বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীগুলোতে ‘ডিস্টোপিয়ান ফিউচার’ (Dystopian Future) জঁনরাটা বেশ জনপ্রিয়। এ ধরনের উপন্যাস বা চলচ্চিত্রে এমন একটি ক্ষয়িষ্ণু, অসাম্য এবং অমানবিক ভবিষ্যতের চিত্র আঁকা হয়, যেখানে চরমভাবে বিভাজিত দুই শ্রেণীর মানুষদেরকে নিয়ে নতুন এক ধরনের সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠে। সমাজের শাসক শ্রেণী এবং তাদের নাগরিকরা বাস করে চরম প্রাচুর্যের মধ্যে, সুরক্ষিত এলাকার মধ্যে। আর সেই সুরক্ষিত এলাকার ঠিক বাইরেই বাস করে চরম শোষিত, নির্যাতিত এবং অবহেলিত একদল জনপদ, যাদেরকে সমাজের উঁচু শ্রেণী মানুষ হিসেবেই গণ্য করে না।
#Gaza compared to #London, #UK.
Why does the world ignore the horrors, torture, suffering, and death in Gaza – the world’s largest concentration and death camp?#Israel and #Egypt are exempt from international laws regarding the rights of humans. @UN #USA #EU are complicit. pic.twitter.com/ubCCH8x6NW
— Dr. David Romei (@DavidRomeiPHD) May 18, 2018
এই ডিস্টোপিয়ান ফিউচারের কাহিনীগুলোতে ভান করা হয় বর্তমান পৃথিবী খুব সভ্য, শোষণহীন এবং সাম্যবাদী। কেবলমাত্র সুদূর ভবিষ্যতেই এরকম সমাজ ব্যবস্থা তৈরি হবে। অথচ বাস্তবে আমরা নিজেরাই বাস করছি এরকম চরম বিভাজিত একটি সমাজ ব্যবস্থায়, যেখানে মিথ্যা কিংবা ত্রুটিপূর্ণ অভিযোগের ভিত্তিতে বিশ্বের শাসক শ্রেণী এবং তাদের তাঁবেদারদের খামখেয়ালিপূর্ণ সিদ্ধান্তে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে একের পর এক দেশ। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে হাজার মাইল দূরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে খেলাচ্ছলে মিসাইল কিংবা ড্রোনের বোতাম চেপে হত্যা করা হচ্ছে ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান কিংবা ইয়েমেনের হাজার হাজার মানুষকে।
তবে ডিস্টোপিয়ান সমাজব্যবস্থার সবচেয়ে বাস্তব উদাহরণ হলো ফিলিস্তিন, বিশেষ করে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা, যেখানে সীমান্তের ওপারের সুজলা-সুফলা উর্বর ভূমিতে হাজার বছর ধরে বসবাস করে আসা স্থানীয় আরবদেরকে বহিষ্কার করে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে ছোট একটি ভূমিতে। গাজা উপত্যকা একদিকে সাগর, একদিকে মিসর আর বাকি দুই দিকে ইসরায়েলের কাঁটা তারের বেড়া দ্বারা বেষ্টিত, যে বেড়ার কাছাকাছি শুধুমাত্র শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান কর্মসূচী পালন করার অভিযোগেই পাখির মতো গুলি করে ফেলা হচ্ছে নারী-শিশুসহ শত শত মানুষকে।
2 different words ?
No 2 different planets !
Glamour +🥂VS death, blood & desolation
Meanwhile, death-toll of the US #EmbassyMove from #TelAviv to #Jerusalem has risen to 52 including 8 kids.
Not a ‘great day’ #Trump , it was the deadliest day in #Gaza since July ‘14 op#Nakba70 pic.twitter.com/axBdcQY8d4— Yalda_So♀ (@Yalda_so) May 14, 2018
গাজাকে বলা হয় বিশ্বের সর্ববৃহৎ উন্মুক্ত কারাগার। মাত্র ৩৬৫ বর্গকিলোমিটারের গাজাতে বসবাস করে অন্তত সাড়ে ১৮ লাখ মানুষ। এখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব কিলোমিটার প্রতি ৫,০০০ এর চেয়েও বেশি, যা গাজাকে পরিণত করেছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোর একটিতে। গাজার জনসংখ্যার একটি বড় অংশের মূল আবাসভূমি সীমান্তের ওপারে বর্তমান ইসরায়েলের অভ্যন্তরে। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েলের স্বাধীনতা ঘোষণার পরদিন ইহুদীরা স্থানীয় আরব গ্রামগুলো দখল করে তাদের বাড়িঘরে জ্বালিয়ে দিলে গৃহহারা হয় অন্তত সাড়ে সাত লাখ স্থানীয় আরব। তাদের অনেকেই আশ্রয় নেয় গাজায়, বাকিরা দেশ ত্যাগ করে আশ্রয় নেয় লেবানন, জর্ডানসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে।
গাজায় বসবাসরত এই ফিলিস্তিনিদের অনেকেরই ভিটেমাটি সীমান্তের ঠিক ওপারে তাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যেই। এদের অনেকের কাছেই এখনও তাদের জমিজমার দলিলপত্র আছে। কিন্তু তারপরেও তারা নিজভূমে পরবাসী। ইসরায়েলি সেনাদের দ্বারা অবরুদ্ধ এক শহরে তাদেরকে মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে। গাজা এলাকাটি নামে স্বাধীন হলেও কার্যত তারা পরাধীন। তাদের কেবল প্রশাসনটাই নিজস্ব, কিন্তু তাদের স্থলপথ, নৌপথ, আকাশপথ- সব অবরুদ্ধ। নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য অস্ত্র তো দূরের কথা, জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ও বস্ত্রসামগ্রী আমদানির জন্যও তাদেরকে নির্ভর করতে হয় ইসরায়েল এবং মিসরের দয়ার উপর।
#Israel, as an occupying power under int’l law, is obligated to protect the pop. of #Gaza & ensure their welfare. But they are in essence caged in a toxic slum from birth to death; deprived of dignity; dehumanised by the Israeli authorities – #Zeid pic.twitter.com/szDXHqu2y4
— UN Human Rights (@UNHumanRights) May 18, 2018
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিবাহিনী ইউরোপজুড়ে স্থাপিত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে বন্দী করে রেখেছিল লক্ষ লক্ষ ইহুদীকে, তাদের উপর চালিয়েছিল নির্বিচার গণহত্যা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে সাত দশক আগে, কিন্তু নাৎসিবাহিনীর সেই ভূমিকাই যেন গ্রহণ করেছে ইসরায়েল। গাজা বলতে গেলে একপ্রকার কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পই। যেখানে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী সিদ্ধান্ত নেয় কে বেঁচে থাকবে, কে মৃত্যুবরণ করবে। গাজার পানি এবং বিদ্যুৎ সংযোগ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে তারা। ইচ্ছে হলে সংযোগ দেয়, ইচ্ছে না হলে কেটে দেয়। তুচ্ছ অভিযোগে ইসরায়েলি বাহিনী যেকোনো মুহূর্তে গাজায় প্রবেশের অধিকার রাখে এবং ‘সন্ত্রাসবাদ’ এর অভিযোগে যেকোনো কাউকে হত্যা করতে বা তুলে নিয়ে যেতে পারে।
১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর থেকেই গাজা ছিল ইসরায়েলের দখলে। কিন্তু ২০০০ সালে শুরু হওয়া দ্বিতীয় ইন্তিফাদায় হামাসের তীব্র প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে শেষপর্যন্ত ২০০৫ সালে ইসরায়েল গাজার নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সাথে সাথে গাজা থেকে প্রস্থান করে ১২টি ইহুদী বসতির প্রায় ৮,৫০০ ইহুদী অভিবাসী। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে গাজা ত্যাগ করলেও জাতিসংঘের দৃষ্টিতে এখনও গাজাকে ইসরায়েল কর্তৃক দখলকৃত হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। কারণ ইসরায়েল এখনও একটি বাদে গাজার প্রতিটি প্রবেশ পথ থেকে শুরু জীবনযাত্রার প্রায় সবটুকুই নিয়ন্ত্রণ করে।
#Gaza. Death toll rose to 59. About 2,800 people wounded. While in Jerusalem Netanyahu and Ivanka Trump celebrated the new US embassy.
Sadly, a predictable disaster. pic.twitter.com/Of0HRWFfPV
— Valerio De Cesaris (@ValerioDeC) May 15, 2018
ইসরায়েল রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিতই হয়েছে ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে, ফিলিস্তিনিদেরকে জোরপূর্বক তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে। কিন্তু যেহেতু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক ইসরায়েল রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল, তাই আন্তর্জাতিকভাবে ইসরায়েলকে একটি বৈধ রাষ্ট্র হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। কিন্তু ইসরায়েল তার সীমারেখা লংঘন করে পরবর্তীতে পবিত্র জেরুজালেমসহ প্রায় সম্পূর্ণ ফিলিস্তিনি ভূমিই দখল করে নেয়। জাতিসংঘের দৃষ্টিতেই ইসরায়েলের এই দখল সম্পূর্ণ অবৈধ, কিন্তু তারপরেও ইসরায়েল দখলকৃত ভূমিগুলোকে একের পর এক নিজের ভূখন্ডের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নিচ্ছে, সেগুলোতে একের পর এক অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করে যাচ্ছে। আর এ কাজে তাকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
সেই ধারাবাহিকতায়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবার পবিত্র শহর জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তেল আবিব থেকে তাদের দূতাবাস স্থানান্তর করেছে এই জেরুজালেমে। আর বরাবরের মতোই এই কাজটি তারা করেছে জাতিসংঘের মতামতের কোনো তোয়াক্কা না করেই। গাজা সীমান্তে গত দেড় মাস ধরেই সাত দশক ধরে বাস্তুহারা ফিলিস্তিনিরা তাদের হারানো ভূমি ফিরে পাওয়ার দাবিতে শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচী পালন করে আসছিল। যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ স্বাভাবিকভাবেই তাদের বিক্ষোভকে আরো উস্কে দিয়েছে। গত ১৫ তারিখ মঙ্গলবার একদিনেই ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছে নারী-শিশুসহ অন্তত ৫৯ ফিলিস্তিনি, আহত হয়েছে দুই সহস্রাধিক।
‘Ashamed to Be Jewish’: As Trump Base Celebrates Embassy Move, Horrified U.S. Jews Mourn Gaza Deaths | @AllisonKSommer https://t.co/33qeDK68j5
— Haaretz.com (@haaretzcom) May 16, 2018
একটি সভ্য সমাজে কখন নিরস্ত্র প্রতিবাদকারীদের উপর গুলি চালানো যাবে, তার সুনির্দিষ্ট বিধি-নিষেধ আছে। কিন্তু যেখানে ফিলিস্তিনিদের হাতে পাথর ছাড়া আর কিছুই নেই, যেখানে একজন ইসরায়েলিও সামান্যতম আহতও হয়নি, সেখানে একের পর এক ড্রোন থেকে টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ, নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যা করা এবং এরপর সেটার পক্ষে জোর গলায় সাফাই গাওয়া কোনো সভ্যতার নির্দেশক হতে পারে না। কেউ স্বীকার করুক আর না করুক, যে সমাজে মাত্র ৯৭ কিলোমিটারের ব্যবধানে এক শহরে শাসক শ্রেণী অবৈধ পদক্ষপে নাচে-গানে উল্লাস করে, আর অন্য শহরে বেঁচে থাকার জন্য প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে মানুষ গণহত্যার শিকার হয়, সে সমাজ একটি ডিস্টোপিয়ান সমাজ।
ডিস্টোপিয়ান সায়েন্স ফিকশনগুলোতে কখনো আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হয় না। দীর্ঘ কয়েক দশক অত্যাচারিত হওয়ার পর অবশেষে কোনো এক নায়কের আবির্ভাব ঘটে, যার দূরদর্শী সিদ্ধান্তে বিপ্লবের মধ্য দিয়েই সমাজ অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর পতন ঘটে, সমাজ থেকে বৈষম্য এবং অত্যাচারের বিলুপ্তি ঘটে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন এবং সহযোগিতায় ইসরায়েল যেভাবে তাদের আগ্রাসী ভূমিকা দিন দিন বৃদ্ধি করে চলছে, এবং কিছু আরব রাষ্ট্রও যেভাবে তাদেরকে মৌন সমর্থন দিচ্ছে, তাতে নিপীড়িত ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর মুক্তিও হয়তো আলোচনার মাধ্যমে ঘটবে না। তাদেরকে হয়তো অপেক্ষা করতে হবে সালাহউদ্দীন আইয়্যুবির মতো নতুন কোনো বীরের আগমনের জন্য।
Featured Image Source: Twitter