দুই মিনিট বাদেই পরীক্ষা শুরু হবে। পকেট থেকে কলম বের করে পরীক্ষার খাতার পাশে রাখলেন জনৈক পরীক্ষার্থী। পাশেরজন কি সামান্য ঈর্ষার চোখে দেখেন তাকে? কেননা তার পকেট থেকেও বের হয়ে এসেছে কলম। নিজেকে খুব উপযুক্ত প্রমাণ করতে এবার পেন্সিল বের করলেন আমাদের প্রথম পরীক্ষার্থী। তৎক্ষণাৎ পাশেরজনের পকেট থেকেও বেরোল পেন্সিল। তবে পেন্সিল সাজিয়েই থেমে গেলেন না তিনি। পকেট থেকে বেরিয়ে এলো আরেকটি কলম! তারপর আরও একটি কলম, এবং… ঠিক ধরেছেন! আরও একটি কলম! পকেট থেকে একের পর এক কলম বের করেই চলেছেন তিনি…
অদ্ভুত লাগছে কি? জনপ্রিয় কমেডি সিরিজ মিস্টার বিনের দৃশ্য এটি। বয়স্ক ব্যক্তির দেহে আটকে পড়া দশ বছরের শিশু মিস্টার বিনের অসাধারণ অভিব্যক্তি আর উদ্ভট কার্যকলাপ দেখে আনন্দ পায়নি, এমন দর্শক পাওয়া মুশকিল। ব্রিটিশ অভিনেতা রোয়ান অ্যাটকিনসন যেন মিস্টার বিন হওয়ার জন্যেই জন্মেছিলেন। নব্বই দশকের মিলেনিয়ালদের কাছে তাই তিনি নিজের নামের থেকে মিস্টার বিন হিসেবেই অধিক পরিচিত! মেরুদণ্ডহীন লর্ড ব্ল্যাকঅ্যাডারই হোক, কিংবা দুর্ঘটনাপ্রবণ বোকা এজেন্ট জনি ইংলিশ, পর্দায় তার উপস্থিতি সবসময়েই দর্শকদের জন্য নির্মল বিনোদনের উৎস!
কাউন্টি ডারহ্যামের সমৃদ্ধ কৃষক পরিবার এলা মে এবং এরিক অ্যাটকিনসনের তিন সন্তানের মাঝে সর্বকনিষ্ঠ রোয়ান সেবাস্টিয়ান অ্যাটকিনসন, জন্ম নেন ৬ জানুয়ারি, ১৯৫৫ সালে। মজার ব্যপার হচ্ছে, কৌতুকাভিনেতা হিসেবে পর্দায় তার অভিনীত চরিত্রগুলো অদ্ভুত সব বোকা বোকা কাণ্ডকারখানা করে বেড়ালেও বাস্তব জীবনের রোয়ান অ্যাটকিনসন কিন্তু অত্যন্ত মেধাবী। এ লেভেলে অসাধারণ ফলাফলের পর ইউনিভার্সিটি অফ নিউক্যাসলে ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রিও বাগিয়ে নেন ঠিক ঠিক। অভিনয় জগতে নিজের স্থান খুঁজে নেয়ার আগে কিছুদিন ডক্টরেটের জন্য পড়াশোনাও শুরু করেছিলেন বলে জানা যায়।
অক্সফোর্ডে পড়ার সময়েই অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ থেকে চেহারার অভিব্যক্তি, কমেডিক আচরণ ইত্যাদিতে নিজেকে দক্ষ করে তোলেন। ড্রামা সোসাইটির মঞ্চে নিজেকে যেন নতুন করে খুঁজে পান এই রম্য অভিনেতা। এডিনবোরো ফেস্টিভ্যালে অভিনেতা রিচার্ড কার্টিস এবং কম্পোজার হাওয়ার্ড গুডঅলের সাথে এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার নিয়েও কাজ করেন।
বিবিসি রেডিওতে ১৯৭৯ সালে ‘দ্য অ্যাটকিনসন পিপল’ নামে একটি রিচার্ড কার্টিসের রচনায় একটি স্যাটায়ারিক্যাল কমেডি শো করতেন তিনি। এর মাঝেই পেয়ে যান টেলিভিশন কমেডি জগতে নিজের প্রথম সুযোগ। রাত নয়টার সংবাদের খবরগুলোর স্যাটায়ার হিসেবে সাজানো কমেডি শো ‘নট দ্য নাইন ও’ক্লক নিউজ’ রোয়ান অ্যাটকিনসনকে ব্রিটিশ দর্শকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।
‘নট দ্য নাইন ও’ক্লক নিউজ’ শোতে কাজ করার সময়েই ‘দ্য ব্ল্যাকেডার’-এর কনসেপ্ট ভাবেন অ্যাটকিনসন এবং কার্টিস। ইতিহাসজুড়ে গুরুত্বপূর্ণ সব ঘটনাবলী, হোক সেটা ক্রুসেড কিংবা চার্চ আর রাজতন্ত্রের লড়াই, সবকিছুকেই ডার্ক কমেডির মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে এই শো-তে।
তবে রোয়ান অ্যাটকিনসনের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র মিস্টার বিন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, যে ১৯৯০-৯৫ সাল পর্যন্ত চলা এই কমেডি শোয়ের রয়েছে মাত্র চৌদ্দটি পর্ব। পরবর্তীতে ‘মিস্টার বিন: দ্য আলটিমেট ডিজাস্টার মুভি’ (১৯৯৭) আর ‘মিস্টার বিন’স হলিডে’ (২০০৭) নামের দুটি সিনেমাও মুক্তি পায় এই জনপ্রিয় চরিত্রকে নিয়ে। দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নিয়ে একেবারেই উদাসীন, স্বভাব-চরিত্রে শিশুসুলভ সরলতা আর দুষ্টুমির অনন্য মিশেলের কারণে অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করা এই চরিত্রের দেখা মেলে ২০১২ অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও!
জনপ্রিয় ব্রিটিশ স্পাই জেমস বন্ডকে কে না চেনে? 007-এর এই চরিত্রের স্যাটায়ার নিয়েই নির্মিত হয় জনি ইংলিশ চরিত্রটি। অ্যাটকিনসনের অনবদ্য অভিনয়ের গুণে একবারের জন্য মনে হয় না সিনেমাটি স্যাটায়ার।
তবে জনি ইংলিশ, মিস্টার বিন ইত্যাদি দেখে যদি আপনার ধারণা হয়ে যায় রোয়ান অ্যাটকিনসন কেবলই একজন কমেডি অভিনেতা, তবে এখনই দেখে ফেলুন টিভি সিরিজ ‘মাইগ্রেঁ’ (Miagret)। ১৯৫০ এর লন্ডনের পটভূমিতে সাজানো এই সিরিজে ফরাসি পুলিশ ইন্সপেক্টর জুলস মাইগ্রেঁ চরিত্রে তার অভিনয় দেখলে ভুলে যাবেন এই সেই ভদ্রলোক যিনি জনি ইংলিশে বারবার মিশনে গুবলেট পাকিয়ে ফেলেন! অ্যাটকিনসনের অভিনয় দক্ষতা আর বহুমুখীতার পরিচয় এই সিরিজে পাওয়া যায়।
অভিনয়ের পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গনেও রয়েছে তার পদচারণা। ২০০৫ এ ধর্মীয় সংগঠনগুলোকে অতিমাত্রায় ক্ষমতা দেয়ার বিরুদ্ধে সমসাময়িক লেখক ও রাজনীতিবিদদের সাথে একজোট হন, কেননা এই ক্ষমতার অপপ্রয়োগ হতে পারে সংখ্যালঘুদের ক্ষতির কারণ।
শক্তিমান এই অভিনেতার বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে গাড়ির প্রতি। পারিবারিক ফার্মে মায়ের মরিস মাইনর গাড়ি চালানো থেকেই শখের শুরু। নিজের শত মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের সম্পদ এই শখের পালে দিয়েছে হাওয়া! বেশ কয়েকটি অ্যাশটন মার্টিন থেকে শুরু করে মালবাহী লরী- কী নেই এই সংগ্রহের তালিকায়! মজার ব্যপার হচ্ছে, জনি ইংলিশ সিনেমায় ব্যবহৃত অ্যাশটন মার্টিন ডিবিসেভেন ভ্যান্টেজ তার সংগ্রহ থেকেই ধার করা হয়েছিল! শখের কনভার্টিবল চালিয়ে স্পীডিং টিকেট তো পেয়েছেন বটেই, দুর্ঘটনাও কিছু কম ঘটাননি! নেহায়েত ভাগ্যের জোরেই বেঁচে ফিরে এসেছেন ভিএইট জ্যাগাটোর ধ্বংসস্তূপ থেকে! অডি, হোন্ডা এমনকি মার্সিডিজ থাকলেও অ্যাটকিনসনের সংগ্রহে নেই পোর্শে। তার ভাষ্যমতে, “পোর্শে চমৎকার গাড়ি, কিন্তু আমি জানি আমি এটা চাই না!” ব্রিটিশ গাড়ি সংশ্লিষ্ট ম্যাগাজিন কারে গাড়ি নিয়ে নিয়মিত লেখালেখিও করেন তিনি!
বিবিসিতে কাজ করার সময় সুনেত্রা শাস্ত্রীর সাথে পরিচয় হয় রোয়ান অ্যাটকিনসনের। ১৯৯০ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তারা। জন্ম হয় বেন এবং লিলি নামে দুই সন্তানের। ২০১৫ সালে সুনেত্রার সাথে বিচ্ছেদের পর অ্যাটকিনসনের জীবনে এসেছেন কমেডিয়ান লুই ফোর্ড। ২০১৬ সালে জন্ম নিয়েছে অ্যাটকিনসনের তৃতীয় আর এই দম্পতির প্রথম সন্তান।