“……মনে পড়ে গেল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নকশা করেছিলেন যে দু’জন তাদের একজনের কথা আমরা একেবারেই ভুলে গিয়েছি। প্রথমত আমরা একেবারেই জানিনা এই মিনারের নকশা কারা করেছিলেন, যদিও বা কেউ জানি তো জানি শুধু শিল্পী হামিদুর রহমানের নাম, খুব কম লোকে চট করে মনে করতে পারে যে হামিদের সঙ্গে আরো একজন ছিলেন। হামিদের সঙ্গে ছিলেন বলাটা ভুল, বলা উচিত দু’জনে একসঙ্গে এই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের রূপটি রচনা করেছিলেন। আর সেই ব্যক্তিটি হচ্ছেন নভেরা আহমেদ”।
উপরের কথাগুলো প্রখ্যাত কবি সৈয়দ শামসুল হক এর এবং তিনি যে ব্যক্তি এবং যে বিষয় সম্পর্কে বলছিলেন সে দু’টিই ভীষণ বিতর্কিত। ১৯৫৬ সালে নভেরা আহমেদ ও হামিদুর রহমান দু’জন মিলে শহীদ মিনারের যে নকশা করেছিলেন তাতে শহীদ মিনারের মূলরূপের পাশাপাশি অন্তর্ভুক্ত ছিল ৬টি ভাস্কর্যও। ভাস্কর্যগুলো ছিল নভেরার দায়িত্বে, যা ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন জারির পর আর করা হয়নি। তাই নভেরাকে ঠিক কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের রূপকার বলা যায় কিনা এটি আজো প্রশ্নবিদ্ধ।
নভেরা আহমেদ, বাংলাদেশের তথা পূর্ব পাকিস্তানের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রথম আধুনিক ভাস্কর। রুদ্রাক্ষের মালা গলায়, উঁচু করে বাঁধা খোপা, কপালে তিলক…নজরকাড়া ব্যক্তিত্ব যা কারুরই চোখ এড়াতো না, নভেরা আহমেদ পঞ্চাশ-ষাটের দশকে রক্ষণশীল সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হেঁটে বেড়াতেন চট্টগ্রাম আর ঢাকার পুরানো রাজপথে। তিনি সবসময়ই ছিলেন সময়ের চেয়ে বেশি এগিয়ে চলা, তাই ঠিক সেসময়ে তিনি ততটা স্বীকৃতি বা গ্রহণযোগ্যতা পাননি, যা তার অবশ্যপ্রাপ্য ছিল। নভেরার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখা মিলবে একাধিক মতের, হেঁয়ালির এবং এসবই তার নিজেকে লুকিয়ে ফেলার ফল।
তিনি জন্মগ্রহণ করেন সুন্দরবন অঞ্চলে, ১৯৩০ অথবা ১৯৩৯ সালের ২৯শে মার্চ। জন্মসালের তথ্যে ৯ বছরের গড়মিল, এ যেন একটু বেশিই! নভেরা তার সম্পর্কে যেকোন আগ্রহকেই অনধিকার চর্চা ভাবতেন, সেটা তারব্যক্তিজীবনই হোক আর শিল্পীজীবনই হোক। বাংলাদেশের ইতিহাসে নভেরা তাই আজো এক রহস্যময় ব্যক্তিত্ব, কিছুটা ধোঁয়াশার আড়ালে থাকা কিংবা বলা যায় একসময় ধোঁয়াশার আড়ালে চলে যাওয়া! ১৯৭৩ সালে পর থেকে নভেরা পুরোটাই অন্তরালে চলে যান এবং বারবার তার মৃত্যুর গুজব শোনা যায় এবং রবীন্দ্রোপন্যাস ‘জীবিত ও মৃত’ এর কাদম্বিনীর মতই ২০১৫ সালে প্যারিসের ‘ওথ ইল’ শহরে মৃত্যুবরণ করে নভেরাও “…মরিয়া প্রমাণ করিল যে সে মরে নাই” ।
তার পিতা সৈয়দ আহমেদের চাকরির সুবাদে নভেরার শৈশব-কৈশোর কাটে কলকাতার বউবাজারে, লরেটা স্কুল থেকে তিনি মেট্রিক পাশ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তারা কুমিল্লায় চলে আসেন এবং নভেরা কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়াশোনা করেন। পিতার চাকরীতে অবসরগ্রহণের পর তারা ফিরে আসেন পৈতৃক নিবাস, চট্টগ্রামের আসকারদীঘির পাড়ে। ছোটবেলায় নভেরাকে সবাই ডাকতো ‘রাণী’ বলে, আর তার ‘নভেরা’ নামটি রেখেছিলেন তার চাচা… ফারসি শব্দ ‘নভেরা’র অর্থ ‘নবাগত’ বা ‘নতুন জন্ম’। নভেরা সত্যিই নতুন জন্ম হয়ে এসেছিলেন এ দেশের ভাস্কর্যশিল্পে, বাংলাদেশের প্রথম মহিলা ভাস্কর। শিল্পী হিসেবে নভেরা আহমেদের আত্মপ্রকাশের পর দেখা যায় যে, সমকালীন পুরুষশিল্পীদের মধ্যে তিনিই একমাত্র নারী শিল্পী; আর সবাই যেখানে চিত্রকর, সেখানে তিনিই কেবল ভাস্কর। নভেরা যে ছবি আঁকেননি, তা নয়…তবে ভাস্কর হিসেবেই নভেরা পরিচিত বেশি। তার চিত্রকর সত্ত্বার চাইতে ভাস্করসত্ত্বাই ছিল অধিক স্বতস্ফূর্ত। প্রখ্যাত ফরাসি ভাস্কর অগাস্টিন রোঁদ্যার বেশ অনুরাগী ছিলেন নভেরা, ১৯৫০ সালে রোঁদ্যার মিউজিয়াম দেখতে যান তিনি।
নভেরাদের কলকাতার বাড়িতে সঙ্গীতচর্চা চালু ছিলো, তার বড় দুই বোনকে রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের গান শেখাতেন সেসময়ের স্বনামধন্য দুই তরুণ শিল্পী। তবে নভেরার আগ্রহ ছিল মূলত নৃত্যে, তার নৃত্যের হাতেখড়ি হয়েছিলো ভারতের বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী সাধনা বসুর কাছে। মায়ের গড়া পুতুল ও পুতুলের ঘর দেখেই হয়তো শখ জেগেছিল নিজে গড়ার, আগ্রহ জন্মেছিলো ত্রিমাত্রিক গড়নের প্রতি…কে জানে! নাচ আর গানের সাথে ছোটবেলায় মাটি দিয়ে মূর্তিও গড়তেন নভেরা, তাই যখন ১৯৫০ সালে তাকে লন্ডনে পাঠানো হয় আইনশিক্ষার জন্য, তখন তিনি তার ভাস্কর্যশিল্পের প্রতি প্রেম থেকে যাওয়া শুরু করেন ‘সিটি এন্ড গিল্ডস্টোন কার্ভিং ক্লাস’ এ। এরপর ১৯৫১ সালে নভেরা ভর্তি হন লন্ডনের ‘ক্যাম্বারওয়েল স্কুল অফ আর্টস এন্ড ক্রাফটস’ এর ‘ন্যাশনাল ডিপ্লোমা ইন ডিজাইন’ এর ‘মডেলিং ও স্কাল্পচার’ কোর্সে। চেক ভাস্কর ড. কারেল ফোগেলের আওতায় সেখানে ১৯৫১ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত চার বছর মেয়াদী ন্যাশনাল ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেছেন নভেরা। এছাড়া ১৯৫৪ সালের জানুয়ারী মাসে নভেরা ভাস্কর্যের নগরী ও ইউরোপীয় রেঁনেসার সূতিকাগার ফ্লোরেন্সে যান ও সেখানে পাঁচমাস অবস্থান করেন, এবং এর মধ্যে দুই অথবা আড়াই মাস তিনি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন ভাস্কর ভেন্তুরিনো ভেন্তুরির কাছে। নভেরার মন ছিল প্রচন্ড ভ্রমণপিয়াসু আর শেখার আকাঙ্ক্ষায় পূর্ণ। বিশ্ববিশ্রুত ভাস্কর জ্যাকব এপস্টাইনের স্টুডিওতেও কিছুদিন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন নভেরা।
স্থায়ীভাবে চট্টগ্রামে বসবাসের সময় এক পুলিশ অফিসারের সঙ্গে বিয়ে হয় নভেরার কিন্তু খুব অল্পদিনের মধ্যেই তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় এবং ১৯৮৪ সালের আগপর্যন্ত আর বিয়ে করেন নি তিনি। ১৯৮৪ সালে প্যারিসে অবস্থানকালে গ্রেগরি দ্য ব্রুহনসকে বিয়ে করেন এবং তার পরবর্তী জীবনেও এই সম্পর্ক স্থায়ী হয়। ভাস্কর তার আবেগ ও নিস্পৃহতার মোহনায় যে কাজ করে যান, স্বামী তার কাজগুলো যত্নে সংরক্ষণ করে রাখেন তাদের স্টুডিওতে। স্টুডিওটি অবস্থিত প্যারিস থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে ‘ভিত’ শহরে। ১৯৭৪ সালে নভেরা এক সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন এবং এরপর থেকে তার জীবনদর্শনে আসে পরিবর্তন, ধারণা করা হয় এ দুর্ঘটনার পর থেকেই তিনি আর কখনো দেশে ফিরে আসতে চাননি; থেকে যেতে চেয়েছেন প্যারিসেই। সড়ক দুর্ঘটনার পর থেকেই একজন ভালো বন্ধু হিসেবে নভেরার সার্বিক দেখাশোনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন গ্রেগরি দ্য ব্রুহন ও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি নভেরার শিল্পচর্চার একজন প্রকৃত গুণগ্রাহী হয়ে তার সঙ্গ দিয়েছেন।
নভেরার ভাস্কর্য তৈরীর মূল প্রবণতা ছিলো ‘ফিগারেটিভ এক্সপ্রেশন’ এবং প্রধান বিষয়বস্তু ছিলো নারীর প্রতিমূর্তি। তথাকথিত ভাস্কর্যশিল্পে আমরা ইন্দ্রিয় সুখাবহ নারীর যে রোমান্টিসিজম দেখি, নভেরার তৈরীকৃত ভাস্কর্যগুলো এই বৈশিষ্ট্য থেকে মুক্ত এবং অনেক বেশি মেদহীন, ঋজু। তার চরিত্রের স্পষ্টতা বারংবার প্রকাশ পেয়েছে তার নির্মাণে। ভাস্কর্য তৈরীর ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ভাস্কর হেনরী মূরের অনুবর্তী, যদিও কিছু বৈসাদৃশ্য আছে দু’জনের শিল্পে। হেনরী মূর যেখানে প্রয়োগ করতেন বৃত্তাকৃতির বা উপবৃত্তাকৃতির ব্যবহার, নভেরা সে স্খানে বেছে নিয়েছেন উল্লবাকৃতি বা ঋজুতা। বারবারা হেপওয়ার্থের শিল্পের প্রভাবও লক্ষ্য করা যায় নভেরার ভাস্কর্যগুলোতে।
তার ভাস্কর্যে মূর্ততার চাইতে নভেরা অধিক জোর দিতেন বিমূর্ত অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতে। নভেরার ভাস্কর্যের মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে ‘চাইল্ড ফিলোসফার’, ‘মা ও শিশু’, ‘এক্সটার্মিনেটিং এঞ্জেল’, ‘পরিবার’ (১৯৫৮), ‘যুগল’ (১৯৬৯), ‘ইকারুস’ (১৯৬৯), ‘জেব্রা ক্রসিং’ (১৯৬৮) ইত্যাদি।
১৯৭৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্যারিসে তার স্বেচ্ছানির্বাসনের জীবন পরিধিতে তিনি বেশ কিছু ছবি এঁকেছিলেন এবং তার মৃত্যুর পর ৪৩টি চিত্রকর্মের খোঁজ মেলে।
নভেরার কাজের সবচেয়ে বড় সংগ্রহ বিদ্যমান ঢাকার শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরে, এছাড়াও প্যারিসে গ্রেগরি দ্য ব্রুহনের স্টুডিওতে ৯টি ভাস্কর্য ও ৪৩টি চিত্রকর্ম রয়েছে।
১৯৫৮ সালে স্থপতি হামিদুর রহমান ও নভেরা আহমেদের শিল্পকর্মের যৌথ একটি প্রদর্শনী হয় ঢাকার কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারে। এরপর তিনবার নভেরা আহমেদের একক শিল্পকর্মের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় ,
প্রথম প্রদর্শনীটি ১৯৬০ সালের ৭ই আগস্ট রোববার বিকেলে ঢাকা কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারে, ‘অন্তর্দৃষ্টি’ বা ‘Inner Gaze’ এই শিরোনামে আয়োজিত হয়। এর উদ্যোক্তা ছিল পাকিস্তান জাতিসংঘ সমিতি এবং সহযোগিতায় এশিয়া ফাউন্ডেশন। সর্বসাকুল্যে প্রায় ৭৫টি ভাস্কর্য প্রদর্শিত হয় এখানে।
দ্বিতীয় প্রদর্শনীটি ১৯৭০ সালের ১৪-২৪শে অক্টোবর ব্যাংককে অনুষ্ঠিত হয়। এতে সবগুলো ভাস্কর্যই ছিল ধাতুর তৈরী এবং ধাতব উপাদান হিসেবে ব্রোঞ্জ, শিট মেটাল, ঝালাইকৃত ও স্টেইনলেস স্টিল ব্যবহার করা হয়েছিলো।
নভেরার তৃতীয় একক প্রদর্শনীটি হয় ১৯৭৩ সালের ৫ই জুলাই প্যারিসে। এতে প্রদর্শিত ১২টি ভাস্কর্যের সবগুলোই ছিলো ব্রোঞ্জনির্মিত। এই প্রদর্শনীতে ভাস্কর্যের সাথে প্রদর্শিত হয় নভেরার আঁকা ১২টি ছবিও, যার একটি ছিল-‘বাংলাদেশ’ (১৯৭১) ।
দীর্ঘ অন্তরালের পর ২০১৪ সালের ১৭ই জানুয়ারী থেকে কয়েকদিনব্যাপী নভেরার একটি রেট্রোস্পেকটিভ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
নভেরাকে নিয়ে কৌতুহলের ফসল হিসেবে আমরা পেয়েছি কথা সাহিত্যিক হাসনাত আবুল হাই রচিত জীবনী উপন্যাস ‘নভেরা’ (প্রকাশকাল-১৯৯৫), এন রাশেদ চৌধুরীর প্রামাণ্যচিত্র ‘শিল্পী নভেরা আহমেদের সৃজন ভুবন ন হন্যতে’ (১৯৯৯) ও চয়ন খায়রুল ইসলামের কবিতা ‘নভেরায় হংসনিল’। নভেরা আহমেদের নামে জাতীয় জাদুঘরের একটি হল নির্মিত হয়েছে- ‘ভাস্কর নভেরা আহমেদ হল’। ১৯৬১ সাল এ তাঁর ‘চাইল্ড ফিলোসফার’ ভাস্কর্যটির জন্য তিনি জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি পান। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘একুশে পদক’ পুরষ্কারে ভূষিত করে কিন্তু তিনি এই পুরষ্কার গ্রহণের জন্যও দেশে আসেননি। শেষ বয়সে তিনি বাংলা বলাও ছেড়ে দিয়েছিলেন এবং প্রবাসী বাঙ্গালিদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতেন। দেশ ও দেশের মানুষ, এমনকি ভাষার প্রতি তার এই অনীহার ঠিক কারণ কেউ জানেনা…শুধু নিজের মতো করে অনুমান করে নেয়।
১৯৭৪ সালের সড়ক দুর্ঘটনার পর থেকেই হুইল চেয়ার ছাড়া চলাফেরা করতে পারতেন না নভেরা, ২০১৪ সাল থেকে শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন তিনি এবং ২০১৫ সালের এপ্রিলে তার শারীরিক অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়। মৃত্যুর দুইদিন আগে তিনি কোমায় চলে যান ও ২০১৫ সালের ৫ই মে প্যারিসের সময়ানুযায়ী দিবাগত রাতে নভেরার মৃত্যু ঘটে। নভেরার মৃত্যু তাকে ঘিরে সৃষ্ট ধোঁয়াশার জালকে চিরস্থায়ী করে দিয়ে যায় এবং তিনি এক রহস্য মানবী হয়েই রয়ে যান।