মহাবিশ্বে আমাদের বসবাস মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে। অ্যান্ড্রোমিডা আমাদের প্রতিবেশী গ্যালাক্সি। এটি আমাদের মিল্কিওয়ের দিকে প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসছে। মহাকাশবিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করেছেন অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির সাথে আমাদের গ্যালাক্সির সংঘর্ষ হতে যাচ্ছে। তো এ রকম দুটি গ্যালাক্সির সংঘর্ষে গ্যালাক্সিগুলো কি নিজেদের ধ্বংস করে ফেলে? কী হবে পৃথিবী সহ অন্যান্য সকল কিছুর ভবিষ্যৎ? নাকি বিজ্ঞানীদের কাছে আছে অন্য উত্তর?
অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি
গ্যালাক্সি হল গ্যাস, ধূলিকণা এবং বিলিয়ন বিলিয়ন নক্ষত্রের ও তাদের নিজস্ব সোলার সিস্টেমের সমারোহ। আমাদের সূর্য মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে (আকাশগঙ্গা ছায়াপথে) অবস্থিত। গ্যালাক্সির মধ্যবর্তী গ্যাস, ধূলিকণা আর নক্ষত্রগুলো মহাকর্ষ বল দ্বারা একত্রে আটকে থাকে। প্রতিটি গ্যালাক্সির এই বিশাল মহাকর্ষ বলের যোগান দিতে এর কেন্দ্রে অবস্থান করে একটি সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল। আমাদের সোলার সিস্টেমের গ্রহগুলো যেমন সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে তেমনি নক্ষত্রগুলো কোনো এক সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলকে কেন্দ্র করে ঘোরে।
কয়েক ডজন গ্যালাক্সি আমাদের মিল্কিওয়ের ছায়াপথের কাছাকাছি অবস্থান করছে, অ্যান্ড্রোমিডা হল আমাদের সবচেয়ে কাছের বিশাল আকারের সর্পিলাকার বা স্পাইরাল গ্যালাক্সি। অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির ব্যাসার্ধ ১১০,০০০ আলোকবর্ষ। অর্থাৎ এর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যেতে আলোর মোটামুটি ২২০,০০০ বছর লেগে যাবে। উত্তর গোলার্ধে রাতের আকাশে অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি খালি চোখে দেখা যায়, যথেষ্ট উজ্জ্বল।
আমাদের মিল্কিওয়ে ছায়াপথের ব্যাসার্ধ ৫২,৮৫০ আলোকবর্ষ যা অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির ব্যাসার্ধের অর্ধেক। গ্রিক মিথোলজির ইথিওপিয়ার রানীর নাম অনুসারে অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিটির নামকরণ করা হয়।
অ্যান্ড্রোমিডার গতি
১৯২০ সাল, এডউইন হাবল ও তার দল দেখলেন অধিকাংশ গ্যালাক্সি আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি বা মেসিয়ার ৩১ (M31)-এর ক্ষেত্রে এরকম দেখা গেল না। মহাকাশবিজ্ঞানীরা দেখলেন গ্যালাক্সিটি প্রতি ঘণ্টায় ২৫০০০০ মাইল বেগে আমাদের গ্যালাক্সির দিকে ধেয়ে আসছে। এই গতিতে আপনি এক ঘণ্টার মধ্যেই পৃথিবী থেকে চাঁদে পৌঁছে যেতে পারবেন।
গ্যালাক্সিগুলোর গতি ডপলার ইফেক্টের উপর ভিত্তি করে নির্ণয় করা হয়। আমরা প্রায়ই কমবেশি শব্দ তরঙ্গের ডপলার ইফেক্ট লক্ষ্য করেছি। এ্যাম্বুলেন্স যখন সাইরেন বাজিয়ে আসতে থাকে তখন শব্দ কিছুটা তীক্ষ্ণ শোনা যায়। আবার যখন কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকে তখন কিছুটা ক্ষীণ শোনা যায়। এ্যাম্বুলেন্স কাছে আসার সময় শব্দের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কমে অর্থাৎ কম্পাঙ্ক বেড়ে যায় আর দূরে সরে যাওয়ার সময় তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বাড়ে অর্থাৎ কম্পনাঙ্ক কমে যায় তাই এমনটা অনুভূত হয়। আলোক তরঙ্গের ক্ষেত্রেও এইরকম দেখা যায়। তাই গ্যালাক্সিগুলো যখন কাছে আসতে থাকে তখন আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ছোট হয়ে যায় অর্থাৎ ব্লু শিফট হয়। আবার যখন দূরে সরে যেতে থাকে তখন তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বেড়ে যায় অর্থাৎ রেড শিফট হয়। এভাবে রেড শিফট এবং ব্লু শিফট নির্ণয় করে মহাকাশের যেকোনো বস্তুর বেগ মাপা যায়।
কিন্তু তৎকালীন এই আবিষ্কার, অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিটি আমাদের দিকে আসবে না এর দিক পরিবর্তন করবে সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এরপর হাবল স্পেস টেলিস্কোপের সাহায্যে বিভিন্ন শ্রমসাধ্য পরিমাপের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা এই গ্যালাক্সির গতি ও অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন। প্রায় একশো বছর পর দুজন মহাকাশ বিজ্ঞানী রোল্যান্ড ভ্যান ডার মারেল এবং স্যাংমো টনি শন বাল্টিমোরে অবস্থিত Space Telescope Science Institute থেকে নিশ্চিত করেন যে অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি বর্তমানে আমাদের থেকে ২.৫ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করছে।
অ্যান্ড্রোমিডা বনাম মিল্কিওয়ে
অ্যান্ড্রোমিডা যে দূরত্বে অবস্থান করছে এবং যে গতিবেগ নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে তাতে ৪ বিলিয়ন বছরের মধ্যেই এই সংঘর্ষটি হতে চলেছে। কিন্তু সংঘর্ষকালীন সময় আমরা যদি উপস্থিত থাকি আমরা কি বেঁচে থাকব? কিংবা আমাদের মিল্কিওয়ে ছায়াপথ কি বিশাল এক সংঘর্ষের মাধ্যমে ধ্বংস হয়ে যাবে? মজার বাপার হল সংঘর্ষ চলাকালীন সময়ে আমরা বেঁচে থাকবো (যদি ততদিনে অন্য কোনো উপায়ে আমাদের অস্তিত্ব ধ্বংস হয়ে না থাকে)। অবিশ্বাস্য হলেও আমাদের মিল্কিওয়ে ছায়াপথও ধ্বংস হয়ে যাবে না!
নাসা নিশ্চিত করে যে এই সংঘর্ষটি আমাদের গ্যালাক্সি, সূর্য এবং আমাদের সোলার সিস্টেমের ওপর প্রভাব ফেলবে। সূর্য তার অবস্থান পরিবর্তন করবে, অর্থাৎ সূর্য আমাদের গ্যালাক্সির যে কক্ষপথে ঘুরছে তা থেকে দূরে সরে যাবে। তবে আমাদের সোলার সিস্টেম ও পৃথিবীতে মারাত্মক কোনো প্রভাব আসবে না। অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির গতি প্রকৃতি এবং অবস্থান নির্ণয়ে হাবল টেলিস্কোপ অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছে। হাবল টেলিস্কোপের বদৌলতেই আজকে বিজ্ঞানীদের কাছে উত্তরটা স্পষ্ট।
মিল্কিওয়ে ও অ্যান্ড্রোমিডার পারস্পরিক মহাকর্ষ বলের টানে এরা একে অপরের দিকে ছুটে আসছে। এর চালিকা হিসবে কাজ করছে গ্যালাক্সিগুলোতে অবস্থিত বিপুল ভর ও ডার্ক ম্যাটার। ডার্ক ম্যাটার সম্পূর্ণ অদৃশ্য বস্তু যেটি মহাকর্ষ দ্বারা প্রভাবিত হয় কিন্তু সাধারণ পদার্থের সাথে অন্য কোনোভাবে মিথস্ক্রিয়ায় জড়ায় না। ডার্ক ম্যাটার মহাকর্ষ বলের প্রভাব ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে শনাক্ত করা যায় না। কারণ অন্য কোনো বল, আলো বা বস্তুর সাথে এর কোনো মিথস্ক্রিয়া নেই। তাই আপাতত ডার্ক ম্যাটার বিজ্ঞানীদের ধরাছোঁয়ার বাইয়ে।
আমাদের মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে অনবরত। মানে একটি গ্যালাক্সি অন্য গ্যালাক্সি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি এই প্রসারণের মধ্যেও তো দূরে সরে যাওয়ার কথা। কিন্তু দূরে সরে যাচ্ছে না কেন? কারণ অ্যান্ড্রোমিডা মিল্কিওয়ের যথেষ্ট কাছে, যাতে করে এদের মধ্যে থাকা ডার্ক ম্যাটার পরস্পরের সাথে মহাকর্ষ প্রভাব দেখাতে পারে। এজন্যই মহাবিশ্ব প্রসারণকে ছাপিয়ে এরা একে অপরের কাছে চলে আসছে।
যেহেতু আমাদের মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে তাই ধারণা করা যায় যে এক সময় আমাদের মহাবিশ্বের আকার ছোট ছিল। মহাবিশ্বের আকার ছোট ছিল বিধায় তখন এরকম গ্যালাক্সি-গ্যালাক্সি সংঘর্ষ খুবই সাধারণ ছিল এবং সচরাচর ঘটতো।
সাধারণত দুটি সর্পিলাকার (স্পাইরাল) গ্যালাক্সির সংঘর্ষে উপবৃত্তাকার গ্যালাক্সির সৃষ্টি হয়। তাই যত উপবৃত্তাকার গ্যালাক্সির দেখা মেলে, প্রায় সবকটির বয়স অনেক বেশি এবং হয়তো দুই বা ততোধিক স্পাইরাল গ্যালাক্সির সংঘর্ষে এরা তৈরি হয়েছে। আমাদের গ্যালাক্সি এবং অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির সংঘর্ষে এ রকম উপবৃত্তাকার গ্যালাক্সির সৃষ্টি হবে। হাবল টেলিস্কোপ থেকে ডেটা নিয়ে সেটাকে কম্পিউটারে সিমুলেট করে দেখা যায়, নব সৃষ্ট গ্যালাক্সিটির আরো দুই মিলিয়ন বছর বেশি লেগে যাবে সম্পূর্ণরূপে যুক্ত হতে ও উপবৃত্তাকার আকৃতি পেতে।
এই উপবৃত্তাকার গ্যালাক্সিগুলোই আমাদের আশেপাশের অঞ্চলে বেশি দেখা যায়। যদিও গ্যালাক্সিগুলো একে অপরকে খুব কাছাকাছি টেনে নেবে কিন্তু তবুও নক্ষত্রগুলোর দূরত্ব এতই বেশি যে এরা একে অপরের মধ্যকার সংঘর্ষ থেকে রেহাই পাবে। কিন্তু সংঘর্ষের পরে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি তার প্রায় বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকা নক্ষত্রগুলো দ্বারা তৈরি চ্যাপ্টা প্যানকেক আকৃতি হারাবে।
ভিডিও: কম্পিউটার সিমুলেশনে অ্যান্ড্রোমিডা ও মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির সংঘর্ষ।
হারিয়ে যাবে রাশিচক্র
গ্যালাক্সির আকার এতই বিশাল যে এর মধ্যে থাকা বস্তুকণা, গ্যাস, গ্রহ, গ্রহাণু ও নক্ষত্রগুলো যথেষ্ট দূরে দূরে অবস্থান করে। ফলে দুটি গ্যালাক্সির সংঘর্ষ হলে সাধারণত এর মধ্যবর্তী নক্ষত্রগুলো পরস্পরের সাথে ধাক্কা খেয়ে ধ্বংস হয়ে যায় না। যথেষ্ট দূরে অবস্থান করার কারণে একে অপরের মহাকর্ষ বলের প্রভাবে নতুন অবস্থান হবে ও গতি পরিবর্তন হবে। নতুন একটা প্যাটার্ন তৈরি হবে। রাতের আকাশের তারাগুলোকে যে একটা নির্দিষ্ট সাজে সজ্জিত হতে দেখা যায়, যা থেকে ১২টি রাশিচক্রের উৎপত্তি, সেই নির্দিষ্ট প্যাটার্নটি তখন বিলুপ্ত হয়ে যাবে। রাতের আকাশের তারাগুলোর অবস্থান পরিবর্তন হবে এবং নতুন নতুন তারার আবির্ভাব ঘটবে।
তবে জ্যোতির্বিদরা ধারণা করছেন মিল্কিওয়ে এবং অ্যান্ড্রোমিডার সংঘর্ষ ছাড়াও পাশে থাকা আরেকটি গ্যালাক্সি সংঘর্ষে অংশ নেবে। তবে এটা হবে মিল্কিওয়ে ও অ্যান্ড্রোমিডার সংঘর্ষের অনেক পর। জ্যোতির্বিদেরা খুব কম সম্ভাবনাই দেখছেন যে এই গ্যালাক্সিটি অ্যান্ড্রোমিডার আগে মিল্কিওয়েতে আঘাত হানবে।
পৃথিবী থেকে সংঘর্ষের চিত্রায়ন
সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় ঘটবে যখন আমারা অ্যান্ড্রোমিডা ও মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির একে অপরের সাথে মিশে যাওয়া পৃথিবী থেকে লক্ষ্য করবো। আমাদের পৃথিবীতে ততদিনে কোনো মানবসভ্যতা টিকে থাকবে কিনা সন্দেহ। কারণ তখন সূর্যের হাইড্রোজেন জ্বালানি শেষ হয়ে যাবে এবং আকারে বৃদ্ধি পেতে থাকবে। সূর্যের আকার এতটাই বেড়ে যাবে যে এটি প্রসারিত হতে হতে শুক্র গ্রহের কক্ষপথে এসে যাবে এবং বুধ ও শুক্রকে গ্রাস করে নেবে। পৃথিবীতে তাপমাত্রা থাকবে তখন প্রচণ্ড বেশি।
কিন্তু তবুও নাসা সিম্যুলেশনের মাধ্যমে সংঘর্ষের সময় আমরা আমাদের আকাশে কী হতে দেখবো সেটি কয়েকটি ছবির মাধ্যমে তুলে ধরেছে। সূর্যের জ্বালানি এবং ফুলে ফেঁপে ওঠার বিষয়টি যদি বাদ দেই তাহলে আমারা দেখব মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ব্যান্ডটি অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি ধীরে ধীরে ঘিরে ফেলছে। অ্যান্ড্রোমিডা এবং মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্র একত্রিত হতে থাকবে।