সম্প্রতি শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে বেশ বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের জনজীবনে এবং সংবাদমাধ্যমে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বভারতীর সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী, যিনি কিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যও বটে, যে ভাষণ দিয়েছেন, তা নাকি রাজনৈতিক এবং তার কথার পরে যে হাততালি পড়েছে, তা শান্তিনিকেতনের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খায় না। এই ঘটনাকে নিন্দা করে শুদ্ধবাদীরা বলেছেন, এতে বিশ্বভারতীর পরম্পরা ব্যাহত হয়েছে।
পাশাপাশি, রাজ্যের একটি বহুল প্রচারিত সংবাদমাধ্যম তার একটি সম্পাদকীয়তে জানিয়েছে যে, মোদীর ভাষণে টেলিপ্রম্পটার-এর উপস্থিতি এটাই প্রমাণ করেছে যে, আচার্যের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের প্রাণের আলাপ অধরাই থেকে গিয়েছে। শিক্ষা বা ছাত্রছাত্রীরা নয়, অনুষ্ঠানের শেষে ছিলেন শুধু মোদী। এবং আচার্য হিসেবে নয়, রাজনীতিবিদ হিসেবে।
বাঙালির শুচিবায়ুগ্রস্ততা ফের সামনে এল
এই সমস্ত বিষয়ই আরেকবার স্থাপিত করল বাঙালির শুচিবায়ুগ্রস্ত চরিত্রটিকে। শান্তিনিকেতনে মোদীর ‘রাজনীতি’কে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর এই প্রয়াস আসলে শান্তিনিকেতনের ‘শুদ্ধতা’কে বাঁচানোর প্রয়াস নয়, তা আসলে একটি প্রতি-রাজনৈতিক বক্তব্য মাত্র।
মোদীকে যেহেতু স্বঘোষিত উদারবাদী বাঙালি মনন বিশেষ দেখতে পারে না, তাই শান্তিনিকেতনে তার আগমনের প্রতি বাঙালির একটি ঘৃণাবোধ ছিলই তলায় তলায়, অবচেতন মনে। যেহেতু রবীন্দ্রনাথ বাঙালির সর্বোচ্চ আশ্রয়, পবিত্রতার শিখর হিসেবে সম্মানিত; তাই সেখানে মোদীর মতো দাঙ্গা অভিযুক্ত রাজনীতিবিদের পদার্পণ করাটা তাদের কাছে এক ধরনের জাতিগত অপমান। আর এখানেই প্রকট হয় বাঙালির মুখোশপরা নীতিবাদ।
মোদীর আগমনেই বিশ্বভারতী প্রথম ‘কলুষিত’ হলো, তা নয়
মোদীর আসাতে শান্তিনিকেতনের কৌলীন্য নতুন করে ম্লান হয়েছে, এমন নয়। এর আগে, আশির দশকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর উপস্থিতিতেও বিশ্বভারতীর পরিবেশ ক্ষুণ্ণ হয়েছিল, প্রশ্ন উঠেছিল শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতির অনুপ্রবেশ নিয়েও।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যম সেই সময়কার অশান্তির মধ্যেও প্রধানমন্ত্রী রাজীবের প্রতিক্রিয়ায় একধরনের সৌজন্যতাবোধ খুঁজে পেয়েছে, যা নাকি মোদীর সময়ে অনুপস্থিত। মহোদয়রা, এখানে এটুকু বলার অভিলাষ রয়েছে যে, শিক্ষাজগতে রাজনীতির অনুপ্রবেশের পথ যখন একবার খুলে দেওয়া হয়েছে, তখন সেই সৌজন্যতাবোধের আশা সবসময় না রাখাই ভালো। রাজনীতিবিদদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য বানালে রাজনৈতিক অশান্তি-বিতর্ক-মানহানির আশঙ্কা সাধারণভাবেই থাকে। সেখানে একটি বা দুটো সৌজন্যতাবোধের দৃষ্টান্তকে সাধারণ নিয়ম মানার কোনো কারণ নেই।
আর পাশাপাশি এটিও মনে রাখা দরকার যে, এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি এক ভয়ঙ্কর ও বিষাক্ত মেরুকরণের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এটি পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু বা রাজীব গান্ধীর সময়ে ছিল না। তাই রাজনীতিবিদরা, তা সে দেশের প্রধানমন্ত্রীই হোন না কেন, যে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য সবরকম মঞ্চেরই পূর্ণ সদ্ব্যবহার করবে, তা নিয়ে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না। মোদীও তাই করেছেন। সুযোগ পেলে আবারও করবেন। অতএব, এই আক্ষেপ অর্থহীন।
যদি মঞ্চ বদলানো না যায়, আচার্য বদলান
যদি সত্যি বিশ্বভারতীকে অরাজনৈতিক দেখাতে হয়, তাহলে রাজনীতির ব্যাপারীদের কাছ থেকে তাকে সম্পূর্ণ আলাদা করতে হবে। আর সেটা না পারলে ভবিষ্যতে আরও রাজনৈতিক পালাগান শোনার জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে। ‘ওই প্রধানমন্ত্রী ভালো ছিলেন’, ‘এই প্রধানমন্ত্রী ভালো না’ ধরনের অবস্থান নেওয়া অবান্তর। ‘এই’ অবস্থায় পড়লে ‘ওই’ প্রধানমন্ত্রীও যে কীরূপ আচরণ করতেন, তা কেউ বলতে পারে না। রাজনীতির চাহিদা বড়ই বর্ণময়। শুদ্ধবাদী ধ্যানধারণা দিয়ে তার আগাম বিশ্লেষণ হয় না। তাই ব্যক্তি মোদীকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।
কীসের গর্ব?
দ্বিতীয়ত, কীসের গরবে বাঙালির এই হা-হুতাশ? মোদী তো না হয় বাইরের লোক, বিশ্বভারতীর ঐতিহ্য সম্পর্কে তত অবগত তিনি না-ই বা হতে পারেন; কিন্তু অতি সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি শঙ্খ ঘোষকে কটাক্ষ করে যে সংস্কৃতির পরিচয় দিয়েছে খোদ রাজ্যের শাসকদলের নেতা-মন্ত্রীরা, তার ব্যাখ্যা আমরা কীভাবে করব?
দুঃখের ব্যাপার এই যে, পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকদলের নেত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জনসমক্ষে বারবার দেখান যে তিনি বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি নয় কতটা ভাবিত। কোনো কোনো সময়ে এই সংবেদনশীলতার অতিরিক্ত প্রদর্শনীতে অনেকে বিরক্তি বা কৌতুক বোধ করলেও, সাধারণভাবে মমতাদেবী যে বঙ্গীয় সংস্কৃতির প্রতি তার পূর্বসূরিদের চেয়ে অনেক বেশি যত্নশীল, তা অনেকেই সংশয়হীনভাবে বোধ করেন। কিন্তু সেই নেত্রীর দলের লোকজনই যখন এক বর্ষীয়ান কবির প্রতিবাদী রচনাকে কেন্দ্র করে মারমুখী হয়ে ওঠে, তখন সংস্কৃতির প্রতি রাজনৈতিক শীর্ষ নেতৃত্বের সমর্পণ নিয়ে সন্দেহ না এসে পারে না।
আবার সুশীল সমাজেও এই নিয়ে বিশেষ ঝড় উঠতেও দেখা যায় না। কারণ বুঝতে অসুবিধা হয় না– ‘কাছের রাজনীতিক’কে চটালে মুশকিল, তাই সেখানে নৈতিকতার ধার না ধারলেও চলে। কিন্তু ‘দূরের রাজনীতিক’কে লক্ষ্য করলে অসুবিধা নেই; বিশেষ করে দুই রাজনীতিকের মধ্যে যদি সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায় হয়।
মহাত্মার প্রতিও তো বাঙালির রাগ; মোদী তো কোন ছার
মোদীর বিরুদ্ধে বাঙালির রাগ (যদিও পরিস্থিতি এখন অনেকটা পাল্টাচ্ছেও) সেই মহাত্মা গান্ধীর প্রতি বাঙালির বিরাগের কথা মনে পরিয়ে দেয়। মহাত্মা বাঙালির অপছন্দের পাত্র ছিলেন কারণ, জাতীয় মঞ্চে তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর বিরোধিতা করেছিলেন এবং দুই ব্যক্তিত্বের সংঘাতে শেষপর্যন্ত পরাজিত হয়েছিলেন সুভাষই।
কিন্তু বাঙালি এটা মনে রাখে না যে, এক সময়ে মহাত্মা গান্ধী রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু বঙ্গদেশে (অবিভক্ত তখন) এসেই তার রাজনৈতিক যাত্রার সূচনা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কেউ তাকে পাত্তাই দেয়নি। কলকাতায় থাকাকালীন নিজে ঝাঁটা নিয়ে ভিড়াক্রান্ত আবাসিক ভবনের শৌচাগার পরিস্কার করেছিলেন। গান্ধীর এই স্বাবলম্বিতা আমরা বাঙালিরা কতটুকু শিখেছি? তার রাজনৈতিক পাঠের কথা তো না হয় ছেড়েই দিলাম। কিন্তু তবু আমরা তার বিরোধিতা করতেই থাকি এই ভেবে যে, তিনি আমাদের জাত্যাভিমানকে আহত করেছেন নেতাজির বিরুদ্ধাচারণ করে। এই অযৌক্তিক তর্কের শেষ কোথায়?
মোদীর বিরুদ্ধেও শুদ্ধবাদী বাঙালিদের একইরকম মনোভাব। তিনি যেহেতু নেহেরুর মতো বিদেশে শিক্ষিত নন; হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলের নেতা, আবার গুজরাট দাঙ্গার অভিযোগও তার বিরুদ্ধে রয়েছে, তাই তার কবিগুরুর পবিত্র শান্তিনিকেতনে আসা এক শ্রেণীর বাঙালির ঘোর অপছন্দ।
তবে মোদীর আগমনের মধ্যে দিয়েই শান্তিনিকেতনের অবক্ষয়ের শুরু হলো- শুদ্ধবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালির এমনতরো ধারণা কিন্তু যথেষ্ঠ ভুল। বিশ্বভারতীর সম্পর্কে অধঃপতনের ধারণা আজ নতুন জন্ম নেয়নি। কবিগুরুর প্রয়াণের পর তার কোনো মন্ত্র-পাঠই আমরা মনে রাখতে পারিনি। পেরেছি শুধু এক ধরনের অন্তঃসারশূন্য গাম্ভীর্যর মুখোশ পরে থাকতে।
সর্বত্র রাজনীতির বীজ পুঁততে বাঙালি চিরকালই ভালোবাসে। ত্রিশোর্ধ বছরের বামপন্থী শাসনের সময়কালে এই কলাকে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি আরও ঘষেমেজে নিয়ে তার তীক্ষ্ণতা বাড়িয়েছে। রাজনৈতিক কূটকাচালি বাঙালি সর্বসময়ের প্রিয় কর্ম। শিল্প এবং সংস্কৃতির উপরে শাসনযন্ত্রের খবরদারিকে বাঙালি অনেক দিন আগেই মান্যতা দিয়েছে; সে কথা এখানে নতুন করে উত্থাপন করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু যখন একজন মোদী অরাজনৈতিককে রাজনৈতিক করে তোলার প্রয়াস দেখান, তখনই পড়ে যায় ‘গেল, গেল’ রব।
মোদী এই মুহূর্তে ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা, তা ভুলে গেলে চলবে না
মোদীর প্রতি এই অচ্ছুতের মনোভাব যে বাঙালির ‘উদার’ ভাবমূর্তিকে অনেকটাই নিষ্প্রভ করে, সে কথা অস্বীকার করা যায় না। মোদী এবং তার ভারতীয় জনতা পার্টির রাজনীতিতে নিশ্চয় অনেক ভুলত্রুটি রয়েছে, কিন্তু পাশাপাশি এটাও মানতে হবে যে, সমকালীন ভারতে তিনিই সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা এবং প্রত্যেক নেতারই তার নিজস্ব পথ থাকে সমর্থক-অনুরাগীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের।
কেন তিনি বিশ্বভারতীতে নেহেরুর মতো গাম্ভীর্য এবং পাণ্ডিত্য নিয়ে নিজেকে পেশ করছেন না, বা কেন তাকে দেখে উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে ‘মোদী, মোদী’ রব উঠেছে শান্তিনিকেতনের স্বর্গীয় নিস্তব্ধতাকে খান খান করে- এই সব প্রশ্ন যারা তুলছেন, তাদের আর যা-ই হোক, উদারবাদী বলা চলে না কোনোভাবেই। কারণ, তাদের চিন্তাভাবনার পথ একমুখী এবং অনমনীয়। কালের সঙ্গে যারা বদলাতে জানেন না।
আর বিশ্বকবির ঐতিহ্যের কথা? সে আমরা বহুদিন আগেই জলাঞ্জলি দিয়েছি। নতুন করে তা নিয়ে নাকিকান্না কেঁদে লাভ নেই। সংস্কৃতির কঙ্কাল আঁকড়ে ধরে এই বিলাপ আসলে এক ধরনের দ্বিচারিতা। রাজনীতিক মোদী তো তাতে নিমিত্তমাত্র।
Featured Image Source: DNA India