ফিফা বর্ষসেরা, ব্যালন ডি’অর – ফুটবল মৌসুমের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচন করার জন্য অনেকগুলো সংস্থা রয়েছে। তবে প্রায় প্রতি বছরই এই ফলাফলকে কেন্দ্র করে কিছু বিতর্ক হয়ে থাকে। চলতি বছরেই যেমন ব্রাজিলের অ্যালিসন বেকারের ফিফা বেস্টের সেরা দশে জায়গা না পাওয়ায় অনেক ভক্ত তো বটেই, ফুটবলবোদ্ধাদের কেউ কেউও অবাক। তিনটা টুর্নামেন্টের সেরা গোলকিপার এবং দুইটা মেজর টুর্নামেন্টজয়ী দলের সদস্য হবার পরও সেরা দশে থাকতে না পারলে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক যে, ঠিক কোন কাজটা করলে এই জায়গায় আসা সম্ভব।
একজন গোলকিপার তো চাইলেই উপরে উঠে এসে গোল করতে পারবেন না। পুরস্কারটা তাহলে কি কেবলই আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের জন্য?
উত্তর পাওয়ার আগে প্রথমে আগের কিছু ইতিহাস জেনে নেওয়া যাক।
কেস স্টাডি – ১
২০০২ সালের ফিফা বর্ষসেরা পুরস্কার কে পেয়েছিলেন, সেটা মনে আছে? ব্রাজিলের রোনালদো সেই বছর বর্ষসেরা পুরষ্কার পান, অলিভার কান দ্বিতীয় হন। রোনালদো সেই বছর আসলে রূপকথার মতো একটা পারফর্মেন্স দেখান। প্রায় দুটো মৌসুম ইনজুরির জন্য খেলার বাইরে থাকার পর বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়ার চেষ্টা হিসেবে কিছু লিগ ম্যাচ খেলেন। ১০ ম্যাচে ৭ গোল করার পর স্কলারি তার উপর বাজি ধরেন এবং সেই বিশ্বকাপে ৮ গোল করে বিশ্বকাপ জেতাতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখেন রোনালদো। অথচ এমন পারফর্মেন্সের পরও রোনালদো কিন্তু সেই বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হতে পারেননি। অলিভার কান সেরা খেলোয়াড় হবার পরও সেটা নিয়ে খুব বেশি বিতর্ক হয়নি, কারণ সেই বিশ্বকাপে জার্মানির মতো ভঙ্গুর দলকে ফাইনালে তোলার পেছনে কানের যথেষ্ট অবদান ছিল।
কিন্তু সেই বছর ফিফা বর্ষসেরা কিংবা ব্যালন ডি’অর যখন রোনালদো জিতলেন, তখন কিছুটা অবাক হতে হলো। কারণ সেই বছর বিশ্বকাপ বাদে রোনালদোর কোনো পারফর্মেন্স ছিল না। ইনজুরির জন্য পুরো মৌসুমে ক্লাবের হয়ে তিনি মাত্র ১৬টি ম্যাচ খেলতে পারেন। ব্যালন কিংবা ফিফা বর্ষসেরা হবার মূল কারণ ছিল বিশ্বকাপ জয়। তাহলে যেই বিশ্বকাপ জেতার কারণে তাকে বর্ষসেরা পুরস্কার দেয়া হলো, তিনি সেই টুর্নামেন্টেরই সেরা খেলোয়াড় হতে পারলেন না। বিষয়টা একটু স্ববিরোধী হয়ে গেল না?
বিশ্বকাপ বাদে যদি রোনালদোর কোনো পারফর্মেন্স থাকতো, তাহলেও না হয় মেনে নেয়া যেত। যুক্তি অনুযায়ী, অন্তত সেই বছর বর্ষসেরা পুরস্কার রোনালদোর পাওয়াটা উচিত হয়নি। বিষয়টা এমন নয় যে, বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়কেই বর্ষসেরা পুরষ্কার পেতে হবে। কিন্তু রোনালদো তো বিশ্বকাপ বাদে অন্য কোনো টুর্নামেন্ট ইনজুরির জন্য খেলতেই পারেননি। এমন যদি হতো যে, রোনালদো বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন, আর কান ফিফা বর্ষসেরা পুরস্কার পেয়েছেন, তাহলেও সেটা কিছুটা যুক্তিসঙ্গত হতে পারতো। তবে রোনালদো যদি বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় আর ফিফা বর্ষসেরা দুটোই হতেন, তাহলেও কোনো বিতর্ক হতো না।
তার মানে, যুক্তি অনুযায়ী বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের বিচারক আর বর্ষসেরার বিচারকের যেকোনো একটা পক্ষ ভুল।
কেস স্টাডি – ২
২০১০ সাল থেকে ফিফা আর ব্যালন কমিটি একসাথে হয়ে পুরস্কার দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, এবং প্রথম বছরের সেই শিরোপাটা জিতে নেন লিওনেল মেসি। সিদ্ধান্তটা অনেকের কাছেই মনঃপুত হয় নি। মেসি সেই বছর লা লিগা এবং স্প্যানিশ সুপার কাপ জেতেন, কিন্তু বিশ্বকাপের কোয়ার্টার থেকে বাদ পড়েন। ২০১০ বিশ্বকাপে মেসি গড়পড়তা পারফর্ম করেন, পুরো টুর্নামেন্টে একটা গোলও করতে পারেননি।
বিশ্বকাপের বছরগুলোতে সচরাচর বিশ্বকাপে ভালো পারফর্ম করা খেলোয়াড়গুলো এগিয়ে থাকে। সেই বছরের চ্যাম্পিয়ন দল স্পেন থেকে জাভি এবং ইনিয়েস্তা ভালো পারফর্ম করলেও স্পেনের বিশ্বজয়ের পেছনে এককভাবে কাউকে কৃতিত্ব দেয়া উচিত হবে না। অবশ্য জাভি এবং ইনিয়েস্তা বার্সেলোনার হয়ে ঘরোয়া লিগেও যথেষ্ট ভালো খেলেছিলেন। কিন্তু কোনো এক বিচিত্র কারণে পেছনে পড়ে গিয়েছিলেন স্নাইডার।
সেই বিশ্বকাপে স্নাইডারের পারফর্মেন্সটা একটু খেয়াল করা যাক,
-
গ্রুপপর্ব : গ্রুপ স্টেজে ডেনমার্ক আর জাপানের বিরুদ্ধে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হন, গোল করেন দু’টি।
-
দ্বিতীয় পর্ব : দ্বিতীয় রাউন্ডে স্লোভাকিয়ার সাথে ২-১ গোলে জেতা ম্যাচে ১ গোল করেন।
-
কোয়ার্টার ফাইনাল : কোয়ার্টারে ব্রাজিলের বিরুদ্ধে ১ গোলে পিছিয়ে পড়ার পর স্নাইডারের করা দুই গোলে ম্যাচটা জেতে নেদারল্যান্ড। ফলশ্রুতিতে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হন স্নাইডার।
-
সেমিফাইনাল : উরুগুয়ের বিরুদ্ধে ৩-২ গোলে জেতা ম্যাচে ১ গোল করেন এবং ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হন।
-
ফাইনাল : স্পেনের কাছে ১-০ গোলে হারে নেদারল্যান্ড।
টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ ৫টি গোল করার পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে তিনটি ম্যাচে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হন, যার মাঝে একটি ছিল শক্তিশালী ব্রাজিলের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচ। এত দুর্দান্ত পারফর্ম করার পরও স্নাইডার বিশ্বকাপের গোল্ডেন বলটা পাননি, সিলভার বল পেয়েছিলেন।
শুধু বিশ্বকাপ নয়, ক্লাব ফুটবলেও সেই মৌসুমে স্নাইডার অসাধারণ ছিলেন। ইন্টার মিলানের হয়ে সেই মৌসুমে ট্রেবল জেতেন স্নাইডার। সেই বছর মোট শিরোপা জেতেন ৫টি, ইতালিয়ান সিরি আ, ইতালিয়ান কাপ, ইতালিয়ান সুপার কাপ, চ্যাম্পিয়নস লিগ, আর ক্লাব বিশ্বকাপ। স্নাইডার শুধু কাপজয়ী দলের সদস্য ছিলেন না, বরং প্রায় প্রতিটি কাপ জয়ে তার সক্রিয় অবদান ছিল। সেই মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সর্বোচ্চ অ্যাসিস্ট (৬টি) ছিল স্নাইডারের। এছাড়া চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের ফ্যানদের ম্যান অব দ্য ম্যাচ পুরষ্কারও পান স্নাইডার।
ক্লাবের এমন পারফর্মেন্সের পর বিশ্বকাপে রানার্সআপের পাশাপাশি সিলভার বল, ফিফা ব্যালন ডি’অর জেতার জন্য আর ঠিক কোন কাজটা করতে হতো তাকে (জেতা দূরে থাক, তিনি সেরা তিনেও আসেননি), সেটা ফুটবল ফ্যানদের কাছে আজীবন প্রশ্নই থেকে যাবে।
কেস স্টাডি – ৩
২০১৬ ফিফা বর্ষসেরার প্রথম তিনে ছিলেন মেসি, ক্রিস্টিয়ানো এবং গ্রিজমান। অনুমিতভাবেই তৃতীয় হয়েছিলেন গ্রিজ্জি। গোল অ্যাসিস্ট কিংবা শিরোপা সংখ্যাতেও বাকি দুইজনের চেয়ে পেছনে ছিলেন তিনি। অথচ বাকি দুইজনকে টপকে বর্ষসেরার পুরস্কার গ্রিজ্জি জিতে গেলেও সেটাকে অমূলক বলা যেত না, বরং অন্য কিছু বিচারকের রায় অনুযায়ী গ্রিজ্জির পুরস্কার না জেতাটাই অন্যায় হয়েছে। কীভাবে, সেটা একটু দেখা যাক।
একজন খেলোয়াড়কে নির্দিষ্ট বছরের বর্ষসেরা পুরষ্কার পেতে হলে কী করতে হবে? মূল টুর্নামেন্টগুলোতে তুলনামূলকভাবে ভালো করতে হবে। মূল টুর্নামেন্টগুলো কোনটা ধরা যায়? লিগ (এখানে আবার প্রাধান্য পাবে স্প্যানিশ, ইংলিশ, জার্মান, ইতালিয়ান), চ্যাম্পিয়নস লিগ আর সেই বছর যদি কোনো বড় ধরণের আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট হয়, সেগুলোকে। সেই বছরের তিনটা বড় টুর্নামেন্টে মেসি এবং ক্রিসের সাথে গ্রিজমানের একটা তুলনা করা যাক।
স্প্যানিশ লিগ
তুলনা করার জন্য সবচেয়ে ভালো একটা টুর্নামেন্ট। কারণ, তিনজন খেলোয়াড়ই এই টুর্নামেন্টে খেলেছেন। সেই বছর স্প্যানিশ লিগের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পেয়েছেন গ্রিজমান। সেই বিচারকেরাও জানতেন যে, গোলসংখ্যায় মেসি কিংবা রনের চেয়ে গ্রিজমান পিছিয়ে। শিরোপাও পাননি, তারপরও কিন্তু সেরা খেলোয়াড় গ্রিজমানই হয়েছেন। বিচারকদের কাছে হয়তো মনে হয়েছিল, এটিএম-এর মতো দলকে শিরোপা জেতাতে না পারলেও যত দূর টেনে নিয়ে এসেছিলেন, সেটা বার্সেলোনার হয়ে শিরোপা জেতা মেসির চাইতে ভালো পারফর্মেন্স।
ইউরো কাপ/ কোপা আমেরিকাঃ
ক্রিসের চেয়ে গ্রিজমান ভালো ছিলেন ইউরোতে, সেটা মনে হয় না বললেও চলে। গোল্ডেন বুট, গোল্ডেন বল দুটি পুরষ্কারই পেয়েছেন গ্রিজমান। কোপাতে মেসির পারফর্মেন্সও মুগ্ধ করা ছিল, ফাইনালেও খেলেছিলেন। কিন্তু গোল্ডেন বল জিতেছিলেন সানচেজ। দুই টুর্নামেন্টের পারফর্মেন্স তুলনা করা একটু কঠিন, তবুও গ্রিজমানকেই মেসির চেয়ে মনে হয় একটু এগিয়ে রাখা যায়।
যেকোনো বোদ্ধারাই কোপার চেয়ে ইউরোর পারফর্মেন্সকে একটু এগিয়ে রাখবে। তাছাড়া আর্জেন্টিনার হয়ে মেসির প্রতিপক্ষের তুলনায় ফ্রান্সের হয়ে গ্রিজমানের প্রতিপক্ষরা মনে হয় একটু সবল ছিল। টপ ফেভারিট জার্মানিকে ২-০ গোলে হারানো ম্যাচের দু’টি গোলই করেন গ্রিজমান। মেসির ফাইনালিস্টের বিপরীতে গ্রিজমানের গোল্ডেন বল আর গোল্ডেন বুট, এখানেও সম্ভবত মেসি বা ক্রিসের চেয়ে গ্রিজমানকেই একটু এগিয়ে রাখা যায়।
চ্যাম্পিয়নস লিগ
সেই বছর মেসি বাকি দু’জনের চেয়ে একটু পিছিয়ে ছিলেন। বার্সাকে কোয়ার্টারে আউট করে দেয়ার পেছনে তো গ্রিজমানের ভূমিকাও অনেক। চ্যাম্পিয়নস লিগের পারফর্মেন্স অনুযায়ী, মেসির চেয়ে নিশ্চিতভাবেই এগিয়ে থাকবেন গ্রিজমান। বাকি থাকলেন ক্রিস। গোল কিংবা অ্যাসিস্টের সংখ্যায় ক্রিসের চেয়ে গ্রিজমান পিছিয়ে থাকলেও রিয়াল মাদ্রিদের চাইতে এটিএম দল হিসেবে কিছুটা কম শক্তিশালী হওয়ায় গ্রিজম্যানই কিছুটা হলেও এগিয়ে থাকার কথা।
এখন মূল কথায় আসা যাক। বড় তিনটা আসরের দু’টিতেই বিজ্ঞ প্যানেলের বিচারেই গ্রিজমান বাকি দু’জনের চেয়ে এগিয়ে থাকেন। চ্যাম্পিয়নস লিগে যেহেতু সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার দেয়া হয়নি, তাই সরাসরি বলা উচিত নয়। তবুও মেসির চেয়ে গ্রিজমান এগিয়ে ছিলেন, সেটা বলাই যায়।
হ্যা, সেই মৌসুমে মেসি তিনটি কাপ এবং ক্রিস দু’টি কাপ জিতেছেন, সত্যি। এর মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, লা লিগা জেতার পরেও বিচারকেরা মনে করেছেন, মেসির চেয়ে গ্রিজমানই সেই টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়। বাকি দুই কাপই মর্যাদার ভিত্তিতে অনেক ছোট। ক্রিস ইউরো জেতার পরও সেই টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় গ্রিজমান।
কিন্তু এরপরেও বর্ষসেরায় মেসি ক্রিসের পেছনে থেকে তৃতীয় হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে গ্রিজমানকে।
৩.
ব্যালন ডি’অর অনেক আগে থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ। এক সময় তো শুধু ইউরোপিয়ান খেলোয়াড়দেরকে পুরষ্কারের বিবেচনায় আনা হতো, তার তুলনায় ফিফা বর্ষসেরা কিছুটা বিতর্কহীন ছিল। ১৯৯১ সাল থেকে ফিফা বর্ষসেরা পুরষ্কারের প্রচলন হয়। সেই সময় থেকে ২০০৯ পর্যন্ত ১৯ বার পুরস্কারের ক্ষেত্রে ফিফাজয়ীর সাথে ব্যালনজয়ীর পার্থক্য হয়েছে ৭ বার, বাকি ১২ বারই বিজয়ীর নামটা একই ছিল।
তবে সমস্যাটা এটা নয়, সমস্যা হচ্ছে বাছাই করার পদ্ধতিতে। শুরুর দিকে ফিফা বর্ষসেরা পুরস্কারের জন্য সকল জাতীয় দলের কোচদের ভোট গ্রহণ করা হতো। এতে প্রত্যেকে তিনটি করে ভোট দিতে পারতেন। প্রথম পছন্দের জন্য ৫ পয়েন্ট, দ্বিতীয় পছন্দের জন্য ২ আর ৩য় পছন্দের জন্য ১ পয়েন্ট ধরে খেলোয়াড়দের মোট পয়েন্ট হিসেব করা হতো। ২০০৩ সাল পর্যন্ত এই নিয়ম চালু ছিল। ২০০৪ সাল থেকে নিয়মে পরিবর্তন আনা হয়, এই বছর থেকে জাতীয় দলের কোচদের সাথে সাথে অধিনায়কেরাও ভোট দেওয়ার সুযোগ পান। এতেও প্রত্যেকে তিনটি করে ভোট দিতে পারতেন। প্রথম পছন্দের জন্য ৫ পয়েন্ট, দ্বিতীয় পছন্দের জন্য ২ আর ৩য় পছন্দের জন্য ১ পয়েন্ট ধরে খেলোয়াড়দের মোট পয়েন্ট হিসেব করা হতো।
২০০৯ সাল থেকে যখন ফিফা ব্যালন ডি’অর নামে পরিচিত হয় পুরস্কারটি, তখন থেকে কোচ আর অধিনায়কদের সাথে মিডিয়ার বিভিন্ন সাংবাদিকদের ভোটও হিসেবে আনা হয়।
২০১৬ সালে আবার ফিফা আর ব্যালন ডি’অর আলাদা হয়ে যায়। সেই বছর থেকে জাতীয় দলের কোচ, অধিনায়ক, সাংবাদিকদের ভোটের সাথে সাথে সাধারণ মানুষদের ভোটও গ্রহণ করা হয়। সাধারণ মানুষদের এই ভোটিং অনলাইনে গ্রহণ করা হয়। এই চার রকমের ভোটের প্রতিটিকে ২৫% করে মোট হিসেব করা হয়।
এত বড় একটা আয়োজন, অথচ সেটা কি না নির্বাচিত হচ্ছে ভোটিংয়ের মাধ্যমে। যেখানে ভোট হবে, সেখানেই স্বজনপ্রীতি হবার সুযোগ থাকবে। এখানে শুধু পারফর্মেন্স না, ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দও কাজ করে। সাধারণ মানুষ তো এটা করেই, এর সাথে সাথে বড় বড় খেলোয়াড়-কোচও করে থাকেন। ব্যালনের ক্ষেত্রে পাবলিক ভোটিং না হলেও খুব কম সাংবাদিকই নিরপেক্ষভাবে ভোট দেন।
ভোটিংয়ের আরেকটা সমস্যা হচ্ছে, এখানে ইমেজ ভ্যালুটা খুবই প্রভাব বিস্তার করে। খেলার বাইরে ক্রিস আর মেসি ইমেজের সৌজন্যে গত কয়েকটি মৌসুমে কিছুটা সুবিধা পেয়েছেন। ওদের দুইজনেরই কিছু অংশ ভোটের নির্বাচনের আগেই দখলে থেকে যায়, মানে হচ্ছে ওদের ক্লাবের সতীর্থ বা আগের ক্লাব সতীর্থ, যারা অধিনায়ক কিন্তু ফ্রেন্ড। ঐ অংশটাতে ৩য় প্লেয়ারটা যে-ই হোক, পিছিয়ে যেত।
ইব্রাহিমোভিচ নাকি একটানা পাঁচ বছরের ভোটেই প্রথম নামটায় মেসিকে রেখেছে। সেই পাঁচ বছরই কি মেসি প্রথম হবার যোগ্য ছিলেন? কোনোবারেই কি অন্য কাউকে রাখা যেত না? কেউ কেউ আবার ক্রিসকেও টানা পাঁচ বছর এক নম্বরে রেখেছেন। অনেকে আবার ব্যক্তিগত অপছন্দের কারণে মেসি অথবা ক্রিসকে সেরা তিনেই রাখেননি। কেউ কেউ আবার মেসিকে রাখলে ক্রিসকে রাখেননি, অনেকে ক্রিসকে রাখলে মেসিকে রাখেননি।
পুরষ্কারটা হওয়া উচিত বছরের পারফর্মেন্স হিসেব করে, কারো ব্যক্তিগত পছন্দের উপর নির্ভর করে না।
৪.
যেকোনো নির্বাচনের পদ্ধতিটা এমন হওয়া উচিত, যেন সেটা সব যুগেই মোটামুটি গ্রহণযোগ্যতা পায়। ভোটিংয়ের ফলে ২০১০ সালের মানুষ যেভাবে ভাববে, ১৯৫০ সালের মানুষের ভাবনা সেরকম না-ও হতে পারে। অথচ কোনো নিয়ম থাকলে সেটা সব যুগের মানুষই মেনে নিতে বাধ্য। নিয়মটাও সময়ের সাথে সাথে সংস্কার হতে পারে।
সবচাইতে ভালো হতো পয়েন্ট সিস্টেম রাখলে। গোল, অ্যাসিস্ট, কী-পাস, ট্যাকল, সেভ, পেনাল্টি সেভ করতে পারলে পয়েন্ট, আবার কার্ডে পয়েন্ট লেস। এতে কিপার কিংবা ডিফেন্ডারদেরও ভাল সুযোগ থাকে। আর ফুটবল মানেই শুধু গোল নয়, ট্যাকল, সেভ, মিড কন্ট্রোলও অনেক বড় বিষয়।
ম্যাচের গুরুত্বও একটা বিষয় হতে পারে। মালাগার সাথে লিগে হ্যাটট্রিক করার চেয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার অথবা সেমিতে একটি অ্যাসিস্টের পয়েন্টও বেশি হতে পারে। নকআউট স্টেজে পেনাল্টি সেভিং ও গোলকিপারকে বাড়তি পয়েন্ট দিতে পারে। ম্যাচের পরিস্থিতিও বিবেচ্য বিষয় হতে পারে। দল ২ গোলে এগিয়ে থাকার পর গোল করলে যে মূল্য, ১ গোলে পিছিয়ে থাকার পর করলে তার মূল্য তুলনামূলকভাবে বেশি হবার কথা।
এভাবে সবগুলো ছোটখাটো বিষয়গুলোকেও যতটা সম্ভব বিবেচনায় নিয়ে আসা উচিত।
ফুটবলটা যেহেতু সায়েন্স নয়, তাই শুধুমাত্র পয়েন্ট সিস্টেম দিয়ে পুর্ণাঙ্গ ফলাফল পাওয়া সম্ভব নয়। পয়েন্ট সিস্টেম দিয়ে প্রাথমিক বাছাইয়ের পর ভোটিং করা যেতে পারে। তবে প্রতিটা ভোটারের ভোট দেয়ার সময় তার নির্বাচনের কারণ লিখে দিতে বললে দায়িত্ববোধ হয়তো কিছুটা বাড়বে। ঠিকমতো কারণ লিখতে না পারলে তার ভোটাধিকার কেড়ে নেয়ার বিধানও রাখা যেতে পারে।
আমরা বছরের সবচেয়ে ভালো পারফর্মেন্স করা খেলোয়াড়কে খুজে বের করতে চাই, সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলোয়াড় নয়। এবং চেষ্টা থাকা উচিত, প্রতি বছর যেন নির্বাচন প্রক্রিয়া মোটামুটি একই রকম থাকে।
এভাবে নির্বাচন করলে বিতর্কটা কম হবার কথা। নয়তো প্রতি বছরেই পক্ষপাত দুষ্টের অভিযোগ উঠলে সেটা খণ্ডানো কঠিন হয়ে যাবে।