গোলাপি গেঞ্জি পরা বিশাল ছাতিওয়ালা ছেলেটি ফুঁ দিলে মানুষ তো নস্যি, রেলইঞ্জিনও উড়ে যেতে পারে। যার বুকে গুলি লেগেও ছিটকে যায়, যে বোমা নিয়ে লোফালুফি করে। আবার মনের দিক দিয়ে খুবই নরম, মানুষের বিপদ দেখলে ছুটে আসে। কিন্তু রেগে গেলে ল্যাম্পপোস্ট উপড়ে ফেলা যার বাঁহাতের খেল! তাকে শায়েস্তা করতে মানুষ কেন, ভূতেরাও অপারগ। ভূতের লম্বা জিব দিয়ে ভূতকেই পেঁচিয়ে দিতে পারে অদ্ভুত ছেলেটি। এমনই নানা অবিশ্বাস্য কাণ্ডের দাপটে কমিকসের রাজ্য প্রায় পাঁচ দশক মাতিয়ে রেখেছে যে চরিত্র, তার নাম ‘বাঁটুল দি গ্রেট’।
ইংরেজী কমিক্সে তো কত সুপার হিরোর নাম শুনি। সুপারম্যান, ব্যাটম্যান, ক্যাপ্টেন আমেরিকা, হাল্ক, ফ্যানটাস্টিক ফোর আরো কত শত নাম। তাদের মাঝেই উজ্জ্বল হয়ে আছে বাংলা কমিক্সের প্রথম সুপার হিরো ‘বাঁটুল দি গ্রেট’। এই কমিক্স পড়েনি এমন বাঙালি পাঠক খুঁজে পাওয়া সত্যিই দুস্কর। বাঁটুলের কমিক্স বই হাতে পেলে এখনো ছোট বুড়ো সকলেই সবকিছু ফেলে রেখে গোগ্রাসে গিলতে থাকে।
বাংলার কমিক্স স্রষ্টা নারায়ণ দেবনাথের এক অসাধারণ সৃষ্টি ‘বাঁটুল দি গ্রেট’। এটি ছিল প্রথম রঙিন কমিক স্ট্রিপ। ১৯৬৫ সালের মে মাসে (বাংলা ১৩৭২, জ্যৈষ্ঠ) প্রকাশিত হয় ‘বাঁটুল দি গ্রেট’ কমিক্সের প্রথম কিস্তি। এরপর ধারাবাহিকভাবে এই কমিক্স প্রকাশিত হতে থাকে। বাঁটুলের কমিক্স প্রকাশের পর প্রথম চারটি সংখ্যা বাঙালি পাঠকদের মনে খুব একটা রেখাপাত করেনি।
কিন্তু কার্তিক ১৩৭২ সংখ্যায় প্রকাশিত হলো ১৯৬৫তে ভারত বনাম পাকিস্তানের যুদ্ধের ময়দানে বাঁটুলের বীরত্ব কাহিনী। তিনটি সংখ্যা জুড়ে প্রকাশিত হলো সেই গল্প! শত্রু সেনার কামানের গোলা ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে বাঁটুল প্যাটন ট্যাঙ্ক হাতে তুলে তাড়া করছে, আর ভারতীয় বাহিনীর জন্য পাক সেনাদের বেঁধে উপহার নিয়ে আসছে। দেশপ্রেমে উদ্বেল বাঙালি পাঠক বাঁটুলের মধ্যে প্রথম নিজস্ব সুপার হিরো খুঁজে পেল। প্রবল জনপ্রিয় হয়ে গেল বাঁটুলের কমিকস। শুকতারায় প্রথমবার বাঁটুলের কমিকস প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে দেব সাহিত্য কুটির থেকে তা খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশিত হতে থাকে।
সেসময় অনেকের মনেই প্রশ্ন ছিল- লেখক কার আদলে তৈরি করেছেন ‘বাঁটুল দ্য গ্রেট’ কমিক্সের প্রধান চরিত্র বাঁটুলকে। অনেকেই ধারণা করতে থাকেন, পশ্চিম বাংলার বিখ্যাত ব্যায়ামগীর মনোহর আইচের আদলে তৈরি করা হয়েছে বাঁটুলকে। হয়তো লেখকের চরিত্র অঙ্কনে কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়া গেলেও অকল্পনীয় শক্তি, বীরত্বে গাঁথা বাঁটুলের তুলনা একমাত্র সুপার হিরোদের সাথেই করা যায়। এখনো পর্যন্ত বাঙালির নিজস্ব সুপারহিরো কিন্তু বাঁটুলই। কেউই তার একনায়কত্বে ভাগ বসাতে আজও পারেনি।
কীভাবে তৈরি হলো এই কমিক্সের চরিত্র? কী বিষয় মাথায় রেখে লেখক নারায়ণ দেবনাথ বাঁটুলের এই চরিত্রটি অঙ্কন করেছেন? লেখক নারায়ণ দেবনাথ এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, একবার কলকাতার কলেজ স্ট্রিট থেকে ফেরার পথে তিনি বাঁটুলের চরিত্রটি কল্পনা করেন ও তৎক্ষণাৎ তার প্রতিকৃতি এঁকে ফেলেন। যদিও তিনি শুরুতে বাঁটুলকে কোনো অলৌকিক শক্তি (সুপার পাওয়ার) দেননি।
বিজ্ঞাপনে লাল-কালো দু’রঙা এই কমিক্সকে বলা হত ‘ছবিতে মজার গল্প’। প্রথম সংখ্যায় দেখা যায় বাঁটুল রজনীগন্ধার গন্ধ শুঁকতে গিয়ে ‘সুপার-পাওয়ার’ হাঁচি দিয়ে সেটা উড়িয়ে দিয়েছে এবং ফের রজনীগন্ধা কিনতে গিয়ে নানা ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছে। শেষ দৃশ্যে বাঁটুলের সঙ্গে দেখা যায় বুড়ি পিসিমাকে।
তৃতীয় গল্পে বাঁটুলের সঙ্গী হয় ‘পটলা’। সপ্তম গল্পে আবির্ভাব হলো ‘লম্বকর্ণ’র, সে কানে আশ্চর্য বেশি শুনতে পায়। বাঁটুলের কমিক্সের শেষ ছবির বক্সে শিল্পীর নামের আদ্যক্ষর পাওয়া গেল- ‘না’।
পরবর্তী সংখ্যাগুলাতে লেখক ধীরে ধীরে বাঁটুলকে একজন প্রচন্ড শক্তিশালী মানুষ হিসেবে তুলে ধরেন। গুলি দিয়ে বাঁটুলকে আঘাত করা যায় না, মাথায় বিরাট হাতুড়ি মারলে তার মনে হয় মাথায় এক ফোঁটা জল পড়ল, মাথায় নারকেল পড়লেও তার কিছু যায় আসে না। কিন্তু তার পোশাক-আশাক মোটেও প্রচলিত সুপারহিরোর মতো নয়। গোলাপী স্যান্ডো গেঞ্জি ,কালো হাফপ্যান্ট তার একমাত্র পোশাক। বাঁটুল সবসময় খালি পায়েই থাকে। কারণ জুতো পরলেই নাকি ছিঁড়ে যায়।
তার আছে দুই স্যাঙাত যাদের নাম বিচ্ছু ও বাচ্ছু, কখনও কখনও তাদের নাম গজা ও ভজা বলেও পরিচিতি পেয়েছে। তারা সবসময়েই ব্যস্ত থাকে কিভাবে বাঁটুলকে জব্দ করবে, কিন্তু শেষে নিজেরাই জব্দ হয়। বাঁটুলের প্রতিবেশী হলেন বটব্যাল বাবু ও তার চাকর। স্থানীয় পুলিশ আধিকারিকের সঙ্গেও বাটুলের বন্ধুত্ব। বাঁটুলের আরেক অনুগত সৈনিকের নাম লম্বকর্ণ। আর বাঁটুলের পোষা কুকুরের নাম ভেদো, পোষা উটপাখির নাম উটো।
মাঝে মাঝেই সমসাময়িক বাস্তব ঘটনায় বাঁটুলকে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। তাকে দেখা গেছে অলিম্পিকে সোনার মেডেল জিততে। সে বেড়াতে ভালবাসে। একবার মিশর বেড়াতে গিয়ে বাঁটুল একটি যান্ত্রিক স্ফিংসকে জব্দ করেছিল।
সে সৎ ও দেশপ্রেমী। ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঁটুলকে নামানো হল ওয়ার ফ্রন্টে। সে দেশের হয়ে যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে। বাঁটুলের প্রচণ্ড শক্তি মাঝে মাঝেই তার প্রতিবেশীদের সমস্যার কারণ হয়। নারায়ণ দেবনাথ তার তুলির ছোঁয়ায় এই কমিক্সকে অসামান্য করে তুলেছেন। সমসাময়িক বিষয় থেকে শুরু করে নানা মজাদার বিষয় ছিল এই কমিক্সের প্রাণ। মজার ছলে লেখক অতি সিরিয়াস কথাকে সহজেই পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করতেন যা এক কথায় অনন্য।
বাঁটুলের বয়স তখন কত? নারায়ণ দেবনাথ জানালেন, ১৭-১৮ বছর। আর ছাতি চল্লিশ ইঞ্চি! ভাবলে সত্যিই অবাক লাগে, পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় প্রকাশিত হয়ে চলেছে ‘বাঁটুল দি গ্রেট’। ২০১৪ সালে হয়ে গেলো ‘বাটুল দ্য গ্রেট’ কমিক্সের সুবর্ণজয়ন্তী। সারা পৃথিবীর ইতিহাসে এ এক বিরলতম ঘটনা। এক অনন্য রেকর্ড। এতো দীর্ঘদিন ধরে কোনো কমিক্স বেঁচে থাকার নজির কমিক্সের দুনিয়াতেও খুব বেশি একটা নেই। এই কমিক্সের বিভিন্ন বয়সীদের মাঝে এতই কদর যে, ‘বাঁটুল দ্য গ্রেট’ কমিক্স নিয়ে তৈরি হয়েছে এনিমেটেড কার্টুন এবং তা দেখার জন্য ছেলে-বুড়ো এখনো টেলিভিশনের পর্দা থেকে মুখ সরিয়ে রাখতে পারে না।
সমসাময়িক বিখ্যাত বিদেশী কমিকস অ্যাসটেরিক্স আজ প্রায় পঞ্চান্ন বছর বছর অতিক্রম করলেও তাতে কাহিনী ও চিত্ররূপ দিয়েছেন দুজন পৃথক শিল্পী। আর শুধু তাই নয়, অ্যাসটেরিক্স কমিকস একটানা পঞ্চাশ বছরও চলেনি। সেদিক থেকে দেখতে গেলে ‘বাঁটুল দি গ্রেট’ কমিক্স সকলকে টেক্কা দিয়েছে ।
সৃজনশীল নারায়ণ দেবনাথের তুলিতে এবং কলমে আজও বাঁটুল সমানভাবে সাবলীল। প্রায় ৯২ বছর বয়সেও নারায়ণ দেবনাথ এখনো মেতে আছেন সৃষ্টির খেলায়। লেখক আজও নিরলসভাবে এঁকে চলেছেন এই কমিক চরিত্র। তার হাতে ফুটে উঠছে বাঁটুলের আজব সব কীর্তিকাহিনী।