সাধারণত সিনেমা কিংবা গল্পের বীরত্বপূর্ণ চরিত্রে পুরুষের তুলনায় নারীর উপস্থিতি নগণ্য। বিশেষ করে থ্রিলার কিংবা অ্যাকশনধর্মী সিনেমা ও সিরিজে কেন্দ্রীয় চরিত্রে পুরুষই থাকে প্রধানত। অনেক ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রের আপত্তিকর উপস্থাপনের জন্যও সমালোচনার তোপে পড়েছে অনেক সিনেমা। দর্শক মহলের একটি অংশ হিরোইজমকে পুরুষোচিত ভাবতেই স্বচ্ছন্দ হলেও অন্য একটি অংশ পর্দায় নারী চরিত্রের উপস্থাপনকে সামগ্রিকভাবে নারীদের অবস্থানের সাথে সম্পর্কিত করে সমালোচনা করে থাকেন।
অন্যতম জনপ্রিয় টিভি সিরিজ ব্রেকিং ব্যাড, যা নিয়ে প্রায় এক যুগ পরও প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা চলমান দর্শকমহলে। সাধারণ এক রসায়নের শিক্ষক কী করে তার সময়কালের সেরা মাদক প্রস্তুতকারক হয়ে ওঠে, এ সূত্র ধরেই এগোতে থাকে উত্তেজনাপূর্ণ কাহিনী। নির্মাণশৈলী এবং প্লট বিবেচনায় এটি অতুলনীয় একটি সৃষ্টি হলেও সমালোচক মহলে সিরিজটির নারী চরিত্রগুলোর উপস্থাপন নিয়ে রয়েছে বেশ কিছু বিতর্ক।
এ সিরিজের অন্যতম প্রধান নারী চরিত্র স্কাইলার হোয়াইট, যে কেন্দ্রীয় চরিত্র ওয়াল্টার হোয়াইটের স্ত্রী। তাকে সিরিজের প্রথমদিকে একজন সাধারণ গৃহিণী হিসেবে দেখা যায়। এ চরিত্রের অভিনেত্রী অ্যানা গান নিজেই তার চরিত্রটিকে ‘সেক্সিজম এবং জেন্ডার রোল আইডিয়ার কম্বিনেশন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। চরিত্রটির জন্য তাকে ব্যক্তিগতভাবে বেশ ধকলও পোহাতে হয়েছে। দুর্দান্ত অভিনয় করে তিনি প্রশংসার চেয়ে কটূক্তিই বেশি কুড়িয়েছেন। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অরুচিকর মন্তব্য থেকে শুরু করে হত্যার হুমকি পর্যন্ত পেয়েছেন তিনি। যদি দর্শক প্রতিক্রিয়ার কথা ধরা হয়, স্কাইলার চরিত্রটিকে বেশ অসহনশীল বলেই দাবি করে থাকে অধিকাংশ দর্শক। এমনকি স্কাইলার বিরোধী বেশ কিছু পাবলিক পেজ ও গ্রুপও আছে ফেসবুকে!
মূলত দর্শকদের এমন বিরূপ প্রতিক্রিয়ার নেপথ্যে চরিত্রটির অবমাননাকর উপস্থাপনই দায়ী। স্কাইলারকে বিরক্তিকর, সমস্যাপ্রবণ স্ত্রী হিসেবে দেখানো হয়েছে পর্দায়। স্বামী ওয়াল্টার ধীরে ধীরে নানা অবৈধ এবং আপাত-অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ে এবং এর সম্পূর্ণটাই সে বিভিন্ন মিথ্যার আশ্রয়ে স্কাইলারের অগোচরে করে। মাদকদ্রব্য প্রস্তুত থেকে শুরু করে মানুষ খুন পর্যন্ত সে করে পরিবারের ভবিষ্যৎ-চিন্তার দোহাই দিয়ে।
পুরুষতন্ত্রের যে ধারণাটি পুরুষদেরই ভোগায়, সেটিরই এখানে বেশ গৌরবমণ্ডিত উপস্থাপন দেখা যায় যে- ‘Man provides’। যেকোনো মূল্যে যাবতীয় দায়িত্ব কেবল পুরুষেরই পালন করা আবশ্যক, এমন ধারণাই সিরিজটির গল্পের শেকড়ে রয়েছে। নিজের ইগোর কাছে হার না মানা ওয়াল্টার যখন তারই তৈরি করা দেয়ালে স্ত্রীকে আড়াল করতে থাকে, তখন স্কাইলার তার বস টেডের সাথে সম্পর্কে জড়ায়। পুরো ব্যাপারটায় দর্শক ওয়াল্টারের প্রতিই সহানুভূতিশীল প্রবণতা দেখায়।
এরই রেশ ধরে তাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে, ওয়াল্টারের চেষ্টা সত্ত্বেও স্কাইলারের আরোপিত বিচ্ছেদে ছন্দপতন ঘটে; কিন্তু নাটকীয়ভাবে ওয়াল্টার স্কাইলারের ভগ্নীপতির চিকিৎসাভার বহনের দায়িত্ব নেয়ার পরই তাদের মধ্যে আবার দূরত্ব কমতে থাকে। এমনকি এ পর্যায়ে স্কাইলার নিজেও তার স্বামীর অনৈতিক কাজের অংশীদার হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। অর্থাৎ, সর্বসাকুল্যে স্কাইলারকে অবিবেচক ও স্বার্থপর হিসাবেই উপস্থাপন করা হয়।
সিরিজটির অন্য নারীচরিত্রগুলোও ‘আন্ডাররিটেন’ বলেই দাবি করা হয় সমালোচক মহলে। বীরত্বপূর্ণ, সাহসী গল্পের কেন্দ্রে থাকা পুরুষদের জীবনে তাদের সঙ্গিনীদের কোনো না কোনো বিপত্তি ঘটাতে দেখা যায়। সিরিজের অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র জেসি পিংকম্যানের প্রেমিকা জেন তাকে হিরোইন আসক্ত করে তোলে এবং তাকে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্ররোচনা দেয়। জেসির অপব্যয় ঠেকাতে ওয়াল্টার যখন তার টাকা নিজের কাছে গচ্ছিত রাখে, জেন ওয়াল্টারকে ব্ল্যাকমেইল করে সে টাকা ফেরত দিতে বাধ্য করে। সামগ্রিকভাবে জেনের ব্যক্তিত্ব কিছুটা ম্যানিয়াক এবং অযৌক্তিক।
স্কাইলারের বোন মেরির চরিত্রটিও একজন ছাঁচে ঢালা বিবাহিতাকে উপস্থাপন করে, যার চরিত্রের একমাত্র বিচিত্র দিক হলো বিভিন্ন দোকান থেকে পছন্দের জিনিস চুরি করার স্বভাব। মেরিকে বাস্তবতা বিবর্জিত, বোকা এবং বাচ্চাসুলভ আচরণ করতেই দেখা যায় পুরো সিরিজ জুড়ে।
ব্যবসায়িকভাবে এবং দর্শক প্রতিক্রিয়ায় অত্যন্ত সফল ও জনপ্রিয় একটি ড্রামা সিরিজ হলেও, নারী চরিত্র সম্পর্কিত প্রচুর প্রশ্ন এবং সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে দক্ষভাবে নির্মিত ব্রেকিং ব্যাড। নির্মাতা ভিন্স গিলিগেন অবশ্য এ নিয়ে বিচলিত নন। তিনি বরং দর্শকদের দৃষ্টিভঙ্গিকেই দায়ী করেছেন।
স্কাইলার হোয়াইটের চরিত্রটি নিয়ে বিপুল কথাবার্তার পর অভিনেত্রী অ্যানা গান নিজে এ নিয়ে বিদ্বেষের শিকার হয়ে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে চরিত্রটি নির্মাণের পেছনে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবকে দায়ী করলেও, নির্মাতা ভিন্স দাবি করেছেন, গল্পের স্বার্থে চরিত্রটির এমন হওয়াই যুক্তিযুক্ত। অ্যানা গানের প্রতি বিদ্বেষ প্রসঙ্গে দর্শকদেরই বরং তিনি মিসোজিনিস্টিক বলে দাবি করেছেন।
নারী চরিত্রের অবমাননাকর উপস্থাপনের ব্যাপারে দ্বিধাবিভক্ত দর্শকেরা। কেউ কেউ মনে করেন, দিনশেষে এটি কেবল মাত্র সুনির্মিত একটি সিরিজ এবং গল্পের প্রয়োজনে চরিত্রের এহেন উপস্থাপনও যৌক্তিক। কিন্তু অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল দর্শকদের মতে, পর্দায় চরিত্রের উপস্থাপন বাস্তব থেকে অনুপ্রাণিত এবং বাস্তব জীবনকে প্রভাবিত করার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। নির্মাতার পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ এসব চরিত্রের মাধ্যমে হয়েছে এবং দর্শকদের দৃষ্টিভঙ্গির উপরও এর প্রভাব পড়তে পারে বলে তারা মনে করেন।
সবকিছু সত্ত্বেও ব্রেকিং ব্যাড অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং জনপ্রিয় সিরিজ। দিনশেষে সকল বিতর্কের পরও এটি দর্শকের কাছে নন্দিত একটি শিল্পকর্ম হয়েই থাকবে। কোনো শিল্পকর্মই সমালোচনার উর্ধ্বে নয়। কিন্তু সর্বোপরি ব্রেকিং ব্যাডের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে দর্শকমহলে অবশ্য দ্বিমত নেই।