দক্ষিণ কলকাতার রজনীসেন রোডের ২১ নাম্বার বাড়িতেই থাকতেন বাংলা সাহিত্যের অমর গোয়েন্দা ফেলুদা ওরফে প্রদোষ চন্দ্র মিত্তির। এই বাড়িতেই নিজ কাকার পরিবারের সাথে থাকতেন তিনি। থাকতেন বলাটা কিছুটা ভুলই হবে, কারণ তিনি এখনো এখানেই থাকেন। বাংলা সাহিত্যে যতদিন ফেলুদা অমর থাকবে ততদিন প্রদোষচন্দ্র মিত্তির এই বাড়িতেই থাকবেন। অবশ্য পাঠকের কল্পনায় কিংবা বইয়ের পাতায় কখনো বা রুপালী পর্দায় ছাড়া প্রদোষচন্দ্র মিত্রের সাথে কারো সামনাসামনি সাক্ষাত হবার সুযোগ হয়নি। তাই একবার কলকাতায় গিয়ে দক্ষিণ কলকাতায় খোঁজ করি। অবাক করার বিষয় যে, দক্ষিণ কলকাতায় রজনীসেন রোড থাকলেও ২১ নাম্বার বাড়িটির কোনো অস্তিত্ব নেই! সত্যজিত রায় বেঁচে থাকলে হয়তো ঠিক বাড়িটি চিনিয়ে দিতেন। বাড়িতে কড়া নাড়তেই হয়তো তোপসে এসে দরজাটা খুলতো। কাকে চাই বা কী দরকার জিজ্ঞেস করলে বলতাম, ফেলু মিত্তিরের সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই।
ফেলুদার এতসব পরিচয় ও রোমাঞ্চকর সব গোয়েন্দাকাহিনী কখনোই পাঠকের জানা হতো না যদি না সত্যজিত রায় ফেলুদাকে নিয়ে লিখতে না বসতেন। ফেলুদার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে সন্দেশ পত্রিকায়। এর কয়েক বছর পর প্রকাশিত হয় বাদশাহী আংটি। এর পরে প্রায় প্রতি বছর সত্যজিৎ রায় ফেলুদার কাহিনী প্রকাশ করতে থাকেন। শেষপর্যন্ত ফেলুদাকে নিয়ে সত্যজিৎ রায় ছোট-বড় মিলিয়ে ৩৫টি লেখা শেষ করে যেতে পেরেছেন। ১৯৬৫-৯৭ সাল পর্যন্ত সত্যজিত রায়ের ফেলুদা সিরিজ নিয়ে ৩৫টি সম্পূর্ণ গল্প, ৪টি অসম্পূর্ণ গল্প ও উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলার পাঠক ফেলুদার প্রথম পরিচয় পায় ১৯৬৫ সালে। সেই বছরের ডিসেম্বর মাসে সন্দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’। এখানেই সর্বপ্রথম ফেলু্দা ওরফে ফেলু মিত্তিরের পরিচয় দেওয়া হয়। এতে ফেলুদা একটি চিঠিতে হুমকির রহস্য সমাধান করেন।
ফেলুদা চরিত্রটির জন্ম খুব আকস্মিক ভাবেই হয়েছিল। সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত লাল রঙের খেরোর খাতা ছিলো, যেখানে তিনি তার গল্পগুলোর খসড়া লিখতেন। এছাড়াও আরো অনেকগুলো খসড়া খাতা ছিল। কিন্তু ১৯৬৫ সালের আগে কোথাও ফেলুদা চরিত্রের কোনো দেখা পাওয়া যায়নি। ১৯৬৫ সালে তাঁর সেই বিখ্যাত খসড়া খাতার তৃতীয় পাতায় খুব নাটকীয়ভাবে হঠাৎ করেই এই গোয়েন্দার আবির্ভাব ঘটে।
ফেলুদা সম্পর্কে সন্দীপ রায় লিখেছেন,
এক নতুন চরিত্রের জন্মের আগে, একজন লেখক সাধারণত যেসব প্রাথমিক খসড়া করে থাকেন, উনি তা কিছুই করেননি। গত চার বছরে লেখা অন্যান্য গল্পের মতো সরাসরি আরম্ভ করে দিয়েছেন।
এই ছিল বাংলা সাহিত্যের এক অমর সৃষ্টির সূচনা। সেদিন সত্যজিত রায় হয়তো ভাবতেই পারেননি, এই ফেলুদাকে প্রতি বছর পাঠকের সামনে এনে হাজির করতে হবে। ফেলুদার পরবর্তী গোয়ান্দাগিরির কাহিনী পড়তে পাঠক অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। আর তাই বাদশাহী আংটির পর থেকে প্রায় প্রতিবছরই সত্যজিত রায় ফেলুদা প্রকাশ করে যেতেন।
গোয়েন্দা থাকবে আর তার সহকারী থাকবে না, সে তো হয় না। ফেলুদার সহকারী চরিত্রটি ছিল তোপসে ওরফে তপেশরঞ্জন মিত্র। তোপসেকে ছাড়া ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি হয়তো এতটা জমে উঠতো না। তপেশরঞ্জন মিত্র ফেলুদার খুড়তুতো ভাই। তার বদৌলতেই ফেলুদার প্রায় সব অভিযানের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা পাওয়া যায়। কেননা সে-ই ফেলুদার প্রায় সব অভিযানের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে রাখে। অবশ্য পাঠকের কাছে ফেলুদার দেয়া তোপসে নামেই সে অধিক পরিচিত। তোপসে চরিত্রটি অনেকটা আর্থার কোনান ডয়েলের জন ওয়াটসন চরিত্র দ্বারা অনুপ্রাণিত। তোপসে ফেলুদার সর্বক্ষণের সঙ্গী। তার বাবা সম্পর্কে ফেলুদার কাকা। ফেলুদা তার কাকার পরিবারের সঙ্গেই থাকেন দক্ষিণ কলকাতার সেই রজনীসেন রোডে।
ফেলুদার গোয়েন্দা গল্পে ফেলুদা ও তোপসের পাশাপাশি আমরা আরও একজনকে প্রায়ই পাই। থ্রি মাস্কেটিয়ার্স এর তৃতীয়জন হলেন ফেলুদার বন্ধু লালমোহন গাঙ্গুলি বা লালমোহনবাবু। ছোটখাট চেহারার টাক পড়া এই ভদ্রলোক পেশায় একজন লেখক। ‘জটায়ু’ ছদ্মনামে রহস্য-রোমাঞ্চ উপন্যাস লেখেন। লালমোহনবাবু বাংলায় রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজের একজন জনপ্রিয় লেখক এবং তার নিজের ধারণানুযায়ী সারা ভারতে তার অসংখ্য অনুগামী ছড়িয়ে আছে। তার লেখা উপন্যাসগুলোর প্রধান চরিত্র সাড়ে ছয় ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট গোয়েন্দা প্রখর রুদ্র। মজার বিষয়, তার অবিশ্বাস্য গল্পগুলো বেস্টসেলার হলেও বইগুলোতে খুবই সাধারণ অনেক ভুল থাকে, যেগুলো ফেলুদাকে শুধরে দিতে হয়। জটায়ু চরিত্রটি ফেলুদার রোমাঞ্চকর অভিযানে পাঠককে হাস্যরসাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে আনন্দ দেয়। নানা মজাদার কাণ্ড আর কথার মাধ্যমে রহস্যঘেরা গল্পগুলোকে গতিশীল করে তোলার পেছনে এই জটায়ুর অবদান বিশাল।
‘সোনার কেল্লা’ গল্পে প্রথম ফেলুদা আর তোপসের সাথে তার পরিচয় হয়। লালমোহনবাবু ওরফে জটায়ুর একটি মাদ্রাজী সবুজ এ্যাম্বাসেডর গাড়ি আছে, যা ফেলুদার অনেক অভিযানের নির্ভরযোগ্য বাহন। সেই সোনার কেল্লা থেকে লালমোহনবাবু ফেলুদা ও তোপসের অভিযানের এক সঙ্গী হয়ে যান।
সেই ১৯৬৫ সালে ফেলুদার আবির্ভাব, তারপর কত সময় গড়িয়েছে। ফেলুদা প্রথম প্রকাশের পর অর্ধশত বছর পেরিয়ে গেলেও ফেলুদা ও তার অভিযানের আকর্ষণ পাঠকের কাছে বিন্দুমাত্র কমেনি। ফেলুদা আজও পাঠকের কাছে সমান জনপ্রিয়। বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দা গল্পের সংখ্যা কম নয়, কিন্তু ফেলুদার মতো এমন টানটান উত্তেজনপূর্ণ ও রোমাঞ্চকর অভিযানের গল্প বিরল। অন্যান্য অনেক গোয়েন্দাকাহিনীর মতো এর বর্ণনাতে কোনো বাহুল্য খুঁজে পাওয়া যায় না। গল্প পড়তে পড়তে পাঠকের কখনো মনে হয় না, এ দৃশ্য না আনলেও চলতো। বরং কেন এত দ্রুত ফেলুদা রহস্য উন্মোচন করে ফেলছেন, গল্পগুলো আরেকটু বড় হলো না কেন- সেই আক্ষেপই থেকে গেছে পাঠকের কাছে সবসময়। ফেলুদার গল্প পড়তে গেলেই বইয়ের ছাপার কালো অক্ষর থেকে বেরিয়ে দৃশ্যগুলো ভেসে উঠতে থাকে চোখের সামনে। এটাই ফেলুদা চরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও সত্যজিত রায়ের লেখার বিশেষ কৌশল। রহস্যের জট খোলাতেও অন্যান্য গোয়েন্দা কাহিনী থেকে ফেলুদার স্বাতন্ত্র্য লক্ষ্য করা যায়।
ফেলুদার অন্যতম আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে ভূগোল, ইতিহাসসহ নানা বিষয় সম্পর্কে তার অসামান্য জ্ঞান। ফেলুদার রহস্য গল্পে যে সকল স্থান এসেছে সেগুলোর ভৌগলিক অবস্থান, ইতিহাস, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সব কিছুই সুন্দরভাবে ফুটে উটেছে রহস্য সমাধানের পাশাপাশি। যে কারণে ফেলুদা তার পাঠকদের কাছে শুধুমাত্র গল্পের চরিত্র নয়, বরং বাস্তবের মানুষ হিসেবে হাজির হয়েছেন। অন্যান্য গোয়েন্দাকাহিনীর সাথে ফেলুদা সিরিজের আরেকটি পার্থক্য হলো, ফেলুদা সিরিজ মূলত গোয়েন্দা কাহিনী হলেও ফেলুদার প্রতিটি কাহিনীতে একটি ভ্রমণ কাহিনীর নির্যাস সবসময় মিশে আছে। সে ভূস্বর্গ কাশ্মীর হোক বা রাজস্থানের সোনালী বালির মরুভূমি। সোনার কেল্লায় রাজস্থানের, গ্যাংটকে গণ্ডোগোলে গ্যাংটকের, দার্জিলিং জমজমাট এ দার্জিলিংয়ের, বাদশাহী আংটিতে লাখনৌর, জয় বাবা ফেলুনাথে কাশি-বেনারসের, যত কান্ড কাঠমুন্ডুতে নেপালের যে বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায় তা ভ্রমণ কাহিনীগুলোর চেয়েও কোনো অংশে কম না। আর এটাই ফেলুদার গোয়েন্দাকাহিনীগুলোকে আরো বেশি জীবন্ত করে তোলে।
ফেলুদা এখনো আমাদের কাছে জীবন্ত। যে বয়সের পাঠকই হোক না কেন, ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি পড়তে পড়তে কখন যেন নিজের চোখের সামনেই দেখতে পান জীবন্ত ফেলু মিত্তিরকে। সত্যজিত রায়কে অসংখ্য ধন্যবাদ ফেলু মিত্তিরের মতো এক চরিত্রের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য। ভালো থাকুন সত্যজিত রায় ও ফেলু মিত্তির দুজনেই।