Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জসীম উদ্‌দীন: প্রাণে ও কবিতায় যার ছিলো বাংলার কাদামাটি গ্রাম

“ঐখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে
তিরিশ বছর ভিজিয়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
এতোটুকু তারে ঘরে এনেছিনু, সোনার মতন মুখ
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেলে পরে কেঁদে ভাসাইতো বুক”- কবর, জসীম উদদীন

বাংলা কবিতার জগতে এ এক চির অনবদ্য কবিতা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চির অম্লান হয়ে আছে এই কবিতার প্রত্যেকটা লাইন প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে। আর তা তো থাকারই কথা, এ তো শুধু কবিতা নয়, গ্রামবাংলার প্রতিটি মানুষের জীবনের মানচিত্র, এর প্রতিটি শব্দ তো বলে যায় আবহমান বাংলার প্রতিটি প্রাণেরই গল্পকথা। রূপে-ছন্দে-গঠনে অনবদ্য এই কবিতা কিন্তু তখনকার কোনো কিংবদন্তী কবির রচনা ছিলো না, ছিলো স্কুলপড়ুয়া এক ছাত্রের রচনা। সেই তরুণ তখনো ছাত্র, যখন এই কবিতা প্রবেশিকার বাংলা পাঠ্যক্রমে সংযুক্ত হয়, এ থেকেই বোঝা যায় কতখানি কাব্যগুণসম্পন্ন একটি কবিতা এটি। এই তরুণই পরে হয়ে ওঠেন গ্রামবাংলার প্রাণের কবি জসীম উদ্‌দীন। তার হাত ধরেই বাংলা সাহিত্য পায় ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ ও ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ এর মতো গীতিময় কবিতার উৎকৃষ্ট সমগ্র।

পল্লীর কবি, প্রকৃতির কবি; source: proticchobi.com

ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে নানাবাড়িতে ১৯০৩ সালের ১লা জানুয়ারি কবির জন্ম হয়। তাম্বুলখানার পাশেই গ্রাম গোবিন্দপুর, এখানেই ছিলো তার বাপ-দাদার ভিটা। মায়ের নাম আমিনা খাতুন, পিতা মওলানা আনছার উদ্দীন মোল্লা ছিলেন গ্রামের বেশ প্রভাবশালী ব্যক্তি, প্রভাবশালী ছিলেন কবির দাদাও। কুমার নদীর কোলঘেঁষা গোবিন্দপুর গ্রামের মাটি আর মানুষের মাঝে বেড়ে ওঠেন তিনি। নিজের রক্ত-মাংস আর মননে এমনিভাবে গ্রামের সহজ স্নেহ লেগে ছিলো বলেই হয়তো তার কলম গ্রামের সরল জীবনের কথা এতো সুন্দরভাবে বলে গেছে। 

ফরিদপুর ওয়েলফেয়ার স্কুল ও পরবর্তীতে ফরিদপুর জেলা স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে কবি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৯ সালে বি.এ এবং ১৯৩১ সালে এম.এ শেষ করেন। ছাত্রাবস্থা থেকেই কবি সাহিত্যচর্চায় উৎসাহী হয়ে ওঠেন। ১৯২১ সালে মোসলেম ভারত পত্রিকায় ‘মিলন গান’ নামে কবির প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯২৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সমসাময়িক বিখ্যাত সাহিত্যপত্রিকা ‘কল্লোল’ এ প্রকাশিত হয় তার অতুলনীয় সৃষ্টি ‘কবর’। ১৯২৮ সালে এই কবিতাটি পাঠ্যপুস্তকে সংযুক্ত করার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নির্বাচিত হয়, যা ছিলো এক তরুণ কবির জন্য অত্যন্ত সম্মানের। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাখালি’ প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। সারাজীবন ধরেই সাহিত্যে তার গৌরবময় সৃষ্টিকর্ম চলে গেছে।

আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যে বা, আমি বাঁধি তার ঘর; source: pinterest.fr

কবির কর্মজীবনও অত্যন্ত বর্ণাঢ্য। ১৯৩৮ সালে যোগদান করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করেন পাঁচ বছর। এর আগে তিনি ১৯৩৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. দীনেশচন্দ্র সেনের অধীনে রামতনু লাহিড়ী গবেষণা সহকারী পদে বেশ কিছুকাল কাজ করেন। এই দীনেশচন্দ্র সেনের সাথেই কবি বাংলা লোকসাহিত্য সংগ্রাহক হিসাবে কাজ করেন এবং প্রায় দশ হাজারেরও অধিক লোক সংগীত সংগ্রহ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ১৯৪৪ সাল থেকে তিনি সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার বিভাগে কাজ করেন এবং সেখান থেকেই তিনি অবসর নেন। বাংলার প্রতি টান তাকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা হিসাবে সামনে আনে।

কর্মজীবনের মাঝে মাঝে চলতে থাকে কবির সাংস্কৃতিক চর্চা ও লেখনীশৈলী। অমর কাহিনীকাব্য ‘নকশীকাঁথার মাঠ’ প্রকাশিত হয় ১৯২৯ সালে। ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত হয় তার আরেক খ্যাতনামা কাব্যগ্রন্থ ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’। তার অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘রঙিলা নায়ের মাঝি’, ‘বালুচর’, ‘এক পয়সার বাঁশী’, ‘হাসু’, ‘ধানখেত’, ‘মাটির কান্না’, ‘রূপবতী’, ‘কাফনের মিছিল’ ইত্যাদি। তবে কেবল কাব্যের ক্ষেত্রেই নয়, জসীম উদদীন তার প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে যান সংগীত, নাটক, উপন্যাস ও সাহিত্য-গবেষণার ক্ষেত্রে। তার রচিত বিখ্যাত গানের মধ্যে রয়েছে- আমার সোনার ময়না পাখি, আমায় ভাসাইলি রে, ও বন্ধু রঙিলা, নিশিতে যাইও ফুলবাণে, ও ভোমরা, প্রাণসখি রে ঐ শোনে কদম্ব তলে ইত্যাদি। তার উল্লেখ্যযোগ্য উপন্যাস ‘বোবাকাহিনী’ এবং ভ্রমণ কাহিনী ‘চলে মুসাফির’, ‘হলদে পরীর দেশে’, ‘যে দেশে মানুষ বড়’, ‘জার্মানীর শহরে বন্দরে’। এছাড়া সাহিত্যের অঙ্গনে রয়েছে তার নাটক ‘পদ্মাপার’, ‘বেদের মেয়ে’, ‘মধুমালা’, ‘পল্লীবধূ’। কবি বাংলা লোকসাহিত্য নিয়ে গবেষণা ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। লোকসাহিত্যের বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও সাহিত্যদর্শন নিয়ে তিনি বেশ কয়েকটি বইও লিখেছেন।

ব্যক্তিজীবনে জসীম উদ্‌দীন ১৯৪৩ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হোন। পাত্রী মমতাজ তখন ছিলেন দশম শ্রেণির ছাত্রী, বিয়ের পরে তিনি হয়ে যান মমতাজ জসীমউদ্দিন। স্ত্রীকে ‘মনিমালা’ নামে ডাকতেন কবি। কবি তার জীবনকালেই প্রচুর সম্মান ও খ্যাতির অধিকারী হোন। ১৯৬৯ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধি দেয়। এছাড়া ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান আমলে পান প্রেসিডেন্টস অ্যাওয়ার্ড ফর প্রাইড অফ পারফরমেন্স পুরস্কার। ১৯৭৬ সালে পান একুশে পদক, ১৯৭৮ সালে পান মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার। ১৯৭৪ সালে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে বাংলা একাডেমী পুরস্কারের জন্য কবি মনোনীত হোন, কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।

ফরিদপুরে কবির বসতভিটা; source: youtube.com

১৯৭৬ সালের ১৩ ই মার্চ কবির এই কর্মময় জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। কবির শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তার শেষকৃত্য সমাপ্ত হয় এবং তারপর ফরিদপুর জেলার আম্বিকাপুর গ্রামে পারিবারিক করবস্থানে দাদীর কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়। সেখানে রয়েছে একই পরিবারের পরপর এগারোটি কবর। কবির কবরের দিকে তাকালে মনে পড়ে যায় কবির সেই বিখ্যাত ‘কবর’ কবিতা, কবিতাটির মতোও একটি ডালিম গাছ বেড়ে উঠেছে শায়িত কবির শিয়রে। কবির গ্রামের অঞ্চলে কবিকে স্মরণ করে প্রতি বছর জানুয়ারি মাসে ‘জসীম মেলা’ নামের একটি অনুষ্ঠান হয়। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কবির নামে একটি আবাসিক হল রয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর সাথে পল্লীকবি; source: plus.google.com

পল্লীকবি উপাধি হলেও কবি যে কেবল গ্রামমুখী সাহিত্যেরই অনুরাগী ছিলেন, তা না। কবিকে নগরবিমুখী বললেও ভুল হবে, কারণ তার ভ্রমণকাহিনী ও গল্প-উপন্যাসে রয়েছে আধুনিক নগরসভ্যতার ছাপ। কবি আজীবন ছিলেন স্বাধীন-সৃজনশীল সাহিত্যচর্চার পক্ষপাতী। বাংলাকে তিনি ভালোবেসেছিলেন হৃদয়ের গভীর থেকে। এদেশের নদীজল, মাঠঘাট বা মুক্ত বিহঙ্গের দল তাকে জীবনের গভীরতম অর্থ শিখিয়েছিলো, জানিয়েছিলো মানব মনের অকৃত্রিম দর্শন। মুক্তিযুদ্ধের সময় কবি রচনা করেন অনেক দেশাত্মবোধক কবিতা ও গান। স্বাধীন বাঙালিসত্ত্বা লালনের তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ সমর্থক। বিশেষ করে এদেশের গ্রামগুলোর একদম সাধারণ মানুষের নিতান্ত সাধারণ জীবন তার মতো করে আর কে-ইবা তুলে আনতে পারেন সাহিত্যের পাতায়? কবি যেন তার কবিতার প্রতি লাইনে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন গ্রামের সাধারণ রাখাল, গৃহবধূ বা সাপুড়ের মেয়ের সাথে। বারবার তিনি এভাবেই আমাদের টেনে নিয়ে যান আবহমান বাংলার সেই মাটির পথে, সেই ছোট ছোট বাড়িঘর বা মাটির ঘর বেয়ে ওঠা সরু লতাপাতার মাঝে, যা আমাদের নিয়ে যায় কবির আপন গ্রামের মতো নদীবিধৌত এই বাংলার প্রতিটি গ্রামের মায়ায়। মনে পড়ে কবির সেই মমতাভরা আহ্বান –

“তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে
আমাদের ছোটো গাঁয়।
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়”….

This article is in Bangla. This is about Poet Jasimuddin.

All sources are hyperlinked inside the article.

Feature Imaged: en.prothomalo.com

Related Articles