বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ও বিভিন্ন উপকথার বরাত দিয়ে আমরা প্রায়ই মানুষরূপী নানা উদ্ভট জন্তুর নাম শুনেছি। মনে করুন, একটি বিজ্ঞানাগারে মানুষ ও অন্যান্য নানা প্রজাতির প্রাণীর ডিএনএ দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে অদ্ভুত সব কদাকার মানুষরূপী পশু। কোনো এক গোপন গবেষণার কাজে এগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে। হঠাৎ এদের মধ্য থেকে একটি হাইব্রিড পশু বিজ্ঞানাগার থেকে পালিয়ে গেল। সেটি লোকালয়ে প্রবেশ করে প্রচুর তান্ডব শুরু করতে লাগলো।
এই ধরনের কাহিনীর উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর শেষ নেই। তাছাড়া বিভিন্ন পুরাণ ও ধর্মশাস্ত্রেও এমন কদাকার প্রাণীর নমুনা রয়েছে। এই ধরুন সেন্টরের কথা। গ্রিক পুরাণের অর্ধেক ঘোড়া ও অর্ধেক মানুষের অবয়ব ধারণ করা এই চরিত্রটি সম্পর্কে আমরা সবাই কম-বেশি জানি। কিন্তু বাস্তবে কী এমন মানুষ আর অন্য কোনো প্রাণীর হাইব্রিড তৈরি করা আসলেই সম্ভব? আর সম্ভব হলেও এগুলো তৈরি করা কী নৈতিকতা বহির্ভূত একটা কাজ হবে না ?
বর্তমানে জীববিজ্ঞান ও জেনেটিক প্রকৌশল বিষয়ক গবেষণা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে তা সাধারণ জনগণ কল্পনাও করতে পারবে না। স্টেম সেল ব্যবহার করে মানুষ ও অন্য কোনো প্রাণীর হাইব্রিড ভ্রূণ তৈরি করা এখন সত্যি সত্যিই সম্ভব। এই ধরনের গবেষণার সাথে নৈতিকতার একটা ব্যাপার সবসময় জড়িত থাকে। এ কারণে এ বিষয়ে গবেষকরা খুব একটা খোলাসা করতে চান না। তাছাড়া বেশিরভাগ দেশেই এই ধরনের গবেষণাকে সরাসরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
সম্প্রতি জাপান সরকার তাদের বিজ্ঞান বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মানুষ ও অন্য প্রাণীর এই হাইব্রিড ভ্রূণ তৈরির গবেষণার উপর নিষেধাজ্ঞাটি তুলে দিয়েছে। সরকারের এমন একটি সিদ্ধান্তের কারণে সেই দেশের বিজ্ঞান মহলে তুমুল আলোচনা ও সমালোচনার সূত্রপাত ঘটে।
জাপানে সর্বপ্রথম হাইব্রিড ভ্রূণের এই গবেষণাটি করার ছাড়পত্র পেয়েছেন উক্ত দেশের জীববিজ্ঞানী ও জেনেটিক প্রকৌশলী হিরোমিতশু নাকুচি। তিনি এর আগে জাপানের ইউনিভার্সিটি অফ টোকিও ও আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ স্ট্যানফোর্ডের বিভিন্ন গবেষণা দলের নেতৃত্বে নিয়োজিত ছিলেন। নেচার সাময়িকীতে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, নাকুচির পরিকল্পনা হলো ইঁদুর ও মানুষের হাইব্রিড ভ্রূণ নিয়ে গবেষণা করা। আর এই গবেষণার পেছনে মূল উদ্দেশ্য হলো মানবদেহের জন্য প্রতিস্থাপনযোগ্য অঙ্গ সৃষ্টি করা। সহজ কথায়, অরগান ট্রান্সপ্ল্যান্টের জন্য অন্য প্রাণীর দেহে মানুষের অঙ্গ তৈরি করা।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির ফলে এখন নষ্ট হয়ে যাওয়া কিডনি কিংবা দুর্বল হৎপিণ্ডের ট্রান্সপ্লান্ট বা প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। কিন্তু এসব অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য অন্য কোনো সুস্থ অঙ্গের জোগান দেওয়া অনেক কঠিন একটা ব্যাপার। প্রতিস্থাপনযোগ্য অঙ্গের অভাব ও এগুলোর উচ্চমূল্যের কারণেই মূলত এই হাইব্রিড ভ্রূণ তৈরির গবেষণাটিকে সমর্থন করা হয়েছে।
বিশ্বের নানা দেশে এমন বৈজ্ঞানিক গবেষণা পুরোপুরি নিষিদ্ধ। এই দেশগুলোর দলে জাপান থাকলেও কিছু বিশেষ নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে সরকার নিয়ন্ত্রন ক্ষমতার মধ্যে রেখে এমন গবেষণার অনুমোদন দিয়েছে। যথারীতি সর্বপ্রথম অনুমোদিত প্রজেক্টের দায়িত্ব নিয়েছেন হিরোমিতশু নাকুচি। আশাহি সিম্বান নামক এক জাপানিজ দৈনিকে তিনি এ বিষয়ে কথা বলেছেন।
আমরা শীঘ্রই প্রতিস্থাপনযোগ্য অঙ্গ তৈরির আশা করছি না। কিন্তু এই অনুমোদন আমাদের আরো উন্নতমানের গবেষণা করার রাস্তা তৈরি করে দিয়েছে। আমরা বর্তমানে এমন এক অবস্থানে আছি যে, অবশেষে ১০ বছর ধরে নেওয়া প্রস্তুতির প্রেক্ষিতে গভীরভাবে নিজেদের গবেষণায় মনোযোগ দিতে পারবো।
এখন এই হাইব্রিড জীব তৈরির প্রক্রিয়া ব্যাখা করা যাক। গবেষণায় মূলত প্রাথমিকভাবে ইঁদুর ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আর যে অঙ্গটি তৈরির পরীক্ষা করা হবে তা হলো অগ্ন্যাশয়। এখন মানবদেহের যে অংশটি কাজে লাগানো হবে তা হলো হিউম্যান-ইনডিউজড প্লুরিপোটেন্ট স্টেম সেল। এই বিশেষ ধরনের কোষের সাথে ইঁদুরের নিষিক্ত ডিম্বানুর সংমিশ্রণ ঘটানো হবে। এরপর উক্ত ডিম্বানুকে এক স্বাস্থ্যকর জরায়ু বা ইঁদুরের গর্ভে স্থাপন করা হবে। এ সময় ইঁদুরটি নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকবে।
এত সহজেই যে হাইব্রিড জীব তৈরি হয়ে যাবে তা কিন্তু নয়। কারণ গবেষকদের আরো বেশ কিছু ক্ষেত্রে অনুমোদন পাওয়া বাকি রয়েছে। নাকুচি নিজেও পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, এই গবেষণায় তিনি ধীরে সুস্থে ও সময় নিয়ে এগোতে চান।
জাপানের হোকাইদো বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈজ্ঞানিক নীতি প্রণয়ন বিষয়ক গবেষক টেটসুয়া ইশি এ ব্যাপারে তার নিজস্ব মতামত প্রকাশ করেন।
এ গবেষণায় ধাপে ধাপে সতর্কতার সাথে এগিয়ে যাওয়াই ভালো। তাহলে সাধারণ জনগণের কাছে এই গবেষণাটি ব্যাখা করা সহজ হবে। যেহেতু তারা এ বিষয়ে বেশ উদ্বিগ্ন।
নাকুচি বলেছেন, তিনি হাইব্রিড ইঁদুরের ভ্রূণগুলোকে সর্বোচ্চ ১৪.৫ দিন পর্যন্ত বড় হওয়ার সুযোগ দেবেন। এই সময়ের মাঝেই মোটের উপর যাবতীয় অঙ্গসমূহ পুরোপুরি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। এরপর তিনি একই পরীক্ষা পুনরায় করবেন ভিন্ন প্রজাতির ইঁদুর ব্যবহার করে। এ ধরনের ইঁদুরগুলোর ভ্রূণ পুরোপুরি গড়ে উঠতে সর্বোচ্চ ১৫.৫ দিন পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। এভাবে তিনি পূর্ণমেয়াদী গবেষণা চালিয়ে যাবেন।
উক্ত গবেষণা সফল হলে নিকুচির এই প্রজেক্ট বর্ধিত করারও পরিকল্পনা রয়েছে। সব ঠিক থাকলে তিনি ইঁদুরের জায়গায় শূকর ব্যবহারের জন্য অনুমোদনের চেষ্টা করবেন বলে জানিয়েছেন। আর এদের হাইব্রিড ভ্রূণের বেড়ে ওঠার মেয়াদ কাল বাড়িয়ে করা হবে ৭০ দিন।
গবেষণার উদ্দেশ্য মহৎ হলেও এর বিপক্ষে কথা বলা মানুষের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। তাদের ভাষ্যমতে, এই পরীক্ষাগুলোর ফলাফল ভিন্ন দিকে মোড় নেওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। প্রতিস্থাপন করা মানব কোষ মিউটেশনের মাধ্যমে একেবারে ভিন্ন কোনো ফলাফল দিতে পারে। আর এই সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়েও দেওয়া যায় না। দেখা গেল, নির্দিষ্ট অঙ্গ প্রস্তুত হওয়ার বদলে এক অদ্ভুত কোনো জন্তু সৃষ্টি হলো, যা সম্পর্কে গবেষকদের কোনো ধারণাই নেই। তবে গবেষকরা এমন একটি প্রজেক্টে যে বেশ সতর্ক থাকবেন তা আগে থেকেই নিশ্চিত করেছেন। তারা জানিয়েছেন যে, পরীক্ষারত হাইব্রিড ভ্রূণের মস্তিষ্কে মানব কোষের পরিমাণ ৩০% এর বেশি হলেই তারা পরীক্ষা স্থগিত করবেন।
সতর্কতা নিশ্চিত করা সত্ত্বেও কিছু গবেষক পুরো গবেষণার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে যাচ্ছেন। জাপানের লাইফ সাইন্স বিশেষজ্ঞ জিরো নুদেশিমা যেমন বলেছেন,
যদি এমন গবেষণার উদ্দেশ্য মানুষের উপকারের জন্যই হয়ে থাকে, তবে পর্যবেক্ষণের জন্য ইঁদুরের দেহ ব্যবহার খুব একটা সুবিধাজনক ফলাফল দেবে না। কারণ প্রস্তুতকৃত অঙ্গসমূহের আকার মানবদেহের জন্য যথেষ্ট হবে না। তাছাড়া শারীরবৃত্তীয় দিক থেকেও তা পুরোপুরি কর্মক্ষম হওয়া থেকে বেশ দূরেই থাকবে।
নুদেশিমা এই গবেষণাকে “নৈতিকতা ও সতর্কতার দিক থেকে ত্রুটিপূর্ণ” একটি গবেষণা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
এতক্ষণ যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো তা অনেকের কাছে নেহায়েত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর কোনো অংশ মনে হতে পারে। কিন্তু এগুলো পুরোপুরি বাস্তব ঘটনা। আবার এমনটাও নয় যে, জাপানই প্রথম এমন গবেষণার অনুমোদন দিয়েছে। অনেক আগে থেকেই আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হাইব্রিড ভ্রূণ তৈরির এই গবেষণা করা হচ্ছে। কিন্তু এ বিষয়গুলো নানা জটিলতার কারণে জনগণের সামনে প্রত্যক্ষভাবে তুলে ধরা হয় না।