‘ম্যাচ ফিক্সিংয়ের কথা আপনারা শিগগিরই জানতে পারবেন। চিন্তা কইরেন না, ওগুলো আসতেছে।’
বক্তার নাম নাজমুল হাসান পাপন। ক্রিকেটাররা ধর্মঘট (২১ অক্টোবর) ঘোষণা করার পর দিনই সংবাদ সম্মেলনে এমন মন্তব্য করেছিলেন বিসিবি সভাপতি।
এক সপ্তাহ পরই ফিক্সিংয়ের বিষবাষ্প কাঁপিয়ে দিল বাংলাদেশের ক্রিকেট। অবিশ্বাস্য, অপ্রত্যাশিত খবর এক লহমায় যেন ওলট-পালট করে দিল অনেক কিছু। ভারতীয় জুয়াড়ি দীপক আগারওয়ালের কাছ থেকে ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব পাওয়ার পরও আইসিসির অ্যান্টি করাপশনাল ইউনিটকে (এসিইউ) জানাতে ভুলে গিয়েছিলেন সাকিব আল হাসান। নিয়ম অনুযায়ী, এমন প্রস্তাব পাওয়ামাত্রই আইসিসি বা সংশ্লিষ্ট ক্রিকেট বোর্ডের এসিইউ’র কর্মকর্তাদের জানাতে হয় ক্রিকেটারদের, যা নির্ভুলভাবে অতীতে দুইবার (সাকিবকে নিয়ে আইসিসির দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ের তথ্য অনুযায়ী ২০০৮ ও ২০০৯ সাল) করে এসেছেন বিশ্বসেরা এই অলরাউন্ডার।
এবার অস্পষ্ট কারণে জুয়াড়ির প্রস্তাবের বিষয়ে রিপোর্ট করেননি বিসিবি বা আইসিসির এসিইউ’র কাছে। প্রাথমিকভাবে এসিইউ’কে না জানানোটা সাকিবের বড় ভুল হিসেবেই প্রতীয়মান হচ্ছে। বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকাকে নিয়ে প্রায় ৮ মাস তদন্ত করেছে এসিইউ। ২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি ও ২৭ আগস্ট দুই দফা সাকিবকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে এসিইউ’র কর্মকর্তারা।
তদন্তে ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব পাওয়ার বিষয়টি এসিইউকে না জানানো সম্পর্কে নিজের ভুল স্বীকার করেছেন সাকিব। তিনবার প্রস্তাব পেয়েও এসিইউকে অবহিত না করায় ২ বছরের জন্য সাকিবকে নিষিদ্ধ করেছে আইসিসি। মঙ্গলবার (২৯ অক্টোবর, ২০১৯) সন্ধ্যায় আইসিসি এই শাস্তি ঘোষণা করেছে।
তবে আপাতত সব ধরনের ক্রিকেট থেকে ১ বছর দূরে থাকতে হবে এই বাঁহাতি অলরাউন্ডারকে। এই সময়ে তার কর্মকাণ্ড সন্তোষজনক হলে ২০২০ সালের ২৯ অক্টোবরের পর ক্রিকেটে ফিরতে পারবেন তিনি। সঙ্গে আইসিসির পর্যবেক্ষণের মধ্যে থাকবেন তিনি। পর্যবেক্ষণের সময়কালে একই অপরাধ করলে নিষিদ্ধ হতে পারেন ৫ বছরের জন্য।
জুয়াড়ির প্রস্তাব পাওয়া নিয়ে সাকিবের বিষয়ে তদন্ত, তার অপরাধ, স্বীকারোক্তি, জুয়াড়ির সঙ্গে তার টেক্সট বিনিময়সহ (ক্ষুদে বার্তা) সবকিছু সবিস্তারে লেখা আছে আইসিসির পাঠানো পূর্ণাঙ্গ রায়ে। যেখানে জুয়াড়ি দীপক আগারওয়ালকে পাঠানো বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়কের কিছু টেক্সটও আঁতকে উঠার মতো, যা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে বিশ্ব ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থা। রোর বাংলা’র পাঠকদের জন্য জুয়াড়ি ও সাকিবের টেক্সট বিনিময় ও পূর্ণাঙ্গ রায়ের অংশ বিশেষ তুলে ধরা হলো।
ঘটনার পটভূমিকা
১) সাকিব আল হাসানকে ঢাকায় দুই দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করে এসিইউ। তারিখ ছিল যথাক্রমে ২৩ জানুয়ারি ২০১৯ এবং ২৭ আগস্ট ২০১৯। এই সময়ে সাকিব আল হাসানকে চলমান তদন্ত এবং আইসিসির তালিকাভুক্ত জুয়াড়ি দীপক আগারওয়ালের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
২) জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় সাকিবকে আগেই জানিয়ে দেওয়া হয় যে, তার দেয়া প্রতিটি উত্তর প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হবে, তদন্ত করার সময় সেটা হতে পারে সরাসরি ম্যাচ ফিক্সিংয়ের জন্য, অথবা তথ্য গোপনের জন্য। সাকিব বিষয়টা মেনে নিয়েই প্রশ্নের উত্তর দেন।
৩) জিজ্ঞাসাবাদের সময় সাকিব স্বীকার করেন, তিনি আইসিসির দুর্নীতিবিরোধী ‘কোড অফ কনডাক্ট’ সম্পর্কে পুরোপুরিভাবে অবগত, এবং এটাও জানান যে, তিনি জানেন উক্ত ‘কোড অফ কনডাক্ট’ ভাঙা হলে একজন ক্রিকেটারকে শাস্তি পেতে হতে পারে।
৪) সাকিব এটাও স্বীকার করেন যে, এসিইউকে রিপোর্ট করতে ব্যর্থ হয়ে তিনি দুর্নীতিবিরোধী ধারা ভঙ্গ করেছেন।
জুয়াড়ি দীপকের সঙ্গে সাকিবের টেক্সট বিনিময়
৫) এসিইউ-এর জিজ্ঞাসাবাদে সাকিব নিম্নোক্ত বিষয়াবলী স্বীকার করে নেন:
৫.১) ২০১৭ সালের নভেম্বরে ঢাকা ডায়নামাইটসের সদস্য ছিলেন তিনি (সাকিব)। এই দলটি সেই বছর ৪ নভেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) খেলেছে।
৫.২) তিনি জানতেন, তার ফোন নম্বর (দীপক) আগারওয়ালকে তারই পরিচিত এক ব্যক্তি দিয়েছিলেন। আগারওয়ালই ওই ব্যক্তিকে বিপিএলে খেলা অন্যান্য ক্রিকেটারদের নম্বর সরবরাহ করতে বলেছিলেন।
৫.৩) ২০১৭ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি আগারওয়ালের প্ররোচনায় তার সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বার্তা আদান-প্রদান করেছিলেন। ওইসব বার্তায় আগারওয়ালের সঙ্গে দেখাও করতে চেয়েছিলেন সাকিব।
৫.৪) ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও জিম্বাবুয়ের মধ্যকার ত্রিদেশীয় সিরিজে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশ দলে ছিলেন তিনি (সাকিব)। এই সিরিজের সময় তিনি ও আগরওয়াল আবারও হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে কথা বলেন।
৫.৫) ২০১৮ সালের ১৯ জানুয়ারি আগারওয়ালের কাছ থেকে একটি হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা পান তিনি (সাকিব)। সেই বার্তায় ওইদিনের খেলায় ‘ম্যান অফ দ্য ম্যাচ’ নির্বাচিত হওয়ায় তাকে অভিনন্দন জানানো হয়। এই বার্তার ধারাবাহিকতায় অন্য এক বার্তায় আগারওয়াল বলেন,
‘Do we work in this, or I wait til the IPL?’
৫.৬) এই মেসেজে ‘work’ বলতে তাকে আগারওয়ালের কাছে অভ্যন্তরীণ তথ্য (ম্যাচের) সরবরাহের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়।
৫.৭) আগারওয়ালের দিক থেকে এই যোগাযোগের কথা তিনি এসিইউ কিংবা অন্য কোনো দুর্নীতি দমন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রকাশ করেননি।
৫.৮) ২০১৮ সালের ২৩ জানুয়ারি তিনি আবারও আগারওয়ালের কাছ থেকে হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা পান। তাতে আগারওয়াল তাকে আবারও অভ্যন্তরীণ তথ্য সরবরাহের প্রস্তাব দিয়ে বলেন,
‘ভাই, এই সিরিজে কিছু হবে?’
৫.৯) তিনি (সাকিব) স্বীকার করেন, এই বার্তাটি ছিল তখনকার চলমান ত্রিদেশীয় সিরিজ নিয়ে আগারওয়ালের (অভ্যন্তরীণ) তথ্য চাওয়ার প্রস্তাব।
৫.১০) আগারওয়ালের চাওয়া এই অভ্যন্তরীণ তথ্যটির ব্যাপারেও সাকিব এসিইউ বা অন্য কোনো দুর্নীতিবিরোধী কর্তৃপক্ষকে কিছু জানাননি।
৫.১১) ২০১৮ সালের ২৬ এপ্রিল তিনি (সাকিব) আইপিএলে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের বিপক্ষে খেলতে নামেন।
৫.১২) খেলার দিন আগারওয়ালের কাছ থেকে সাকিব একটি হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা পান, যেখানে আগারওয়াল তার কাছে ‘নির্দিষ্ট’ এক ক্রিকেটারের ব্যাপারে জানতে চান যে, তিনি সেদিনের ম্যাচ খেলবে কি না। অর্থাৎ আরও একবার অভ্যন্তরীণ তথ্য জানতে চান তিনি।
৫.১৩) আগারওয়াল তার এই আলোচনা অব্যাহত রাখেন, বিটকয়েন-ডলার অ্যাকাউন্ট নিয়ে কথা বলেন, এবং সাকিবের ডলার অ্যাকাউন্টের ব্যাপারে জানতে চান। এই পর্যায়ে সাকিব আগারওয়ালকে বলেন, তিনি আগে তার সঙ্গে ‘সাক্ষাৎ’ করতে চান।
৫.১৪) ২০১৮ সালের ২৬ এপ্রিলের এই বার্তাগুলোর সঙ্গে অনেকগুলো মুছে ফেলা বার্তাও পাওয়া যায়। সাকিব নিশ্চিত করেন, এর মধ্যে ভেতরের খবর জানতে চাওয়ার অনুরোধমূলক বার্তাও ছিল।
৫.১৫) সাকিব নিশ্চিত করেন, আগারওয়ালকে তিনি একজন ‘ফন্দিবাজ’ হিসেবেই চিনতেন, আর আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে বুঝে যান, ওই ব্যক্তি একজন বুকি।
৫.১৬) ২৬ এপ্রিল আগারওয়ালের কাছ থেকে পাওয়া প্রস্তাব ও কথোপকথনের ব্যাপারেও এসিইউ বা অন্য কোনো দুর্নীতিবিরোধী কর্তৃপক্ষকে কিছু জানাননি সাকিব।
৬) সাকিব এসিইউকে বলেন, আগারওয়ালের কাছে পাওয়া কোনো প্রস্তাব তিনি গ্রহণ করেননি। তার কথামতো কোনো কাজ করেননি। তার অনুরোধ মেনে তাকে কোনো তথ্যও দেননি। আগারওয়ালের কাছ থেকে কোনো অর্থ বা অন্য কোনো পুরস্কারও নেননি। তবে, তিনি এইসব আলাপের বিষয়ে কখনো এসিইউ কিংবা অন্য কোনো দুর্নীতিবিরোধী কর্তৃপক্ষকে কিছু জানাননি।
পাদটীকা
বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার শুধু নন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দুই দফা বাংলাদেশ জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব করেছেন সাকিব। দেশের হয়ে তিন ফরম্যাটে ৩৩৮ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন তিনি, যার মধ্যে ২০৬টি ওয়ানডে, ৫৬টি টেস্ট ও ৭৬টি টি-টোয়েন্টি রয়েছে। ২০০৬ সালের আগস্টে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার অভিষেক।
এক যুগের লম্বা ক্যারিয়ারে আইসিসির অনেক টুর্নামেন্ট খেলেছেন, প্রতিটি সিরিজ-টুর্নামেন্টের আগে দুর্নীতিবিরোধী সেমিনার, মিটিংয়ে অংশ নিয়েছেন সাকিব। অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় হলেও নিমর্ম সত্য যে, পরপর তিনবার জুয়াড়ি দীপক আগারওয়ালের প্রস্তাবের পরও যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানাননি তিনি। দীপক আগারওয়াল জুয়াড়ি বুঝতে পারার পরও আলাপ চালিয়ে গেছেন সাকিব। তার সঙ্গে দেখা করতেও চেয়েছেন তিনি।
‘নন্দিত’ ক্রিকেটার সাকিব ‘নিন্দিত’ হয়ে পড়েছেন মূলত ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব পাওয়ার তথ্য গোপন করেই।