিষিদ্ধ করেন। তার ভাষ্য অনুসারে, উগান্ডাকে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যেই তিনি এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। এর পাশাপাশি উগান্ডার রাজপ্রথাও তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। জেমস ইসাবিরিয় বলেন
এই ঘোষণার পর থেকেই বাদকরা উন্মুক্তভাবে বিগওয়ালা বাজানো বন্ধ করে দেয়। যারা বিগওয়ালা বাজাতো তারা আত্মগোপনে চলে যায়। যারা গোপনে বিগওয়ালা বাজানোর চেষ্টা করতো তাদের গ্রেফতার করা হয়। এরপর ধীরে ধীরে এই বাদ্যটি হারিয়ে যায়।
কিন্তু ১৯৯০ সালে উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ইয়ওয়ারি মুসভেনি পুনরায় প্রতীকী রাজপ্রথা ফিরিয়ে আনলে বিগওয়ালার উপর থেকেও নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। তবে ততদিনে বিগওয়ালা মানুষের মধ্য থকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। এমতাবস্থায় ২০০৫ সালে জেমস ইসাবিরিয়র উদ্যোগে উগান্ডায় একটি জাতীয় সাংস্কৃতিক উৎসবের আয়োজন করা হয়। সেই উৎসবেই ইসাবিরিয় দেশের সকল বয়স্ক মানুষদের ডেকে তাদের কাছে বিগওয়ালার গুরুত্ব তুলে ধরেন এবং যারা এই বাদ্য বাজাতে পারেন কিংবা বাজাতে শুনেছেন, তাদেরকে এটি উদ্ধারে এগিয়ে আসার আহবান জানান।
এরপর অনেক খোঁজাখুঁজির পর ২০১২ সাল পর্যন্ত মাত্র ২ জন জীবিত বিগওয়ালা বাদকের সন্ধান পাওয়া যায়। জেমস ইসাবিরিয় তাদেরকে নিয়েই বিগওয়ালা পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে নামেন। জেমস ইসাবিরিয় বলেন
এই সংগীত বাসোগা জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। যদি এই ঐতিহ্যটি হারিয়ে যায় তবে বাসোগা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের আত্মপরিচয়ও হারিয়ে যাবে। অথচ জনগণের একটি বড় অংশই জানে না যে, বিগওয়ালা কী ছিল।
এই প্রেরণাকে ধারণ করে জেমস ইসাবিরিয় বিগওয়ালা সংরক্ষণের জন্য ইউনেস্কোকে এগিয়ে আসার আহবান জানান। তিনি ইউনেস্কোর কাছে আর্থিক সহায়তা চেয়ে আবেদন করেন। ইউনেস্কো তার আবেদনে সাড়া দেয় এবং আর্থিক সাহায্য পেয়ে জেমস ইসাবিরিয় পুরোদমে বিগওয়ালা গবেষণায় লেগে যান। কিন্তু প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়, বিগওয়ালা তৈরির কাঁচামালের সঙ্কট। বলে নেওয়া দরকার যে, পরিপক্ক লাউয়ের খোসা থেকে এই বাদ্য যন্ত্রটি প্রস্তুত করা হয়। এই লাউয়ের গঠন আমাদের দেশের লাউ থেকে কিছুটা ভিন্নতর, তবে অনেকটা মিল রয়েছে। এর গলার দিকটা অনেক লম্বাটে হয়। নিচের ছবি দ্রষ্টব্য। জেমস ইসাবিরিয় বলেন-
লাউ গাছের বীজ উগান্ডা থেকে প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল। অনেক প্রচেষ্টার মাধ্যমে কয়েকটি বীজ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়।
সম্ভবত বিগওয়ালা নিষিদ্ধ করার পরে, মানুষ ভয়ে লাউ গাছ রোপণ করাও বন্ধ করে দিয়েছিল। লাউ যখন পূর্ণ বয়স্ক হয় তখন তার খোসা শক্ত হয়ে যায়। সেই খোসা একটির উপর আরকটি সংযুক্ত করে বিগওয়ালা তৈরি করা হয়। উগান্ডার আঞ্চলিক ভাষায়, লাউকেই বিগওয়ালা বলা হয়। একটি বিগওয়ালা বাদ্য তৈরি করতে ৫টি লাউয়ের শিঙা প্রয়োজন হয়। যখন বিগওয়ালা বাজানো হয়, তখন বাদক এবং দর্শক উভয়েই নৃত্য করতে থাকে। জেমস ইসাবিরিয় বলেন-
এই শিঙার আওয়াজ যেকোনো শ্রোতার জন্য আনন্দদায়ক। যেকোনো বাদ্য যন্ত্রের তুলনায় এর সরল গঠন চমকপ্রদ। গ্রাম থেকে কয়েকটি পরিপক্ক লাউ সংগ্রহ করেই এই বাদ্য নির্মাণ করা যেতো।
এক সময় উগান্ডার জনগণ বাদ্যযন্ত্র তৈরি ছাড়াও পানি পান করতে, বিয়ার বহন করতে কিংবা খাদ্যশস্য সংরক্ষণ করতে লাউয়ের খোসা ব্যবহার করতো। সর্বোপরি, সবার কাছে এটি রাজকীয় নিদর্শন হিসেবে শোভা পেত।
পাশাপাশি বিগওয়ালা একটি গণতান্ত্রিক বাদ্য হিসেবে স্বীকৃত ছিল। এই বাদ্য বাজানোর সময় রাজা-প্রজা নির্বিশেষে সবাই নৃত্যে অংশগ্রহণ করতে পারতেন। নৃত্যের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ম মানার প্রয়োজন হতো না। যে যার মতো করে নিজ নিজ ছন্দে নৃত্যে অংশগ্রহণ করতে পারতেন। যখন রাজা এই নৃত্যে অংশগ্রহণ করতো, তখন প্রজাদের মধ্যে একটি অনুপম অনুভূতি সৃষ্টি হতো। তখন সবাই তাদের নিজেদের আত্মপরিচয় (বুসোগা জাতি হিসেবে) খুঁজে পেতো।
বিগওয়ালা তৈরির জন্য প্রথমে গ্রাম থেকে পরিপক্ক লাউ সংগ্রহ করতে হয়। তারপর সেই লাউ প্রায় এক মাস যাবত রোদে শুকাতে হয়। এতে লাউয়ের খোসা থেকে অতিরিক্ত দ্রব্যগুলো আলাদা হয়ে যায়। ফলে লাউয়ের খোসাগুলো বিগওয়ালা তৈরির জন্য উপযুক্ত কাঁচামাল হিসেবে প্রস্তুত হয়। তবে এটি রোদ দেয়ার সময় নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হয়, কেননা অতিরিক্ত রোদে লাউয়ের খোসাগুলোতে ফাটল ধরে যেতে পারে। ফেটে গেলে তা আর কাজে লাগানো যায় না।
কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, বর্তমানে উগান্ডায় কারো কাছে লাউয়ের বীজ সংরক্ষিত নেই! বিগওয়ালা পুনর্জীবিত করার লড়াইয়ের অন্যতম কর্মী ও স্থানীয় নারীনেত্রী আইরিন নাবিরি; যিনি একজন গোত্র প্রধানও বটে। তিনি তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন-
লাউয়ের বীজ অনুসন্ধানের জন্য আমি গ্রামের পর গ্রাম চষে বেড়িয়েছি। একবার আমি আমার মোটরবাইকে প্রায় পাঁচ ঘন্টা দূরে যাওয়ার পর এক বয়স্কা নারীর সাক্ষাৎ পাই। তার নাম মাওয়ানগা।আমি তার মতো আরও কয়েকজন বয়স্কা ও নেতৃত্বের গুণাবলী সমৃদ্ধ নারীকে খুঁজে বের করি। তারপর তাদের সকলকে বিগওয়ালার গুরুত্ব বুঝিয়ে বলি এবং এটা সংরক্ষণের জন্য লাউয়ের বীজের প্রয়োজনীয়তা তাদের সামনে তুলে ধরি। তারাই আমাকে এক বৃদ্ধা মহিলার সন্ধান দেন। তার কাছে আমরা একটি পরিপক্ক লাউ পাই। সেই লাউয়ে ৩৬টি বীজ ছিল। সেই বীজ থেকেই আমরা বিগওয়ালা পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা শুরু করি।
পাঁচটি লাউয়ের খোসা একত্রে সংযুক্ত করার জন্য আঠার ব্যবহার করা হয়। আঠা শুকিয়ে গেলে সংযুক্তির স্থান রবার দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। ইউনেস্কোর সহায়তায় ২০১৫ সাল পর্যন্ত এই বাদ্য পুনরুজ্জীবিত করার লড়াইয়ে শতাধিক যুবক যোগ দিয়েছে। বিগওয়ালা বাজানো উগান্ডায় নতুন করে রেওয়াজে পরিণত হচ্ছে। এছাড়া দেশটির সরকারি পাঠ্যপুস্তকেও বিগওয়ালার গুরুত্ব তুলে ধরা হচ্ছে। বিগওয়ালাকে কেন্দ্র করে দেশটিতে প্রায় ৮টি বাদকদল গড়ে উঠেছে। এভাবেই সকল বাধা পেরিয়ে বিগওয়ালা ফের জনগণের মাঝে ফিরে আসছে।